মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
‘আগে মানুষ মাটি হারাতো, এখন হারায় নিজস্বতা। একসময় উপনিবেশ ছিল ভূখ-ে, আজ তা গড়ে উঠছে তথ্যের পাতায়...’Ñমানব ইতিহাসে উপনিবেশের ধারণা নতুন নয়। একসময় ধনসম্পদ, জমি কিংবা মানুষ দখল করাই ছিল শক্তির প্রকাশ; কিন্তু এখন সময় বদলেছে। আজকের বিশ্বে যিনি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাধর। অস্ত্র, রাজনীতি বা অর্থনীতি নয়Ñবর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী উপনিবেশ হলো ডিজিটাল কলোনি, যার শাসক বৃহৎ প্রযুক্তি করপোরেশন ও তথ্য নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলো।
আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট দিই, গুগলে কিছু খুঁজি, ইউটিউবে ভিডিও দেখি কিংবা টিকটকে স্ক্রল করিÑভাবি সবকিছু করছি নিজের ইচ্ছায়। অথচ বাস্তবে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের আগেভাগে বিশ্লেষণ করে নিয়েছেÑআমাদের পছন্দ, অবস্থান, বয়স, ভাষা, এমনকি মন-মেজাজ পর্যন্ত। প্রতিটি ক্লিক, লাইক, সার্চ ও দেখার সময় অনুযায়ী তারা প্রোফাইল তৈরি করে। আমরা অজান্তেই হয়ে উঠছি নতুন প্রজন্মের ডেটা-দাস।
গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ৩.৫ কুয়িন্টিলিয়ন (৩.৫ মিলিয়ন টেরাবাইট) তথ্য তৈরি হয়, যার ৯০% নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠানÑগুগল, মেটা (ফেসবুক), অ্যামাজন, অ্যাপল ও মাইক্রোসফট। তারা শুধু তথ্য জমা রাখে না, বরং প্রভাবিত করেÑআমরা কীভাবে ভাববো, কী কিনবো, এমনকি কাকে ভোট দেবো। ২০১৮ সালের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে দেখা গেছে, প্রায় আট কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ডিজিটাল দুনিয়া শুধু বিনোদনের নয়Ñএটি এক ভয়াবহ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৪ কোটির বেশি হবে। কিন্তু ২০২৪ সালে বিআইআইডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৫% ব্যবহারকারী জানেন না তাদের তথ্য কোথায় যাচ্ছে বা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম যখন টিকটক, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন তা শুধু সময়ের অপচয় নয়Ñচিন্তার স্বাধীনতাও সীমিত হয়ে পড়ে, আর সেই সুযোগে তারা অজান্তেই অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
আমরা গর্ব করি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিয়ে, কিন্তু খুব কম মানুষই ভাবিÑএই প্রযুক্তির কতটুকু আমাদের নিজস্ব? নীতিনির্ধারণ, নিরাপত্তা, অ্যালগরিদম ও সার্ভারÑসবই যদি বিদেশি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে এই উন্নয়ন কতটা স্বাধীনতা দেয়?
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশীয় প্রযুক্তি উন্নয়ন অপরিহার্যÑযেমন নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন, অ্যাপস ও সামাজিক মাধ্যম। তথ্য সুরক্ষা আইনকে আরও কার্যকর করতে হবে এবং ডিজিটাল শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন প্রযুক্তি সচেতনভাবে ব্যবহার করা যায়।
ডিজিটাল কলোনি কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়, এটি বাস্তবতা। এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অদৃশ্য শৃঙ্খলের বন্দি হয়ে পড়বে। তথ্যের এই যুগে টিকে থাকতে হলে শুধু ব্যবহারকারী নয়, হতে হবে সচেতন নাগরিক।
ওম্মে হাবিবা তৃষা
দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫
‘আগে মানুষ মাটি হারাতো, এখন হারায় নিজস্বতা। একসময় উপনিবেশ ছিল ভূখ-ে, আজ তা গড়ে উঠছে তথ্যের পাতায়...’Ñমানব ইতিহাসে উপনিবেশের ধারণা নতুন নয়। একসময় ধনসম্পদ, জমি কিংবা মানুষ দখল করাই ছিল শক্তির প্রকাশ; কিন্তু এখন সময় বদলেছে। আজকের বিশ্বে যিনি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাধর। অস্ত্র, রাজনীতি বা অর্থনীতি নয়Ñবর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী উপনিবেশ হলো ডিজিটাল কলোনি, যার শাসক বৃহৎ প্রযুক্তি করপোরেশন ও তথ্য নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলো।
আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট দিই, গুগলে কিছু খুঁজি, ইউটিউবে ভিডিও দেখি কিংবা টিকটকে স্ক্রল করিÑভাবি সবকিছু করছি নিজের ইচ্ছায়। অথচ বাস্তবে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের আগেভাগে বিশ্লেষণ করে নিয়েছেÑআমাদের পছন্দ, অবস্থান, বয়স, ভাষা, এমনকি মন-মেজাজ পর্যন্ত। প্রতিটি ক্লিক, লাইক, সার্চ ও দেখার সময় অনুযায়ী তারা প্রোফাইল তৈরি করে। আমরা অজান্তেই হয়ে উঠছি নতুন প্রজন্মের ডেটা-দাস।
গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ৩.৫ কুয়িন্টিলিয়ন (৩.৫ মিলিয়ন টেরাবাইট) তথ্য তৈরি হয়, যার ৯০% নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠানÑগুগল, মেটা (ফেসবুক), অ্যামাজন, অ্যাপল ও মাইক্রোসফট। তারা শুধু তথ্য জমা রাখে না, বরং প্রভাবিত করেÑআমরা কীভাবে ভাববো, কী কিনবো, এমনকি কাকে ভোট দেবো। ২০১৮ সালের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে দেখা গেছে, প্রায় আট কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ডিজিটাল দুনিয়া শুধু বিনোদনের নয়Ñএটি এক ভয়াবহ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৪ কোটির বেশি হবে। কিন্তু ২০২৪ সালে বিআইআইডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৫% ব্যবহারকারী জানেন না তাদের তথ্য কোথায় যাচ্ছে বা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম যখন টিকটক, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন তা শুধু সময়ের অপচয় নয়Ñচিন্তার স্বাধীনতাও সীমিত হয়ে পড়ে, আর সেই সুযোগে তারা অজান্তেই অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
আমরা গর্ব করি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিয়ে, কিন্তু খুব কম মানুষই ভাবিÑএই প্রযুক্তির কতটুকু আমাদের নিজস্ব? নীতিনির্ধারণ, নিরাপত্তা, অ্যালগরিদম ও সার্ভারÑসবই যদি বিদেশি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে এই উন্নয়ন কতটা স্বাধীনতা দেয়?
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশীয় প্রযুক্তি উন্নয়ন অপরিহার্যÑযেমন নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন, অ্যাপস ও সামাজিক মাধ্যম। তথ্য সুরক্ষা আইনকে আরও কার্যকর করতে হবে এবং ডিজিটাল শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন প্রযুক্তি সচেতনভাবে ব্যবহার করা যায়।
ডিজিটাল কলোনি কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়, এটি বাস্তবতা। এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অদৃশ্য শৃঙ্খলের বন্দি হয়ে পড়বে। তথ্যের এই যুগে টিকে থাকতে হলে শুধু ব্যবহারকারী নয়, হতে হবে সচেতন নাগরিক।
ওম্মে হাবিবা তৃষা
দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়