আসফাক বীন রহমান
“ আমার কি ইচ্ছে করে , জানেন ?”
শামীম ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আমি বললাম ,“ এফ,সি,পি,এস, পাশ করতে চান ।”
হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য দিয়ে শামীম ভাই ট্রেনের জানালা দিয়ে দৌলতকান্দি মহিউদ্দিন ভুঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয় দেখিয়ে বললেন , “ যদি সুযোগ পেতাম ,এই স্কুলে পড়ার জন্য ভর্তি হতাম ।”
আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠি । কারণ ,উনি আমার মনের অনেক ভিতরের একটা কথা বলে ফেলেছেন । শামীম ভাই আমার কলিগ ; শিশু বিশেষজ্ঞ হবার জন্য পড়াশোনা করছেন । ভাবী চাকুরি-সূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্টেড । এ কারণে শামীম ভাই মাঝে মাঝে ট্রেনে আমার সঙ্গী হন । নরসিংদীর রায়পুরার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই সুন্দর । দৌলতকান্দি এম,বি স্কুলটি নদীর পাড়ে গাছপালা ঘেরা মাঠের ঐ পাশে । নদীটাকে মরা নদী বলে । আসলে এটা মেঘনাকে সাপমারায় ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে যোগ করেছে । আমরা ভৈরব- ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার সময় এই স্কুলের পরিবেশ দেখি আর হাঃ হুতাশ করি , কেন এরকম একটি সুন্দর স্কুলে পড়তে পারলাম না ! ছাত্ররা না জানি কত সুখী !
সুযোগ পেলেই রায়পুরার বিভিন্ন এলাকায় বিকেলে আমি হাঁটতে বের হই । যখন পা আর চলে না তখন রিক্সা নিয়ে ডরমেটরিতে ফেরত আসি । মাঝে মাঝে তুলাতুলী এলাকার হাসপাতাল কমপ্লেক্স থেকে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীরামপুর রেলগেট পার হয়ে রায়পুরা বাজারে চলে আসি । একটু নাস্তা করে পূব বরাবর আর একটু হাঁটলেই মেঘনা নদীর একটা শাখায় পৌঁছে যাই । গুদারাঘাটে দাঁড়িয়ে মনে মনে পরিকল্পনা করি কোন একদিন নদী পাড় হয়ে সৈয়দাবাদের ওহেদুজ্জামান ভাইসাহেব-শাহ আলম ভাইসাহেবদের বাড়ি বেড়িয়ে নবীনগরের বাইশ মৌজা - লালপুর গ্রামে পৌঁছে যাবো । লালপুর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকা তিন -চার মাইল ।
হাসপাতালের ষ্টাফ আলী হোসেন মিয়া , এম,এল,এস,এস মুজিবর মাঝে মাঝে রায়পুরা বাজার পর্যন্ত সঙ্গী হোন । আলী হোসেন মিয়া খুবই অমায়িক সরল একজন মানুষ । উনার বাড়ি এই উপজেলার অন্য আরেক প্রান্তে । আমাকে মাঝে মাঝে রায়পুরা এলাকা সম্বন্ধে টিপস দেন । গত পড়শুদিন বলেন ,“ স্যার , বাদাম গাছ দেখছেন ? আপনেতো মেঘনার চরের কাছাকাছি যান । ” আমি ওনাকে বলি , “বাদাম মাটির নীচের ফল , এটা জানি কিন্তু বাদাম গাছ চিনি না । ” তাই আমাকে বাদাম গাছ দেখাতে রায়পুরা বাজার পর্যন্ত ট্যাগ হয়েছেন । “ঐযে স্যার , আপনার পায়ের নীচে ” হোসেন মিয়া বলার সাথে সাথে আমি ভয়ে লাফ দেই । ভাবলাম সাপ-টাপ নাকি ! হোসেন মিয়া লতানো গাছটিকে টান দিয়ে ছোট ছোট বাদামসমেত শিকড় দেখালেন ।
ইপিআই এর টিকা কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ইউনিয়নে কার্যক্রম ঠিকমত হচ্ছে কিনা পরিদর্শনে যাই । আমি নৌকা ,ট্রলার ,ট্রেন, রিক্সা যখন যেটা দরকার সেই বাহনে চেপে দূরবর্তী ইউনিয়নগুলো পরিদর্শনে যাই । চব্বিশটা ইউনিয়ন নিয়ে নরসিংদীর বিশাল রায়পুরা উপজেলায় ছয়টি রেলস্টেশন। মাঝেমাঝে টি,এইচ,এফ,পিও সাহেব এম্বুলেন্সে যাবার জন্য ব্যবস্থা করে দেন । আমার আগ্রহ দেখে স্যার অন্যান্য কলিগদের সাথে হাসাহাসি করেন । আমি বিশাল গাছ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখে অবাক হই । দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড় ।
দৌলতকান্দি স্টেশন পার হতেই একটি পিচের রাস্তা ডান দিকে ভৈরব বরাবর চলে গেছে । শামীম ভাইকে ওই রাস্তা দেখিয়ে বলি , “ একদিন এই রাস্তা ধরে আমি ভৈরবের পাশে মেঘনার পাড়ে চলে গিয়েছিলাম ।”
প্রায়ই হরতাল হতো । হরতালের সময় মাঝেমাঝে নরসিংদী বা টঙ্গীতে ট্রেন কোন কারণে আটকা পড়লে বিকল্প পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতাম । আলী হোসেন মিয়ার সাথে কথা বলায় রায়পুরা বাজার থেকে বামদিকে মৌলভীবাজার -সাপমারা রোডের কথা জানতে পারি । এক হরতালের দিনে বিসমিল্লাহ বলে রিকশা নিয়ে এই রাস্তা বরাবর এগুতে থাকি । রিক্সাওয়ালা বেশ কথক । এই এলাকা সম্বন্ধে জানতে চাইলে উনি রেডিও বাংলাদেশের ফুটবল ধারাভাষ্যকার খোদা বক্স মৃধার মতো একটানা এলাকা সম্বন্ধে ধারা বিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন । “ ঐযে টিনের বড় বাড়ীটা দেখতাছেন এইটা হইলো আগের এম,পি সাবের বাড়ী । সামনে মহিষমারা গ্রাম ,তার বাদে সাপমারা গ্রাম । ” এটা শুনে আমি হেসে বলি , “ আপনাদের এখানে খালি মারামারির ব্যাপার-স্যাপার । গ্রামের নামেও দেখি মারামারি ঢুকে পড়েছে ।” মাঝপথে বেশ কয়টি খালের উপর দিয়ে উঁচু পুল পার হতে রিক্সা থেকে নামতে হলো । একটি প্রাচীন মসজিদ দেখিয়ে উনি বললেন ,“ বুঝলেন ভাই ,এই মজ্জিদে আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম ।” উনার উচ্ছ্বাস দেখে আমিও মনে মনে হাসি । এই রাস্তার শেষ মাথায় এসে আমাকে সামনের দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটি দেখিয়ে বললেন , “ হেইদিকে আরেট্টু দূর আগাইলে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের বাড়ি । জায়গাটা সাপমারার মতিউরনগর । ”
হঠাৎ করে ফাঁকা রাস্তার দিকে সামনে তাকাতেই দেখি দৌলতকান্দি রেলস্টেশন ।এখান থেকে ডানদিকে অসংখ্য বিশালকায় শিমুল ফুলের গাছের নীচ দিয়ে যাবার সময় মনে হলো , এতো সুন্দর পথেতো আগে কখনোই আসিনি । সড়কের চারপাশে ধান ক্ষেত , আকাশের নীলচে কালো ক্যানভাসের মাঝে শিমুল - মান্দার গাছের লাল ফুল এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে । সাপমারা -গৌরীপুর রোড ধরে কোহিনুর জুট মিলকে পাশে রেখে মেঘনার গৌরীপুর মিল বাজার ঘাটে পৌঁছে যাই । ইঞ্জিনের নৌকায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঐপাড়ে আশুগঞ্জে পৌঁছি ।
“ চলো আজকে তোমাকে চিতই পিঠা খাওয়াবো ” ফারুক ভাইয়ের গরমের দিনে এই উদ্ভট দাওয়াতে চমকে গেলাম । মাহবুবও ফারুক ভাইয়ের সাথে গলা মেলালো । আমি ডেন্টিষ্ট আর শিশুশল্যবিদের মাথার স্ক্রু-টিস্ক্রু পড়ে গেছে কিনা জানতে চাই । দুজনেই আমাকে বগলদাবা করে তুলাতলী মোড় থেকে বেবিট্যাক্সিতে উঠালো । ওরা দুইজন যাবে ঢাকা- বারৈচা থেকে । যাবার পথে লোচনপুরসহ আশেপাশের ক্ষেতে শুধু সবজির বাগান । ধান চাষ খুব কম হয় । সবজিতেই সমৃদ্ধি । বারৈচা আর মরজালে পাইকারি দরে বিভিন্ন সবজি ট্রাকের পর ট্রাক লোড হয় । দুপুরে ডিউটি শেষে হাসপাতালের ডরমেটরিতে ভাত খেতে খেতে খবর পেলাম আজকের ঈশা খাঁ মেইল রেকর্ড ব্রেক করে সময়মতো ভৈরবের দিকে চলে গেছে । এখন সড়ক পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া ছাড়া উপায় নাই । বারৈচায় ট্যাক্সি থেকে নেমে ফারুক ভাই হাতের ডানদিকে এক পিঠাওয়ালি খালার কাছে অর্ডার দিলেন চিতই পিঠার । “ মিঞা , রিকশাওয়ালা মুটে-মজুরদের দুটি চিতই খেলেই দুপুরের লাঞ্চ হয়ে যায় । এটা গরম গরম আর সেফ ।” ঢাকা রওনা হবার আগে দুজনেই পেট ভরে চিতই পিঠা- চা খেয়ে নেয় ।
গতদিন আলী হোসেন মিয়া রায়পুরা বাজার থেকে তুলাতুলী আসার পথে পিটিআই রায়পুরার আশেপাশের প্রাচীন অনেকগুলো বাড়ী দেখিয়ে বলেন,“ এহনো লোকজন এই বাড়ীতে থাকে । ” বিরাট স্তম্ভের মতো বাড়িগুলোর পলেস্তারা খসে গেছে ।কালের আবর্তনে কৌণিক ইটগুলো অনেকটা গোলচে শেপের হয়ে গেছে । দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে । প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ীর চারপাশে বিরাটকায় প্রাচীন গাছ । সন্ধ্যায় ফিলিপসের হালকা হলদে বিষণ্ন আলোর বাল্বগুলো মন খারাপ করা চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয় ; জীবন ক্ষণস্থায়ী - এই বাড়ীগুলোর প্রতিষ্ঠাতা একদিন ছিল ,এখন আর নাই ।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]
আসফাক বীন রহমান
বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই ২০২৩
“ আমার কি ইচ্ছে করে , জানেন ?”
শামীম ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আমি বললাম ,“ এফ,সি,পি,এস, পাশ করতে চান ।”
হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য দিয়ে শামীম ভাই ট্রেনের জানালা দিয়ে দৌলতকান্দি মহিউদ্দিন ভুঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয় দেখিয়ে বললেন , “ যদি সুযোগ পেতাম ,এই স্কুলে পড়ার জন্য ভর্তি হতাম ।”
আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠি । কারণ ,উনি আমার মনের অনেক ভিতরের একটা কথা বলে ফেলেছেন । শামীম ভাই আমার কলিগ ; শিশু বিশেষজ্ঞ হবার জন্য পড়াশোনা করছেন । ভাবী চাকুরি-সূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পোস্টেড । এ কারণে শামীম ভাই মাঝে মাঝে ট্রেনে আমার সঙ্গী হন । নরসিংদীর রায়পুরার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই সুন্দর । দৌলতকান্দি এম,বি স্কুলটি নদীর পাড়ে গাছপালা ঘেরা মাঠের ঐ পাশে । নদীটাকে মরা নদী বলে । আসলে এটা মেঘনাকে সাপমারায় ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে যোগ করেছে । আমরা ভৈরব- ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার সময় এই স্কুলের পরিবেশ দেখি আর হাঃ হুতাশ করি , কেন এরকম একটি সুন্দর স্কুলে পড়তে পারলাম না ! ছাত্ররা না জানি কত সুখী !
সুযোগ পেলেই রায়পুরার বিভিন্ন এলাকায় বিকেলে আমি হাঁটতে বের হই । যখন পা আর চলে না তখন রিক্সা নিয়ে ডরমেটরিতে ফেরত আসি । মাঝে মাঝে তুলাতুলী এলাকার হাসপাতাল কমপ্লেক্স থেকে হাঁটতে হাঁটতে শ্রীরামপুর রেলগেট পার হয়ে রায়পুরা বাজারে চলে আসি । একটু নাস্তা করে পূব বরাবর আর একটু হাঁটলেই মেঘনা নদীর একটা শাখায় পৌঁছে যাই । গুদারাঘাটে দাঁড়িয়ে মনে মনে পরিকল্পনা করি কোন একদিন নদী পাড় হয়ে সৈয়দাবাদের ওহেদুজ্জামান ভাইসাহেব-শাহ আলম ভাইসাহেবদের বাড়ি বেড়িয়ে নবীনগরের বাইশ মৌজা - লালপুর গ্রামে পৌঁছে যাবো । লালপুর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকা তিন -চার মাইল ।
হাসপাতালের ষ্টাফ আলী হোসেন মিয়া , এম,এল,এস,এস মুজিবর মাঝে মাঝে রায়পুরা বাজার পর্যন্ত সঙ্গী হোন । আলী হোসেন মিয়া খুবই অমায়িক সরল একজন মানুষ । উনার বাড়ি এই উপজেলার অন্য আরেক প্রান্তে । আমাকে মাঝে মাঝে রায়পুরা এলাকা সম্বন্ধে টিপস দেন । গত পড়শুদিন বলেন ,“ স্যার , বাদাম গাছ দেখছেন ? আপনেতো মেঘনার চরের কাছাকাছি যান । ” আমি ওনাকে বলি , “বাদাম মাটির নীচের ফল , এটা জানি কিন্তু বাদাম গাছ চিনি না । ” তাই আমাকে বাদাম গাছ দেখাতে রায়পুরা বাজার পর্যন্ত ট্যাগ হয়েছেন । “ঐযে স্যার , আপনার পায়ের নীচে ” হোসেন মিয়া বলার সাথে সাথে আমি ভয়ে লাফ দেই । ভাবলাম সাপ-টাপ নাকি ! হোসেন মিয়া লতানো গাছটিকে টান দিয়ে ছোট ছোট বাদামসমেত শিকড় দেখালেন ।
ইপিআই এর টিকা কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ইউনিয়নে কার্যক্রম ঠিকমত হচ্ছে কিনা পরিদর্শনে যাই । আমি নৌকা ,ট্রলার ,ট্রেন, রিক্সা যখন যেটা দরকার সেই বাহনে চেপে দূরবর্তী ইউনিয়নগুলো পরিদর্শনে যাই । চব্বিশটা ইউনিয়ন নিয়ে নরসিংদীর বিশাল রায়পুরা উপজেলায় ছয়টি রেলস্টেশন। মাঝেমাঝে টি,এইচ,এফ,পিও সাহেব এম্বুলেন্সে যাবার জন্য ব্যবস্থা করে দেন । আমার আগ্রহ দেখে স্যার অন্যান্য কলিগদের সাথে হাসাহাসি করেন । আমি বিশাল গাছ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখে অবাক হই । দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড় ।
দৌলতকান্দি স্টেশন পার হতেই একটি পিচের রাস্তা ডান দিকে ভৈরব বরাবর চলে গেছে । শামীম ভাইকে ওই রাস্তা দেখিয়ে বলি , “ একদিন এই রাস্তা ধরে আমি ভৈরবের পাশে মেঘনার পাড়ে চলে গিয়েছিলাম ।”
প্রায়ই হরতাল হতো । হরতালের সময় মাঝেমাঝে নরসিংদী বা টঙ্গীতে ট্রেন কোন কারণে আটকা পড়লে বিকল্প পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতাম । আলী হোসেন মিয়ার সাথে কথা বলায় রায়পুরা বাজার থেকে বামদিকে মৌলভীবাজার -সাপমারা রোডের কথা জানতে পারি । এক হরতালের দিনে বিসমিল্লাহ বলে রিকশা নিয়ে এই রাস্তা বরাবর এগুতে থাকি । রিক্সাওয়ালা বেশ কথক । এই এলাকা সম্বন্ধে জানতে চাইলে উনি রেডিও বাংলাদেশের ফুটবল ধারাভাষ্যকার খোদা বক্স মৃধার মতো একটানা এলাকা সম্বন্ধে ধারা বিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন । “ ঐযে টিনের বড় বাড়ীটা দেখতাছেন এইটা হইলো আগের এম,পি সাবের বাড়ী । সামনে মহিষমারা গ্রাম ,তার বাদে সাপমারা গ্রাম । ” এটা শুনে আমি হেসে বলি , “ আপনাদের এখানে খালি মারামারির ব্যাপার-স্যাপার । গ্রামের নামেও দেখি মারামারি ঢুকে পড়েছে ।” মাঝপথে বেশ কয়টি খালের উপর দিয়ে উঁচু পুল পার হতে রিক্সা থেকে নামতে হলো । একটি প্রাচীন মসজিদ দেখিয়ে উনি বললেন ,“ বুঝলেন ভাই ,এই মজ্জিদে আমি একদিন নামাজ পড়ছিলাম ।” উনার উচ্ছ্বাস দেখে আমিও মনে মনে হাসি । এই রাস্তার শেষ মাথায় এসে আমাকে সামনের দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটি দেখিয়ে বললেন , “ হেইদিকে আরেট্টু দূর আগাইলে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের বাড়ি । জায়গাটা সাপমারার মতিউরনগর । ”
হঠাৎ করে ফাঁকা রাস্তার দিকে সামনে তাকাতেই দেখি দৌলতকান্দি রেলস্টেশন ।এখান থেকে ডানদিকে অসংখ্য বিশালকায় শিমুল ফুলের গাছের নীচ দিয়ে যাবার সময় মনে হলো , এতো সুন্দর পথেতো আগে কখনোই আসিনি । সড়কের চারপাশে ধান ক্ষেত , আকাশের নীলচে কালো ক্যানভাসের মাঝে শিমুল - মান্দার গাছের লাল ফুল এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে । সাপমারা -গৌরীপুর রোড ধরে কোহিনুর জুট মিলকে পাশে রেখে মেঘনার গৌরীপুর মিল বাজার ঘাটে পৌঁছে যাই । ইঞ্জিনের নৌকায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঐপাড়ে আশুগঞ্জে পৌঁছি ।
“ চলো আজকে তোমাকে চিতই পিঠা খাওয়াবো ” ফারুক ভাইয়ের গরমের দিনে এই উদ্ভট দাওয়াতে চমকে গেলাম । মাহবুবও ফারুক ভাইয়ের সাথে গলা মেলালো । আমি ডেন্টিষ্ট আর শিশুশল্যবিদের মাথার স্ক্রু-টিস্ক্রু পড়ে গেছে কিনা জানতে চাই । দুজনেই আমাকে বগলদাবা করে তুলাতলী মোড় থেকে বেবিট্যাক্সিতে উঠালো । ওরা দুইজন যাবে ঢাকা- বারৈচা থেকে । যাবার পথে লোচনপুরসহ আশেপাশের ক্ষেতে শুধু সবজির বাগান । ধান চাষ খুব কম হয় । সবজিতেই সমৃদ্ধি । বারৈচা আর মরজালে পাইকারি দরে বিভিন্ন সবজি ট্রাকের পর ট্রাক লোড হয় । দুপুরে ডিউটি শেষে হাসপাতালের ডরমেটরিতে ভাত খেতে খেতে খবর পেলাম আজকের ঈশা খাঁ মেইল রেকর্ড ব্রেক করে সময়মতো ভৈরবের দিকে চলে গেছে । এখন সড়ক পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া ছাড়া উপায় নাই । বারৈচায় ট্যাক্সি থেকে নেমে ফারুক ভাই হাতের ডানদিকে এক পিঠাওয়ালি খালার কাছে অর্ডার দিলেন চিতই পিঠার । “ মিঞা , রিকশাওয়ালা মুটে-মজুরদের দুটি চিতই খেলেই দুপুরের লাঞ্চ হয়ে যায় । এটা গরম গরম আর সেফ ।” ঢাকা রওনা হবার আগে দুজনেই পেট ভরে চিতই পিঠা- চা খেয়ে নেয় ।
গতদিন আলী হোসেন মিয়া রায়পুরা বাজার থেকে তুলাতুলী আসার পথে পিটিআই রায়পুরার আশেপাশের প্রাচীন অনেকগুলো বাড়ী দেখিয়ে বলেন,“ এহনো লোকজন এই বাড়ীতে থাকে । ” বিরাট স্তম্ভের মতো বাড়িগুলোর পলেস্তারা খসে গেছে ।কালের আবর্তনে কৌণিক ইটগুলো অনেকটা গোলচে শেপের হয়ে গেছে । দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে । প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ীর চারপাশে বিরাটকায় প্রাচীন গাছ । সন্ধ্যায় ফিলিপসের হালকা হলদে বিষণ্ন আলোর বাল্বগুলো মন খারাপ করা চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয় ; জীবন ক্ষণস্থায়ী - এই বাড়ীগুলোর প্রতিষ্ঠাতা একদিন ছিল ,এখন আর নাই ।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]