নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন কমান্ড এরিয়ার স্পর্শকাতর স্থান সিলট্রাপের বালু অপসারণে শক্তিশালী অবৈধ বোমা মেশিন বসিয়ে খননের কাজ চলছে। ঝুঁকিতে তিস্তা ব্যারেজ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি অর্থবছরের শুকনো মৌসুমে আসন্ন ইরি চাষাবাদে সুষ্ঠুভাবে পানি সেচ প্রদানের লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারেজের প্রধান সেচ ক্যানেলের শুরুতেই সিলট্রাপের বালু অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। ডিমলার ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ লাখ ৮৫ হাজার ঘন মিটার বালু অপসারণে দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে খননের কাজ শুরু করেছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, দেশের উত্তর অঞ্চলের কৃষকদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে বিগত ১৯৭৯ সালে শুরু করে ১৯৯০ সালে তিস্তা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। তৎকালীন নির্মাণ কাজে ব্যয় করা হয় ২ হাজার ৫ শত কোটি টাকা।
ডালিয়ায় তিস্তা নদীর ওপর দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ কাজ শুরু করে ১৯৯০ সালে শেষ করা হয়। সে সময়ে শুকনো মৌসুমে ইরি চাষাবাদের লক্ষ্যে ৬ লাখ কিউসেক পানি চাষাবাদ জমিতে সেচের জন্য তিস্তার পানি সরবরাহে ব্যারেজের উজানে পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য জলকপাট সম্বলিত আরও একটি প্রধান ক্যানেল ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। তিস্তার বালু যুক্ত পানির গতি বন্ধ হয়ে মিশ্রিত বালু নিচে জমে পরিষ্কার পানি প্রধান সেচ ক্যানেল দিয়ে প্রবাহিত করে ইরি চাষাবাদের জন্য। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীসহ ৭টি জেলার ৩৫টি উপজেলায় চাষাবাদের জন্য তৎকালীন সরকার পরিকল্পনা করে ব্যারেজ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরহুম এইচ এম এরশাদ দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারেজকে সেচ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে তিস্তা ব্যারেজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ব্যারেজ নির্মাণকালীন সময়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে তিস্তার পানি ইরি চাষাবাদ কাজের ব্যবহার সরবরাহে মূল ক্যানেলের শুরুতে তিস্তার পলিযুক্ত বালু মুক্ত করার জন্য ৪৫ হেক্টর জমি জুড়ে সিলট্রাপ তৈরি করা হয়।
তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পর থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে তিস্তা নদীর পানি সরবরাহ করে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তিস্তা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সেচ কার্যক্রম পরিচালনায় তিস্তা নদীর পানি সরবরাহে সিলট্রাপে জমে থাকা পলিযুক্ত বালু অপসারণ কাজে ব্যাবহারের জন্য পরবর্তী সময়ে কানাডা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৩টি ড্রেজার মেশিন ক্রয় করে নিয়ে আসা হয়। সরবরাহকৃত ড্রেজার মেশিন ৩টি ইতোমধ্যে বিকল হয়ে পড়ায় প্রতি ২/৩ বছর অন্তর অন্তর শুকনো মৌসুমে সেচ কার্যক্রম শুরুর আগে সিলট্রাপ হতে পলিমিশ্রিত বালু অপসারণ করে আসছেন পাউবো কর্তৃপক্ষ। গত ২০২২ সালে পলিমিশ্রিত বালু অপসারণ করা হলেও গত বর্ষা মৌসুমে এবং সম্প্রতি তিস্তা নদীর উজানে ভারত থেকে ধেয়ে আসা প্রবল স্রোত ও ভয়াবহ বন্যার পানির কারণে সিলট্রাপে পলিমিশ্রিত বালু পুনরায় জমে চর জেগে অকার্যকর হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অকার্যকর সিলট্রাপকে কার্যকর ও সচল করতে চলতি অর্থবছরে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ ৪ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার ২৮২ টাকা ব্যয় বরাদ্দে ২ লাখ ৮৫ হাজার ঘন মিটার পলিযুক্ত বালু অপসারণে ২ জন ঠিকাদারকে নিয়োগ করে।
এর মধ্যে ইউনাইটেড ব্রাদার্স রংপুরের অধীনে ১ লাখ ৭০ হাজার ঘন মিটার পলিযুক্ত বালু অপসারণের অনুকূলে ২ কোটি ৬২ লাখ ২২ হাজার ২৮২ টাকা এবং শামিমুর রহমান সিরাজগঞ্জের অধীনে ১ লাখ ১৫ হাজার ঘন মিটার পলিযুক্ত বালু অপসারণের অনুকূলে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫৪৭ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ব্রাদার্সের পক্ষে ২০/২৫টি বোমা মেশিন লাগিয়ে পলিযুক্ত বালু অপসারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শামিমুর রহমান খুব শীঘ্রই সিলট্রাপ থেকে বালু অপসারণের কাজ শুরু করবেন মর্মে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মশিউর রহমান মন্ডল জানিয়েছেন।
সর্বোপরি এ জেলার সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক ও উপজেলার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সঙ্গত কারণে সরকারি, আধা সরকারি সব দপ্তরের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হস্তক্ষেপ ও দেখভাল করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এর পাশাপাশি কোনো দপ্তর বা ব্যক্তি কর্তৃক দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো রকম ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেটাও কঠোর হস্তে প্রতিহত করে রক্ষা করার দায়-দায়িত্বও বর্তায় এ দুটি দপ্তরের কর্মকর্তার ওপর। কোনো ক্রমেই দায় এড়াতে পারে না তারা।
সে কারণে এলাকার সচেতন মহল জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন তুলছেন, সরকারের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা খরচ করে জনস্বার্থে সরকারের তৈরি আইন অমান্য করে একক কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সিলট্রাপের পলিযুক্ত বালু অপসারণে ড্রেজার মেশিনের পরিবর্তে ভিন্ন পন্থায় অবৈধভাবে শক্তিশালী বোমা মেশিন বসিয়ে বালু অপসারণের কাজ চালানো হচ্ছে। আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১৫ দশমিক ৪৪ মিটার ৪৪টি জলকপাট সম্বলিত এ দেশের সেচ প্রকল্পের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প। এই মহামূল্যবান সম্পদ তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন কমান্ড এলাকার সিলট্রাপের বালু অপসারণে শক্তিশালী ভারী বোমা মেশিন দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা বোধগম্য নয়। এটা নিশ্চয় আত্মঘাতী ও দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত কিনা? তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে অতীব জরুরি মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক্তিশালী বোমা মেশিন মাটির তলদেশে গভীর থেকে অতি গভীর গিয়ে মাটির স্তর ভেদ করে গভীর গর্তের সৃষ্টি করে। সে কারণে তিস্তা ব্যারেজের নিচের মূল ফাউন্ডেশনের মাটি সরে গিয়ে ব্রিজটি বিপর্যস্ত হয়ে ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তকে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নস্যাৎ ও অকার্যকর করার পরিকল্পনায় ভারতের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন অংশের এজেন্ডা হিসেবেও চিহ্নিত করছেন।
এ প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সিলট্রাপের জায়গাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। বৈধ-অবৈধ পন্থার বিষয় দেখার সুযোগ বা অধিকার অন্য কোনো দপ্তর বা কারোরোই নেই।
নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ। তিস্তার পানি সেচ কাজে ব্যবহার করার জন্য ১৯৯০ সালে এ ৪৪টি জল কপাট সম্বলিত এ ব্রিজটি নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। এটা নির্মাণের তৎকালীন সরকার আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। নিঃসন্দেহে তিস্তা ব্রিজটি এ দেশের একটি বড় সম্পদ। ব্রিজের আশপাশে এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না যাহাতে ব্রিজটির অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি হয়। ব্রিজের অবকাঠামো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সতর্ক থাকতে হবে। ব্রিজের কমান্ডিং এলাকায় ভারী মেশিন দিয়ে বালু অপসারণের কাজ আত্মঘাতী হবে মর্মে আমি বিশ্বাস করি। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আহ্বান করছি।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরীর বলেন, আমাদের দপ্তরের তিনটি ড্রেজার মেশিন ছিল। ড্রেজার মেশিনগুলো ২০১৭ সালে অকেজো হয়ে পড়ায় বিকল্প পন্থায় স্থানীয় ড্রেজার দিয়ে সিলট্রাপের পলি ও বালু অপসারণের কাজ করা হচ্ছে । এ পদ্ধতিতে ড্রেজার ও ভেক্যু মেশিনের চেয়ে খরচ কম। তিনি আরও বলেন, ব্রিজের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। এতে ব্রিজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
জেলা প্রশাসক নাইরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমি ডিমলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে অবগত হয়েছি। তিস্তা ব্যারেজ কমান্ডিং এলাকায় ভারী মেশিন দিয়ে বালু অপসরণের প্রশ্নই ওঠে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিমলার ইউএনও কে ঘটনা স্থল পরিদর্শন করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানানোর জন্য বলা হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইমরানুজ্জামান সোমবার, বিকেলে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলট্রাপ এলাকা পরিদর্শন করেন। সিলট্রাপে বোমা মেশিন দিয়ে বালু অপসারণে বিষয়টি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় তিনি সংবাদকে জানান, আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছি যা দেখলাম তা আমি ডিসি স্যারকে অবগত করবো। যা ব্যবস্থা নেয়ার তিনি নিবেন।
ডিমলা, (নীলফামারী): সোমবার, বিকেলে বোমা মেশিন দিয়ে বালু অপসারণ কাজের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইমরানুজ্জামান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মীর হাসান আল বান্না।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন কমান্ড এরিয়ার স্পর্শকাতর স্থান সিলট্রাপের বালু অপসারণে শক্তিশালী অবৈধ বোমা মেশিন বসিয়ে খননের কাজ চলছে। ঝুঁকিতে তিস্তা ব্যারেজ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি অর্থবছরের শুকনো মৌসুমে আসন্ন ইরি চাষাবাদে সুষ্ঠুভাবে পানি সেচ প্রদানের লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারেজের প্রধান সেচ ক্যানেলের শুরুতেই সিলট্রাপের বালু অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। ডিমলার ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ লাখ ৮৫ হাজার ঘন মিটার বালু অপসারণে দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে খননের কাজ শুরু করেছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, দেশের উত্তর অঞ্চলের কৃষকদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে বিগত ১৯৭৯ সালে শুরু করে ১৯৯০ সালে তিস্তা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। তৎকালীন নির্মাণ কাজে ব্যয় করা হয় ২ হাজার ৫ শত কোটি টাকা।
ডালিয়ায় তিস্তা নদীর ওপর দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ কাজ শুরু করে ১৯৯০ সালে শেষ করা হয়। সে সময়ে শুকনো মৌসুমে ইরি চাষাবাদের লক্ষ্যে ৬ লাখ কিউসেক পানি চাষাবাদ জমিতে সেচের জন্য তিস্তার পানি সরবরাহে ব্যারেজের উজানে পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য জলকপাট সম্বলিত আরও একটি প্রধান ক্যানেল ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। তিস্তার বালু যুক্ত পানির গতি বন্ধ হয়ে মিশ্রিত বালু নিচে জমে পরিষ্কার পানি প্রধান সেচ ক্যানেল দিয়ে প্রবাহিত করে ইরি চাষাবাদের জন্য। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীসহ ৭টি জেলার ৩৫টি উপজেলায় চাষাবাদের জন্য তৎকালীন সরকার পরিকল্পনা করে ব্যারেজ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরহুম এইচ এম এরশাদ দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে তিস্তা ব্যারেজকে সেচ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে তিস্তা ব্যারেজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ব্যারেজ নির্মাণকালীন সময়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে তিস্তার পানি ইরি চাষাবাদ কাজের ব্যবহার সরবরাহে মূল ক্যানেলের শুরুতে তিস্তার পলিযুক্ত বালু মুক্ত করার জন্য ৪৫ হেক্টর জমি জুড়ে সিলট্রাপ তৈরি করা হয়।
তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পর থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে তিস্তা নদীর পানি সরবরাহ করে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তিস্তা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সেচ কার্যক্রম পরিচালনায় তিস্তা নদীর পানি সরবরাহে সিলট্রাপে জমে থাকা পলিযুক্ত বালু অপসারণ কাজে ব্যাবহারের জন্য পরবর্তী সময়ে কানাডা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৩টি ড্রেজার মেশিন ক্রয় করে নিয়ে আসা হয়। সরবরাহকৃত ড্রেজার মেশিন ৩টি ইতোমধ্যে বিকল হয়ে পড়ায় প্রতি ২/৩ বছর অন্তর অন্তর শুকনো মৌসুমে সেচ কার্যক্রম শুরুর আগে সিলট্রাপ হতে পলিমিশ্রিত বালু অপসারণ করে আসছেন পাউবো কর্তৃপক্ষ। গত ২০২২ সালে পলিমিশ্রিত বালু অপসারণ করা হলেও গত বর্ষা মৌসুমে এবং সম্প্রতি তিস্তা নদীর উজানে ভারত থেকে ধেয়ে আসা প্রবল স্রোত ও ভয়াবহ বন্যার পানির কারণে সিলট্রাপে পলিমিশ্রিত বালু পুনরায় জমে চর জেগে অকার্যকর হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অকার্যকর সিলট্রাপকে কার্যকর ও সচল করতে চলতি অর্থবছরে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ ৪ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার ২৮২ টাকা ব্যয় বরাদ্দে ২ লাখ ৮৫ হাজার ঘন মিটার পলিযুক্ত বালু অপসারণে ২ জন ঠিকাদারকে নিয়োগ করে।
এর মধ্যে ইউনাইটেড ব্রাদার্স রংপুরের অধীনে ১ লাখ ৭০ হাজার ঘন মিটার পলিযুক্ত বালু অপসারণের অনুকূলে ২ কোটি ৬২ লাখ ২২ হাজার ২৮২ টাকা এবং শামিমুর রহমান সিরাজগঞ্জের অধীনে ১ লাখ ১৫ হাজার ঘন মিটার পলিযুক্ত বালু অপসারণের অনুকূলে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫৪৭ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ব্রাদার্সের পক্ষে ২০/২৫টি বোমা মেশিন লাগিয়ে পলিযুক্ত বালু অপসারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শামিমুর রহমান খুব শীঘ্রই সিলট্রাপ থেকে বালু অপসারণের কাজ শুরু করবেন মর্মে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মশিউর রহমান মন্ডল জানিয়েছেন।
সর্বোপরি এ জেলার সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক ও উপজেলার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সঙ্গত কারণে সরকারি, আধা সরকারি সব দপ্তরের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হস্তক্ষেপ ও দেখভাল করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এর পাশাপাশি কোনো দপ্তর বা ব্যক্তি কর্তৃক দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো রকম ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেটাও কঠোর হস্তে প্রতিহত করে রক্ষা করার দায়-দায়িত্বও বর্তায় এ দুটি দপ্তরের কর্মকর্তার ওপর। কোনো ক্রমেই দায় এড়াতে পারে না তারা।
সে কারণে এলাকার সচেতন মহল জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন তুলছেন, সরকারের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা খরচ করে জনস্বার্থে সরকারের তৈরি আইন অমান্য করে একক কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সিলট্রাপের পলিযুক্ত বালু অপসারণে ড্রেজার মেশিনের পরিবর্তে ভিন্ন পন্থায় অবৈধভাবে শক্তিশালী বোমা মেশিন বসিয়ে বালু অপসারণের কাজ চালানো হচ্ছে। আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১৫ দশমিক ৪৪ মিটার ৪৪টি জলকপাট সম্বলিত এ দেশের সেচ প্রকল্পের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প। এই মহামূল্যবান সম্পদ তিস্তা ব্যারেজ সংলগ্ন কমান্ড এলাকার সিলট্রাপের বালু অপসারণে শক্তিশালী ভারী বোমা মেশিন দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা বোধগম্য নয়। এটা নিশ্চয় আত্মঘাতী ও দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত কিনা? তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে অতীব জরুরি মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক্তিশালী বোমা মেশিন মাটির তলদেশে গভীর থেকে অতি গভীর গিয়ে মাটির স্তর ভেদ করে গভীর গর্তের সৃষ্টি করে। সে কারণে তিস্তা ব্যারেজের নিচের মূল ফাউন্ডেশনের মাটি সরে গিয়ে ব্রিজটি বিপর্যস্ত হয়ে ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তকে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নস্যাৎ ও অকার্যকর করার পরিকল্পনায় ভারতের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন অংশের এজেন্ডা হিসেবেও চিহ্নিত করছেন।
এ প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সিলট্রাপের জায়গাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। বৈধ-অবৈধ পন্থার বিষয় দেখার সুযোগ বা অধিকার অন্য কোনো দপ্তর বা কারোরোই নেই।
নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ। তিস্তার পানি সেচ কাজে ব্যবহার করার জন্য ১৯৯০ সালে এ ৪৪টি জল কপাট সম্বলিত এ ব্রিজটি নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। এটা নির্মাণের তৎকালীন সরকার আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। নিঃসন্দেহে তিস্তা ব্রিজটি এ দেশের একটি বড় সম্পদ। ব্রিজের আশপাশে এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না যাহাতে ব্রিজটির অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি হয়। ব্রিজের অবকাঠামো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সতর্ক থাকতে হবে। ব্রিজের কমান্ডিং এলাকায় ভারী মেশিন দিয়ে বালু অপসারণের কাজ আত্মঘাতী হবে মর্মে আমি বিশ্বাস করি। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আহ্বান করছি।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরীর বলেন, আমাদের দপ্তরের তিনটি ড্রেজার মেশিন ছিল। ড্রেজার মেশিনগুলো ২০১৭ সালে অকেজো হয়ে পড়ায় বিকল্প পন্থায় স্থানীয় ড্রেজার দিয়ে সিলট্রাপের পলি ও বালু অপসারণের কাজ করা হচ্ছে । এ পদ্ধতিতে ড্রেজার ও ভেক্যু মেশিনের চেয়ে খরচ কম। তিনি আরও বলেন, ব্রিজের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। এতে ব্রিজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
জেলা প্রশাসক নাইরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমি ডিমলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে অবগত হয়েছি। তিস্তা ব্যারেজ কমান্ডিং এলাকায় ভারী মেশিন দিয়ে বালু অপসরণের প্রশ্নই ওঠে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিমলার ইউএনও কে ঘটনা স্থল পরিদর্শন করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানানোর জন্য বলা হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইমরানুজ্জামান সোমবার, বিকেলে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলট্রাপ এলাকা পরিদর্শন করেন। সিলট্রাপে বোমা মেশিন দিয়ে বালু অপসারণে বিষয়টি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় তিনি সংবাদকে জানান, আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছি যা দেখলাম তা আমি ডিসি স্যারকে অবগত করবো। যা ব্যবস্থা নেয়ার তিনি নিবেন।
ডিমলা, (নীলফামারী): সোমবার, বিকেলে বোমা মেশিন দিয়ে বালু অপসারণ কাজের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইমরানুজ্জামান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মীর হাসান আল বান্না।