alt

মুক্ত আলোচনা

আমার বন্ধু শামিম কবির

আইয়ুব কাদরী

: সোমবার, ০৫ আগস্ট ২০১৯

‘Old men forget: yet all shall be forgot,

But he’ll remember with advantages

What feats he did that day:’

William Shakespeare, Henry V, Before spoken by King Henry

সেই সোমবারে সকাল ১০টার পরও ঘুমাচ্ছিলাম। বহু বছর আগে অবসর নেয়ার পর থেকেই বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস আমার। টেলিফোনটার কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভাঙল। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দ্বিধাগ্রস্তকণ্ঠে তানভীর দেওয়ান বলল, কয়েকটা অনলাইন নিউজপেপারে দেখলাম যে, শামিম কবির আর নেই। ঘুমঘোর না কাটা আমার প্রথম মনে হয়েছিল, তানভীর ভুল পড়েছে। এরপর আমার মনে হলো, খবরটা যদি সত্যি হয়, তাহলে শামিম ও আমি আগের মতো আর কখনোই একসঙ্গে ঘোড়াশাল বা ৫৬ ব্যান্ডেল রোডে (আমার চট্টগ্রামের বাড়ি) ঘুরতে যেতে পারব না।

ভয়ানক এই খবর কতটুকু সত্য, সেটি যাচাই করার জন্য খোঁজখবর নেয়ার আগেই ঢাকা ক্লাব থেকে একটি মেসেজ পেলাম। মৃত্যু-পরবর্তী আমাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলো এমন যে, স্বজন ও বন্ধুরা সেসব নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে- শোক করার অবকাশ আর থাকে না। আচার-অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে বিষাদ ঘিরে ধরে। শামিমের ভাতিজা মিশুর (আলতামাশ কবির) সঙ্গে যখন যোগাযোগ করতে পারলাম, তখন তার কাছে দাফন-কাফনের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। প্রায় এক দশক ধরে অসুখে ভোগা আমার বন্ধুটি কীভাবে, কখন, কোথায় এবং কেন মারা গেল, সেসবের কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। শামিমের স্ত্রী নেলী ভাবীকে ফোন করার শক্তি তখনও আমি সঞ্চয় করতে পারিনি।

শামিম কবিরের জীবনে অনেক অর্জন ছিল। বিখ্যাত এক পরিবারে জন্ম নেয়া শামিম স্কুল ও কলেজে থাকা অবস্থায় খেলাধুলায় উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। সে ছিল ক্রিকেটস্টার। সে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক। পরবর্তীকালে জাতীয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজারও ছিল কিছুকাল। ঢাকা ক্লাবের এযাবৎকালের ইতিহাসে শামিম ছিল সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের কাছে সে ছিল মহৎ বন্ধু ও সহচর। অসুস্থতা তাকে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে গেল। আমার মনে হয়, তার যা প্রাপ্য, এর তুলনায় জীবনে সে কমই পেয়েছে।

শামিমকে প্রথম দেখি ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিনে। আমরা দু’জনই বিএ (অনার্স) ক্লাসে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। সে ভর্তি হবে ইতিহাসে আর আমি ইংলিশে। আড়ম্বরপূর্ণ বেশভূষায় লক্ষণীয় হাবভাবে মধুর ক্যান্টিনের ভিড়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল। এরই মধ্যে সে জনপ্রিয় বিশিষ্ট খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। অনেকেই তাকে চেনে। আর চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া আমি চিনি না কাউকেই। শামিমের সঙ্গে আলাপ কীভাবে হয়েছিল, সেটি আর এখন আমার মনে পড়ে না। তবে এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম।

আমি থাকতাম এসএম হলে। যদি আমি ঠিকঠাক স্মরণ করে থাকি, তাহলে শামিমও শুরুতে একই হলের অ্যাটাচড স্টুডেন্ট ছিল এবং তার বড় ভাই আহমদুল কবিরের (মনু ভাই) সঙ্গে ধানমন্ডিতে থাকত। সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে, অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষার আগে শামিম হলে এসে উঠল। আমরা চার ঘনিষ্ঠ বন্ধু একটি রুম শেয়ার করতাম। আমাদের বাকি দুই বন্ধু ছিল মাহবুব আহমেদ ও নাজিব হায়দার। শামিমের মতো মাহবুব আর নাজিবও বিশিষ্ট ক্রিকেটার। তবে তারা শামিমের মতো বিখ্যাত ছিল না। মাহবুব খেলত আজাদ বয়েজে আর নাজিব খেলত ভিক্টোরিয়ায়। শুধু আমারই খেলাধুলায় কোন অর্জন নেই। মাহবুব রিটায়ার্ড ব্যাংকার, থাকে ঢাকায়। নাজিব থাকে পাকিস্তানে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরে শামিমের সঙ্গে আমি মনু ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় প্রায়ই যেতাম। পরে তার ইন্দিরা রোডের বাসাতেও অনেকবার গিয়েছি। হলের নিরস খাবার এড়িয়ে কোন ভণিতা না করে মনু ভাইয়ের বাসায় সুস্বাদু খাবার খেতে যেতাম। লায়লা ভাবী (লায়লা কবির) খুব যত্ন করে স্নেহের সঙ্গে আমাদের খাওয়াতেন। ট্রেনে চেপে শামিমের ঘোড়াশালের পৈতৃক বাড়িতেও গিয়েছি। সেই চার বছরে শামিমের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যেরই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। শামিমও আমার মা-বাবা ও ভাই-বোনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমার পরিবারের সবাই তাকে খুব পছন্দ করতেন। আমার মনে আছে, ১৯৭১ সালে আমার ছোট এক ভাই যখন সারগোদার স্কুল থেকে দেশে ফিরছিল, তখন তাকে সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত ঢাকার বিমানবন্দর থেকে নিয়ে চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল শামিম।

কেউ পছন্দ করুক, চাই না করুক- বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিনগুলো থেকেই শামিমের পোশাক এবং আচার-ব্যবহারে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যেহেতু সে নিজের এই অভ্যাস থেকে কখনও বিচ্যুত হয়নি, সেহেতু তাকে কারও কারও কঠোর ও রক্ষণশীল মনে হতে পারে। হয়তো সে রক্ষণশীল ছিলও। তবে যারা তার ঘনিষ্ঠ ছিল, তারা জানে যে- সে নরম মনের, দয়ালু, সহানুভূতিশীল ও পরোপকারী ছিল। তাকে আমরা ভালোবেসে বলতাম কাইন্টা বা কেন্ট কবির।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চট্টগ্রামে সরকারি কমার্স কলেজে জয়েন করি। সেখানে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলাম। ওই সময় শামিম বেশ কয়েকবার চট্টগ্রামে গেছে আমাদের ৫৬ ব্যান্ডেল রোডের বাসায় থেকেছে। একবার এক ক্রিকেট ম্যাচ খেলার আগে প্র্যাকটিসের সময় গোড়ালি মচকে যায় শামিমের। ফলে ওই ম্যাচ আর সে খেলতে পারেনি। ওই সময় আমি ঢাকায় এসে মনু ভাইয়ের ইন্দিরা রোডের বাসায় তার সঙ্গে থেকেছি। সেবার মনু ভাইয়ের বাসায় অতুলনীয় আতিথেয়তা পেয়েছি।

১৯৬৮ সালে যখন সিএসএস পরীক্ষা দিই, শামিম তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলছে। সিএসএস পরীক্ষার জন্য ঢাকায় দীর্ঘ এক মাস থাকা দরকার ছিল আমার। শামিমের অনুপস্থিতিতে মনু ভাইয়ের বাসায় থাকার কথা ভাবতে আমার একটুও কুণ্ঠা হয়নি। মনু ভাইয়ের বাসায় দীর্ঘ এক মাস থাকাকালে লায়লা ভাবীর অনেক যত্ন আর স্নেহ পেয়েছি। সেখানে থেকে পড়ার সময় মনু ভাই, ভাবী আর তাদের সন্তানদের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কেটেছে। মিশু (আলতামাশ কবির) আর টিটু (আরদাশির কবির) তখন বেশ ছোট। পুচি’র (নিহাদ কবির) সম্ভবত তখনও জন্ম হয়নি।

সিভিল সার্ভিসে জয়েন করার পরও শামিমের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। ঢাকার বাইরে পোস্টিং হওয়ার কারণে অবশ্য আগের মতো অত ঘন ঘন যোগাযোগ হতো না। ততদিনে শামিমের নিজের জগৎ গড়ে উঠেছে। ইস্পাহানি কলোনিতে এবং পরে তেজকুনিপাড়ায় তার বাসায় ডিনার করার কথা আমার মনে পড়ে। তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত ১৯৭৫ সালে কুমিল্লায় এডিসি হিসেবে ছিলাম। মনু ভাই একবার সিলেট যাওয়ার পথে কুমিল্লায় থেমে আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

শামিমের দুই ছেলে আরিফ ও ইউসুফ। দুই ছেলেকে নিয়ে সে অনেক গর্ব করত। তার ছেলেরা কীভাবে বড় হচ্ছে, ওই গল্প করত। তাদের লেখাপড়া আর বিভিন্ন অর্জন নিয়ে কথা বলত। দুই ছেলের সঙ্গে শামিমের স্ত্রী নেলী কবিরের চমৎকার সম্পর্ক আমাকে মুগ্ধ করেছে। চমৎকার এই সম্পর্কে শামিম আর সন্তানদের অবদান নিশ্চয় আছে। তবে আমি মনে করি, এই সম্পর্কের জন্য নেলী ভাবীই বেশি কৃতিত্বের দাবিদার।

শামিম যখন নেলীকে ঘরোয়াভাবে বিয়ে করে, তখন বিষয়টা কেবল পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু শামিমের পরিবার সাব্যস্ত করল যে, মাহবুব আর আমাকে ছাড়া এই ঘটনা অপূর্ণ থেকে যাবে। শেষ মুহূর্তে আমাদের দু’জনকে আনা হলো। তাদের বিয়েতে অংশ নিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে।

গত কয়েক বছর ঢাকা ক্লাবে শামিমের সঙ্গে আমার বেশিরভাগ সময়ই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ ঘটেছে। অন্তত তার অথবা আমার বাসায় হওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎ আর ডিনারের তুলনায় তা সামান্যই। পাকিস্তান থেকে নাজিব মাঝে মধ্যে আসত আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। তবে কয়েক বছর আগে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। শেষ দীর্ঘ সাক্ষাৎ হয়েছিল বছর দুয়েক আগে আমার বাসায়। ওই রাতে ডিনারে শুধু শামিম আর তার স্ত্রী নেলী ছিল আমাদের অতিথি। ওই রাতে আমরা বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি।

আমার মা আমাকে বাদলা বলে ডাকতেন। বাদল না বলে মা আমাকে ওভাবেই ডাকতেন। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে একবার শামিম এই ডাক শুনতে পায়। তারপর থেকে কেবল সেই আমাকে বাদলা বলে ডাকত। যখনই আমার সঙ্গে দেখা হতো, তখনই বলত- ‘কিরে বাদলা, ঘোড়াশাল কবে যাবি’ অথবা ‘কিরে বাদলা, আমারে ৫৬ ব্যান্ডেল রোডে নিয়া যাবি না।’

সেটি আর হবে না আমার বন্ধু। সর্বশক্তিমান এমন কিছুই নির্ধারণ করে রেখেছেন যে, এখন আমাকে বাদলা বলে ডাকার আর কেউই রইল না।

Only the ‘old men forget’ part of the opening quotation appears relevant, not having done any feats myself, I wish I could remember Shamim’s feats with advantage’ Alas!

Ayub Quadri

দৈনিক সংবাদ : ৫ আগস্ট ২০১৯, সোমবার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

পলিথিনের পাপ, প্রকৃতির প্রতিশোধ

হারিয়ে যাওয়া অভিযোগকৃত চেকের মামলা

জার্মানীতে এসবি ৬২ সম্মেলন : বাংলাদেশের নজর অর্থায়নের ন্যায্যতায়

ছবি

শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আদিবাসী মুণ্ডা ভাষার বাঁচার আর্তনাদ

মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা : এক হারানো সম্ভাবনার খোঁজে

বিশ্ব রেড ক্রস দিবস

আত্মরক্ষার খালি-হাতের ইতিহাস ও আধুনিক বিস্তার

বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর : সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ

ছবি

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস “বিজয় বসন্ত“গ্রন্থের লেখক

পয়লা বৈশাখ : বাঙালির সংহতি চেতনার সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কমরেড রূপনারায়ণ রায়

সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা

রেসলিং

কোটা সমাচার

বাজেট ২০২৪-২৫: তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা শুরু হোক এবার

সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: উন্নত ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়

ছবি

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

tab

মুক্ত আলোচনা

আমার বন্ধু শামিম কবির

আইয়ুব কাদরী

সোমবার, ০৫ আগস্ট ২০১৯

‘Old men forget: yet all shall be forgot,

But he’ll remember with advantages

What feats he did that day:’

William Shakespeare, Henry V, Before spoken by King Henry

সেই সোমবারে সকাল ১০টার পরও ঘুমাচ্ছিলাম। বহু বছর আগে অবসর নেয়ার পর থেকেই বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস আমার। টেলিফোনটার কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভাঙল। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দ্বিধাগ্রস্তকণ্ঠে তানভীর দেওয়ান বলল, কয়েকটা অনলাইন নিউজপেপারে দেখলাম যে, শামিম কবির আর নেই। ঘুমঘোর না কাটা আমার প্রথম মনে হয়েছিল, তানভীর ভুল পড়েছে। এরপর আমার মনে হলো, খবরটা যদি সত্যি হয়, তাহলে শামিম ও আমি আগের মতো আর কখনোই একসঙ্গে ঘোড়াশাল বা ৫৬ ব্যান্ডেল রোডে (আমার চট্টগ্রামের বাড়ি) ঘুরতে যেতে পারব না।

ভয়ানক এই খবর কতটুকু সত্য, সেটি যাচাই করার জন্য খোঁজখবর নেয়ার আগেই ঢাকা ক্লাব থেকে একটি মেসেজ পেলাম। মৃত্যু-পরবর্তী আমাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলো এমন যে, স্বজন ও বন্ধুরা সেসব নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে- শোক করার অবকাশ আর থাকে না। আচার-অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে বিষাদ ঘিরে ধরে। শামিমের ভাতিজা মিশুর (আলতামাশ কবির) সঙ্গে যখন যোগাযোগ করতে পারলাম, তখন তার কাছে দাফন-কাফনের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। প্রায় এক দশক ধরে অসুখে ভোগা আমার বন্ধুটি কীভাবে, কখন, কোথায় এবং কেন মারা গেল, সেসবের কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। শামিমের স্ত্রী নেলী ভাবীকে ফোন করার শক্তি তখনও আমি সঞ্চয় করতে পারিনি।

শামিম কবিরের জীবনে অনেক অর্জন ছিল। বিখ্যাত এক পরিবারে জন্ম নেয়া শামিম স্কুল ও কলেজে থাকা অবস্থায় খেলাধুলায় উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। সে ছিল ক্রিকেটস্টার। সে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক। পরবর্তীকালে জাতীয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজারও ছিল কিছুকাল। ঢাকা ক্লাবের এযাবৎকালের ইতিহাসে শামিম ছিল সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের কাছে সে ছিল মহৎ বন্ধু ও সহচর। অসুস্থতা তাকে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে গেল। আমার মনে হয়, তার যা প্রাপ্য, এর তুলনায় জীবনে সে কমই পেয়েছে।

শামিমকে প্রথম দেখি ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিনে। আমরা দু’জনই বিএ (অনার্স) ক্লাসে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। সে ভর্তি হবে ইতিহাসে আর আমি ইংলিশে। আড়ম্বরপূর্ণ বেশভূষায় লক্ষণীয় হাবভাবে মধুর ক্যান্টিনের ভিড়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল। এরই মধ্যে সে জনপ্রিয় বিশিষ্ট খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। অনেকেই তাকে চেনে। আর চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া আমি চিনি না কাউকেই। শামিমের সঙ্গে আলাপ কীভাবে হয়েছিল, সেটি আর এখন আমার মনে পড়ে না। তবে এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম।

আমি থাকতাম এসএম হলে। যদি আমি ঠিকঠাক স্মরণ করে থাকি, তাহলে শামিমও শুরুতে একই হলের অ্যাটাচড স্টুডেন্ট ছিল এবং তার বড় ভাই আহমদুল কবিরের (মনু ভাই) সঙ্গে ধানমন্ডিতে থাকত। সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে, অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষার আগে শামিম হলে এসে উঠল। আমরা চার ঘনিষ্ঠ বন্ধু একটি রুম শেয়ার করতাম। আমাদের বাকি দুই বন্ধু ছিল মাহবুব আহমেদ ও নাজিব হায়দার। শামিমের মতো মাহবুব আর নাজিবও বিশিষ্ট ক্রিকেটার। তবে তারা শামিমের মতো বিখ্যাত ছিল না। মাহবুব খেলত আজাদ বয়েজে আর নাজিব খেলত ভিক্টোরিয়ায়। শুধু আমারই খেলাধুলায় কোন অর্জন নেই। মাহবুব রিটায়ার্ড ব্যাংকার, থাকে ঢাকায়। নাজিব থাকে পাকিস্তানে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরে শামিমের সঙ্গে আমি মনু ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় প্রায়ই যেতাম। পরে তার ইন্দিরা রোডের বাসাতেও অনেকবার গিয়েছি। হলের নিরস খাবার এড়িয়ে কোন ভণিতা না করে মনু ভাইয়ের বাসায় সুস্বাদু খাবার খেতে যেতাম। লায়লা ভাবী (লায়লা কবির) খুব যত্ন করে স্নেহের সঙ্গে আমাদের খাওয়াতেন। ট্রেনে চেপে শামিমের ঘোড়াশালের পৈতৃক বাড়িতেও গিয়েছি। সেই চার বছরে শামিমের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যেরই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। শামিমও আমার মা-বাবা ও ভাই-বোনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমার পরিবারের সবাই তাকে খুব পছন্দ করতেন। আমার মনে আছে, ১৯৭১ সালে আমার ছোট এক ভাই যখন সারগোদার স্কুল থেকে দেশে ফিরছিল, তখন তাকে সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত ঢাকার বিমানবন্দর থেকে নিয়ে চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল শামিম।

কেউ পছন্দ করুক, চাই না করুক- বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিনগুলো থেকেই শামিমের পোশাক এবং আচার-ব্যবহারে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যেহেতু সে নিজের এই অভ্যাস থেকে কখনও বিচ্যুত হয়নি, সেহেতু তাকে কারও কারও কঠোর ও রক্ষণশীল মনে হতে পারে। হয়তো সে রক্ষণশীল ছিলও। তবে যারা তার ঘনিষ্ঠ ছিল, তারা জানে যে- সে নরম মনের, দয়ালু, সহানুভূতিশীল ও পরোপকারী ছিল। তাকে আমরা ভালোবেসে বলতাম কাইন্টা বা কেন্ট কবির।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চট্টগ্রামে সরকারি কমার্স কলেজে জয়েন করি। সেখানে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলাম। ওই সময় শামিম বেশ কয়েকবার চট্টগ্রামে গেছে আমাদের ৫৬ ব্যান্ডেল রোডের বাসায় থেকেছে। একবার এক ক্রিকেট ম্যাচ খেলার আগে প্র্যাকটিসের সময় গোড়ালি মচকে যায় শামিমের। ফলে ওই ম্যাচ আর সে খেলতে পারেনি। ওই সময় আমি ঢাকায় এসে মনু ভাইয়ের ইন্দিরা রোডের বাসায় তার সঙ্গে থেকেছি। সেবার মনু ভাইয়ের বাসায় অতুলনীয় আতিথেয়তা পেয়েছি।

১৯৬৮ সালে যখন সিএসএস পরীক্ষা দিই, শামিম তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলছে। সিএসএস পরীক্ষার জন্য ঢাকায় দীর্ঘ এক মাস থাকা দরকার ছিল আমার। শামিমের অনুপস্থিতিতে মনু ভাইয়ের বাসায় থাকার কথা ভাবতে আমার একটুও কুণ্ঠা হয়নি। মনু ভাইয়ের বাসায় দীর্ঘ এক মাস থাকাকালে লায়লা ভাবীর অনেক যত্ন আর স্নেহ পেয়েছি। সেখানে থেকে পড়ার সময় মনু ভাই, ভাবী আর তাদের সন্তানদের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কেটেছে। মিশু (আলতামাশ কবির) আর টিটু (আরদাশির কবির) তখন বেশ ছোট। পুচি’র (নিহাদ কবির) সম্ভবত তখনও জন্ম হয়নি।

সিভিল সার্ভিসে জয়েন করার পরও শামিমের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। ঢাকার বাইরে পোস্টিং হওয়ার কারণে অবশ্য আগের মতো অত ঘন ঘন যোগাযোগ হতো না। ততদিনে শামিমের নিজের জগৎ গড়ে উঠেছে। ইস্পাহানি কলোনিতে এবং পরে তেজকুনিপাড়ায় তার বাসায় ডিনার করার কথা আমার মনে পড়ে। তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত ১৯৭৫ সালে কুমিল্লায় এডিসি হিসেবে ছিলাম। মনু ভাই একবার সিলেট যাওয়ার পথে কুমিল্লায় থেমে আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

শামিমের দুই ছেলে আরিফ ও ইউসুফ। দুই ছেলেকে নিয়ে সে অনেক গর্ব করত। তার ছেলেরা কীভাবে বড় হচ্ছে, ওই গল্প করত। তাদের লেখাপড়া আর বিভিন্ন অর্জন নিয়ে কথা বলত। দুই ছেলের সঙ্গে শামিমের স্ত্রী নেলী কবিরের চমৎকার সম্পর্ক আমাকে মুগ্ধ করেছে। চমৎকার এই সম্পর্কে শামিম আর সন্তানদের অবদান নিশ্চয় আছে। তবে আমি মনে করি, এই সম্পর্কের জন্য নেলী ভাবীই বেশি কৃতিত্বের দাবিদার।

শামিম যখন নেলীকে ঘরোয়াভাবে বিয়ে করে, তখন বিষয়টা কেবল পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু শামিমের পরিবার সাব্যস্ত করল যে, মাহবুব আর আমাকে ছাড়া এই ঘটনা অপূর্ণ থেকে যাবে। শেষ মুহূর্তে আমাদের দু’জনকে আনা হলো। তাদের বিয়েতে অংশ নিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে।

গত কয়েক বছর ঢাকা ক্লাবে শামিমের সঙ্গে আমার বেশিরভাগ সময়ই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ ঘটেছে। অন্তত তার অথবা আমার বাসায় হওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎ আর ডিনারের তুলনায় তা সামান্যই। পাকিস্তান থেকে নাজিব মাঝে মধ্যে আসত আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। তবে কয়েক বছর আগে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। শেষ দীর্ঘ সাক্ষাৎ হয়েছিল বছর দুয়েক আগে আমার বাসায়। ওই রাতে ডিনারে শুধু শামিম আর তার স্ত্রী নেলী ছিল আমাদের অতিথি। ওই রাতে আমরা বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি।

আমার মা আমাকে বাদলা বলে ডাকতেন। বাদল না বলে মা আমাকে ওভাবেই ডাকতেন। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে একবার শামিম এই ডাক শুনতে পায়। তারপর থেকে কেবল সেই আমাকে বাদলা বলে ডাকত। যখনই আমার সঙ্গে দেখা হতো, তখনই বলত- ‘কিরে বাদলা, ঘোড়াশাল কবে যাবি’ অথবা ‘কিরে বাদলা, আমারে ৫৬ ব্যান্ডেল রোডে নিয়া যাবি না।’

সেটি আর হবে না আমার বন্ধু। সর্বশক্তিমান এমন কিছুই নির্ধারণ করে রেখেছেন যে, এখন আমাকে বাদলা বলে ডাকার আর কেউই রইল না।

Only the ‘old men forget’ part of the opening quotation appears relevant, not having done any feats myself, I wish I could remember Shamim’s feats with advantage’ Alas!

Ayub Quadri

দৈনিক সংবাদ : ৫ আগস্ট ২০১৯, সোমবার, ৭ এর পাতায় প্রকাশিত

back to top