মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
আজকের যুগকে বলা যায়প্রযুক্তি , প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তাযর যুগ ।এই সময়ের তরুণরা বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রজন্ম, কিন্তু একই সঙ্গে তারা মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে রয়েছে। শিক্ষা, ক্যারিয়ার, সম্পর্ক, সামাজিক প্রত্যাশা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাস্তব তুলনা সব মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মের মনে তৈরি হচ্ছে এক নীরব সংকট, যার নাম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ।
বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীতেই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এখন এক নীরব মহামারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি চারজন তরুণের একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে, অথচ তাদের অধিকাংশই কখনো চিকিৎসা বা সহায়তা পায় না। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মসম্মানবোধের অভাব ও আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন তরুণ সমাজে বাড়ছে।
তরুণরা জীবনের এমন এক পর্যায়ে থাকে, যেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন ও দুশ্চিন্তা পাশাপাশি চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরি পাওয়া, পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করা এসবই তাদের উপর চাপ তৈরি করে। একদিকে তারা সাফল্যের জন্য দৌড়াচ্ছে, অন্যদিকে ব্যর্থতার ভয় তাদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এই চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে অন্যদের “সাফল্যের ছবি” দেখে অনেক তরুণ নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে করে। এই তুলনা থেকে জন্ম নিচ্ছে হীনমন্যতা, একাকিত্ব ও আত্মঅবিশ্বাস। তাছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মুখোমুখি যোগাযোগ কমে যাওয়ায় তারা একাকিত্বের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
আরও একটি বড় কারণ হলো পারিবারিক ও সামাজিক মনোভাব। আমাদের সমাজে এখনো “মন খারাপ” বা “উদ্বেগ” কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বরং অনেকে মনে করে মানসিক সমস্যায় ভোগা মানে দুর্বলতা বা অলসতা। ফলে তরুণরা নিজেদের সমস্যা চেপে রাখে, কারো সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পারে না। এই চুপচাপ ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাওয়াই অনেক সময় আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তে ঠেলে দেয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ ও আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। পড়াশোনা, প্রেম-সম্পর্কে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও পারিবারিক সমস্যা সব মিলিয়ে তরুণদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্তত দুজন নিয়মিত মানসিক চাপ অনুভব করে, অথচ তাদের খুব অল্প সংখ্যকই কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা নেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য সচেতনতা ও সহানুভূতি সবচেয়ে জরুরি। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ,তিনটি স্তরেই এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে।পরিবারে বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তার মানসিক অবস্থা বোঝা এবং তাকে নিজের অনুভূতি প্রকাশে উৎসাহ দেওয়া।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেবা চালু থাকা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়লে সাহায্য চাইতে পারে।সরকারি ও সামাজিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচারণা, হেল্পলাইন, ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।এছাড়া তরুণদের নিজেদেরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেমন,পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগ, এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা রাখা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা যেন নিজের মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেয় এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে লজ্জা না পায়।
মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয় এটি মানবজীবনের মৌলিক প্রয়োজন। তরুণরা যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে, তবে তাদের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও স্বপ্ন সবই ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।আমাদের সমাজকে বুঝতে হবে মনও যত্ন চায়, যেমন শরীর চায়। তরুণদের হাসি-আনন্দে ভরা মনটাই একটি সুস্থ সমাজ ও উন্নত জাতির ভিত্তি। তাই এখনই সময়, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নীরবতা ভেঙে, কথা বলার,নিজেদের ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষার স্বার্থে।
সুরাইয়া বিনতে হাসান
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
আজকের যুগকে বলা যায়প্রযুক্তি , প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তাযর যুগ ।এই সময়ের তরুণরা বিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রজন্ম, কিন্তু একই সঙ্গে তারা মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে রয়েছে। শিক্ষা, ক্যারিয়ার, সম্পর্ক, সামাজিক প্রত্যাশা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাস্তব তুলনা সব মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মের মনে তৈরি হচ্ছে এক নীরব সংকট, যার নাম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ।
বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীতেই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এখন এক নীরব মহামারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি চারজন তরুণের একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে, অথচ তাদের অধিকাংশই কখনো চিকিৎসা বা সহায়তা পায় না। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মসম্মানবোধের অভাব ও আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন তরুণ সমাজে বাড়ছে।
তরুণরা জীবনের এমন এক পর্যায়ে থাকে, যেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন ও দুশ্চিন্তা পাশাপাশি চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরি পাওয়া, পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করা এসবই তাদের উপর চাপ তৈরি করে। একদিকে তারা সাফল্যের জন্য দৌড়াচ্ছে, অন্যদিকে ব্যর্থতার ভয় তাদের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এই চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে অন্যদের “সাফল্যের ছবি” দেখে অনেক তরুণ নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে করে। এই তুলনা থেকে জন্ম নিচ্ছে হীনমন্যতা, একাকিত্ব ও আত্মঅবিশ্বাস। তাছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মুখোমুখি যোগাযোগ কমে যাওয়ায় তারা একাকিত্বের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
আরও একটি বড় কারণ হলো পারিবারিক ও সামাজিক মনোভাব। আমাদের সমাজে এখনো “মন খারাপ” বা “উদ্বেগ” কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বরং অনেকে মনে করে মানসিক সমস্যায় ভোগা মানে দুর্বলতা বা অলসতা। ফলে তরুণরা নিজেদের সমস্যা চেপে রাখে, কারো সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পারে না। এই চুপচাপ ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাওয়াই অনেক সময় আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তে ঠেলে দেয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ ও আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। পড়াশোনা, প্রেম-সম্পর্কে ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও পারিবারিক সমস্যা সব মিলিয়ে তরুণদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্তত দুজন নিয়মিত মানসিক চাপ অনুভব করে, অথচ তাদের খুব অল্প সংখ্যকই কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা নেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য সচেতনতা ও সহানুভূতি সবচেয়ে জরুরি। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ,তিনটি স্তরেই এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে।পরিবারে বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, তার মানসিক অবস্থা বোঝা এবং তাকে নিজের অনুভূতি প্রকাশে উৎসাহ দেওয়া।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেবা চালু থাকা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়লে সাহায্য চাইতে পারে।সরকারি ও সামাজিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচারণা, হেল্পলাইন, ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।এছাড়া তরুণদের নিজেদেরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেমন,পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগ, এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা রাখা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা যেন নিজের মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেয় এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে লজ্জা না পায়।
মানসিক স্বাস্থ্য কোনো বিলাসিতা নয় এটি মানবজীবনের মৌলিক প্রয়োজন। তরুণরা যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে, তবে তাদের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও স্বপ্ন সবই ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।আমাদের সমাজকে বুঝতে হবে মনও যত্ন চায়, যেমন শরীর চায়। তরুণদের হাসি-আনন্দে ভরা মনটাই একটি সুস্থ সমাজ ও উন্নত জাতির ভিত্তি। তাই এখনই সময়, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নীরবতা ভেঙে, কথা বলার,নিজেদের ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষার স্বার্থে।
সুরাইয়া বিনতে হাসান
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা