alt

suppliment » anniversary2025

গণমানুষের সংগ্রামের প্রগতিশীল মুখপত্র

নাসির আহমেদ

: মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দূর শৈশবেই সংবাদ-এর সঙ্গে পরিচয়। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আমার আলিনগর প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির সহপাঠী অমূল্য পোদ্দারদের বাসায় প্রথম এই পত্রিকাটি দেখি। তখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পড়তো আজাদ, কেউ কেউ ইত্তেফাক। সংবাদ পড়তেন কম লোক। কিন্তু তারা সচেতন এবং প্রগতিশীল বামরাজনীতির অনুরাগী। আমাদের গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ষাটের দশকের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ইসহাক জমদ্দারকেও সংবাদ পড়তে দেখতাম।

বড় হয়ে এটা বুঝতে পারি এই পত্রিকা সেই সব মানুষই পড়েন, যারা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একটি সমাজ বা সাম্যভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেন। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরাও কাগজটা পড়তো।

সকলেই জানি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাগুলির অন্যতম ‘সংবাদ’। পত্রিকাটি গণমুখী চেতনা ধারণ করেই দীর্ঘ ৭৪ বছর অতিক্রম করে ৭৫-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৯৫১ থেকে ২০২৫- এই দীর্ঘকাল পরিসরে এদেশের ইতিহাসের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ঢেউ বুকে ধারণ করেই ‘সংবাদ’ এগিয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে।

যে কাল পরিসরে ‘সংবাদ’ আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই সময়টা সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষ মাত্র ধাক্কাটা খেয়েছে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। পাকিস্তান আন্দোলনের সেই আবেগও কেটে গেছে সচেতন অনেকেরই। বাঙালিত্বের বোধ আর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় জাগতে শুরু করেছে পূর্ব বাংলা। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম সরকার প্রধান (গভর্নর জেনারেল) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে অন্যায়ভাবে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্র যুবসমাজ যখন মুখর, মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র বোধ তখন সূচিত হয়ে গেছে। এরকম বাস্তবতায় ১৯৫১ সালে সংবাদের আত্মপ্রকাশ।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়ার আগে পর্যন্ত সংবাদ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় নানা কারণেই অবতীর্ণ হয়নি। কিন্তু গত বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের পরেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিটি ক্ষুব্ধ তরঙ্গ বুকে ধারণ করেই এগিয়ছে। পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের প্রতিটি আন্দোলনে, সংগ্রামে তথা মানব মুক্তির মিছিলে সাহসী ভূমিকা নিয়ে এগিয়েছে সংবাদ।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাসের তথ্য হিসেবে উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলে সংবাদ নবগঠিত ন্যাপকে সমর্থন করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সংবাদ যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন না করলেও যখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয়, তখন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে ‘সংবাদ’।

’৫৪ পরবর্তীকালে আন্দোলনে মুখর উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান যখন ইসকান্দার মির্জাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন, তারপর থেকেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় পত্রিকার উপর। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পূর্ব পর্যন্ত এই কঠোরতা বলবৎ ছিল। কিন্তু সংবাদ সাহসের সঙ্গে সেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও জনগণের পক্ষে কলম ধরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের রোষানলে পড়ে।

বিশেষ করে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন যখন নিয়ন্ত্রিত ও বৈষম্য মূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করে, তার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের আন্দোলন ও বিক্ষোভের খবর প্রকাশে, এবং আন্দোলনের স্বপক্ষে সমর্থনমূলক সম্পাদকীয় অভিমত প্রকাশে সংবাদ অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা নেয়। এই সমর্থনের কারণে যে তিনটি পত্রিকাকে পাকিস্তান সরকার কালো তালিকাভুক্ত করে, তার একটি সংবাদ।

জেনারেল আইয়ুবের সামরিক শাসনকালে সংবাদ কী রকম বিপদের সম্মুখীন হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক। সংবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, সম্পাদক আহমদুল কবির স্মারকগ্রন্থে (বজলুর রহমান ও আবুল হাসনাত সম্পাদিত, প্রকাশকাল ২০০৪) বড় একটি লেখার সূত্র থেকে। ঘটনাটি এরকম:

সংবাদের মফস্বল পাতায় একটি সিঙ্গেল কলাম নিউজ ছাপা হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল- “রামগতিতে চালের দর ৪২ টাকা।” এই ছোট্ট নিউজে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে, তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী হাফিজুর রহমান ‘সংবাদ’-সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও সাংবাদের তৎকালীন পরিচালক (অর্থ) আহমদুল কবির সাহেবকে জবাবদিহি করতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয় খাদ্যমন্ত্রী স্বয়ং সরেজমিন তদন্তে দিয়েছিলেন রামগতিতে। ভাগ্য ভালো যে, সংবাদদাতার পাঠানো খবরে মণপ্রতি চালের দাম লেখা হয়েছিল ৪২ টাকা। কিন্তু ঐদিন প্রকৃতপক্ষে ৪২ টাকা আট আনা ছিল প্রতি মণের দাম।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে পুরো বাংলা সংবাদসহ কয়েকটি কাগজের এই সাহসী ভূমিকা মোকাবিলার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রেস ট্রাস্ট গঠন করে পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়। ট্রাস্ট থেকে সরকারি খরচে পত্রিকাও প্রকাশ শুরু করে। কিন্তু তাতে তেমন একটা ফল হয়নি। কারণ ট্রাস্টের কাগজে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেও নেতৃস্থানীয় অনেকে ছিলেন সংবাদের সাবেক কর্মী এবং বাম রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী।

আইয়ুবী শাসনামলের আগে থেকেই আজাদ জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা ঘোষণা করেন, তার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিল ঐ জনপ্রিয় পত্রিকাটি। অন্যদিকে ইত্তেফাক আর সংবাদ ছয় দফার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের ও তাঁকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ এবং মুক্তির দাবিতে ’৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভা থেকে যে দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিয়েছিলেন, সে খবরও সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি সামরিক শাসক আইয়ুবের দুঃশাসন বিরোধী রাজপথের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হওয়ার পর দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সংবাদ সে সময়ও খবর এবং অভিমত প্রকাশের ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালন করে। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

১৯৬৯-এর মার্চে জেনারেল আইয়ুবের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের অধীনে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সকলেরই জানা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেওয়ার পরিবর্তে নানা রকম ষড়যন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন পূর্ব বাংলা উত্তাল, সেই ঝুঁকিপূর্ণ সময়েও সংবাদের ভূমিকা ছিল গণমানুষের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর পয়লা মার্চ ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন, ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের খবর এবং অভিমত প্রকাশে সংবাদ নীতিতে অটল থেকেছে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।

সাংবাদ-এর এই সাহসী ভূমিকার পরিণতি আমরা দেখেছি পঁচিশে মার্চেই। সে রাতে পিলখানা ইপিয়ার সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ পাকবাহিনীর রাজধানী ঢাকায় যতগুলো টার্গেট ছিল, তার মধ্যে সংবাদও ছিল একটি। সে রাতেই বংশালের সংবাদ কার্যালয় আগুনে পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী। সংবাদ অফিসের ভিতরে পুড়ে মারা যান বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদ সাবের। সাংবাদের যুগ্ম সম্পাদক বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৪ই ডিসেম্বর হত্যা করে পাকসেনাদের এদেশীয় দোসর আল বদরবাহিনী।

সংবাদ পুড়িয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক সরকার সংবাদ কর্তৃপক্ষকে বিপুল অংকের ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিয়েছিল ভবন পুনঃনির্মাণ করে দেবে পাকিস্তানের স্বপক্ষে তারা লিখলে। নীতিতে অটল সম্পাদক প্রকাশক আহমদুল কবির সে প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও ‘সংবাদ’ তার প্রগতিশীল তথা অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার প্রকাশের আদর্শে অটল থেকেছে। গণমানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা আর সামাজিক অবিচার, অন্যায় আর মানবাধিকারের পাশাপাশি গণসংকটকে বড় করে তুলে ধরেছে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের মানুষের দুঃখদুর্দশার চিত্র অসাধারণ সৎ সাহসী সাংবাদিক সংবাদের নিজস্ব প্রতিনিধি মোনাজাত উদ্দিন যেভাবে সাংবাদে তুলে ধরতে পেরেছেন, তা কেবল সংবাদ কর্তৃপক্ষের গণমুখী নীতির কারণেই।

ষাটের দশকে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে ‘সংবাদ’-এর ইতিবাচক ভূমিকা যেমন স্মরণীয়, তেমনি স্মরণীয় এরশাদ শাসনামলে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সংবাদ-এর সোচ্চার ভূমিকাও। নিউজে যেমন, অভিমতেও তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ায় সচেতন ভূমিকা পালন করে সংবাদ।

৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদকদের সংগঠিত করার কাজেও সংবাদের কর্ণধার আহমদুল কবিরের ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। সব মিলিয়ে সংবাদ পত্রিকাটিকে ‘প্রগতিশীলতার বাতিঘর’ বললে সম্ভবত অতিশয়োক্তি বলা যাবে না।

সংবাদকে একসময় বলা হতো সাংবাদিকতার স্কুল। কারণ এখান থেকেই গড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য অনেক সাংবাদিক এবং সেই ধারাটি প্রগতিশীলতারই ধারা। দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সাংবাদে কাজ করেছেন কিন্তু পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ধারণ করেছেন, এমন সাংবাদিক প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। পঞ্চাশের দশকের রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা কাজের সুযোগ হয়নি বটে, কিন্তু পরবর্তীকালের যাঁদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে- সম্পাদক বজলুর রহমান (খেলাঘরের পরিচালক, ভাইয়া), সন্তোষ গুপ্ত, নির্মল সেন তাঁদের মতো উঁচুমাপের মানুষ এবং সাংবাদিক অগ্রজদের আজ আর কোথায় পাবো! আবার দীর্ঘদিন যাঁদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি, সংবাদ সম্পর্কে জেনেছি তাঁরাই বা কিংবদন্তি কে নন? তোয়াব খান, গোলাম সারওয়ারের মতো দেশবরেণ্য সম্পাদকরা তো সংবাদেরই প্রোডাক্ট। কর্মস্থলে তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সংবাদের ঐতিহ্যের অনেক গল্প শুনেছি। জনাব এটিএম শামসুদ্দীন ছিলেন জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। একই বিভাগে কাজের সুবাদে দেখেছি কী অসাধারণ জানাশোনা এক আলোকিত মানুষ, আমৃত্যু প্রগতিশীল শামসুদ্দীন ভাই সংবাদের কিংবদন্তিদের অনেক গল্প শুনিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কাজের স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই কিংবদন্তিদের অনেককে না দেখেও অভিভূত হয়েছি।

আমি খেলাঘরের সদস্য ছিলাম না বটে, কিন্তু উচ্চশিক্ষা জীবনে বংশালে সাপ্তাহিক আসরে গেছি, খেলাঘরের অনুষ্ঠানে সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে বহুবার গিয়েছি আশির দশক পর্যন্ত। সেখানে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, জাতীয় পর্যায়ে তাঁরা অনেকেই আজ সুপরিচিত।

বাংলাদেশে প্রগতিশীল সাহিত্যের বিকাশে ‘খেলাঘর’ এবং ‘সংবাদ সাময়িকী’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে আবুল হাসনাতের মতো আলোকিত এবং মোহমুক্ত লেখক সাংবাদিক এই সমাজে কজন পাবো! অত্যন্ত যতেœ আর শ্রমে সংবাদের সাময়িকী পাতাগুলো সুপরিকল্পিতভাবে তিনি করে গেছেন দীর্ঘকাল।

একটি আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য যে অসাম্প্রদায়িক, উদার গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটা সমাজ গড়ে তুলতে হয়, আধুনিক সচেতনতামূলক গণজাগরণ প্রয়োজন হয়, সংবাদ সেই প্রয়োজনীয়তা মনে রেখেই দীর্ঘ সাত দশকের অধিক কাল এর প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। বিবর্তিত বাস্তবতায় আজ প্রগতির পথে থাকা যতই কঠিন হোক, সকল দুঃসময় এড়িয়ে সংবাদ তার ঐতিহ্য সঙ্গী করে এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে, এখনো এ বিশ্বাস রাখি।

ছবি

গাছপাথরের সময়

ছবি

সন্তোষ গুপ্ত : এক বিরল ব্যক্তিত্ব

ছবি

সংস্কৃতি কি বাঁচাবে আমাদের?

ছবি

স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা নারীর সংখ্যালঘু-দশার শেষ কোথায়?

ছবি

পার্বত্য আদিবাসী সংস্কৃতির ভেতর-বাহির

ছবি

বিশ্বসেরা বিাশ্ববিদ্যালয়ে কাব্যচর্চা

ছবি

গণমাধ্যমের হাল-হকিকত

ছবি

গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য মুক্ত ভাবনার সুরক্ষা

ছবি

সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ জহুর হোসেন চৌধুরী

ছবি

জন্মেজয় দৈনিক সংবাদ যেন সফল হয় সর্প নিধনে

ছবি

পঁচাত্তর বছরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ

ছবি

গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

উত্তাল চল্লিশে দেশ বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?

ছবি

দৈনিক সংবাদের সাথেই বেড়ে উঠেছি

সংবাদ থাকুক সংবাদ-এর মতোই

ক্ষমতার হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই

tab

suppliment » anniversary2025

গণমানুষের সংগ্রামের প্রগতিশীল মুখপত্র

নাসির আহমেদ

মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দূর শৈশবেই সংবাদ-এর সঙ্গে পরিচয়। যতদূর মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আমার আলিনগর প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির সহপাঠী অমূল্য পোদ্দারদের বাসায় প্রথম এই পত্রিকাটি দেখি। তখন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পড়তো আজাদ, কেউ কেউ ইত্তেফাক। সংবাদ পড়তেন কম লোক। কিন্তু তারা সচেতন এবং প্রগতিশীল বামরাজনীতির অনুরাগী। আমাদের গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ষাটের দশকের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ইসহাক জমদ্দারকেও সংবাদ পড়তে দেখতাম।

বড় হয়ে এটা বুঝতে পারি এই পত্রিকা সেই সব মানুষই পড়েন, যারা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একটি সমাজ বা সাম্যভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেন। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরাও কাগজটা পড়তো।

সকলেই জানি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাগুলির অন্যতম ‘সংবাদ’। পত্রিকাটি গণমুখী চেতনা ধারণ করেই দীর্ঘ ৭৪ বছর অতিক্রম করে ৭৫-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৯৫১ থেকে ২০২৫- এই দীর্ঘকাল পরিসরে এদেশের ইতিহাসের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ঢেউ বুকে ধারণ করেই ‘সংবাদ’ এগিয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে।

যে কাল পরিসরে ‘সংবাদ’ আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই সময়টা সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা এই বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষ মাত্র ধাক্কাটা খেয়েছে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। পাকিস্তান আন্দোলনের সেই আবেগও কেটে গেছে সচেতন অনেকেরই। বাঙালিত্বের বোধ আর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় জাগতে শুরু করেছে পূর্ব বাংলা। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম সরকার প্রধান (গভর্নর জেনারেল) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে অন্যায়ভাবে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্র যুবসমাজ যখন মুখর, মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র বোধ তখন সূচিত হয়ে গেছে। এরকম বাস্তবতায় ১৯৫১ সালে সংবাদের আত্মপ্রকাশ।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়ার আগে পর্যন্ত সংবাদ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় নানা কারণেই অবতীর্ণ হয়নি। কিন্তু গত বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের পরেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিটি ক্ষুব্ধ তরঙ্গ বুকে ধারণ করেই এগিয়ছে। পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের প্রতিটি আন্দোলনে, সংগ্রামে তথা মানব মুক্তির মিছিলে সাহসী ভূমিকা নিয়ে এগিয়েছে সংবাদ।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাসের তথ্য হিসেবে উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলে সংবাদ নবগঠিত ন্যাপকে সমর্থন করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সংবাদ যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন না করলেও যখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয়, তখন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে ‘সংবাদ’।

’৫৪ পরবর্তীকালে আন্দোলনে মুখর উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান যখন ইসকান্দার মির্জাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন, তারপর থেকেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় পত্রিকার উপর। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পূর্ব পর্যন্ত এই কঠোরতা বলবৎ ছিল। কিন্তু সংবাদ সাহসের সঙ্গে সেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও জনগণের পক্ষে কলম ধরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের রোষানলে পড়ে।

বিশেষ করে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন যখন নিয়ন্ত্রিত ও বৈষম্য মূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করে, তার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের আন্দোলন ও বিক্ষোভের খবর প্রকাশে, এবং আন্দোলনের স্বপক্ষে সমর্থনমূলক সম্পাদকীয় অভিমত প্রকাশে সংবাদ অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা নেয়। এই সমর্থনের কারণে যে তিনটি পত্রিকাকে পাকিস্তান সরকার কালো তালিকাভুক্ত করে, তার একটি সংবাদ।

জেনারেল আইয়ুবের সামরিক শাসনকালে সংবাদ কী রকম বিপদের সম্মুখীন হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক। সংবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, সম্পাদক আহমদুল কবির স্মারকগ্রন্থে (বজলুর রহমান ও আবুল হাসনাত সম্পাদিত, প্রকাশকাল ২০০৪) বড় একটি লেখার সূত্র থেকে। ঘটনাটি এরকম:

সংবাদের মফস্বল পাতায় একটি সিঙ্গেল কলাম নিউজ ছাপা হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল- “রামগতিতে চালের দর ৪২ টাকা।” এই ছোট্ট নিউজে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে, তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী হাফিজুর রহমান ‘সংবাদ’-সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও সাংবাদের তৎকালীন পরিচালক (অর্থ) আহমদুল কবির সাহেবকে জবাবদিহি করতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয় খাদ্যমন্ত্রী স্বয়ং সরেজমিন তদন্তে দিয়েছিলেন রামগতিতে। ভাগ্য ভালো যে, সংবাদদাতার পাঠানো খবরে মণপ্রতি চালের দাম লেখা হয়েছিল ৪২ টাকা। কিন্তু ঐদিন প্রকৃতপক্ষে ৪২ টাকা আট আনা ছিল প্রতি মণের দাম।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে পুরো বাংলা সংবাদসহ কয়েকটি কাগজের এই সাহসী ভূমিকা মোকাবিলার লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রেস ট্রাস্ট গঠন করে পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়। ট্রাস্ট থেকে সরকারি খরচে পত্রিকাও প্রকাশ শুরু করে। কিন্তু তাতে তেমন একটা ফল হয়নি। কারণ ট্রাস্টের কাগজে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেও নেতৃস্থানীয় অনেকে ছিলেন সংবাদের সাবেক কর্মী এবং বাম রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী।

আইয়ুবী শাসনামলের আগে থেকেই আজাদ জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা ঘোষণা করেন, তার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিল ঐ জনপ্রিয় পত্রিকাটি। অন্যদিকে ইত্তেফাক আর সংবাদ ছয় দফার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের ও তাঁকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ এবং মুক্তির দাবিতে ’৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভা থেকে যে দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিয়েছিলেন, সে খবরও সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি সামরিক শাসক আইয়ুবের দুঃশাসন বিরোধী রাজপথের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হওয়ার পর দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সংবাদ সে সময়ও খবর এবং অভিমত প্রকাশের ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালন করে। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

১৯৬৯-এর মার্চে জেনারেল আইয়ুবের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের অধীনে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সকলেরই জানা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেওয়ার পরিবর্তে নানা রকম ষড়যন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন পূর্ব বাংলা উত্তাল, সেই ঝুঁকিপূর্ণ সময়েও সংবাদের ভূমিকা ছিল গণমানুষের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর পয়লা মার্চ ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন, ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের খবর এবং অভিমত প্রকাশে সংবাদ নীতিতে অটল থেকেছে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।

সাংবাদ-এর এই সাহসী ভূমিকার পরিণতি আমরা দেখেছি পঁচিশে মার্চেই। সে রাতে পিলখানা ইপিয়ার সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ পাকবাহিনীর রাজধানী ঢাকায় যতগুলো টার্গেট ছিল, তার মধ্যে সংবাদও ছিল একটি। সে রাতেই বংশালের সংবাদ কার্যালয় আগুনে পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী। সংবাদ অফিসের ভিতরে পুড়ে মারা যান বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদ সাবের। সাংবাদের যুগ্ম সম্পাদক বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৪ই ডিসেম্বর হত্যা করে পাকসেনাদের এদেশীয় দোসর আল বদরবাহিনী।

সংবাদ পুড়িয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানি সামরিক সরকার সংবাদ কর্তৃপক্ষকে বিপুল অংকের ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিয়েছিল ভবন পুনঃনির্মাণ করে দেবে পাকিস্তানের স্বপক্ষে তারা লিখলে। নীতিতে অটল সম্পাদক প্রকাশক আহমদুল কবির সে প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও ‘সংবাদ’ তার প্রগতিশীল তথা অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার প্রকাশের আদর্শে অটল থেকেছে। গণমানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা আর সামাজিক অবিচার, অন্যায় আর মানবাধিকারের পাশাপাশি গণসংকটকে বড় করে তুলে ধরেছে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের মানুষের দুঃখদুর্দশার চিত্র অসাধারণ সৎ সাহসী সাংবাদিক সংবাদের নিজস্ব প্রতিনিধি মোনাজাত উদ্দিন যেভাবে সাংবাদে তুলে ধরতে পেরেছেন, তা কেবল সংবাদ কর্তৃপক্ষের গণমুখী নীতির কারণেই।

ষাটের দশকে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে ‘সংবাদ’-এর ইতিবাচক ভূমিকা যেমন স্মরণীয়, তেমনি স্মরণীয় এরশাদ শাসনামলে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সংবাদ-এর সোচ্চার ভূমিকাও। নিউজে যেমন, অভিমতেও তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ায় সচেতন ভূমিকা পালন করে সংবাদ।

৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদকদের সংগঠিত করার কাজেও সংবাদের কর্ণধার আহমদুল কবিরের ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। সব মিলিয়ে সংবাদ পত্রিকাটিকে ‘প্রগতিশীলতার বাতিঘর’ বললে সম্ভবত অতিশয়োক্তি বলা যাবে না।

সংবাদকে একসময় বলা হতো সাংবাদিকতার স্কুল। কারণ এখান থেকেই গড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য অনেক সাংবাদিক এবং সেই ধারাটি প্রগতিশীলতারই ধারা। দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সাংবাদে কাজ করেছেন কিন্তু পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ধারণ করেছেন, এমন সাংবাদিক প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। পঞ্চাশের দশকের রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা কাজের সুযোগ হয়নি বটে, কিন্তু পরবর্তীকালের যাঁদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে- সম্পাদক বজলুর রহমান (খেলাঘরের পরিচালক, ভাইয়া), সন্তোষ গুপ্ত, নির্মল সেন তাঁদের মতো উঁচুমাপের মানুষ এবং সাংবাদিক অগ্রজদের আজ আর কোথায় পাবো! আবার দীর্ঘদিন যাঁদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি, সংবাদ সম্পর্কে জেনেছি তাঁরাই বা কিংবদন্তি কে নন? তোয়াব খান, গোলাম সারওয়ারের মতো দেশবরেণ্য সম্পাদকরা তো সংবাদেরই প্রোডাক্ট। কর্মস্থলে তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সংবাদের ঐতিহ্যের অনেক গল্প শুনেছি। জনাব এটিএম শামসুদ্দীন ছিলেন জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। একই বিভাগে কাজের সুবাদে দেখেছি কী অসাধারণ জানাশোনা এক আলোকিত মানুষ, আমৃত্যু প্রগতিশীল শামসুদ্দীন ভাই সংবাদের কিংবদন্তিদের অনেক গল্প শুনিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কাজের স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই কিংবদন্তিদের অনেককে না দেখেও অভিভূত হয়েছি।

আমি খেলাঘরের সদস্য ছিলাম না বটে, কিন্তু উচ্চশিক্ষা জীবনে বংশালে সাপ্তাহিক আসরে গেছি, খেলাঘরের অনুষ্ঠানে সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে বহুবার গিয়েছি আশির দশক পর্যন্ত। সেখানে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, জাতীয় পর্যায়ে তাঁরা অনেকেই আজ সুপরিচিত।

বাংলাদেশে প্রগতিশীল সাহিত্যের বিকাশে ‘খেলাঘর’ এবং ‘সংবাদ সাময়িকী’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে আবুল হাসনাতের মতো আলোকিত এবং মোহমুক্ত লেখক সাংবাদিক এই সমাজে কজন পাবো! অত্যন্ত যতেœ আর শ্রমে সংবাদের সাময়িকী পাতাগুলো সুপরিকল্পিতভাবে তিনি করে গেছেন দীর্ঘকাল।

একটি আধুনিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য যে অসাম্প্রদায়িক, উদার গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটা সমাজ গড়ে তুলতে হয়, আধুনিক সচেতনতামূলক গণজাগরণ প্রয়োজন হয়, সংবাদ সেই প্রয়োজনীয়তা মনে রেখেই দীর্ঘ সাত দশকের অধিক কাল এর প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। বিবর্তিত বাস্তবতায় আজ প্রগতির পথে থাকা যতই কঠিন হোক, সকল দুঃসময় এড়িয়ে সংবাদ তার ঐতিহ্য সঙ্গী করে এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে, এখনো এ বিশ্বাস রাখি।

back to top