alt

মুক্ত আলোচনা

ডায়াবেটিস গর্ভবতী মায়েদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ

মোহাম্মদ ইশতিয়াক

: শনিবার, ০৫ জুন ২০২১

ঝর্ণা বেগমের সন্তান ধারণের পর পরই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। সন্তান ধারনের পুরো সময় তাকে ডাক্তারের নির্দেশনা মতো চলতে হয়েছে, কখনো কখনো ইনসুলিন নিতে হয়েছে। শারীরিক সমস্যা বিবেচনা করে তিনি ঝুঁকি না নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেছেন। ফলে সন্তানের ওজন হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কম। প্রায় বিশ দিন ইনকিউবেটরে থাকতে হয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির অসুখ বিসুখও বেড়েছে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস মা ও শিশু উভয়ের জন্যই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বদাই সাবধান থাকতে হবে।

তনিমা শহরিন ২৮। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা। তিনি জানান, গর্ভাবস্থায় ওজন ছিল বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তিনি প্রথম জানতে পারেন, সন্তান গর্ভধারনের আট সপ্তাহের মাথায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে। শুরুতেই তিনি নিয়মিত ইনসুলিন নিয়েছেন। সেই সঙ্গে মেনে চলেছেন, সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খেয়েছে এবং হালকা শারীরিক ব্যায়মও করেছেন। নিয়ম মেনে চলার সুফল পেয়েছেন। সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

সবচেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে প্রায় ৫০ কোটি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের মতে, প্রতি দুজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে একজন জানেই না সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের আকস্মিক মৃত্যুর আশঙ্কা একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর পঞ্চম কারণ হবে ডায়াবেটিস। আর তখন মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকদের মতে, বংশে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে, অধিক ওজন, বয়স ২৮ বছরের বেশি এমন মায়েদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত ২০ বা ২৪ সপ্তাহের পর যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। আগে থেকে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন মায়েদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে মায়ের একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি হতে পারে। সময়ের আগে প্রসববেদনা শুরু বা অপরিপক্ব সন্তন প্রসবের ঝুঁকি থাকে। মায়ের দেহ থেকে গর্ভের সন্তানের দেহে গর্ভফুলের মাধ্যমে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভের সন্তানের ওজন অনেক কম অথবা অনেক বেশি (ম্যাক্রোসেমিয়া) হতে পারে। জন্মের পর সন্তানের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট এবং দেহে তাপমাত্রা বজায় রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের ৫০ শতাংশের সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস আর থাকে না।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসেব মতে, বছরে দেশে মোট সন্তান প্রসব হয় ২১ লাখ ৯০ হাজার। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ১০ ভাগ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনেক সময় গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার হার বেড়ে যায় এবং সন্তন প্রসবের পর তা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। একে গর্ভকালীন বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলে। গর্ভবতী নারীরা সচারাচর গর্ভাবস্থার ৮ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তবে শুরুর দিকেও হতে পারেন। খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫ দশমিক ২ হলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা হয়। এটা থাকতে হবে খালি পেটে ৫ দশমিক ১-এর নিচে এবং খাওয়ার পর ৭-এর নিচে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে তেমন নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝাপসা দৃষ্টি, ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত ক্লান্তি, অতিরিক্ত পানির তৃষ্ণা, বমি বমি ভাব অথবা বমি করা ইত্যাদি লক্ষণগুলো ডায়াবেটিস হলে প্রকাশ পায়। আবার ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে গেলে এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার একটি বিশেষ লক্ষণ।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যবহার করতে হবে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ঔষধ যত কম খাওয়া যা ততই ভালো। যাদের গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে এবং মুখে খাওয়ার ঔষধ ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ খাওয়া ঔষধ বন্ধ করে ইনসুলিন ব্যবহার শুরু করতে হবে।

গর্ভাবস্থায় সকলেরই সঠিক পরিমাণে ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে রোগীকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। সাধারণভাবে খাদ্য তালিকায় দৈনিক ৪০ ভাগ আমিষ, ৪০ ভাগ শর্করা ও ২০ ভাগ চর্বি জাতীয় খাদ্য বা ফ্যাট থাকতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ অথবা একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীদের গর্ভাবস্থায় নিয়মিতভাবে হাল্কা হাঁটার অভ্যাস থাকতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো ভারি ব্যয়াম করা ঠিক নয়। নিয়মিতভাবে রক্তের সুগার পরীক্ষা ও ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা পরিমাপ করাও একজন গর্ভবতী ডায়াবেটিক নারীসহ সকল ডায়াবেটিক রোগীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো জটিলতা না থাকলে একজন গর্ভবতী মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েও প্রসব স্বাভাবিকভাবে হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলেই সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রসবের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।

ভালো স্বাস্থ্য সুস্থ জীবনের প্রতীক। ডায়াবেটিক রোগের বিষয়ে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার দেশব্যাপী স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও নার্স নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। করোনাকালেও সরকার দুই হাজার ডাক্তার এবং পাঁচ হাজারের বেশি নার্স নিয়োগ দিয়েছে। সরকার গ্রামীণ জনপদের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। যে সকল গর্ভবতী নারী কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রসবপূর্বক ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারীগণ তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও সরকার টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিক রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেওয়ার চিন্তা করেছে।

সরকার সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তবে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতে পারলে ডায়াবেটিসের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বোপরি ডায়াবেটিস একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে মা ও সন্তানের জটিলতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। প্রয়োজন সকলের সচেতনতা, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া।

[লেখক : চিকিৎসক]

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

ডায়াবেটিস গর্ভবতী মায়েদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ

মোহাম্মদ ইশতিয়াক

শনিবার, ০৫ জুন ২০২১

ঝর্ণা বেগমের সন্তান ধারণের পর পরই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। সন্তান ধারনের পুরো সময় তাকে ডাক্তারের নির্দেশনা মতো চলতে হয়েছে, কখনো কখনো ইনসুলিন নিতে হয়েছে। শারীরিক সমস্যা বিবেচনা করে তিনি ঝুঁকি না নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করেছেন। ফলে সন্তানের ওজন হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কম। প্রায় বিশ দিন ইনকিউবেটরে থাকতে হয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির অসুখ বিসুখও বেড়েছে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস মা ও শিশু উভয়ের জন্যই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বদাই সাবধান থাকতে হবে।

তনিমা শহরিন ২৮। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা। তিনি জানান, গর্ভাবস্থায় ওজন ছিল বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তিনি প্রথম জানতে পারেন, সন্তান গর্ভধারনের আট সপ্তাহের মাথায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে। শুরুতেই তিনি নিয়মিত ইনসুলিন নিয়েছেন। সেই সঙ্গে মেনে চলেছেন, সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খেয়েছে এবং হালকা শারীরিক ব্যায়মও করেছেন। নিয়ম মেনে চলার সুফল পেয়েছেন। সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

সবচেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে প্রায় ৫০ কোটি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের মতে, প্রতি দুজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে একজন জানেই না সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের আকস্মিক মৃত্যুর আশঙ্কা একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর পঞ্চম কারণ হবে ডায়াবেটিস। আর তখন মৃত্যু বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকদের মতে, বংশে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে, অধিক ওজন, বয়স ২৮ বছরের বেশি এমন মায়েদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত ২০ বা ২৪ সপ্তাহের পর যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। আগে থেকে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন মায়েদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে মায়ের একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি হতে পারে। সময়ের আগে প্রসববেদনা শুরু বা অপরিপক্ব সন্তন প্রসবের ঝুঁকি থাকে। মায়ের দেহ থেকে গর্ভের সন্তানের দেহে গর্ভফুলের মাধ্যমে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভের সন্তানের ওজন অনেক কম অথবা অনেক বেশি (ম্যাক্রোসেমিয়া) হতে পারে। জন্মের পর সন্তানের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট এবং দেহে তাপমাত্রা বজায় রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের ৫০ শতাংশের সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস আর থাকে না।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসেব মতে, বছরে দেশে মোট সন্তান প্রসব হয় ২১ লাখ ৯০ হাজার। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ১০ ভাগ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনেক সময় গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার হার বেড়ে যায় এবং সন্তন প্রসবের পর তা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। একে গর্ভকালীন বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলে। গর্ভবতী নারীরা সচারাচর গর্ভাবস্থার ৮ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তবে শুরুর দিকেও হতে পারেন। খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫ দশমিক ২ হলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা হয়। এটা থাকতে হবে খালি পেটে ৫ দশমিক ১-এর নিচে এবং খাওয়ার পর ৭-এর নিচে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে তেমন নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝাপসা দৃষ্টি, ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত ক্লান্তি, অতিরিক্ত পানির তৃষ্ণা, বমি বমি ভাব অথবা বমি করা ইত্যাদি লক্ষণগুলো ডায়াবেটিস হলে প্রকাশ পায়। আবার ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে গেলে এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার একটি বিশেষ লক্ষণ।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যবহার করতে হবে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ঔষধ যত কম খাওয়া যা ততই ভালো। যাদের গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে এবং মুখে খাওয়ার ঔষধ ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ খাওয়া ঔষধ বন্ধ করে ইনসুলিন ব্যবহার শুরু করতে হবে।

গর্ভাবস্থায় সকলেরই সঠিক পরিমাণে ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে রোগীকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। সাধারণভাবে খাদ্য তালিকায় দৈনিক ৪০ ভাগ আমিষ, ৪০ ভাগ শর্করা ও ২০ ভাগ চর্বি জাতীয় খাদ্য বা ফ্যাট থাকতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ অথবা একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীদের গর্ভাবস্থায় নিয়মিতভাবে হাল্কা হাঁটার অভ্যাস থাকতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো ভারি ব্যয়াম করা ঠিক নয়। নিয়মিতভাবে রক্তের সুগার পরীক্ষা ও ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা পরিমাপ করাও একজন গর্ভবতী ডায়াবেটিক নারীসহ সকল ডায়াবেটিক রোগীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো জটিলতা না থাকলে একজন গর্ভবতী মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েও প্রসব স্বাভাবিকভাবে হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলেই সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রসবের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।

ভালো স্বাস্থ্য সুস্থ জীবনের প্রতীক। ডায়াবেটিক রোগের বিষয়ে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার দেশব্যাপী স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও নার্স নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। করোনাকালেও সরকার দুই হাজার ডাক্তার এবং পাঁচ হাজারের বেশি নার্স নিয়োগ দিয়েছে। সরকার গ্রামীণ জনপদের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। যে সকল গর্ভবতী নারী কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রসবপূর্বক ও প্রসবোত্তর সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারীগণ তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও সরকার টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিক রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেওয়ার চিন্তা করেছে।

সরকার সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তবে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতে পারলে ডায়াবেটিসের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বোপরি ডায়াবেটিস একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে মা ও সন্তানের জটিলতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। প্রয়োজন সকলের সচেতনতা, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া।

[লেখক : চিকিৎসক]

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

back to top