কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানায় র্যাবের অভিযান, নকল ওষুধ জব্দ -সংবাদ
দেশে ভেজাল, মানহীন ওষুধ উৎপাদন বন্ধই হচ্ছে না। অথচ মানহীন ওষুধের কারণে অনেকে রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে আরও অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এমনই এক ওষুধ কারখানা গত তিন বছর ধরে কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করছে। সেখানে একটি বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তারা এসব ওষুধ তৈরি করে চলেছে।
ভেজাল ওষুধ কারখানা, ৩ বছর ধরে ১৭ ধরনের ওষুধ তৈরি ও বিক্রি
নকল ওষুধগুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা
ভেজাল ওষুধে রোগীর কিডনি বিকলসহ মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে: ডা. আয়শা
বেশি দামের ওষুধ নকল হচ্ছে, চিকিৎসায় কাজ হয় না: ডা. আখতারুজ্জামান
অবশেষে র্যাব ও ওষুধ প্রশাসনের অভিযানে তারা ধরা পড়লো। র্যাব-১০-এর সহকারী পরিচালক তাপস কর্মকার এ তথ্য নিশ্চিত করেন। অভিযানে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ ও ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক হাসিবুর রহমান ছিলেন।
সময়ে সময়ে এমন অনেক কোম্পানির ওষুধই ভেজাল ও মানবহির্ভূত ধরা পড়ে। এসব ওষুধ ব্যবহার না করতে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু এই বার্তা যাদের কাছে পৌঁছানোর দরকার বেশি, সেই ওষুধ বিক্রেতারা বিষয়টি না জানার কথা বলেছেন। এ কারণে তাদের কাছ থেকে সাধারণ খুচরা ক্রেতারা এসব ওষুধ কিনে ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন।
র্যাবের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের শুভ্যাঢা এলাকায় অনুমোদনহীন মেয়াদোর্ত্তীর্ণ নকল, ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। সম্প্রতি র্যাব অভিযান চালিয়ে ৬ তলা ভবনের নিচ তলা, দোতলা ও তৃতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে ১৭ ধরনেরও ভেজাল ওষুধ উদ্ধার করেছে।
তাৎক্ষণিকভাবে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ভেজাল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে জয়মন্ডল নামে একজনকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও বাবুল মিয়া নামে একজনকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা এবং বায়েজিদ নামে একজনের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। আর অভিযানের সময় উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে। আর জনস্বার্থে ভেজাল ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে র্যাব জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিবেন।
অভিযানে থাকা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ জানায়, কেরানীগঞ্জের ওই নকল করখানায় ১৭ ধরনের ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট নকল হত। তাদের কারখানার ওষুধ প্রশাসনের কোনো অনুমোদন ছিল না। অনুমোদনহীন অবস্থায় এসব ওষুধ সাপ্লিমেন্ট তৈরি করতো। অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন।
গত ৪ নভেম্বর দুপুর ১২টা থেকে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে তারা এ অভিযান চালিয়েছিলেন। র্যাব জানায়, তাদের ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। আরও নকলবাজদের সন্ধানে ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা গোপনে তথ্য সংগ্রহে কাজ করছেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, উদ্ধারকৃত ভেজাল ওষুধের মোড়কে লেখা ছিল। উদ্ধারকৃত ওষুধগুলো খেলে ডায়বেটিস ও কিডনি রোগসহ নানা রোগ ভালো হয়ে যায়। কিন্তু অভিযানের সময় জিজ্ঞাসাবাদে নকলবাজরা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।
জানা গেছে, এসব ভেজাল ওষুধ যেখানেই তৈরি করা হোক না কেন, তা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়া হয়। কখনো কখনো লোক মারফতও ট্রেনে, বাসে পৌঁছে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
গাজীপুর জেলার খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জানায়, চালু ওষুধগুলো মাঝে মধ্যে নকল দেখা যায়। এর মধ্যে দামি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল আছে। সংক্ষিপ্ত নাম দিয়ে দোকানে ওসব ওষুধ বিক্রি করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ঔষধ প্রশাসন কী করছে
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের হোমপেইজে একটি মেনুর লিঙ্কে ক্লিক করলে আসে সতর্কতা দেয়া ওষুধের তালিকা। এটি রয়েছে ইংরেজি ভাষায়। সেখানে অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে বাংলা পিডিএফ ফাইল রয়েছে, যা ডাউনলোড করে পড়তে হবে।
রাজধানীর বেশ কয়েকজন খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী এবং ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউ এভাবে ওয়েবসাইটে ঢুকে সতর্কতা দেখেননি। সরকারি নিয়মানুযায়ী ত্রুটির কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারকের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এটিও তাদের চোখে পড়ে না বললেই চলে।
ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি (বিসিডিএস) নেতা মোহাম্মদ আল-আমিন খান জানায়- নকল, ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে আমরা কাজ করছি। আর মানুষ যাতে সঠিক ওষুধ পায় তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বলে জানান। নকলবাজদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করলে মানুষ উপকৃত হবে।
এ সম্পর্কে মহাখালী ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানায়, কেরানীগঞ্জে বড় ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে। র্যাবের সহায়তা এই অভিযান চালানো হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে তাদের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে তদারকি ও তৎপরতা রয়েছে। এর আগেও নকল ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে।
নকল ভেজাল ওষুধ সম্পর্কে রাজধানীর শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানায়, রোগীদেরকে নকল ও ভেজাল ওষুধ খাওয়ালে কিডনি বিকল থেকে শুরু করে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেস্থেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক ডা. এ কে এম আখতারুজ্জামান বলেন, সাধারণত ক্যান্সারসহ বেশি দামের ওষুধ নকল হচ্ছে।
ভেজাল ওষুখ খাইলে কাজ হয় না। ভেজাল ওষুধ আটা-ময়দাসহ অন্যান্য কেমিক্যাল নিয়ে তৈরি করা হয়। এতে রোগীর উপকার তো হয় না বরং ক্ষতিই বেশি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অপরাধবিষয়ক সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী জানায়, ওষুধ নকল ভেজাল করে বিক্রি করা জঘন্য অপরাধ। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। ওষুধ আইন আরও কঠিন করে তাদের সাজা দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশের একজন ডিআইজি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এই ধরনের অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। এজন্য সঠিক আইনের প্রয়োগ দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভেজাল প্যারসিটামল সিরাপ সেবনের কারণে ২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কিডনি নষ্ট হয়ে ২৮ শিশু মারা যায়। সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এ খবর প্রকাশ হয়। এরপর গত ২২ জুলাই কারখানাটি বন্ধ করে দেয় ওষুধ প্রশাসন। এ ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্যারসিটামল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘রিড ফার্মা’ সিরাপে বিষাক্ত পদার্থ ডাই-ইথানল গ্লাইকল ব্যবহার করছিল।
উৎপাদন ব্যয় কমাতেই তারা প্রোপাইলিন গ্লাইকনের পরিবর্তে বিষাক্ত ডাই-ইথানল গ্লাইকল ব্যবহার করে, যা শিশুদের মৃত্যু ডেকে আনে। সে সময় রিড ফার্মার রিডাপ্লে. (ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স সিরাপ) এবং টেমসেট (প্যারাসিটামল সাসপেনশন) নামে দুটি ওষুধ নিষিদ্ধও করা হয়।
এই ঘটনায় মামলা হয়। কিন্তু দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে মামলার আসামি রিড ফার্মার মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান, মিজানুর রহমানের স্ত্রী রিড ফার্মার পরিচালক শিউলি রহমান, পরিচালক আবদুল গনি, ফার্মাসিস্ট মাহবুবুল ইসলাম ও এনামুল হক ড্রাগ আদালত থেকে খালাস পান, যা বিস্মিত করে সংশ্লিষ্টদের। যদিও পরে আপিল করা হয়।
ভেজাল ও নকল ওষুধ ঠেকাতে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি দেশের ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এর মধ্যে ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তারা। এছাড়া ২০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয় আর ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করার কথা বলা হয়। কিন্তু ওধুধ প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। এভাবে কিছু কাজ হলেও থামছে না নকল ওষুধ তৈরির অপতৎপরতা।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানায় র্যাবের অভিযান, নকল ওষুধ জব্দ -সংবাদ
শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
দেশে ভেজাল, মানহীন ওষুধ উৎপাদন বন্ধই হচ্ছে না। অথচ মানহীন ওষুধের কারণে অনেকে রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে আরও অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এমনই এক ওষুধ কারখানা গত তিন বছর ধরে কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করছে। সেখানে একটি বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তারা এসব ওষুধ তৈরি করে চলেছে।
ভেজাল ওষুধ কারখানা, ৩ বছর ধরে ১৭ ধরনের ওষুধ তৈরি ও বিক্রি
নকল ওষুধগুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা
ভেজাল ওষুধে রোগীর কিডনি বিকলসহ মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে: ডা. আয়শা
বেশি দামের ওষুধ নকল হচ্ছে, চিকিৎসায় কাজ হয় না: ডা. আখতারুজ্জামান
অবশেষে র্যাব ও ওষুধ প্রশাসনের অভিযানে তারা ধরা পড়লো। র্যাব-১০-এর সহকারী পরিচালক তাপস কর্মকার এ তথ্য নিশ্চিত করেন। অভিযানে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ ও ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক হাসিবুর রহমান ছিলেন।
সময়ে সময়ে এমন অনেক কোম্পানির ওষুধই ভেজাল ও মানবহির্ভূত ধরা পড়ে। এসব ওষুধ ব্যবহার না করতে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়। কিন্তু এই বার্তা যাদের কাছে পৌঁছানোর দরকার বেশি, সেই ওষুধ বিক্রেতারা বিষয়টি না জানার কথা বলেছেন। এ কারণে তাদের কাছ থেকে সাধারণ খুচরা ক্রেতারা এসব ওষুধ কিনে ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন।
র্যাবের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের শুভ্যাঢা এলাকায় অনুমোদনহীন মেয়াদোর্ত্তীর্ণ নকল, ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। সম্প্রতি র্যাব অভিযান চালিয়ে ৬ তলা ভবনের নিচ তলা, দোতলা ও তৃতীয় তলায় অভিযান চালিয়ে ১৭ ধরনেরও ভেজাল ওষুধ উদ্ধার করেছে।
তাৎক্ষণিকভাবে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ভেজাল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে জয়মন্ডল নামে একজনকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও বাবুল মিয়া নামে একজনকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা এবং বায়েজিদ নামে একজনের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। আর অভিযানের সময় উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, এই ধরনের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে। আর জনস্বার্থে ভেজাল ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে র্যাব জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিবেন।
অভিযানে থাকা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ জানায়, কেরানীগঞ্জের ওই নকল করখানায় ১৭ ধরনের ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট নকল হত। তাদের কারখানার ওষুধ প্রশাসনের কোনো অনুমোদন ছিল না। অনুমোদনহীন অবস্থায় এসব ওষুধ সাপ্লিমেন্ট তৈরি করতো। অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন।
গত ৪ নভেম্বর দুপুর ১২টা থেকে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে তারা এ অভিযান চালিয়েছিলেন। র্যাব জানায়, তাদের ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। আরও নকলবাজদের সন্ধানে ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা গোপনে তথ্য সংগ্রহে কাজ করছেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, উদ্ধারকৃত ভেজাল ওষুধের মোড়কে লেখা ছিল। উদ্ধারকৃত ওষুধগুলো খেলে ডায়বেটিস ও কিডনি রোগসহ নানা রোগ ভালো হয়ে যায়। কিন্তু অভিযানের সময় জিজ্ঞাসাবাদে নকলবাজরা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।
জানা গেছে, এসব ভেজাল ওষুধ যেখানেই তৈরি করা হোক না কেন, তা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়া হয়। কখনো কখনো লোক মারফতও ট্রেনে, বাসে পৌঁছে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
গাজীপুর জেলার খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জানায়, চালু ওষুধগুলো মাঝে মধ্যে নকল দেখা যায়। এর মধ্যে দামি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল আছে। সংক্ষিপ্ত নাম দিয়ে দোকানে ওসব ওষুধ বিক্রি করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ঔষধ প্রশাসন কী করছে
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের হোমপেইজে একটি মেনুর লিঙ্কে ক্লিক করলে আসে সতর্কতা দেয়া ওষুধের তালিকা। এটি রয়েছে ইংরেজি ভাষায়। সেখানে অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে বাংলা পিডিএফ ফাইল রয়েছে, যা ডাউনলোড করে পড়তে হবে।
রাজধানীর বেশ কয়েকজন খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী এবং ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউ এভাবে ওয়েবসাইটে ঢুকে সতর্কতা দেখেননি। সরকারি নিয়মানুযায়ী ত্রুটির কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারকের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এটিও তাদের চোখে পড়ে না বললেই চলে।
ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি (বিসিডিএস) নেতা মোহাম্মদ আল-আমিন খান জানায়- নকল, ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে আমরা কাজ করছি। আর মানুষ যাতে সঠিক ওষুধ পায় তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বলে জানান। নকলবাজদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করলে মানুষ উপকৃত হবে।
এ সম্পর্কে মহাখালী ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানায়, কেরানীগঞ্জে বড় ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে। র্যাবের সহায়তা এই অভিযান চালানো হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে তাদের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে তদারকি ও তৎপরতা রয়েছে। এর আগেও নকল ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে।
নকল ভেজাল ওষুধ সম্পর্কে রাজধানীর শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানায়, রোগীদেরকে নকল ও ভেজাল ওষুধ খাওয়ালে কিডনি বিকল থেকে শুরু করে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেস্থেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক ডা. এ কে এম আখতারুজ্জামান বলেন, সাধারণত ক্যান্সারসহ বেশি দামের ওষুধ নকল হচ্ছে।
ভেজাল ওষুখ খাইলে কাজ হয় না। ভেজাল ওষুধ আটা-ময়দাসহ অন্যান্য কেমিক্যাল নিয়ে তৈরি করা হয়। এতে রোগীর উপকার তো হয় না বরং ক্ষতিই বেশি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অপরাধবিষয়ক সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী জানায়, ওষুধ নকল ভেজাল করে বিক্রি করা জঘন্য অপরাধ। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। ওষুধ আইন আরও কঠিন করে তাদের সাজা দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশের একজন ডিআইজি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এই ধরনের অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। এজন্য সঠিক আইনের প্রয়োগ দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভেজাল প্যারসিটামল সিরাপ সেবনের কারণে ২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কিডনি নষ্ট হয়ে ২৮ শিশু মারা যায়। সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এ খবর প্রকাশ হয়। এরপর গত ২২ জুলাই কারখানাটি বন্ধ করে দেয় ওষুধ প্রশাসন। এ ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্যারসিটামল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘রিড ফার্মা’ সিরাপে বিষাক্ত পদার্থ ডাই-ইথানল গ্লাইকল ব্যবহার করছিল।
উৎপাদন ব্যয় কমাতেই তারা প্রোপাইলিন গ্লাইকনের পরিবর্তে বিষাক্ত ডাই-ইথানল গ্লাইকল ব্যবহার করে, যা শিশুদের মৃত্যু ডেকে আনে। সে সময় রিড ফার্মার রিডাপ্লে. (ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স সিরাপ) এবং টেমসেট (প্যারাসিটামল সাসপেনশন) নামে দুটি ওষুধ নিষিদ্ধও করা হয়।
এই ঘটনায় মামলা হয়। কিন্তু দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে মামলার আসামি রিড ফার্মার মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান, মিজানুর রহমানের স্ত্রী রিড ফার্মার পরিচালক শিউলি রহমান, পরিচালক আবদুল গনি, ফার্মাসিস্ট মাহবুবুল ইসলাম ও এনামুল হক ড্রাগ আদালত থেকে খালাস পান, যা বিস্মিত করে সংশ্লিষ্টদের। যদিও পরে আপিল করা হয়।
ভেজাল ও নকল ওষুধ ঠেকাতে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি দেশের ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এর মধ্যে ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তারা। এছাড়া ২০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয় আর ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করার কথা বলা হয়। কিন্তু ওধুধ প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। এভাবে কিছু কাজ হলেও থামছে না নকল ওষুধ তৈরির অপতৎপরতা।