মিথুশিলাক মুরমু
রাঙ্গামাটিতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাড়ি ও প্রার্থণালয় ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা
পার্বত্য চট্টগ্রাম ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আবাসস্থল। বরাবর শুনে এসেছি, অত্র অঞ্চলে ১১টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে-চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, তংচঙ্গ্যা, বম, পাংখোয়া, খিয়াং, খুমী, চাক এবং লুসাই। কিন্তু এখানে সাঁওতাল, গোর্খা, অসমীয়াও রয়েছে। কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ, ক্ষেত্রফলের পরিমাণ প্রায় ১৩,০০০ কিলোমিটার। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারির অস্থায়ী রিটার্নে তিনটি জেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ১২০ জন। এ অঞ্চলে ৫৪.৫% আদিবাসী মানুষ এবং ধর্মানুসারে থেরাবাদ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ৪৪%, ৬.৫% হিন্দু, ৩% খ্রিস্টান এবং ১% এনিমিস্ট। ৪৫.৫% শতাংশ বাঙালি (৪২% মুসলমান এবং ৩.৫% হিন্দু) এবং বাঙালিরা বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী। জেলাভিত্তিক দেখা যায়, রাঙ্গামাটিতেÑ ৩৬.৮২% ইসলাম ধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধ ৫৬.০৬%, হিন্দ ৫.৩০%, খ্রিস্টধর্ম ১.৮১%। বান্দরবান জেলাতে ৫০.৩৩% বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৩৩.৮৮% ইসলাম, ৩.৬২% হিন্দু, ১২.১৭% খ্রিস্ট ধর্মানুসারী। খাগড়াছড়িতে ৪৩.৫২% ইসলাম, ৩৯.২৮% বৌদ্ধ, ১৬.৪৩% হিন্দু এবং ০.৭৭% খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বসবাস রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে এ যেন এক বাগানের ফুল।
গত ২১ জুলাই পত্রিকার অন্যতম শিরোনাম ছিল ‘জেলা বান্দরবানে বোমাং রাজবিহারের দশম রাজগুরু কেটু মহাথেরের অভিষেক’। জানা গেছে, গত বছরের ১১ জুলাই নবম রাজগুরুর প্রয়াণের পর রাজগুরুর পদটি শূন্য হয়। এটি পূরণের জন্য পরিচালনা কমিটি আলোচনা করে হাংসামাপাড়া বিহারের বিরাধ্যক্ষকে রাজগুরু হিসেবে মনোনীত করে রাজার কাছে সুপারিশ করেন। কেটু মহাথের ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর থানচি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে উপসম্পদা গ্রহণ করে ভিক্ষু হন। বাংলাদেশে পড়াশোনা শেষে মিয়ানমারে বুদ্ধ দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে কেটু মহাথের জেলা শহরতলির হাংসামাপাড়া বিহারে বিহারাধ্যক্ষ ছিলেন। বোমাং রাজা উচ প্রু চৌধুরীর কাছ থেকে রাজগুরু ভান্তে বা বিহারাধ্যক্ষ হওয়ার পত্র গ্রহণ করেছেন। কেটু মহাথের বোমাং সার্কেল বান্দরবানের বৌদ্ধধর্মালম্বীদের কেন্দ্রীয় বিহারের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। অভিষেক অনুষ্ঠানকে আলোকময় করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বোমাং রাজপরিবার ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বান্দরবান জেলা শহরে রাজবিহারটি প্রতিষ্ঠিত করে। এটি বোমাং সার্কেল বা বান্দরবানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কেন্দ্রীয় বিহার হিসেবে পরিচিত। এ বিহারের অষ্টম রাজগুরু উপঞা জোত মহাথের বা উচহ্লা ভান্তে গত বছরের ১২ এপ্রিল মারা যান। এরপর জ্ঞানপ্রিয় মহাথের নবম রাজগুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার দুই মাস পর মারা যান। তখন থেকে বিহারাধ্যক্ষ বা রাজগুরু পদটি শূন্য ছিল। আমরা এই নবভিষিক্ত রাজগুরু ভান্তেকে স্বাগত জানাই। কেটু মহাথের শুধু বান্দরবান জেলা নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। পাহাড়ি ৩ জেলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দায়িত্ববোধ সংখ্যালগরিষ্ঠতা থেকেই পালন করতে হবে। মহামতি গৌতম বুদ্ধের বিশ্বাস, বাণী ও প্রচারের সারবস্তুকে ধারণ করার মাধ্যমে সম্প্রীতির পতাকাকে ওড়াতে হবে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৬ জুলাই, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার সকালে রাঙ্গামাটি থেকে একজন সুহৃদ ফোন করেছেন, জানালেন ‘বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ফেলোশিপ’-এর আওতাভুক্ত চার্চ সৈয়ন্দরপাড়া ট্রাইবাল ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ-এর মাননীয় পুরোহিত জ্যোতি লাসু চাকমা ও সহকারী পুরোহিত অনন্ত বিকাশ চাকমা’র বাড়ি ও গির্জাঘর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর অনুসারীরা রাতের অন্ধকারে ভাঙচুর করেছে। অপর আরেকজন সহবিশ^াসী ক্ষুব্ধ হয়ে লিখে পাঠালেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে, রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়াচার উপজেলার সৈয়ন্দর পাড়া ব্যাপ্টিষ্ট চার্চকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা জঙ্গি গোষ্ঠীরা ভাঙচুর করেছে অর্থাৎ ভেঙে ফেলা হয়েছে, তাছাড়া খ্রিস্টান পরিবারদের মারধর করে এলাকাছাড়া করেছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছেও অবগত করতেও পারছেনা, অত্র এলাকার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভয়ে, তারা কিছু করতে পারছে না, যারা গির্জাঘর ভেঙে দিয়ে দিয়েছে, তাদের পেছনে রয়েছে আঞ্চলিক দল।’
পরবর্তীকালে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করি, বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ফেলোশিপের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। জানালেন, ১১টি পরিবার নিয়ে চার্চ যাত্রা শুরু হয় প্রায় তিন বছর পূর্বে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এ বছরই আধা-পাকা টিনঘর নির্মাণ করে একপ্রকার নিজেদের অর্থায়নেই। দৃশ্যমান গির্জাঘর নির্মাণের পর থেকেই স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আকার-ইঙ্গিতে এবং দু’একদিন পূর্বে প্রকাশ্যে এসে খ্রিস্টান পুরোহিতকে পূর্বের ধর্মে প্রত্যাবর্তনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। তাদের মন্তব্য ছিলো-খ্রিস্টান হয়ে থাকতে পারবে না, আমরা প্রয়োজনে পেশীশক্তি ব্যবহার করতেও দ্বিধান্বিত হবো না। ১৫ জুলাই রাতে দলবল নিয়ে আসার সংবাদ শোনার পরই পুরোহিত জ্যোতি লাসু চাকমা ও তার পরিবার, সহকারী পুরোহিত অনন্ত বিকাশ চাকমা ও তার পরিবার রাতের অন্ধকারে জীবনের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। দেশীয় অন্ত্র নিয়ে প্রথমে তাদের বাড়িতে আক্রমণ চালায় এবং ভাঙচুর করে। অতঃপর গির্জাঘরে হামলা করে। ইটের দেয়াল ভেঙে গির্জা ঘরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র তছনছ করে। সর্বোপরি, গির্জাঘরের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। যতদূর জানা গেছে, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন-এর রাঙ্গামাটি শাখার কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিষয়টি সমঝোতায় পৌঁছিয়েছে এবং সৈয়ন্দরপাড়া ট্রাইবাল ব্যাপ্টিস্ট চার্চ-এর পুরোহিত ও সহকারী পুরোহিত দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর ২২ জুলাই, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসে। পারস্পরিক সমঝোতায় একে-অপরকে নিজ নিজ ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান পালনে বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। বোধকরি, আলোচনান্তে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে ৪১ অনুচ্ছেদটি। ৪১. ক তে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে’। অর্থাৎ
দেশের অভ্যন্তরে থাকা একজন নাগরিক যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন ও প্রচারের অধিকার রয়েছে। তবে হ্যাঁ, ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়াদি রয়েছে। অভিযুক্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পেশী শক্তির ব্যবহার করে মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণœ করেছে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে আইনানুযায়ী অপরাধীদের সনাক্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করা;
স্থানীয় খ্রিস্টবিশ্বাসীসহ আমাদের কাছে সমঝোতার বিষয়টি চমৎকার মনে হয়েছে কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট করা হয়নি। মৌখিক বিষয়গুলো আমাদের পথ দেখাতে পারে না; সেক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর উপর্যুপরি ঘটনা সংগঠিত করতে পারে। সুদীর্ঘ শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনের উপস্থিতিতে সমঝোতা স্বাক্ষর হলে বিশ^াসযোগ্যতা এবং আইনের দিক থেকে বৈধতার বিষয়টি গুরুত্বতা পেয়ে থাকে।
প্রত্যেক ধর্ম বিশ^াসী নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করবে, এটিই স্বাভাবিক। কোনো ধর্মকে আঘাত, খাটো কিংবা অপব্যাখ্যা করে নয়। কোন লোভ-লালসা বা প্রাপ্তির আশায় কাউকে স্বপক্ষে নিয়ে আসা এটি আইনের পরিপন্থি। খ্রিস্টধর্ম কখনোই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইন লঙ্ঘন করলে আইনানুযায়ীই মোকাবিলা করা আবশ্যিক।
ধর্ম বিশ্বাসীদের মানবিক গুণাবলির পরিবর্তন ঘটাই, সেটি হোক আত্মিক কিংবা জাগতিক। সত্যানুসারীরা কখনোই অন্যধর্মকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন না; বরং প্রত্যাশা করেন, একজন ভালো বুদ্ধিষ্ট, একজন ভালো হিন্দু, একজন ভালো মুসলিম এবং একজন ভালো খ্রিস্টান হয়ে জীবনযাপন করবেন।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সার্বজনীন দর্শন ও কর্মকা- পরিচালনা করছে। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। দৈহিক শক্তিতে ইট-পাথরের গির্জাঘরকে ভেঙে দেয়া যায়, রাষ্ট্র জয় করা যায় কিন্তু মানুষের মনকে জয় করা যায় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবিনয়ে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রীতি বিনষ্টের নেপথ্যে কী ধর্মই না অন্য কোনো এজেন্ডা রয়েছে! অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান, দেশবিরোধী কর্মকা- পরিচালনার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, চাঁদাবাজি করে উগ্রবাদীরা নিজেদের জীবনাচরণকে সচল রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামাঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেরাই নিজেদের অবিশ্বস্ত করে তুলেছে। আর এর পেছনে রয়েছে সম্প্রীতি বিনষ্টের সুকৌশল চক্রান্ত। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের বিজয় দিবস উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সব ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ... এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ১৬ কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সবার। এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোন ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আমরা দেব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।’ আমরা বিভেদ নয়, শান্তির প্রত্যাশী; শান্তির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হই।
মিথুশিলাক মুরমু
রাঙ্গামাটিতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাড়ি ও প্রার্থণালয় ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা
বুধবার, ২৮ জুলাই ২০২১
পার্বত্য চট্টগ্রাম ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আবাসস্থল। বরাবর শুনে এসেছি, অত্র অঞ্চলে ১১টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে-চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, তংচঙ্গ্যা, বম, পাংখোয়া, খিয়াং, খুমী, চাক এবং লুসাই। কিন্তু এখানে সাঁওতাল, গোর্খা, অসমীয়াও রয়েছে। কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ, ক্ষেত্রফলের পরিমাণ প্রায় ১৩,০০০ কিলোমিটার। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারির অস্থায়ী রিটার্নে তিনটি জেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ১২০ জন। এ অঞ্চলে ৫৪.৫% আদিবাসী মানুষ এবং ধর্মানুসারে থেরাবাদ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ৪৪%, ৬.৫% হিন্দু, ৩% খ্রিস্টান এবং ১% এনিমিস্ট। ৪৫.৫% শতাংশ বাঙালি (৪২% মুসলমান এবং ৩.৫% হিন্দু) এবং বাঙালিরা বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী। জেলাভিত্তিক দেখা যায়, রাঙ্গামাটিতেÑ ৩৬.৮২% ইসলাম ধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধ ৫৬.০৬%, হিন্দ ৫.৩০%, খ্রিস্টধর্ম ১.৮১%। বান্দরবান জেলাতে ৫০.৩৩% বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৩৩.৮৮% ইসলাম, ৩.৬২% হিন্দু, ১২.১৭% খ্রিস্ট ধর্মানুসারী। খাগড়াছড়িতে ৪৩.৫২% ইসলাম, ৩৯.২৮% বৌদ্ধ, ১৬.৪৩% হিন্দু এবং ০.৭৭% খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বসবাস রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে এ যেন এক বাগানের ফুল।
গত ২১ জুলাই পত্রিকার অন্যতম শিরোনাম ছিল ‘জেলা বান্দরবানে বোমাং রাজবিহারের দশম রাজগুরু কেটু মহাথেরের অভিষেক’। জানা গেছে, গত বছরের ১১ জুলাই নবম রাজগুরুর প্রয়াণের পর রাজগুরুর পদটি শূন্য হয়। এটি পূরণের জন্য পরিচালনা কমিটি আলোচনা করে হাংসামাপাড়া বিহারের বিরাধ্যক্ষকে রাজগুরু হিসেবে মনোনীত করে রাজার কাছে সুপারিশ করেন। কেটু মহাথের ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর থানচি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে উপসম্পদা গ্রহণ করে ভিক্ষু হন। বাংলাদেশে পড়াশোনা শেষে মিয়ানমারে বুদ্ধ দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে কেটু মহাথের জেলা শহরতলির হাংসামাপাড়া বিহারে বিহারাধ্যক্ষ ছিলেন। বোমাং রাজা উচ প্রু চৌধুরীর কাছ থেকে রাজগুরু ভান্তে বা বিহারাধ্যক্ষ হওয়ার পত্র গ্রহণ করেছেন। কেটু মহাথের বোমাং সার্কেল বান্দরবানের বৌদ্ধধর্মালম্বীদের কেন্দ্রীয় বিহারের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। অভিষেক অনুষ্ঠানকে আলোকময় করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বোমাং রাজপরিবার ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বান্দরবান জেলা শহরে রাজবিহারটি প্রতিষ্ঠিত করে। এটি বোমাং সার্কেল বা বান্দরবানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কেন্দ্রীয় বিহার হিসেবে পরিচিত। এ বিহারের অষ্টম রাজগুরু উপঞা জোত মহাথের বা উচহ্লা ভান্তে গত বছরের ১২ এপ্রিল মারা যান। এরপর জ্ঞানপ্রিয় মহাথের নবম রাজগুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার দুই মাস পর মারা যান। তখন থেকে বিহারাধ্যক্ষ বা রাজগুরু পদটি শূন্য ছিল। আমরা এই নবভিষিক্ত রাজগুরু ভান্তেকে স্বাগত জানাই। কেটু মহাথের শুধু বান্দরবান জেলা নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। পাহাড়ি ৩ জেলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দায়িত্ববোধ সংখ্যালগরিষ্ঠতা থেকেই পালন করতে হবে। মহামতি গৌতম বুদ্ধের বিশ্বাস, বাণী ও প্রচারের সারবস্তুকে ধারণ করার মাধ্যমে সম্প্রীতির পতাকাকে ওড়াতে হবে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৬ জুলাই, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার সকালে রাঙ্গামাটি থেকে একজন সুহৃদ ফোন করেছেন, জানালেন ‘বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ফেলোশিপ’-এর আওতাভুক্ত চার্চ সৈয়ন্দরপাড়া ট্রাইবাল ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ-এর মাননীয় পুরোহিত জ্যোতি লাসু চাকমা ও সহকারী পুরোহিত অনন্ত বিকাশ চাকমা’র বাড়ি ও গির্জাঘর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর অনুসারীরা রাতের অন্ধকারে ভাঙচুর করেছে। অপর আরেকজন সহবিশ^াসী ক্ষুব্ধ হয়ে লিখে পাঠালেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে, রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়াচার উপজেলার সৈয়ন্দর পাড়া ব্যাপ্টিষ্ট চার্চকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা জঙ্গি গোষ্ঠীরা ভাঙচুর করেছে অর্থাৎ ভেঙে ফেলা হয়েছে, তাছাড়া খ্রিস্টান পরিবারদের মারধর করে এলাকাছাড়া করেছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছেও অবগত করতেও পারছেনা, অত্র এলাকার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভয়ে, তারা কিছু করতে পারছে না, যারা গির্জাঘর ভেঙে দিয়ে দিয়েছে, তাদের পেছনে রয়েছে আঞ্চলিক দল।’
পরবর্তীকালে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করি, বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ফেলোশিপের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। জানালেন, ১১টি পরিবার নিয়ে চার্চ যাত্রা শুরু হয় প্রায় তিন বছর পূর্বে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এ বছরই আধা-পাকা টিনঘর নির্মাণ করে একপ্রকার নিজেদের অর্থায়নেই। দৃশ্যমান গির্জাঘর নির্মাণের পর থেকেই স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আকার-ইঙ্গিতে এবং দু’একদিন পূর্বে প্রকাশ্যে এসে খ্রিস্টান পুরোহিতকে পূর্বের ধর্মে প্রত্যাবর্তনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন। তাদের মন্তব্য ছিলো-খ্রিস্টান হয়ে থাকতে পারবে না, আমরা প্রয়োজনে পেশীশক্তি ব্যবহার করতেও দ্বিধান্বিত হবো না। ১৫ জুলাই রাতে দলবল নিয়ে আসার সংবাদ শোনার পরই পুরোহিত জ্যোতি লাসু চাকমা ও তার পরিবার, সহকারী পুরোহিত অনন্ত বিকাশ চাকমা ও তার পরিবার রাতের অন্ধকারে জীবনের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। দেশীয় অন্ত্র নিয়ে প্রথমে তাদের বাড়িতে আক্রমণ চালায় এবং ভাঙচুর করে। অতঃপর গির্জাঘরে হামলা করে। ইটের দেয়াল ভেঙে গির্জা ঘরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র তছনছ করে। সর্বোপরি, গির্জাঘরের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। যতদূর জানা গেছে, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন-এর রাঙ্গামাটি শাখার কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিষয়টি সমঝোতায় পৌঁছিয়েছে এবং সৈয়ন্দরপাড়া ট্রাইবাল ব্যাপ্টিস্ট চার্চ-এর পুরোহিত ও সহকারী পুরোহিত দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর ২২ জুলাই, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসে। পারস্পরিক সমঝোতায় একে-অপরকে নিজ নিজ ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান পালনে বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। বোধকরি, আলোচনান্তে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে ৪১ অনুচ্ছেদটি। ৪১. ক তে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে’। অর্থাৎ
দেশের অভ্যন্তরে থাকা একজন নাগরিক যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন ও প্রচারের অধিকার রয়েছে। তবে হ্যাঁ, ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়াদি রয়েছে। অভিযুক্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পেশী শক্তির ব্যবহার করে মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণœ করেছে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে আইনানুযায়ী অপরাধীদের সনাক্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করা;
স্থানীয় খ্রিস্টবিশ্বাসীসহ আমাদের কাছে সমঝোতার বিষয়টি চমৎকার মনে হয়েছে কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট করা হয়নি। মৌখিক বিষয়গুলো আমাদের পথ দেখাতে পারে না; সেক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর উপর্যুপরি ঘটনা সংগঠিত করতে পারে। সুদীর্ঘ শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনের উপস্থিতিতে সমঝোতা স্বাক্ষর হলে বিশ^াসযোগ্যতা এবং আইনের দিক থেকে বৈধতার বিষয়টি গুরুত্বতা পেয়ে থাকে।
প্রত্যেক ধর্ম বিশ^াসী নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করবে, এটিই স্বাভাবিক। কোনো ধর্মকে আঘাত, খাটো কিংবা অপব্যাখ্যা করে নয়। কোন লোভ-লালসা বা প্রাপ্তির আশায় কাউকে স্বপক্ষে নিয়ে আসা এটি আইনের পরিপন্থি। খ্রিস্টধর্ম কখনোই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইন লঙ্ঘন করলে আইনানুযায়ীই মোকাবিলা করা আবশ্যিক।
ধর্ম বিশ্বাসীদের মানবিক গুণাবলির পরিবর্তন ঘটাই, সেটি হোক আত্মিক কিংবা জাগতিক। সত্যানুসারীরা কখনোই অন্যধর্মকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন না; বরং প্রত্যাশা করেন, একজন ভালো বুদ্ধিষ্ট, একজন ভালো হিন্দু, একজন ভালো মুসলিম এবং একজন ভালো খ্রিস্টান হয়ে জীবনযাপন করবেন।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সার্বজনীন দর্শন ও কর্মকা- পরিচালনা করছে। ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। দৈহিক শক্তিতে ইট-পাথরের গির্জাঘরকে ভেঙে দেয়া যায়, রাষ্ট্র জয় করা যায় কিন্তু মানুষের মনকে জয় করা যায় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবিনয়ে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রীতি বিনষ্টের নেপথ্যে কী ধর্মই না অন্য কোনো এজেন্ডা রয়েছে! অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান, দেশবিরোধী কর্মকা- পরিচালনার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, চাঁদাবাজি করে উগ্রবাদীরা নিজেদের জীবনাচরণকে সচল রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামাঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেরাই নিজেদের অবিশ্বস্ত করে তুলেছে। আর এর পেছনে রয়েছে সম্প্রীতি বিনষ্টের সুকৌশল চক্রান্ত। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের বিজয় দিবস উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সব ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ... এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ১৬ কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সবার। এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোন ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আমরা দেব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।’ আমরা বিভেদ নয়, শান্তির প্রত্যাশী; শান্তির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হই।