alt

উপ-সম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধে চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর

দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি তত্ত্ব

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

: রোববার, ১১ এপ্রিল ২০২১

(শেষাংশ)

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের ভেতরে কয়েকটি অঞ্চলে বামপন্থিদের নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। গেরিলা বাহিনী গঠন ও ঘাঁটি স্থাপন করে তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তৎকালীন মহকুমা সদর বাগেরহাটের চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরে গড়ে ওঠা গেরিলা ঘাঁটি এবং নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ এরকম একটি উদাহরণ। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির আঞ্চলিক প্রধান রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্ভেদ্য গেরিলা ঘাঁটি গড়ে ওঠে।

‘দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ তত্ত্ব

১১ আগস্ট কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) হক-তোয়াহা গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে জীবন মুখার্জী, ললিত মোহন বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ তত্ত্ব হাজির করে পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদ’ মোকাবেলার প্রস্তাব দিলে রফিক বাহিনী ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং দুজনকেই ক্যাম্প ত্যাগ করে চলে যেতে বলা হয়।

২৮ সেপ্টেম্বর জীবন মুখার্জী ও ললিত মোহন পুনরায় বিষ্ণুপুর এসে আগের প্রস্তাব উত্থাপন করলে বাহিনী প্রধান রফিক সাফ জানিয়ে দেন, তারা যদি তৃতীয়বার এ প্রস্তাব নিয়ে আসেন তাহলে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না। বাহিরদিয়ার মানস ঘোষ ও তার বাহিনী এ প্রস্তাব গ্রহণ করে পাক বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ মোকাবেলার লাইন গ্রহণ করেন।

পানিঘাটের যুদ্ধ : গেরিলা যুদ্ধের মডেল

২৫, ২৬, ২৭ ও ২৯ আগস্ট পাক বাহিনীর বারবার আক্রমণে বিষ্ণুপুরের গেরিলারা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হন। পাক বাহিনী সন্তোষপুর ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়। এ সময় বাহিনী ছেড়ে তাজুল ইসলাম ভারতে চলে যান। ৩০ আগস্ট আহত রফিক বিষ্ণুপুর ক্যাম্পে ফিরে আসেন এবং মুক্তিযোদ্ধারা সামর্থ্য অনুযায়ী পুনরায় সংগঠিত হয়ে শক্তি সংহত করার চেষ্টা চালান।

সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরের গেরিলা ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য পাক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পানিঘাট এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা জড়ো হতে থাকে। বিষ্ণুপুরের গেরিলাদের জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এ লড়াই ছিল তাদের অস্তিত্ব রক্ষার। এটি বিখ্যাত পানিঘাটের যুদ্ধ নামে পরবর্তীতে খ্যাতি লাভ করে। গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি অনন্যসাধারণ লড়াই। অন্যান্যদের সাথে এখনকার খ্যাতনামা সাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।

লড়াইয়ের প্রস্ততি হিসেবে ভৈরব নদীর তীর ধরে গেরিলারা ২শ’ গজ দূরত্বের মধ্যে ডিফেন্স লাইন নির্মাণ করেন। নদীর বাঁকের দুই দিকেই বাংকার খুঁড়ে প্রতিটিতে ২ জন করে গেরিলা অবস্থান নেন। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে করতে লঞ্চ নিয়ে পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স লাইন ভেদ করার চেষ্টা চালায়। গেরিলাদের পাল্টা গুলিতে সারেং গুলিবিদ্ধ হলে একাধিক জায়গায় ফুটো হয়ে যাওয়া লঞ্চ নদীতে ঘুরপাক খেতে থাকে। এই যুদ্ধে গেরিলারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অংশ নেয়। এ সময় সড়ক পথে আগুয়ান হানাদারদের একটি দল গেরিলাদের গুলির মুখে পালিয়ে যায়। পানিঘাটের এই যুদ্ধে ১৬ জন পাক সেনাসহ অগণিত রাজাকার নিহত হয়। বাগেরহাট শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে নিহতদের লাশ অপসারণ করা হয়।

কয়েকটি যুদ্ধে গেরিলাদের সাফল্য

মধ্য আগস্ট থেকে পাক বাহিনীর প্রতিদিনের আক্রমণের তীব্রতার মুখে রফিক বাহিনী কিছুটা হলেও বিপন্ন ও অসহায় হয়ে পড়ে। অস্ত্রের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে। ২৪ আগস্ট মানস ঘোষের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে রফিক, কালিপদ ব্যানার্জী, রতন মাস্টার ও বিনয় অস্ত্র সংগ্রহে রওনা হন। ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি কোন এক স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা থাকলেও পথিমধ্যে পাক হানাদারদের আক্রমণের মুখে পড়ে যান তারা। পশ্চাৎপসরণ করতে যেয়ে রফিক আহত হন। ওই দিনেই দেবী বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক বাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে ৩ পাক সেনা ও ৫ রাজাকার নিহত হয়।

১৩ সেপ্টেম্বর দেপাড়া ব্রিজের কাছে পুনরায় গেরিলারা পাক বাহিনীর মুখোমুখি হন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থায়ী এই যুদ্ধে বিজয় পাল শহীদ হন। ৩ জন পাক সেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। মধ্য অক্টোবরে গেরিলাদের জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ভারত প্রত্যাগত পাক বিমান বাহিনীর কর্পোরেল আমজাদুল হকের বাহিনী বিষ্ণুপুরের গেরিলাদের সাথে যোগ দেন। সংগ্রাম কমিটি সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার ও আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আরো ৭-৮ জন এই বাহিনীতে যোগ দেয়।

১৫ অক্টোবর ভাটছালা ব্রিজের কাছে পাক বাহিনীর সাথে গেরিলাদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে কোন পক্ষেরই তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। ৩০ অক্টোবর গোটাপাড়া ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজারে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সম্মিলিত বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে রফিক বাহিনীর মুখোমুখি হয়। চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরের মুক্তিযুদ্ধে এটি ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই। ওই দিন সকালেই পাক বাহিনী ভৈরব নদী পেরিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাবুরহাটে গেরিলাদের শক্ত অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। সুরক্ষিত অবস্থান থেকে পাল্টা আক্রমণে পাক বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ দিগি¦দিক পালিয়ে যায়।

পাক হানাদারদের অন্য অংশটি বাবুরহাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাজারের কাছাকাছি বাংকারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ইউনিফর্ম পরে অপেক্ষা করছিল। এর ফলে পাক বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আকবর নামের কিশোরের মাথায় কার্তুজের বাক্স তুলে দিয়ে পাক বাহিনী এগোতে থাকে। ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই কিশোরটি খালে লাফিয়ে পড়ে। পাক বাহিনী গেরিলাদের গুলিবৃষ্টির মধ্যে পড়ে। অতর্কিত এই আক্রমণে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৪ হানাদার সেনা ও ৩ রাজাকার নিহত হয়।

৯ নভেম্বর গেরিলাদের সাথে পাক বাহিনীর আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই দিন ভৈরব নদী অতিক্রম করে ৩ মাইল দূর থেকে মর্টার শেলিং করতে করতে পাক বাহিনী এগোতে থাকে। বাবুরহাটে পৌঁছলে গেরিলারা তিন দিক থেকে হানাদারদের ঘিরে ফেলে। পাক বাহিনী মরিয়া হয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। চারদিক থেকে গেরিলারা সাঁড়াশি আক্রমণ রচনা করে। মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে ৫ জন পাক সেনাসহ অগণিত রাজাকার নিহত হয় এবং আল শামসের একজন সদস্যকে জীবন্ত ধরে ফেলা হয়। একজন পাক সেনাকে ধাওয়া করে ইসমাইল হোসেন (মেজো) হাতাহাতি যুদ্ধে একটি হেভি মেশিনগান (এমএমজি) ছিনিয়ে নেন। বিষ্ণুপুর এলাকার যুদ্ধে এটি ছিল একেবারেই সনাতনী মুখোমুখি যুদ্ধ। এদিন পালাতে গিয়ে পাক বাহিনীর কয়েকজন গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয়।

মুজিব বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সাথে লড়াই

৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে পাক বাহিনীকে বাগেরহাট থেকে সরিয়ে নিয়ে খুলনায় নিয়োগ দেয়া হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের একটি যৌথ দল নিয়মিত টহল দানকালে বিষ্ণুপুর গেরিলাদের সহযোগী মজিবরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করলে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। মজিবর ও ইসমাইল হোসেন (মেজো) বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কে অ্যামবুশ করে একটি ট্রাকে হামলা চালিয়ে দু’জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়।

১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হলে বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করতে থাকে। কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী শহরে অবস্থান নেয় এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আসেন মেজর জয়নুল আবেদীন, পরে আসেন ক্যাপ্টেন নোমান উল্লাহ। ১৭ ডিসেম্বর বিষ্ণুপুরের গেরিলারা পিসি কলেজে ক্যাম্প করে। কয়েকজন গেরিলাকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে রেস্ট হাউসে বন্দী করে রাখে। এ ঘটনার পরে রফিকের নেতৃত্বে গেরিলারা পুনরায় বিষ্ণুপুরে ফিরে যায় এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মুজিব বাহিনীর ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পানিঘাটের কাছে রেকি করতে আসা মুজিব বাহিনীর অশোক ও জাহাঙ্গীরকেও তারা আটক করে।

রফিক বাহিনী এ সময় ঘোষণা করে- জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের লড়াই শেষ হয়নি। পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের কবলে পড়েছে। নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে পানিঘাট এলাকায় ভৈরব নদীতে গানবোটে অবস্থান নেয়া ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাথে গেরিলাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গেরিলাদের আক্রমণের তীব্রতার মুখে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষে তেমন কোন ক্ষয়-ক্ষতি না হলেও এর সুদূরপ্রসারি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। উত্তরকালে এসব ঘটনা ভারত বিরোধিতার ক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আহত পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়েছে- এ আশঙ্কায় রফিকুল ইসলাম খোকন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চলে যান। ৩১ জানুয়ারি রাশেদ খান মেননের উপস্থিতিতে ‘টোকেন’ হিসেবে মহকুমা প্রশাসকের কাছে বিষ্ণুপুরের গেরিলারা কিছু অস্ত্র জমা দেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে রক্ষী বাহিনীর তৎপরতা ও পার্টির সিদ্ধান্তে বাগেরহাট টেনিস গ্রাউন্ডে সংরক্ষিত অস্ত্রের ভান্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও যশোরের তৎকালীন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর বীর উত্তমের (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানে নিহত) উপস্থিতিতে জমা দেয়া হয়।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

প্রসঙ্গ : রাজধানীর যানজট

নবায়নযোগ্য জ্বালানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি

তাহলে একাত্তরে হয়নিকো কোনো অপরাধ!

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে বাস্তববাদী বাঁক

রম্যগদ্য : ‘জনগণের ভালোবাসা কি আমার ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াইবো?’

ভালো থাকার কঠিন কলা : কিছু সরল সত্য

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধে চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুর

দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি তত্ত্ব

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

রোববার, ১১ এপ্রিল ২০২১

(শেষাংশ)

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের ভেতরে কয়েকটি অঞ্চলে বামপন্থিদের নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। গেরিলা বাহিনী গঠন ও ঘাঁটি স্থাপন করে তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তৎকালীন মহকুমা সদর বাগেরহাটের চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরে গড়ে ওঠা গেরিলা ঘাঁটি এবং নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ এরকম একটি উদাহরণ। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির আঞ্চলিক প্রধান রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্ভেদ্য গেরিলা ঘাঁটি গড়ে ওঠে।

‘দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ তত্ত্ব

১১ আগস্ট কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) হক-তোয়াহা গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে জীবন মুখার্জী, ললিত মোহন বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ তত্ত্ব হাজির করে পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ভারতীয় ‘সম্প্রসারণবাদ’ মোকাবেলার প্রস্তাব দিলে রফিক বাহিনী ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং দুজনকেই ক্যাম্প ত্যাগ করে চলে যেতে বলা হয়।

২৮ সেপ্টেম্বর জীবন মুখার্জী ও ললিত মোহন পুনরায় বিষ্ণুপুর এসে আগের প্রস্তাব উত্থাপন করলে বাহিনী প্রধান রফিক সাফ জানিয়ে দেন, তারা যদি তৃতীয়বার এ প্রস্তাব নিয়ে আসেন তাহলে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না। বাহিরদিয়ার মানস ঘোষ ও তার বাহিনী এ প্রস্তাব গ্রহণ করে পাক বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ মোকাবেলার লাইন গ্রহণ করেন।

পানিঘাটের যুদ্ধ : গেরিলা যুদ্ধের মডেল

২৫, ২৬, ২৭ ও ২৯ আগস্ট পাক বাহিনীর বারবার আক্রমণে বিষ্ণুপুরের গেরিলারা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হন। পাক বাহিনী সন্তোষপুর ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়। এ সময় বাহিনী ছেড়ে তাজুল ইসলাম ভারতে চলে যান। ৩০ আগস্ট আহত রফিক বিষ্ণুপুর ক্যাম্পে ফিরে আসেন এবং মুক্তিযোদ্ধারা সামর্থ্য অনুযায়ী পুনরায় সংগঠিত হয়ে শক্তি সংহত করার চেষ্টা চালান।

সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরের গেরিলা ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য পাক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পানিঘাট এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা জড়ো হতে থাকে। বিষ্ণুপুরের গেরিলাদের জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এ লড়াই ছিল তাদের অস্তিত্ব রক্ষার। এটি বিখ্যাত পানিঘাটের যুদ্ধ নামে পরবর্তীতে খ্যাতি লাভ করে। গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি অনন্যসাধারণ লড়াই। অন্যান্যদের সাথে এখনকার খ্যাতনামা সাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।

লড়াইয়ের প্রস্ততি হিসেবে ভৈরব নদীর তীর ধরে গেরিলারা ২শ’ গজ দূরত্বের মধ্যে ডিফেন্স লাইন নির্মাণ করেন। নদীর বাঁকের দুই দিকেই বাংকার খুঁড়ে প্রতিটিতে ২ জন করে গেরিলা অবস্থান নেন। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে করতে লঞ্চ নিয়ে পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স লাইন ভেদ করার চেষ্টা চালায়। গেরিলাদের পাল্টা গুলিতে সারেং গুলিবিদ্ধ হলে একাধিক জায়গায় ফুটো হয়ে যাওয়া লঞ্চ নদীতে ঘুরপাক খেতে থাকে। এই যুদ্ধে গেরিলারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অংশ নেয়। এ সময় সড়ক পথে আগুয়ান হানাদারদের একটি দল গেরিলাদের গুলির মুখে পালিয়ে যায়। পানিঘাটের এই যুদ্ধে ১৬ জন পাক সেনাসহ অগণিত রাজাকার নিহত হয়। বাগেরহাট শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে নিহতদের লাশ অপসারণ করা হয়।

কয়েকটি যুদ্ধে গেরিলাদের সাফল্য

মধ্য আগস্ট থেকে পাক বাহিনীর প্রতিদিনের আক্রমণের তীব্রতার মুখে রফিক বাহিনী কিছুটা হলেও বিপন্ন ও অসহায় হয়ে পড়ে। অস্ত্রের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে। ২৪ আগস্ট মানস ঘোষের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে রফিক, কালিপদ ব্যানার্জী, রতন মাস্টার ও বিনয় অস্ত্র সংগ্রহে রওনা হন। ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি কোন এক স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা থাকলেও পথিমধ্যে পাক হানাদারদের আক্রমণের মুখে পড়ে যান তারা। পশ্চাৎপসরণ করতে যেয়ে রফিক আহত হন। ওই দিনেই দেবী বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক বাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে ৩ পাক সেনা ও ৫ রাজাকার নিহত হয়।

১৩ সেপ্টেম্বর দেপাড়া ব্রিজের কাছে পুনরায় গেরিলারা পাক বাহিনীর মুখোমুখি হন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থায়ী এই যুদ্ধে বিজয় পাল শহীদ হন। ৩ জন পাক সেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। মধ্য অক্টোবরে গেরিলাদের জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ভারত প্রত্যাগত পাক বিমান বাহিনীর কর্পোরেল আমজাদুল হকের বাহিনী বিষ্ণুপুরের গেরিলাদের সাথে যোগ দেন। সংগ্রাম কমিটি সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার ও আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আরো ৭-৮ জন এই বাহিনীতে যোগ দেয়।

১৫ অক্টোবর ভাটছালা ব্রিজের কাছে পাক বাহিনীর সাথে গেরিলাদের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে কোন পক্ষেরই তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। ৩০ অক্টোবর গোটাপাড়া ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজারে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সম্মিলিত বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে রফিক বাহিনীর মুখোমুখি হয়। চিরুলিয়া-বিষ্ণুপুরের মুক্তিযুদ্ধে এটি ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই। ওই দিন সকালেই পাক বাহিনী ভৈরব নদী পেরিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাবুরহাটে গেরিলাদের শক্ত অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। সুরক্ষিত অবস্থান থেকে পাল্টা আক্রমণে পাক বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ দিগি¦দিক পালিয়ে যায়।

পাক হানাদারদের অন্য অংশটি বাবুরহাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাজারের কাছাকাছি বাংকারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ইউনিফর্ম পরে অপেক্ষা করছিল। এর ফলে পাক বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আকবর নামের কিশোরের মাথায় কার্তুজের বাক্স তুলে দিয়ে পাক বাহিনী এগোতে থাকে। ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই কিশোরটি খালে লাফিয়ে পড়ে। পাক বাহিনী গেরিলাদের গুলিবৃষ্টির মধ্যে পড়ে। অতর্কিত এই আক্রমণে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৪ হানাদার সেনা ও ৩ রাজাকার নিহত হয়।

৯ নভেম্বর গেরিলাদের সাথে পাক বাহিনীর আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই দিন ভৈরব নদী অতিক্রম করে ৩ মাইল দূর থেকে মর্টার শেলিং করতে করতে পাক বাহিনী এগোতে থাকে। বাবুরহাটে পৌঁছলে গেরিলারা তিন দিক থেকে হানাদারদের ঘিরে ফেলে। পাক বাহিনী মরিয়া হয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। চারদিক থেকে গেরিলারা সাঁড়াশি আক্রমণ রচনা করে। মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে ৫ জন পাক সেনাসহ অগণিত রাজাকার নিহত হয় এবং আল শামসের একজন সদস্যকে জীবন্ত ধরে ফেলা হয়। একজন পাক সেনাকে ধাওয়া করে ইসমাইল হোসেন (মেজো) হাতাহাতি যুদ্ধে একটি হেভি মেশিনগান (এমএমজি) ছিনিয়ে নেন। বিষ্ণুপুর এলাকার যুদ্ধে এটি ছিল একেবারেই সনাতনী মুখোমুখি যুদ্ধ। এদিন পালাতে গিয়ে পাক বাহিনীর কয়েকজন গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয়।

মুজিব বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সাথে লড়াই

৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে পাক বাহিনীকে বাগেরহাট থেকে সরিয়ে নিয়ে খুলনায় নিয়োগ দেয়া হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের একটি যৌথ দল নিয়মিত টহল দানকালে বিষ্ণুপুর গেরিলাদের সহযোগী মজিবরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করলে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। মজিবর ও ইসমাইল হোসেন (মেজো) বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কে অ্যামবুশ করে একটি ট্রাকে হামলা চালিয়ে দু’জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়।

১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হলে বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করতে থাকে। কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী শহরে অবস্থান নেয় এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আসেন মেজর জয়নুল আবেদীন, পরে আসেন ক্যাপ্টেন নোমান উল্লাহ। ১৭ ডিসেম্বর বিষ্ণুপুরের গেরিলারা পিসি কলেজে ক্যাম্প করে। কয়েকজন গেরিলাকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে রেস্ট হাউসে বন্দী করে রাখে। এ ঘটনার পরে রফিকের নেতৃত্বে গেরিলারা পুনরায় বিষ্ণুপুরে ফিরে যায় এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মুজিব বাহিনীর ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পানিঘাটের কাছে রেকি করতে আসা মুজিব বাহিনীর অশোক ও জাহাঙ্গীরকেও তারা আটক করে।

রফিক বাহিনী এ সময় ঘোষণা করে- জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের লড়াই শেষ হয়নি। পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের কবলে পড়েছে। নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে পানিঘাট এলাকায় ভৈরব নদীতে গানবোটে অবস্থান নেয়া ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাথে গেরিলাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গেরিলাদের আক্রমণের তীব্রতার মুখে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষে তেমন কোন ক্ষয়-ক্ষতি না হলেও এর সুদূরপ্রসারি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। উত্তরকালে এসব ঘটনা ভারত বিরোধিতার ক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আহত পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়েছে- এ আশঙ্কায় রফিকুল ইসলাম খোকন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চলে যান। ৩১ জানুয়ারি রাশেদ খান মেননের উপস্থিতিতে ‘টোকেন’ হিসেবে মহকুমা প্রশাসকের কাছে বিষ্ণুপুরের গেরিলারা কিছু অস্ত্র জমা দেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে রক্ষী বাহিনীর তৎপরতা ও পার্টির সিদ্ধান্তে বাগেরহাট টেনিস গ্রাউন্ডে সংরক্ষিত অস্ত্রের ভান্ডার আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও যশোরের তৎকালীন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর বীর উত্তমের (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানে নিহত) উপস্থিতিতে জমা দেয়া হয়।

[লেখক : সাবেক সংবাদকর্মী]

back to top