alt

মুক্ত আলোচনা

স্বপ্নের নায়িকা কবরী

সাইফুজ্জামান

: শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১

সিনেমা দেখা অনেকের হবি। ষাট ও সত্তর দশকের বাংলা সিনেমা নিটোল গল্প ও অভিনয় দক্ষতায় উঁচুমানের ছিল। বাবা-চাচারা এসব সিনেমার ভক্ত ছিলেন। পরে আমরা ভক্ত হয়ে উঠি। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই সব সিনেমা আমরা দেখতাম। নির্দিষ্ট সিনেমা ছাড়া অধিকাংশ সিনেমার কিছু দেখে হল থেকে পালাতাম। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল কবরী-রাজ্জাক জুটির সিনেমা। সেই কবরী করোনাক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।

এ সংবাদ তার ভক্তকুলের জন্য যেমন বেদনার, আমার জন্য হাহাকারের। কবরী ছিলেন আমাদের স্বপ্নের নায়িকা। অসম্ভব প্রাণ খোলা হাসি, কথা প্রক্ষেপণ, দুষ্টু-মিষ্টি আচরণ তাকে আমাদের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। আমাদের পূর্রপুরুষদের নায়ক-নায়িকা ছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। উত্তম-সুচিত্রার কেমিস্ট্রি ছিল অম্ল­মধুর। তাদের পোশাক, শাড়ি, শার্ট, প্যান্ট, চুলের স্টাইল, প্রশাধন বাঙালি নর-নারীকে আকৃষ্ট করত। এমন কি কাজল পরা মুখের কালো তিল, গানের দৃশ্যের অন্তরঙ্গতা ছিল নজর কাড়া।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির পাশাপাশি ষাট ও সত্তর দশকের ইংরেজি সিনেমার নায়ক-নায়িকা, কাহিনীর নাটকীয়তা মুগ্ধ করার মতো ছিল। এর মধ্যে কবরী-রাজ্জাক ঝড়ের মতো এসে মানুষের চিত্ত জয় করেছিলেন। কবরী অনেক নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। সবখানেই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছেন। তিনি যখন অভিনয় শুরু করেন তখন প্রযুক্তির উন্নয়ন এমন ঘটেনি। লাইট, সাউন্ড, স্টেজ, এডিটিং, ফটোশপের আধুনিক ব্যবহার ঘটেনি। সাদামাটা কাহিনীকে অসাধারণ দক্ষতায় দর্শক নন্দিত করার কৃতিত্ব ছিল কবরীর।

কবরী সুতরাং সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সুভাষ দত্তের আবিষ্কার যে হীরা চিনিয়াছিল তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। ময়নামতি, তিতাস একটি নদীর নাম, সারেং বৌ, নীল আকাশের নিচে, সুজন সখী প্রভৃতি সিনেমাতে কবরী ধ্রুপদী ধারার অভিনয় শৈলীতে দর্শক হৃদয় জয় করেন।

অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনা দিয়ে তার সাত দশকের জীবন পরিপূর্ণ ছিল। মনের গহীনে দুঃখ ছিল। সব সৃজনশীল মানুষের অতৃপ্তি থাকে। কবরীর ও ছিল। তাইতো তাকে বলতে হয়েছে, জীবনে ভালো বন্ধু পেলাম না। না স্বামী, না বন্ধু। সন্তানরা দূরে থাকে। কারও সঙ্গে গল্প করা- এক সঙ্গে কফি খাওয়ার মুহূর্ত তার জীবনে আসেনি, তিনি আক্ষেপ করেছেন। সুতরাং ছবির জরিনা চরিত্রে কাকে কাস্ট করা যায় এমন একজনকে খুঁজে ফিরছিলেন সুভাষ দত্ত। সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা চট্টগ্রামের এক মঞ্চকর্মী মীনা পালের সন্ধান দিলেন। মেয়েটি সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো, কিন্তু অসাধারণ অভিনয় করেন। প্রস্তাব শুনে সুভাষ দত্ত নড়েচড়ে বসেন। বিমানে চড়ে চট্টগ্রাম যান বিধি বাম। মীনা পাল তখন ময়মনসিংহে। সুভাষ দত্তের অনুরোধে ডা. কামাল মীনা পালের কিছু ছবি তুলে সুভাষ দত্তকে পাঠান। সুভাষ দত্ত নানা ব্যস্ততার কারণে মীনা পালের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভুলে যান।

পরে ডা, কামালকে সুভাষ দত্ত জানান মেয়েটিকে তার পছন্দ হয়েছে। মেয়েটির বয়স তখন ১৩ কিংবা ১৪ বছর। মা রাজি নয় তার মেয়ে অভিনয়ে আসুক। শুধু বাবার উৎসাহে মীনা পাল ঢাকাই আসেন। বিউটি বোর্ডিংয়ে তিনি উঠেন। সালোয়ার-কামিজ পরা এক কিশোরীকে শাড়ি পরতে হয়। কণ্ঠ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ছুটতে হয় এক স্টুডিওতে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান ছেড়ে মীনাপালের নায়িকা হয়ে ওঠার গল্পের সূচনা এরকম। সৈয়দ শামসুল হককে দায়িত্ব দেয়া হয় মীনা পালের পোশাকী নাম দেয়ার। সব নামই কমন পড়ে যায়। অবশেষে নাম রাখা হয় করবী। তিনি হয়ে যান কবরী।

কবরীর জন্ম ১৯৫২ সালের ১৯ জুলাই। বাবা কৃষন দাস পাল। মা লাবন্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে নৃত্যশিল্পী তার মঞ্চে অভিষেক। টেলিভিশন, রে ডিওতে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। পরে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতির মধ্যগগনে আরোহণ করেন। ১৯৬৪ সালে অভিনীত ছায়াছবির জন্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা পান তিনি। ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় চলট্টিত্র পুরস্কার পায় সুতরাং। মিষ্টি মেয়ে উপাধি তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরের ছায়া ছবি নীল কাশের নিচে কবরী জুটি বাঁধেন রাজ্জাকের সঙ্গে। হেসে খেলে জীবনটা, নীল আকাশের নিচে, গান হয়ে এলে, প্রেমের নাম বেদনা।

১৯৭৩ সালে জহিরুল হক পরিচালিত রংবাজ ছবি মুক্তি পায়। এ এক চলচ্চিত্র গতানুগতিক ধারা বদলে দেয়। ১৯৭৩ সালে কবরী অভিনীত তিতাস একটি নদীর নাম মুক্তি পায়। রংবাজ এ ছবিতে কবরী ও নায়ক রাজ্জাকের অভিনয় ছিল অত্যন্ত আবেগঘন। ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি পরিচালনা করেন জহিরুল হক। এর ‘হৈ হৈ হৈ রঙিলা’, ‘সে যে কেন এলো না’ গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

তিতাস একটি নদীর নাম ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কালজয়ী সাহিত্যনির্ভর ছবি। যা অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাহিনি নিয়ে তৈরি এ ছায়াছবিতে ১৯৭৩, এ কবরী অনবদ্য অভিনয় করেন।

বেইমান কবরী-রাজ্জাক অভিনীত আলোচিত ও সফল ছায়া ছবি। এ ছবিতেও তার নায়ক ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবি পরিচালনা করেন রুহুল আমিন।

মাসুদ রানা গোয়েন্দা চরিত্র মাসুদ রানা রূপায়িত হয় চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র মাসুদ রানাতে অভিনয় করেন সোহেল রানা, অলিভিয়া ও কবরী। মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।

সুজন সখী ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কবরী-ফারুক অভিনীত ছায়াছবি। ছবি অন্যতম রোমান্টিক পিস হিসেবে ধরা হয়। পরিচালনা করেন চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে দুই ভাইয়ের বিচ্ছেদ ও তাদের মিলনের গল্প উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে।

সারেং বৌ নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গ্রামের সহজ সরল মেয়ে নবিতুনকে নিয়ে এর গল্প। নারীর জীবনযুদ্ধের কাহিনী স্থান পায়। বউ উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নারীর সংগ্রাম। যা সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলেন কবরী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান কবরী। কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেন ফারুক।

১২ দিন করোনাভাইরাসের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হয়। কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী ১৭ এপ্রিল রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কবরীর মতো উঁচুমানের শিল্পী যুগে যুগে আসে না। তার স্থান অপূরণীয়। শুনেছি তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কবরী অভিনীত ছায়াছবি সংরক্ষণ করা জরুরি। কালের বিবর্তনে কবরী যেন না হারিয়ে যান সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার অভিনয় শৈলী ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তর গবেষণার অবকাশ রয়েছে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

স্বপ্নের নায়িকা কবরী

সাইফুজ্জামান

শনিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২১

সিনেমা দেখা অনেকের হবি। ষাট ও সত্তর দশকের বাংলা সিনেমা নিটোল গল্প ও অভিনয় দক্ষতায় উঁচুমানের ছিল। বাবা-চাচারা এসব সিনেমার ভক্ত ছিলেন। পরে আমরা ভক্ত হয়ে উঠি। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই সব সিনেমা আমরা দেখতাম। নির্দিষ্ট সিনেমা ছাড়া অধিকাংশ সিনেমার কিছু দেখে হল থেকে পালাতাম। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল কবরী-রাজ্জাক জুটির সিনেমা। সেই কবরী করোনাক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।

এ সংবাদ তার ভক্তকুলের জন্য যেমন বেদনার, আমার জন্য হাহাকারের। কবরী ছিলেন আমাদের স্বপ্নের নায়িকা। অসম্ভব প্রাণ খোলা হাসি, কথা প্রক্ষেপণ, দুষ্টু-মিষ্টি আচরণ তাকে আমাদের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। আমাদের পূর্রপুরুষদের নায়ক-নায়িকা ছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। উত্তম-সুচিত্রার কেমিস্ট্রি ছিল অম্ল­মধুর। তাদের পোশাক, শাড়ি, শার্ট, প্যান্ট, চুলের স্টাইল, প্রশাধন বাঙালি নর-নারীকে আকৃষ্ট করত। এমন কি কাজল পরা মুখের কালো তিল, গানের দৃশ্যের অন্তরঙ্গতা ছিল নজর কাড়া।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির পাশাপাশি ষাট ও সত্তর দশকের ইংরেজি সিনেমার নায়ক-নায়িকা, কাহিনীর নাটকীয়তা মুগ্ধ করার মতো ছিল। এর মধ্যে কবরী-রাজ্জাক ঝড়ের মতো এসে মানুষের চিত্ত জয় করেছিলেন। কবরী অনেক নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। সবখানেই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছেন। তিনি যখন অভিনয় শুরু করেন তখন প্রযুক্তির উন্নয়ন এমন ঘটেনি। লাইট, সাউন্ড, স্টেজ, এডিটিং, ফটোশপের আধুনিক ব্যবহার ঘটেনি। সাদামাটা কাহিনীকে অসাধারণ দক্ষতায় দর্শক নন্দিত করার কৃতিত্ব ছিল কবরীর।

কবরী সুতরাং সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সুভাষ দত্তের আবিষ্কার যে হীরা চিনিয়াছিল তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। ময়নামতি, তিতাস একটি নদীর নাম, সারেং বৌ, নীল আকাশের নিচে, সুজন সখী প্রভৃতি সিনেমাতে কবরী ধ্রুপদী ধারার অভিনয় শৈলীতে দর্শক হৃদয় জয় করেন।

অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনা দিয়ে তার সাত দশকের জীবন পরিপূর্ণ ছিল। মনের গহীনে দুঃখ ছিল। সব সৃজনশীল মানুষের অতৃপ্তি থাকে। কবরীর ও ছিল। তাইতো তাকে বলতে হয়েছে, জীবনে ভালো বন্ধু পেলাম না। না স্বামী, না বন্ধু। সন্তানরা দূরে থাকে। কারও সঙ্গে গল্প করা- এক সঙ্গে কফি খাওয়ার মুহূর্ত তার জীবনে আসেনি, তিনি আক্ষেপ করেছেন। সুতরাং ছবির জরিনা চরিত্রে কাকে কাস্ট করা যায় এমন একজনকে খুঁজে ফিরছিলেন সুভাষ দত্ত। সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা চট্টগ্রামের এক মঞ্চকর্মী মীনা পালের সন্ধান দিলেন। মেয়েটি সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো, কিন্তু অসাধারণ অভিনয় করেন। প্রস্তাব শুনে সুভাষ দত্ত নড়েচড়ে বসেন। বিমানে চড়ে চট্টগ্রাম যান বিধি বাম। মীনা পাল তখন ময়মনসিংহে। সুভাষ দত্তের অনুরোধে ডা. কামাল মীনা পালের কিছু ছবি তুলে সুভাষ দত্তকে পাঠান। সুভাষ দত্ত নানা ব্যস্ততার কারণে মীনা পালের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভুলে যান।

পরে ডা, কামালকে সুভাষ দত্ত জানান মেয়েটিকে তার পছন্দ হয়েছে। মেয়েটির বয়স তখন ১৩ কিংবা ১৪ বছর। মা রাজি নয় তার মেয়ে অভিনয়ে আসুক। শুধু বাবার উৎসাহে মীনা পাল ঢাকাই আসেন। বিউটি বোর্ডিংয়ে তিনি উঠেন। সালোয়ার-কামিজ পরা এক কিশোরীকে শাড়ি পরতে হয়। কণ্ঠ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ছুটতে হয় এক স্টুডিওতে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান ছেড়ে মীনাপালের নায়িকা হয়ে ওঠার গল্পের সূচনা এরকম। সৈয়দ শামসুল হককে দায়িত্ব দেয়া হয় মীনা পালের পোশাকী নাম দেয়ার। সব নামই কমন পড়ে যায়। অবশেষে নাম রাখা হয় করবী। তিনি হয়ে যান কবরী।

কবরীর জন্ম ১৯৫২ সালের ১৯ জুলাই। বাবা কৃষন দাস পাল। মা লাবন্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে নৃত্যশিল্পী তার মঞ্চে অভিষেক। টেলিভিশন, রে ডিওতে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। পরে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতির মধ্যগগনে আরোহণ করেন। ১৯৬৪ সালে অভিনীত ছায়াছবির জন্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা পান তিনি। ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় চলট্টিত্র পুরস্কার পায় সুতরাং। মিষ্টি মেয়ে উপাধি তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরের ছায়া ছবি নীল কাশের নিচে কবরী জুটি বাঁধেন রাজ্জাকের সঙ্গে। হেসে খেলে জীবনটা, নীল আকাশের নিচে, গান হয়ে এলে, প্রেমের নাম বেদনা।

১৯৭৩ সালে জহিরুল হক পরিচালিত রংবাজ ছবি মুক্তি পায়। এ এক চলচ্চিত্র গতানুগতিক ধারা বদলে দেয়। ১৯৭৩ সালে কবরী অভিনীত তিতাস একটি নদীর নাম মুক্তি পায়। রংবাজ এ ছবিতে কবরী ও নায়ক রাজ্জাকের অভিনয় ছিল অত্যন্ত আবেগঘন। ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি পরিচালনা করেন জহিরুল হক। এর ‘হৈ হৈ হৈ রঙিলা’, ‘সে যে কেন এলো না’ গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

তিতাস একটি নদীর নাম ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কালজয়ী সাহিত্যনির্ভর ছবি। যা অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাহিনি নিয়ে তৈরি এ ছায়াছবিতে ১৯৭৩, এ কবরী অনবদ্য অভিনয় করেন।

বেইমান কবরী-রাজ্জাক অভিনীত আলোচিত ও সফল ছায়া ছবি। এ ছবিতেও তার নায়ক ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবি পরিচালনা করেন রুহুল আমিন।

মাসুদ রানা গোয়েন্দা চরিত্র মাসুদ রানা রূপায়িত হয় চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র মাসুদ রানাতে অভিনয় করেন সোহেল রানা, অলিভিয়া ও কবরী। মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।

সুজন সখী ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কবরী-ফারুক অভিনীত ছায়াছবি। ছবি অন্যতম রোমান্টিক পিস হিসেবে ধরা হয়। পরিচালনা করেন চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে দুই ভাইয়ের বিচ্ছেদ ও তাদের মিলনের গল্প উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে।

সারেং বৌ নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গ্রামের সহজ সরল মেয়ে নবিতুনকে নিয়ে এর গল্প। নারীর জীবনযুদ্ধের কাহিনী স্থান পায়। বউ উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নারীর সংগ্রাম। যা সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলেন কবরী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান কবরী। কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেন ফারুক।

১২ দিন করোনাভাইরাসের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হয়। কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী ১৭ এপ্রিল রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কবরীর মতো উঁচুমানের শিল্পী যুগে যুগে আসে না। তার স্থান অপূরণীয়। শুনেছি তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কবরী অভিনীত ছায়াছবি সংরক্ষণ করা জরুরি। কালের বিবর্তনে কবরী যেন না হারিয়ে যান সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার অভিনয় শৈলী ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তর গবেষণার অবকাশ রয়েছে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ]

back to top