alt

মুক্ত আলোচনা

জিয়া-মঞ্জুর হত্যা এবং এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল

মোহাম্মদ শাহজাহান

: মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০১৯

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’ অর্থাৎ একেবারে না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়াটা ভালো। বিলম্বে হলেও বিচার না হওয়ার বদনাম থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার বিচার শুরু হয় ২৩ বছর পর। ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে মুজিব হত্যার দায়ে জীবিত ১১ খুনির মধ্যে ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশকের বেশি সময় পর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক আদালতের রায় ১৪ বছর পর ঘোষিত হয়েছে। গত ৩৮ বছরে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার বিচার হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে শনিবার ভোরে জিয়া হত্যার ২ দিন পর ১ জুন সোমবার দিবাগত মধ্যরাতে উপর মহলের নির্দেশে ঠান্ডা মাথায় একটিমাত্র বুলেটে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। তবে জিয়া হত্যার পর বিদ্রোহের দায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রহসনের গোপন বিচারে ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে এরশাদ। মঞ্জুর হত্যার ১৯ বছর পর মঞ্জুর হত্যার বিচার চেয়ে তার ছোট ভাই মামলা করেন। বিচার কাজ সম্পন্ন হলেও শুধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারীকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মঞ্জুর হত্যার রায় দেয়া হচ্ছে না। যদি শেষ পর্যন্ত ঘাতক সর্দারের জীবিতাবস্থায় মঞ্জুর হত্যা মামলার রায় না হয়, ইতিহাস একদিন বলবে- একজন ভন্ড, প্রতারক, পাকিস্তানের চর ও খুনিকে বাঁচানোর জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল এমএ মঞ্জুর বীর উত্তমের বিচারের রায় দেয়া হয়নি।

আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন জেনারেল জিয়া। স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এ দেশীয় চর জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা। বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলজ বলেছেন, ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া মদদ না দিলে ফারুক-রশীদরা কোনোদিনই শেখ মুজিবকে হত্যার সাহস পেত না।’ জিয়া-মঞ্জুর হত্যার সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন এরশাদ। গত ৩৮ বছরে জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকান্ড নিয়ে বই প্রকাশসহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। এটা প্রায় শতভাগ প্রমাণিত সত্য যে, জিয়া-মঞ্জুর হত্যার মূল হোতা হচ্ছে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ। জিয়া ছাড়া যেমন বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যা হতো না, তেমনি এরশাদ ছাড়া জিয়া হত্যা হতো না। মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষী তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধানের সাক্ষ্য, তৎকালীন আইজিপির বক্তব্য, বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলজের ধারাবাহিক নিবন্ধ, মঞ্জুর হত্যা মামলার এজাহার ও চার্জশিট এবং মেজর আরেফিনের লেখা ‘জিয়া-মঞ্জুর হত্যা ও তারপর’ গ্রন্থের সারসংক্ষেপ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের চর তৎকালীন সেনাপ্রধানের নির্দেশেই সুপরিকল্পিতভাবে আটক মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে। জিয়া হত্যার পর মঞ্জুর জীবিত থাকলে জিয়া হত্যাকারীর মুখোশ যেমন উন্মেচিত হতো, তেমনি এরশাদও রাষ্ট্রপতির গদি দখল করতে পারত না। জিয়া-মঞ্জুর হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। যেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরাই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল।

জিয়া হত্যার সময় বিমানবাহিনী প্রধান ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দিন। সদরউদ্দিন সাহেব মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, ১৯৮১ সালের ১ জুন বিকেলে আমি বঙ্গভবনে ছিলাম। এ সময় ফোনে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, মঞ্জুর ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির লাল টেলিফোনে এরশাদ কোন একজনকে বলেন, ‘পুলিশের কাছে মঞ্জুর ধরা পড়েছে। তাকে দ্রুততার সঙ্গে নিয়ে এসে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করো।’ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তেজিত সেনাপ্রধান বলেন, ‘এয়ার চিফ আপনি কিছুই বোঝেন না?’ সদরউদ্দিনের কথার প্রমাণ রয়েছে মেজর আরেফিনের লেখা তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থে। আরেফিন লিখেছেন, ‘ওই রাতে ঢাকার নির্দেশেই সুপরিকল্পিতভাবে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন সিও ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম আরেক ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) লতিফের সামনে ক্যাপ্টেন এমদাদকে নির্দেশ দেন যে, হাটহাজারী থেকে সেনানিবাসে যাওয়ার সময় মঞ্জুরকে হত্যা করতে হবে।’

জিয়া হত্যার পর ঠান্ডা মাথার খুনি এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেননি। হত্যার পরপর এরশাদ ক্ষমতা নিলে দেশ-বিদেশের সবাই বলত এরশাদই খুনি। যেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আসল খুনি জিয়াকে রাষ্ট্রপতি করা হয়নি। জিয়া হত্যার পর ওই সময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থাকলেও ক্ষমতার দন্ড ছিল সেনাপ্রধান এরশাদের হাতে। রাষ্ট্রপতি হত্যার পর ধুরন্ধর এরশাদ তার ক্ষমতা দখলের পথে বাধাগুলো অপসারণ করেন। সেই লক্ষ্যে প্রথমে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। এর পর জিয়া হত্যার সময় বিদ্রোহের অভিযোগে সাজানো ও ভুয়া বিচারে ১৩ জনকে ফাঁসি, ৭ জনকে যাবজ্জীবন ও ৬ জনকে ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফাঁসি দেয়া ১৩ জনের মধ্যে অন্তত ১০-১১ জন জিয়া হত্যার বিষয়ে কিছুই জানত না। এরপর পাকিস্তানপন্থি সেনাকর্মকর্তাদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। জিয়া হত্যার ১০ মাস পর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ক্ষমতা দখলের পর একইভাবে তার গুরু জিয়াকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা চিরতরে মুছে ফেলার কাজ সম্পন্ন করেন এইচএম এরশাদ।

তবে জিয়া হত্যার জন্য এরশাদগং মঞ্জুরকে দায়ী করলেও মঞ্জুর নাকি ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। চার দশক পরেও জিয়া হত্যাকে কেন্দ্র করে ১৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে ফাঁসি দেয়ার গোপন বিচারটি যদি উচ্চ আদালতে পুনঃবিচার করা হতো তাহলে বহু ঐতিহাসিক তথ্য ও অজানা ষড়যন্ত্রের কথা জানা যেত। শোনা যায়, জে. মঞ্জুর খুবই ঘৃণার চোখে দেখতেন এরশাদকে। মঞ্জুর সেনাপ্রধানের নামটিও উচ্চারণ করতেন না। তাকে বলতেন ‘থিফ’।

জিয়া হত্যা অপারেশনে নেতৃত্ব দেয় লে. কর্নেল মতিউর রহমান। প্রকৃতপক্ষে দুই লে. কর্নেল মতিউর এবং মাহবুবই ছিল জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দু’জনই বেঁচে নেই। জানা যায়, জিয়া হত্যার ২ দিন পর ৩১ মে রাতে সেনানিবাস থেকে অন্যত্র যাওয়ার পথে সরকারি সৈন্যদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হয়। এ সময় মতিউর চেঁচিয়ে বলে, ‘শুট মি মাহবুব শুট মি।’ দু’জনের স্টেনগান থেকেই গুলি বের হয় এবং চিরতরে শেষ হয়ে যায় ওই দু’জন। এ দু’জনই ভালোভাবে বলতে পারত জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল কথা। জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রে এ দুই হোতা মতি-মাহবুবের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।

কোনো কোনো সূত্র মতে, জে. এরশাদের সঙ্গে মতি-মাহবুবের গভীর সখ্য ছিল। তারা দু’জন জে. এরশাদের চর হিসেবে তার নির্দেশেই জে. জিয়াকে হত্যা করে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এদিকে জে. জিয়াকে হত্যার সময় যেসব সেনা সদস্য সার্কিট হাউসে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই জানত না যে, রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হবে। পাকিস্তানে বসবাসকারী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে জিয়া হত্যার ঘটনাবলী রয়েছে। ঘাতক দলের নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল মতিউর রহমান। গ্রন্থে বলা হয়, ১৬ জন অফিসারকে নিয়ে একটি পিকআপে উঠে মতি। মতি সঙ্গীদের বলে, ‘আমরা আজ প্রেসিডেন্টকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।’ ঘাতক বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়। ৯ নম্বর কক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর আঘাত হানার দায়িত্ব দেয়া হয় লে. কর্নেল ফজলে হোসেনকে। মতি নিজে থাকল দ্বিতীয় দলে।

বৃষ্টির মধ্যে কালুরঘাট থেকে রাত সাড়ে ৩টার দিকে রওনা হওয়ার পর লে. রফিক প্রথম দলের পিকআপে বসে ফজলেকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি প্রেসিডেন্টকে খুন করতে যাচ্ছেন?’ কর্নেল ফজলে জানান, ‘না, আমরা শুধুই তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।’ এ নির্দোষ তরুণ যুবক রফিককেও হত্যা করা হয়। রফিক মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৪ সদস্যের পেছনের দলে কর্নেল মতিসহ অন্যরা ৯ নম্বর কক্ষ খুঁজতে থাকে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে দরজা ভেঙে ওই কক্ষে ড. আমিনা রহমানকে দেখতে পায়। এই হুড়োহুড়ির মধ্যে ৪ নম্বর কক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়া বের হয়ে আসেন। সাদা পায়জামা পরা উস্কোখুস্কো চুলে রাষ্ট্রপতি তার হাত দুটি সামনের দিকে সামান্য উঁচিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- ‘তোমরা কি চাও?’ রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে কাছে ছিল মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন। মোজাফফর দৃশ্যত ভয়ে কাঁপছিল। মোসলেহ উদ্দিন রাষ্ট্রপতিকে আশ্বস্ত করে বলছিল- ‘স্যার আপনি ঘাবড়াবেন না। এখানে ভয়ের কিছু নেই।’ ওই দু’জন অফিসার তখন বিশ্বাস করছিল, তারা রাষ্ট্রপতিকে উঠিয়ে নিতেই এসেছে, হত্যা করতে নয়। মতি কাছেই ছিল। রাষ্ট্রপতির প্রতি তার বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া ছিল না।

রাষ্ট্রপতির প্রতি মোসলেহ উদ্দিনের আশ্বাসের বাণী মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘাতক মতি তার এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে দেয়। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে জিয়ার শরীর একেবারে ঝাঁজরা করে ফেলে। দরজার কাছেই মেঝেতে রাষ্ট্রপতি লুটিয়ে পড়েন। মতি বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উল্টিয়ে নেয়। এরপর জিয়ার মুখমণ্ডল আর বুকের ওপর মতি এসএমজির ট্রিগার টিপে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মিটিয়ে নেয়। জিপে চড়ে সেনানিবাসের দিকে যাওয়ার পথে মেজর মোজাফফর ক্ষোভ-দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমি জানতাম না, আমরা রাষ্ট্রপতিকে খুন করতে যাচ্ছি।’ জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম গুলি থেমে গেলে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, ‘আমি দরজার কাছে রাষ্ট্রপতির প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখি। গুলির আঘাতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার একটা চোখ সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। ঘাড়ের মাংসগুলো কোথাও যেন উড়ে চলে গেছে। তার বুকে, পেটে আর গায়ে অগণিত গুলির চিহ্ন ফুটে রয়েছে।’

তবে চরম দুঃখজনক ও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, দুই টার্মে খালেদা জিয়া ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও স্বামী হত্যার বিচার করেননি। অবশেষে স্বামী হত্যার ৩৩ বছর পর খুনি এরশাদের বিচারের কথা উচ্চারণ করেন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৪ মে ঢাকায় প্রেসক্লাবে দলের গণঅনশন কর্মসূচিতে বক্তৃতাকালে খালেদা জিয়া আকস্মিকভাবে জিয়া-মঞ্জুর ত্যার জন্য এরশাদকে সরাসরি দায়ী করে বলেন- ‘মঞ্জুর ও জিয়াউর রহমানের খুনি এরশাদ। খুনি এরশাদের বিচার করতে হবে। তার বিচার করা হবে।’ খালেদার অভিযোগের ৫ দিন পর ১০ মে এরশাদ দলীয় অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জিয়া হত্যা নিয়ে ব্লেম গেম চলছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেন, আমি খুনি। আমি খুনি নই। আমি জানি জিয়ার খুনি কে।’ এরশাদ তার বক্তব্যে জিয়া হত্যার জন্য বি. চৌধুরীকে দায়ী করেন। এরশাদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন বি. চৌধুরী। এরশাদকে জিয়া হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘এরশাদ একজন কম্পালসিভ লায়ার’ (সহজাত/ স্বভাবজাত মিথ্যাবাদী)। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলজের লেখা উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যাকান্ডের বিবরণীতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মঞ্জুরকে যারা হত্যা করেছে, সেই চক্রে প্রথম নাম জে. এরশাদ। একটি মাত্র কারণেই জে. মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণটি হচ্ছে মঞ্জুর বেঁচে থাকলে জিয়া হত্যাকান্ডের সঙ্গে এরশাদের সংশ্লিষ্টতা নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে যেত।’

বিএনপি আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার ‘রণ থেকে জন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জে. মঞ্জুর পালাতে চাননি। তাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। জিয়া হত্যার নেপথ্য রহস্য উদ্ঘাটনে বাধা প্রদানই ছিল এ হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য।’ জিয়া হত্যা মামলার আসামিদের সাক্ষ্য ও বর্ণনা উল্লেখ করে গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্টকে হত্যাসংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা দু-একজন ছাড়া চট্টগ্রাম বিদ্রোহের লোকজনদের কারোই জানা ছিল না। সব মিলিয়ে অনুমিত হয়, মঞ্জুর শেষ পর্যন্ত ঘটনার শিকার হয়েছেন।’

ধরা পড়ার পর সেনানিবাসে আসার পথে জে. মঞ্জুর বুঝতে পেরেছিলেন কি হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে সেনানিবাসের ফায়ারিং রেঞ্জে ঢুকে জিপ থেকে নামানো হলো জেনারেলকে। শেষ কথাগুলো ক্যাপ্টেন এমদাদ ও জওয়ানদের মঞ্জুর বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বলবেন আমাকে মাফ করে দিতে। তার জন্য, সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না।’ মেজর এমদাদ ও জওয়ানরা ক্ষমা চাইলেন জেনারেলের কাছে। দোয়া-দরুদ পড়লেন সবাই। হাবিলদার আবদুল মালেক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে মঞ্জুরের মাথায় একটা মাত্র গুলি করে। ১ জুন দিবাগত রাত ১২টা বাজতে তখনও কয়েক মিনিট বাকি। (পৃ. ২১২)।

ফাঁসিতে নিহত ব্রিগেডিয়ার মোহসীন ও কর্নেল মাহফুজ দু’জনই জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ী করেছে। (পৃষ্ঠা ১৫৪) খালেদা জিয়া কি কারণে তার স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার করেননি, আওয়ামী লীগ সরকার বিচারটি করলে হয়তো কারণটি বের হয়ে আসত। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রে জিয়া যেমনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, জিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে এরশাদ তার চেয়ে বেশি জড়িত। জে. মঞ্জুর স্ত্রী-সন্তান ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ও একজন ঘাতক সর্দারকে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানি বীর উত্তম জেনারেল মঞ্জুর হত্যার বিচার না করার দায়ভার কাউকে না কাউকে তো গ্রহণ করতেই হবে।

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক ]

bandhu.ch77@yahoo.com

দৈনিক সংবাদ : ২৮ মে ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

পলিথিনের পাপ, প্রকৃতির প্রতিশোধ

হারিয়ে যাওয়া অভিযোগকৃত চেকের মামলা

জার্মানীতে এসবি ৬২ সম্মেলন : বাংলাদেশের নজর অর্থায়নের ন্যায্যতায়

ছবি

শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আদিবাসী মুণ্ডা ভাষার বাঁচার আর্তনাদ

মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা : এক হারানো সম্ভাবনার খোঁজে

বিশ্ব রেড ক্রস দিবস

আত্মরক্ষার খালি-হাতের ইতিহাস ও আধুনিক বিস্তার

বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর : সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ

ছবি

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস “বিজয় বসন্ত“গ্রন্থের লেখক

পয়লা বৈশাখ : বাঙালির সংহতি চেতনার সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কমরেড রূপনারায়ণ রায়

সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা

রেসলিং

কোটা সমাচার

বাজেট ২০২৪-২৫: তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা শুরু হোক এবার

সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: উন্নত ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়

ছবি

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

tab

মুক্ত আলোচনা

জিয়া-মঞ্জুর হত্যা এবং এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল

মোহাম্মদ শাহজাহান

মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০১৯

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’ অর্থাৎ একেবারে না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়াটা ভালো। বিলম্বে হলেও বিচার না হওয়ার বদনাম থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার বিচার শুরু হয় ২৩ বছর পর। ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে মুজিব হত্যার দায়ে জীবিত ১১ খুনির মধ্যে ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশকের বেশি সময় পর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক আদালতের রায় ১৪ বছর পর ঘোষিত হয়েছে। গত ৩৮ বছরে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার বিচার হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে শনিবার ভোরে জিয়া হত্যার ২ দিন পর ১ জুন সোমবার দিবাগত মধ্যরাতে উপর মহলের নির্দেশে ঠান্ডা মাথায় একটিমাত্র বুলেটে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। তবে জিয়া হত্যার পর বিদ্রোহের দায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রহসনের গোপন বিচারে ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে এরশাদ। মঞ্জুর হত্যার ১৯ বছর পর মঞ্জুর হত্যার বিচার চেয়ে তার ছোট ভাই মামলা করেন। বিচার কাজ সম্পন্ন হলেও শুধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারীকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মঞ্জুর হত্যার রায় দেয়া হচ্ছে না। যদি শেষ পর্যন্ত ঘাতক সর্দারের জীবিতাবস্থায় মঞ্জুর হত্যা মামলার রায় না হয়, ইতিহাস একদিন বলবে- একজন ভন্ড, প্রতারক, পাকিস্তানের চর ও খুনিকে বাঁচানোর জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল এমএ মঞ্জুর বীর উত্তমের বিচারের রায় দেয়া হয়নি।

আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন জেনারেল জিয়া। স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এ দেশীয় চর জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা। বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলজ বলেছেন, ‘তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া মদদ না দিলে ফারুক-রশীদরা কোনোদিনই শেখ মুজিবকে হত্যার সাহস পেত না।’ জিয়া-মঞ্জুর হত্যার সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি হচ্ছেন এরশাদ। গত ৩৮ বছরে জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকান্ড নিয়ে বই প্রকাশসহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। এটা প্রায় শতভাগ প্রমাণিত সত্য যে, জিয়া-মঞ্জুর হত্যার মূল হোতা হচ্ছে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ। জিয়া ছাড়া যেমন বঙ্গবন্ধু মুজিব হত্যা হতো না, তেমনি এরশাদ ছাড়া জিয়া হত্যা হতো না। মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষী তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধানের সাক্ষ্য, তৎকালীন আইজিপির বক্তব্য, বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলজের ধারাবাহিক নিবন্ধ, মঞ্জুর হত্যা মামলার এজাহার ও চার্জশিট এবং মেজর আরেফিনের লেখা ‘জিয়া-মঞ্জুর হত্যা ও তারপর’ গ্রন্থের সারসংক্ষেপ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের চর তৎকালীন সেনাপ্রধানের নির্দেশেই সুপরিকল্পিতভাবে আটক মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে। জিয়া হত্যার পর মঞ্জুর জীবিত থাকলে জিয়া হত্যাকারীর মুখোশ যেমন উন্মেচিত হতো, তেমনি এরশাদও রাষ্ট্রপতির গদি দখল করতে পারত না। জিয়া-মঞ্জুর হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। যেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরাই জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল।

জিয়া হত্যার সময় বিমানবাহিনী প্রধান ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দিন। সদরউদ্দিন সাহেব মঞ্জুর হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেয়ার সময় বলেছেন, ১৯৮১ সালের ১ জুন বিকেলে আমি বঙ্গভবনে ছিলাম। এ সময় ফোনে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, মঞ্জুর ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির লাল টেলিফোনে এরশাদ কোন একজনকে বলেন, ‘পুলিশের কাছে মঞ্জুর ধরা পড়েছে। তাকে দ্রুততার সঙ্গে নিয়ে এসে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করো।’ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উত্তেজিত সেনাপ্রধান বলেন, ‘এয়ার চিফ আপনি কিছুই বোঝেন না?’ সদরউদ্দিনের কথার প্রমাণ রয়েছে মেজর আরেফিনের লেখা তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থে। আরেফিন লিখেছেন, ‘ওই রাতে ঢাকার নির্দেশেই সুপরিকল্পিতভাবে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামের তৎকালীন সিও ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম আরেক ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) লতিফের সামনে ক্যাপ্টেন এমদাদকে নির্দেশ দেন যে, হাটহাজারী থেকে সেনানিবাসে যাওয়ার সময় মঞ্জুরকে হত্যা করতে হবে।’

জিয়া হত্যার পর ঠান্ডা মাথার খুনি এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেননি। হত্যার পরপর এরশাদ ক্ষমতা নিলে দেশ-বিদেশের সবাই বলত এরশাদই খুনি। যেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আসল খুনি জিয়াকে রাষ্ট্রপতি করা হয়নি। জিয়া হত্যার পর ওই সময় বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থাকলেও ক্ষমতার দন্ড ছিল সেনাপ্রধান এরশাদের হাতে। রাষ্ট্রপতি হত্যার পর ধুরন্ধর এরশাদ তার ক্ষমতা দখলের পথে বাধাগুলো অপসারণ করেন। সেই লক্ষ্যে প্রথমে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। এর পর জিয়া হত্যার সময় বিদ্রোহের অভিযোগে সাজানো ও ভুয়া বিচারে ১৩ জনকে ফাঁসি, ৭ জনকে যাবজ্জীবন ও ৬ জনকে ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফাঁসি দেয়া ১৩ জনের মধ্যে অন্তত ১০-১১ জন জিয়া হত্যার বিষয়ে কিছুই জানত না। এরপর পাকিস্তানপন্থি সেনাকর্মকর্তাদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। জিয়া হত্যার ১০ মাস পর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ক্ষমতা দখলের পর একইভাবে তার গুরু জিয়াকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন এবং বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা চিরতরে মুছে ফেলার কাজ সম্পন্ন করেন এইচএম এরশাদ।

তবে জিয়া হত্যার জন্য এরশাদগং মঞ্জুরকে দায়ী করলেও মঞ্জুর নাকি ওই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। চার দশক পরেও জিয়া হত্যাকে কেন্দ্র করে ১৩ জন সেনাকর্মকর্তাকে ফাঁসি দেয়ার গোপন বিচারটি যদি উচ্চ আদালতে পুনঃবিচার করা হতো তাহলে বহু ঐতিহাসিক তথ্য ও অজানা ষড়যন্ত্রের কথা জানা যেত। শোনা যায়, জে. মঞ্জুর খুবই ঘৃণার চোখে দেখতেন এরশাদকে। মঞ্জুর সেনাপ্রধানের নামটিও উচ্চারণ করতেন না। তাকে বলতেন ‘থিফ’।

জিয়া হত্যা অপারেশনে নেতৃত্ব দেয় লে. কর্নেল মতিউর রহমান। প্রকৃতপক্ষে দুই লে. কর্নেল মতিউর এবং মাহবুবই ছিল জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দু’জনই বেঁচে নেই। জানা যায়, জিয়া হত্যার ২ দিন পর ৩১ মে রাতে সেনানিবাস থেকে অন্যত্র যাওয়ার পথে সরকারি সৈন্যদের দ্বারা তারা আক্রান্ত হয়। এ সময় মতিউর চেঁচিয়ে বলে, ‘শুট মি মাহবুব শুট মি।’ দু’জনের স্টেনগান থেকেই গুলি বের হয় এবং চিরতরে শেষ হয়ে যায় ওই দু’জন। এ দু’জনই ভালোভাবে বলতে পারত জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের মূল কথা। জিয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রে এ দুই হোতা মতি-মাহবুবের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।

কোনো কোনো সূত্র মতে, জে. এরশাদের সঙ্গে মতি-মাহবুবের গভীর সখ্য ছিল। তারা দু’জন জে. এরশাদের চর হিসেবে তার নির্দেশেই জে. জিয়াকে হত্যা করে থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এদিকে জে. জিয়াকে হত্যার সময় যেসব সেনা সদস্য সার্কিট হাউসে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই জানত না যে, রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হবে। পাকিস্তানে বসবাসকারী সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে জিয়া হত্যার ঘটনাবলী রয়েছে। ঘাতক দলের নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল মতিউর রহমান। গ্রন্থে বলা হয়, ১৬ জন অফিসারকে নিয়ে একটি পিকআপে উঠে মতি। মতি সঙ্গীদের বলে, ‘আমরা আজ প্রেসিডেন্টকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।’ ঘাতক বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়। ৯ নম্বর কক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর আঘাত হানার দায়িত্ব দেয়া হয় লে. কর্নেল ফজলে হোসেনকে। মতি নিজে থাকল দ্বিতীয় দলে।

বৃষ্টির মধ্যে কালুরঘাট থেকে রাত সাড়ে ৩টার দিকে রওনা হওয়ার পর লে. রফিক প্রথম দলের পিকআপে বসে ফজলেকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা কি প্রেসিডেন্টকে খুন করতে যাচ্ছেন?’ কর্নেল ফজলে জানান, ‘না, আমরা শুধুই তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।’ এ নির্দোষ তরুণ যুবক রফিককেও হত্যা করা হয়। রফিক মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ৪ সদস্যের পেছনের দলে কর্নেল মতিসহ অন্যরা ৯ নম্বর কক্ষ খুঁজতে থাকে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে দরজা ভেঙে ওই কক্ষে ড. আমিনা রহমানকে দেখতে পায়। এই হুড়োহুড়ির মধ্যে ৪ নম্বর কক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়া বের হয়ে আসেন। সাদা পায়জামা পরা উস্কোখুস্কো চুলে রাষ্ট্রপতি তার হাত দুটি সামনের দিকে সামান্য উঁচিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- ‘তোমরা কি চাও?’ রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে কাছে ছিল মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন। মোজাফফর দৃশ্যত ভয়ে কাঁপছিল। মোসলেহ উদ্দিন রাষ্ট্রপতিকে আশ্বস্ত করে বলছিল- ‘স্যার আপনি ঘাবড়াবেন না। এখানে ভয়ের কিছু নেই।’ ওই দু’জন অফিসার তখন বিশ্বাস করছিল, তারা রাষ্ট্রপতিকে উঠিয়ে নিতেই এসেছে, হত্যা করতে নয়। মতি কাছেই ছিল। রাষ্ট্রপতির প্রতি তার বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া ছিল না।

রাষ্ট্রপতির প্রতি মোসলেহ উদ্দিনের আশ্বাসের বাণী মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘাতক মতি তার এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে দেয়। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে জিয়ার শরীর একেবারে ঝাঁজরা করে ফেলে। দরজার কাছেই মেঝেতে রাষ্ট্রপতি লুটিয়ে পড়েন। মতি বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উল্টিয়ে নেয়। এরপর জিয়ার মুখমণ্ডল আর বুকের ওপর মতি এসএমজির ট্রিগার টিপে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মিটিয়ে নেয়। জিপে চড়ে সেনানিবাসের দিকে যাওয়ার পথে মেজর মোজাফফর ক্ষোভ-দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমি জানতাম না, আমরা রাষ্ট্রপতিকে খুন করতে যাচ্ছি।’ জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম গুলি থেমে গেলে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, ‘আমি দরজার কাছে রাষ্ট্রপতির প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখি। গুলির আঘাতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার একটা চোখ সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। ঘাড়ের মাংসগুলো কোথাও যেন উড়ে চলে গেছে। তার বুকে, পেটে আর গায়ে অগণিত গুলির চিহ্ন ফুটে রয়েছে।’

তবে চরম দুঃখজনক ও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, দুই টার্মে খালেদা জিয়া ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও স্বামী হত্যার বিচার করেননি। অবশেষে স্বামী হত্যার ৩৩ বছর পর খুনি এরশাদের বিচারের কথা উচ্চারণ করেন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৪ মে ঢাকায় প্রেসক্লাবে দলের গণঅনশন কর্মসূচিতে বক্তৃতাকালে খালেদা জিয়া আকস্মিকভাবে জিয়া-মঞ্জুর ত্যার জন্য এরশাদকে সরাসরি দায়ী করে বলেন- ‘মঞ্জুর ও জিয়াউর রহমানের খুনি এরশাদ। খুনি এরশাদের বিচার করতে হবে। তার বিচার করা হবে।’ খালেদার অভিযোগের ৫ দিন পর ১০ মে এরশাদ দলীয় অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জিয়া হত্যা নিয়ে ব্লেম গেম চলছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেন, আমি খুনি। আমি খুনি নই। আমি জানি জিয়ার খুনি কে।’ এরশাদ তার বক্তব্যে জিয়া হত্যার জন্য বি. চৌধুরীকে দায়ী করেন। এরশাদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন বি. চৌধুরী। এরশাদকে জিয়া হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘এরশাদ একজন কম্পালসিভ লায়ার’ (সহজাত/ স্বভাবজাত মিথ্যাবাদী)। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে বিদেশি সাংবাদিক লিফশুলজের লেখা উল্লেখ করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যাকান্ডের বিবরণীতে স্পষ্ট বোঝা যায়, মঞ্জুরকে যারা হত্যা করেছে, সেই চক্রে প্রথম নাম জে. এরশাদ। একটি মাত্র কারণেই জে. মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণটি হচ্ছে মঞ্জুর বেঁচে থাকলে জিয়া হত্যাকান্ডের সঙ্গে এরশাদের সংশ্লিষ্টতা নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে যেত।’

বিএনপি আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার ‘রণ থেকে জন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জে. মঞ্জুর পালাতে চাননি। তাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। জিয়া হত্যার নেপথ্য রহস্য উদ্ঘাটনে বাধা প্রদানই ছিল এ হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য।’ জিয়া হত্যা মামলার আসামিদের সাক্ষ্য ও বর্ণনা উল্লেখ করে গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্টকে হত্যাসংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা দু-একজন ছাড়া চট্টগ্রাম বিদ্রোহের লোকজনদের কারোই জানা ছিল না। সব মিলিয়ে অনুমিত হয়, মঞ্জুর শেষ পর্যন্ত ঘটনার শিকার হয়েছেন।’

ধরা পড়ার পর সেনানিবাসে আসার পথে জে. মঞ্জুর বুঝতে পেরেছিলেন কি হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে সেনানিবাসের ফায়ারিং রেঞ্জে ঢুকে জিপ থেকে নামানো হলো জেনারেলকে। শেষ কথাগুলো ক্যাপ্টেন এমদাদ ও জওয়ানদের মঞ্জুর বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বলবেন আমাকে মাফ করে দিতে। তার জন্য, সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না।’ মেজর এমদাদ ও জওয়ানরা ক্ষমা চাইলেন জেনারেলের কাছে। দোয়া-দরুদ পড়লেন সবাই। হাবিলদার আবদুল মালেক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে মঞ্জুরের মাথায় একটা মাত্র গুলি করে। ১ জুন দিবাগত রাত ১২টা বাজতে তখনও কয়েক মিনিট বাকি। (পৃ. ২১২)।

ফাঁসিতে নিহত ব্রিগেডিয়ার মোহসীন ও কর্নেল মাহফুজ দু’জনই জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ী করেছে। (পৃষ্ঠা ১৫৪) খালেদা জিয়া কি কারণে তার স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার করেননি, আওয়ামী লীগ সরকার বিচারটি করলে হয়তো কারণটি বের হয়ে আসত। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রে জিয়া যেমনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, জিয়া হত্যা ষড়যন্ত্রে এরশাদ তার চেয়ে বেশি জড়িত। জে. মঞ্জুর স্ত্রী-সন্তান ও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ও একজন ঘাতক সর্দারকে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানি বীর উত্তম জেনারেল মঞ্জুর হত্যার বিচার না করার দায়ভার কাউকে না কাউকে তো গ্রহণ করতেই হবে।

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক ]

bandhu.ch77@yahoo.com

দৈনিক সংবাদ : ২৮ মে ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

back to top