খন্দকার মুনতাসীর মামুন
দেশে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ দিন দিন কমছে। সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারি, জবাবদিহি ও আন্তরিকতার অভাব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশেষ বিশেষ দিবস পালন ও উৎসব উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির কদর তো বাড়ছেই, তার ওপর পরীক্ষা আর মুখস্থ বিদ্যার চাপে স্কুল থেকে সংস্কৃতিচর্চা একেবারেই নির্বাসিত হয়ে পড়েছে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রের চাপ সামলাতে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা, ডিগ্রি আর সনদের মধ্যে আটকে গেছে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যে শরীর-মনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যেসব খোরাক-রসদ দরকার, তার কিছুই দিতে পারে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার কারণে তাদের মধ্যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, নিজেকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারার ও অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের অক্ষমতা, বিচারহীনতা তৈরি হচ্ছে। তার ওপর রাজধানীর খোলা জায়গা এবং খেলার মাঠগুলো চলে গেছে ভূমিদস্যু ও দখলবাজদের দখলে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা না থাকা এবং খেলাধুলার সুযোগ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তরুণরা সামাজিক-সম্প্রীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে তাদের চিন্তাভাবনা। ফলে তরুণরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভুল শিক্ষা নিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এরই চরম পরিণতি হিসেবে গুলশান-কিশোরগঞ্জে জঙ্গি হামলায় মানুষ হত্যার ঘটনা দেখতে হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, যারা জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদে জড়িত, তারা পরিবার, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন। ধর্মের নামে তাদের এমন উগ্রতায় দীক্ষিত করা হচ্ছে যে, তারা নিষ্ঠুরভাবে মানুষ হত্যা করছে। মাত্র অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণে তারা কী করে এভাবে অমানুষ হতে পারে, এটা ভাবার বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনা করে রাজনীতি। আর এর পেছনে থাকে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো রাষ্ট্র ও জাতির অসাধারণ সম্পদ। এর চর্চা না হলে ছেলেমেয়েরা বিপথগামী হবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অবস্থায় সরকার কী করতে পারে? সংস্কৃতি কোন আরোপিত বিষয় নয়। ভাষা ও সংস্কৃতি সব সময় গতিশীল, তাই এর রূপান্তর, পরিবর্তন, উত্তরণ ঘটবেই এবং তাতে গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকবেই। সরকারের কাছে কাম্য হলো সুস্থ সংস্কৃতির ধারা বহমান রাখা এবং তার অনুকূলে ভূমিকা পালন। সুস্থ প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত হবে সমাজকে আরও জায়গা দেয়া, সৃষ্টিশীল মানুষদের স্বাধীনতার পরিসর বাড়তে দেয়া এবং শিক্ষাকে স্বদেশ ও সংস্কৃতি চর্চার সমন্বয়ে প্রাণবন্ত মানবিক ও গভীরতায় সমৃদ্ধ হতে দেয়া।
সংস্কৃতি নিরন্তর পরিবর্তনশীল একটি প্রবাহ। ক্রমাগত গ্রহণ এবং বর্জনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি-প্রবাহ নিত্য বহমান। সাধারণভাবে সংস্কৃতি হলো বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য এবং জ্ঞান। যার মধ্যে ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার, সঙ্গীত এবং শিল্পকলা এ বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি একই সাথে স্থানিক এবং বৈশ্বিক। এজন্য বাঙালির সংস্কৃতি বিশ্ব সংস্কৃতির একটি অংশ। একই সময় মনে রাখতে হবে বাঙালির সংস্কৃতিও কিন্তু এক রৈখিক নয়। বাংলা ভূ-খন্ডে বসবাসরত বাঙালি এবং বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি মিথষ্ক্রিয়ায় বাঙালির সংস্কৃতি-প্রবাহ তৈরি হয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় বাঙালির জাতি গঠন প্রক্রিয়া যেমন পূর্ণতা পেয়েছে তেমনি বাঙালির সংস্কৃতিও দৃঢ়ভিত্তির ওপর ঘনবদ্ধ হয়েছে।
প্রতিটি সময়কালে সংস্কৃতির মূলধারার একটি প্রতিপক্ষ থাকে। এ প্রতিপক্ষ কায়েমি স্বার্থের ধারক। এরা সংস্কৃতির প্রধান ধারা জনসংস্কৃতিকে নিজ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি মুসলিম মানস উদার এবং অসাম্প্রদায়িক। তবে রাজনৈতিক ধর্মবাদীদের প্রভাবে বাঙালি মুসলমানদের একাংশে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। ধর্মাশ্রয়ী কুপমন্ডুকতা বাড়ছে। চতুর স্বার্থবাদীরা ধর্মকে তাদের পক্ষে ব্যবহার করছে।
আগে পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার থাকত। খেলার মাঠ থাকত। পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, যাত্রাগান-পালাগান, গ্রামাঞ্চলে পুঁথিপাঠের আসর বসত। মানুষ রাত জেগে যাত্রা দেখত, সেখান থেকে মানবিক হয়ে ওঠার শিক্ষা পেত। এখন যাত্রা করতে দেয়া হয় না। সর্বজনীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করে দেয়া হয় প্রশাসনিক পুলিশি নির্দেশে। সাংস্কৃতিক বোধ এবং সাংস্কৃতিক চর্চা শক্তিশালী হবে কিভাবে। শক্তিশালী সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চর্চাই সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় রাজনীতির মতো অপশক্তিগুলোকে রুখে দিতে পারে। এ দেশেই সেটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সেই সংস্কৃতির চর্চাকেই এখন নিয়ন্ত্রণ করে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছে। আগে সাংস্কৃতিক কিছু কর্মকা- সবাইকে আন্দোলিত করত। কিন্তু এখন সেগুলো হারিয়ে গেছে। সংস্কৃতি স্বাভাবিক প্রবহমানতা রুদ্ধ করে সংস্কৃতিতে ‘ফরমায়েশি এবং প্রাতিষ্ঠানিক’ অচলায়তনে পরিণত করা হচ্ছে। অল্প পরিসরে যেটা আছে, তা কোন আবেদন রাখতে পারছে না। তারা যে ধরনের রুচি গড়ে তুলেছে, তাতে তাদের বাঙালি সাংস্কৃতির যে মূলধারা, তা তাদের কোনও আকর্ষণ করে না।
আগে গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। একই গ্রামে কামার, কুমার, জেলে, নাপিত, তাঁতির বসবাস ছিল পাশাপাশি। একে অন্যের পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় বিরোধহীন বয়ে যেত শান্তির সুবাতাস। গ্রামের এপারে মসজিদ, মাঝখানে মন্দির। একই নদীতে ‘ঠাকুর ঘাট’-এর বউ-ঝিরা ‘শেখের ঘাট’-এ ডুব দিয়ে পবিত্র হতো আবার হাজিপাড়ার ছেলেমেয়েরা বেনেপুকুরে নেমে ‘কাদাখেড়’ (পূজার সময় উঠানে পানি ঢেলে বাড়তি কাদা এনে তার ওপর নাচানাচি করা) করত। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সব ঘরের বিবাহিত মেয়েরা নাইওরের সময় বলতে বুঝত দুর্গাপূজার দিনগুলো। কোরবানি ঈদকে বলা হতো বকরি ঈদ। যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মবোধ অসম্মানিত না হয়। মুসলমান বউটি পাশের বাড়ির সিঁদুর পরা বউটির কাছে কুমড়োর বড়ি বানানো শিখত আবার হিন্দু বউটি সেমাই রাঁধতে গিয়ে গলিয়ে ফেলে হেসে কুটিকুটি হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসত; যা বলছি এসব নিতান্তই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু নিজেকে সমৃদ্ধ করার এ শিক্ষা বৃহত্তর আঙ্গিকেও প্রভাব বিস্তার করে। এর থেকে লাভটা যা, তা ছিল সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার উন্মেষ। একদিন এদেশে রোগ-শোক, অভাব-অনটন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও সামাজিক সম্প্রীতি ছিল, এক হয়ে বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। কিন্তু এখন নেই কেন? আজকের সমাজে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি থেকেও যে পৃথক-তার দায় কার? দূষিত রাজনীতি, মুক্তচিন্তার পথে প্রতিবন্ধকতা, গণতন্ত্রহীনতা, ক্ষমতার দম্ভ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, কালো টাকার বাহাদুরি, শোষণ-বঞ্চনার পাহাড় মানুষের সুস্থ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের ষড়যন্ত্র।
সম্প্রীতি একজনে হয় না, হয় জনে জনে। কোনো সমাজ বিচ্ছিন্ন একক মানুষের সম্প্রীতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পরিবারে কিংবা সমাজে বসবাস করতে গেলে সম্প্রীতি ছাড়া চলে না। মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সংযোগ ছাড়া সম্প্রীতি গড়ে ওঠে না। ভোগবাদী সমাজে স্বার্থপরতা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। আমরা নিজেকে ছাড়া এখন আর কিছুই বুঝি না। আত্মীয়-স্বজন, এমনকি বয়স্ক মা-বাবার ক্ষেত্রেই যেখানে কারও কারও সীমাহীন উদাসীনতা, তখন অন্য মানুষের কাছাকাছি হওয়ার সময়-সুযোগ হয় কী করে! একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, মাড়িয়ে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখন সর্বত্র। মানুষ যদি জীবনাচরণের মৌলিক গুণাবলীর পার্থক্য নির্ণয় করতে না পারে, তাহলে সেই খন্ডিত বোধ তীব্রভাবে আঘাত করে সংস্কৃতিকে। যদি পার্থক্য নির্ণয় করা না যায় ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার, সাহস ও সন্ত্রাসের, শক্তি ও ক্ষমতার, বিনয় ও দম্ভের, সত্য ও মিথ্যার- তাহলে মূল্যবোধের ভিত নড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা তৈরি হয়।
সব অপশক্তিকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হলো সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা। সংস্কৃতি মানুষকে হতাশা থেকে বাঁচায়। সংস্কৃতি যত ছড়াবে মানুষের মন তত আলোকিত হবে। সমাজের অভ্যন্তরে সাংস্কৃতিক জাগরণের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে বাংলার উদার মানবিক ধারার সংস্কৃতিচর্চার পথ খুলে তা বেগবান করতে হবে, পরস্পরের সঙ্গে ভাবনা-বিনিময় বাড়াতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে ধর্মান্ধ বা জঙ্গি সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়। ধ্বংস নয়, মানুষকে ভালোবাসাই যে পরম ধর্ম- এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে সবার অন্তরে।
suva.muntasir@gmail.com
দৈনিক সংবাদ : রোববার, ৭ জুলাই ২০১৯, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত
খন্দকার মুনতাসীর মামুন
রোববার, ০৭ জুলাই ২০১৯
দেশে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ দিন দিন কমছে। সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারি, জবাবদিহি ও আন্তরিকতার অভাব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশেষ বিশেষ দিবস পালন ও উৎসব উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির কদর তো বাড়ছেই, তার ওপর পরীক্ষা আর মুখস্থ বিদ্যার চাপে স্কুল থেকে সংস্কৃতিচর্চা একেবারেই নির্বাসিত হয়ে পড়েছে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রের চাপ সামলাতে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা, ডিগ্রি আর সনদের মধ্যে আটকে গেছে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যে শরীর-মনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য যেসব খোরাক-রসদ দরকার, তার কিছুই দিতে পারে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার কারণে তাদের মধ্যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, নিজেকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারার ও অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের অক্ষমতা, বিচারহীনতা তৈরি হচ্ছে। তার ওপর রাজধানীর খোলা জায়গা এবং খেলার মাঠগুলো চলে গেছে ভূমিদস্যু ও দখলবাজদের দখলে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা না থাকা এবং খেলাধুলার সুযোগ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তরুণরা সামাজিক-সম্প্রীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে তাদের চিন্তাভাবনা। ফলে তরুণরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভুল শিক্ষা নিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এরই চরম পরিণতি হিসেবে গুলশান-কিশোরগঞ্জে জঙ্গি হামলায় মানুষ হত্যার ঘটনা দেখতে হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, যারা জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদে জড়িত, তারা পরিবার, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন। ধর্মের নামে তাদের এমন উগ্রতায় দীক্ষিত করা হচ্ছে যে, তারা নিষ্ঠুরভাবে মানুষ হত্যা করছে। মাত্র অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণে তারা কী করে এভাবে অমানুষ হতে পারে, এটা ভাবার বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনা করে রাজনীতি। আর এর পেছনে থাকে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো রাষ্ট্র ও জাতির অসাধারণ সম্পদ। এর চর্চা না হলে ছেলেমেয়েরা বিপথগামী হবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অবস্থায় সরকার কী করতে পারে? সংস্কৃতি কোন আরোপিত বিষয় নয়। ভাষা ও সংস্কৃতি সব সময় গতিশীল, তাই এর রূপান্তর, পরিবর্তন, উত্তরণ ঘটবেই এবং তাতে গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকবেই। সরকারের কাছে কাম্য হলো সুস্থ সংস্কৃতির ধারা বহমান রাখা এবং তার অনুকূলে ভূমিকা পালন। সুস্থ প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত হবে সমাজকে আরও জায়গা দেয়া, সৃষ্টিশীল মানুষদের স্বাধীনতার পরিসর বাড়তে দেয়া এবং শিক্ষাকে স্বদেশ ও সংস্কৃতি চর্চার সমন্বয়ে প্রাণবন্ত মানবিক ও গভীরতায় সমৃদ্ধ হতে দেয়া।
সংস্কৃতি নিরন্তর পরিবর্তনশীল একটি প্রবাহ। ক্রমাগত গ্রহণ এবং বর্জনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি-প্রবাহ নিত্য বহমান। সাধারণভাবে সংস্কৃতি হলো বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য এবং জ্ঞান। যার মধ্যে ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার, সঙ্গীত এবং শিল্পকলা এ বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি একই সাথে স্থানিক এবং বৈশ্বিক। এজন্য বাঙালির সংস্কৃতি বিশ্ব সংস্কৃতির একটি অংশ। একই সময় মনে রাখতে হবে বাঙালির সংস্কৃতিও কিন্তু এক রৈখিক নয়। বাংলা ভূ-খন্ডে বসবাসরত বাঙালি এবং বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি মিথষ্ক্রিয়ায় বাঙালির সংস্কৃতি-প্রবাহ তৈরি হয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় বাঙালির জাতি গঠন প্রক্রিয়া যেমন পূর্ণতা পেয়েছে তেমনি বাঙালির সংস্কৃতিও দৃঢ়ভিত্তির ওপর ঘনবদ্ধ হয়েছে।
প্রতিটি সময়কালে সংস্কৃতির মূলধারার একটি প্রতিপক্ষ থাকে। এ প্রতিপক্ষ কায়েমি স্বার্থের ধারক। এরা সংস্কৃতির প্রধান ধারা জনসংস্কৃতিকে নিজ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি মুসলিম মানস উদার এবং অসাম্প্রদায়িক। তবে রাজনৈতিক ধর্মবাদীদের প্রভাবে বাঙালি মুসলমানদের একাংশে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। ধর্মাশ্রয়ী কুপমন্ডুকতা বাড়ছে। চতুর স্বার্থবাদীরা ধর্মকে তাদের পক্ষে ব্যবহার করছে।
আগে পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার থাকত। খেলার মাঠ থাকত। পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, যাত্রাগান-পালাগান, গ্রামাঞ্চলে পুঁথিপাঠের আসর বসত। মানুষ রাত জেগে যাত্রা দেখত, সেখান থেকে মানবিক হয়ে ওঠার শিক্ষা পেত। এখন যাত্রা করতে দেয়া হয় না। সর্বজনীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করে দেয়া হয় প্রশাসনিক পুলিশি নির্দেশে। সাংস্কৃতিক বোধ এবং সাংস্কৃতিক চর্চা শক্তিশালী হবে কিভাবে। শক্তিশালী সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চর্চাই সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় রাজনীতির মতো অপশক্তিগুলোকে রুখে দিতে পারে। এ দেশেই সেটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সেই সংস্কৃতির চর্চাকেই এখন নিয়ন্ত্রণ করে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছে। আগে সাংস্কৃতিক কিছু কর্মকা- সবাইকে আন্দোলিত করত। কিন্তু এখন সেগুলো হারিয়ে গেছে। সংস্কৃতি স্বাভাবিক প্রবহমানতা রুদ্ধ করে সংস্কৃতিতে ‘ফরমায়েশি এবং প্রাতিষ্ঠানিক’ অচলায়তনে পরিণত করা হচ্ছে। অল্প পরিসরে যেটা আছে, তা কোন আবেদন রাখতে পারছে না। তারা যে ধরনের রুচি গড়ে তুলেছে, তাতে তাদের বাঙালি সাংস্কৃতির যে মূলধারা, তা তাদের কোনও আকর্ষণ করে না।
আগে গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। একই গ্রামে কামার, কুমার, জেলে, নাপিত, তাঁতির বসবাস ছিল পাশাপাশি। একে অন্যের পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় বিরোধহীন বয়ে যেত শান্তির সুবাতাস। গ্রামের এপারে মসজিদ, মাঝখানে মন্দির। একই নদীতে ‘ঠাকুর ঘাট’-এর বউ-ঝিরা ‘শেখের ঘাট’-এ ডুব দিয়ে পবিত্র হতো আবার হাজিপাড়ার ছেলেমেয়েরা বেনেপুকুরে নেমে ‘কাদাখেড়’ (পূজার সময় উঠানে পানি ঢেলে বাড়তি কাদা এনে তার ওপর নাচানাচি করা) করত। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সব ঘরের বিবাহিত মেয়েরা নাইওরের সময় বলতে বুঝত দুর্গাপূজার দিনগুলো। কোরবানি ঈদকে বলা হতো বকরি ঈদ। যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মবোধ অসম্মানিত না হয়। মুসলমান বউটি পাশের বাড়ির সিঁদুর পরা বউটির কাছে কুমড়োর বড়ি বানানো শিখত আবার হিন্দু বউটি সেমাই রাঁধতে গিয়ে গলিয়ে ফেলে হেসে কুটিকুটি হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসত; যা বলছি এসব নিতান্তই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু নিজেকে সমৃদ্ধ করার এ শিক্ষা বৃহত্তর আঙ্গিকেও প্রভাব বিস্তার করে। এর থেকে লাভটা যা, তা ছিল সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার উন্মেষ। একদিন এদেশে রোগ-শোক, অভাব-অনটন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও সামাজিক সম্প্রীতি ছিল, এক হয়ে বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। কিন্তু এখন নেই কেন? আজকের সমাজে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি থেকেও যে পৃথক-তার দায় কার? দূষিত রাজনীতি, মুক্তচিন্তার পথে প্রতিবন্ধকতা, গণতন্ত্রহীনতা, ক্ষমতার দম্ভ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, কালো টাকার বাহাদুরি, শোষণ-বঞ্চনার পাহাড় মানুষের সুস্থ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের ষড়যন্ত্র।
সম্প্রীতি একজনে হয় না, হয় জনে জনে। কোনো সমাজ বিচ্ছিন্ন একক মানুষের সম্প্রীতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পরিবারে কিংবা সমাজে বসবাস করতে গেলে সম্প্রীতি ছাড়া চলে না। মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সংযোগ ছাড়া সম্প্রীতি গড়ে ওঠে না। ভোগবাদী সমাজে স্বার্থপরতা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। আমরা নিজেকে ছাড়া এখন আর কিছুই বুঝি না। আত্মীয়-স্বজন, এমনকি বয়স্ক মা-বাবার ক্ষেত্রেই যেখানে কারও কারও সীমাহীন উদাসীনতা, তখন অন্য মানুষের কাছাকাছি হওয়ার সময়-সুযোগ হয় কী করে! একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, মাড়িয়ে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখন সর্বত্র। মানুষ যদি জীবনাচরণের মৌলিক গুণাবলীর পার্থক্য নির্ণয় করতে না পারে, তাহলে সেই খন্ডিত বোধ তীব্রভাবে আঘাত করে সংস্কৃতিকে। যদি পার্থক্য নির্ণয় করা না যায় ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার, সাহস ও সন্ত্রাসের, শক্তি ও ক্ষমতার, বিনয় ও দম্ভের, সত্য ও মিথ্যার- তাহলে মূল্যবোধের ভিত নড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা তৈরি হয়।
সব অপশক্তিকে প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হলো সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা। সংস্কৃতি মানুষকে হতাশা থেকে বাঁচায়। সংস্কৃতি যত ছড়াবে মানুষের মন তত আলোকিত হবে। সমাজের অভ্যন্তরে সাংস্কৃতিক জাগরণের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে বাংলার উদার মানবিক ধারার সংস্কৃতিচর্চার পথ খুলে তা বেগবান করতে হবে, পরস্পরের সঙ্গে ভাবনা-বিনিময় বাড়াতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে ধর্মান্ধ বা জঙ্গি সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়। ধ্বংস নয়, মানুষকে ভালোবাসাই যে পরম ধর্ম- এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে সবার অন্তরে।
suva.muntasir@gmail.com
দৈনিক সংবাদ : রোববার, ৭ জুলাই ২০১৯, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত