alt

মুক্ত আলোচনা

শব্দদূষণ রোধে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

গাজী শরিফুল হাসান

: শনিবার, ২২ মে ২০২১

আমরা যা কিছু শুনি তাই শব্দ। শব্দ এক প্রকার শক্তি। কোন একটি উৎস থেকে শব্দ তৈরি হয়ে বায়ুবীয় অথবা কঠিন বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। শব্দ মানুষের কানের শ্রুতি-গ্রাহক পর্দায় আঘাত করে মস্তিষ্কে বিশেষ অনুভূতির জন্ম দেয়। তখনই আমরা শুনতে পাই। কোন কিছু থেকে সৃষ্ট তীব্র শব্দ যখন অস্বাভাবিক মাত্রায় প্রবাহিত হয়ে শ্রবণশক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তাকেই শব্দদূষণ বলে। আকস্মিক তীব্র শব্দে অন্তকর্ণের ক্ষতির ফলে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। তাই শব্দদূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক গভীর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ১ জন বধিরতা নিয়ে জন্মায়। শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ, যার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচার-আচরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

দুই প্রজন্মের মানুষ শব্দদূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার। শিশু, যারা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ এবং বৃদ্ধ যারা আমাদের পরিবারকে সংগঠিত করে রাখে। এর পাশাপাশি গর্ভবতী নারীরাও রয়েছেন, যারা শব্দদূষণের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, শারীরিক নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক অবসাদগ্রস্ততাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে শব্দ দূষণের কারণে।

শহরে সাধারণত যানবাহন ও গাড়ির হর্নের শব্দই শব্দদূষণের মূল কারণ। তবে এর বাইরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার, নির্মাণ কাজজনিত শব্দ ইত্যাদি শব্দদূষণের বড় কারণ। উচ্চমাত্রার শব্দ হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ঝুঁকি সবেচেয়ে বেশি, এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও ক্ষতির শিকার হয় এর ফলে। বাংলাদেশে শব্দ, বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণ বর্তমানে অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। নানাভাবে আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে শব্দদূষণ একটি। বর্তমানে ঢাকা শহরের শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশঙ্কাজনক। এ সমস্যাগুলো মানুষেরই সৃষ্টি। আমদের একটু সচেতনতা এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বাড়িতে, অফিস, রাস্তাঘাট এমনকি বিনোদনের সময়ও আমরা বিভিন্নভাবে শব্দদূষণের শিকার হয়, যা সচেতনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। বাংলাদেশেও বর্তমানে পরিবেশ দূষণ রোধের বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি অনেক ব্যক্তি, বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি তথা পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছে। পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যা জনস্বার্থ ও পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। সামাজিক জীবনে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এবং সবুজ বনায়নের বিষয়গুলোতে অনেক উদ্যোগ নেয়া হলেও শব্দদূষণ সম্পর্কে উদ্যোগ সীমিত। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার নদী ও ঢাকার খালের পানি প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে। নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সবুজ বেষ্টনী গড়তে মুজিববর্ষে এক কোটি বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। শব্দদূষণ নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেই। শব্দদূষণের কারণেও মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন শব্দদূষণ নিয়ে কাজ করলেও তা সমস্যার তুলনায় তা খুবই সামান্য। ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধ, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধকরণসহ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। শব্দদূষণের কিছু মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত এবং সে সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত গ্রহণ এবং তা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কিছু সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হবে। শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশেও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করেছে। বিধিমালা বাস্তবায়নে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে শব্দদূষণের সমস্যা থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা প্রয়োজন। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবেল।

বাংলাদেশ শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এর আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজে শব্দদূষণকারী যন্ত্র চালানো যাবে না, আবাসিক এলাকার সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না এবং আবদ্ধ কোন স্থানে শব্দ করলেও, শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বড় শহরগুলোতে সারা রাতই নির্মাণকাজ চলে। শব্দদূষণের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সচিবালয় এলাকাকে শব্দদূষণমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা শহরের শব্দের পরিমাণ বেশি এলাকাকে প্রতীকী হর্নমুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে। কিছু এলাকাকে ‘নো হর্ন জোন’ হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গাড়িতে বেশি শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রাফিক পুলিশ তৎপর রয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। শব্দদূষণ রোধে সরকার আন্তরিক ও তৎপর। সরকারের উদ্যোগ এবং সবার সচেতনতায় শব্দদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব।

করোনাভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারীতে লকডাউনের ফলে দেশে শব্দদূষণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। রাস্তায় গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল, ছিল না ঢাকার চিরচেনা ট্রাফিক জ্যাম। পরিবেশ ছিল নির্মল। করোনায় মানুষের জীবন-যাত্রায় ছন্দপতন ঘটলেও পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ সবই প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিল।

শব্দদূষণ নীরব ঘাতক। শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে, সেখানে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাত ১০টার পর কোনভাবেই উচ্চ শব্দের কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এক্ষেত্রে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবে। পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ারও বিধান রয়েছে।

শব্দদূষণ রোধে সচেতনতার পাশাপাশি সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল হতে হবে। অযথা হর্ন বাজানো, সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান-বাজনা বাজানো থেকে বিরত থাকতে হবে। শব্দদূষণ বিষয়ে জনগণের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শব্দদূষণ মানুষের শারীরিক নানা সমস্যাসহ কর্মস্পৃহা নষ্ট করে, কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই শব্দদূষণে বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যমে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে ৯৯৯-এ কল করে প্রতিকার পাওয়া যায়। এসব উদ্যোগ শব্দদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

শব্দদূষণ রোধে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

গাজী শরিফুল হাসান

শনিবার, ২২ মে ২০২১

আমরা যা কিছু শুনি তাই শব্দ। শব্দ এক প্রকার শক্তি। কোন একটি উৎস থেকে শব্দ তৈরি হয়ে বায়ুবীয় অথবা কঠিন বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। শব্দ মানুষের কানের শ্রুতি-গ্রাহক পর্দায় আঘাত করে মস্তিষ্কে বিশেষ অনুভূতির জন্ম দেয়। তখনই আমরা শুনতে পাই। কোন কিছু থেকে সৃষ্ট তীব্র শব্দ যখন অস্বাভাবিক মাত্রায় প্রবাহিত হয়ে শ্রবণশক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তাকেই শব্দদূষণ বলে। আকস্মিক তীব্র শব্দে অন্তকর্ণের ক্ষতির ফলে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। তাই শব্দদূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক গভীর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ১ জন বধিরতা নিয়ে জন্মায়। শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ, যার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচার-আচরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

দুই প্রজন্মের মানুষ শব্দদূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার। শিশু, যারা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ এবং বৃদ্ধ যারা আমাদের পরিবারকে সংগঠিত করে রাখে। এর পাশাপাশি গর্ভবতী নারীরাও রয়েছেন, যারা শব্দদূষণের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, শারীরিক নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক অবসাদগ্রস্ততাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে শব্দ দূষণের কারণে।

শহরে সাধারণত যানবাহন ও গাড়ির হর্নের শব্দই শব্দদূষণের মূল কারণ। তবে এর বাইরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার, নির্মাণ কাজজনিত শব্দ ইত্যাদি শব্দদূষণের বড় কারণ। উচ্চমাত্রার শব্দ হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ঝুঁকি সবেচেয়ে বেশি, এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও ক্ষতির শিকার হয় এর ফলে। বাংলাদেশে শব্দ, বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণ বর্তমানে অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। নানাভাবে আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে শব্দদূষণ একটি। বর্তমানে ঢাকা শহরের শব্দদূষণ যে পর্যায়ে অবস্থান করছে তা খুবই আশঙ্কাজনক। এ সমস্যাগুলো মানুষেরই সৃষ্টি। আমদের একটু সচেতনতা এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বাড়িতে, অফিস, রাস্তাঘাট এমনকি বিনোদনের সময়ও আমরা বিভিন্নভাবে শব্দদূষণের শিকার হয়, যা সচেতনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণ রোধে সোচ্চার। বাংলাদেশেও বর্তমানে পরিবেশ দূষণ রোধের বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি অনেক ব্যক্তি, বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি তথা পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছে। পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যা জনস্বার্থ ও পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। সামাজিক জীবনে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এবং সবুজ বনায়নের বিষয়গুলোতে অনেক উদ্যোগ নেয়া হলেও শব্দদূষণ সম্পর্কে উদ্যোগ সীমিত। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার নদী ও ঢাকার খালের পানি প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে। নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সবুজ বেষ্টনী গড়তে মুজিববর্ষে এক কোটি বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। শব্দদূষণ নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেই। শব্দদূষণের কারণেও মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন শব্দদূষণ নিয়ে কাজ করলেও তা সমস্যার তুলনায় তা খুবই সামান্য। ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ, বায়ুদূষণ রোধ, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধকরণসহ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। শব্দদূষণের কিছু মৌলিক সমস্যা চিহ্নিত এবং সে সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত গ্রহণ এবং তা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কিছু সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হবে। শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশেও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করেছে। বিধিমালা বাস্তবায়নে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে শব্দদূষণের সমস্যা থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা প্রয়োজন। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবেল।

বাংলাদেশ শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এর আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজে শব্দদূষণকারী যন্ত্র চালানো যাবে না, আবাসিক এলাকার সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না এবং আবদ্ধ কোন স্থানে শব্দ করলেও, শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বড় শহরগুলোতে সারা রাতই নির্মাণকাজ চলে। শব্দদূষণের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সচিবালয় এলাকাকে শব্দদূষণমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা শহরের শব্দের পরিমাণ বেশি এলাকাকে প্রতীকী হর্নমুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে। কিছু এলাকাকে ‘নো হর্ন জোন’ হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গাড়িতে বেশি শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ট্রাফিক পুলিশ তৎপর রয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। শব্দদূষণ রোধে সরকার আন্তরিক ও তৎপর। সরকারের উদ্যোগ এবং সবার সচেতনতায় শব্দদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব।

করোনাভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারীতে লকডাউনের ফলে দেশে শব্দদূষণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। রাস্তায় গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল, ছিল না ঢাকার চিরচেনা ট্রাফিক জ্যাম। পরিবেশ ছিল নির্মল। করোনায় মানুষের জীবন-যাত্রায় ছন্দপতন ঘটলেও পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ সবই প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিল।

শব্দদূষণ নীরব ঘাতক। শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে, সেখানে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাত ১০টার পর কোনভাবেই উচ্চ শব্দের কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এক্ষেত্রে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবে। পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ারও বিধান রয়েছে।

শব্দদূষণ রোধে সচেতনতার পাশাপাশি সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল হতে হবে। অযথা হর্ন বাজানো, সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান-বাজনা বাজানো থেকে বিরত থাকতে হবে। শব্দদূষণ বিষয়ে জনগণের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শব্দদূষণ মানুষের শারীরিক নানা সমস্যাসহ কর্মস্পৃহা নষ্ট করে, কর্মক্ষমতা কমে যায় এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই শব্দদূষণে বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যমে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে ৯৯৯-এ কল করে প্রতিকার পাওয়া যায়। এসব উদ্যোগ শব্দদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

back to top