তপন মিত্র চৌধুরী
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা কম্বোডিয়ার সিয়াম রিপ প্রদেশের আংকর ওয়াট (আঙ্করভাট)। আংকর অর্থ নগরী আর ওয়াট অর্থ মন্দির। অর্থাৎ মন্দিরের নগর।
রাজা জয়বর্মন-২ (৮০২-৮৩৫) খেমার রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তরুণ বয়সে তিনি জাভার শৈলেন্দ্র বংশের রাজসভায় থাকতেন। পরে বহু সংঘাত, জোট ও যুদ্ধের পর তিনি দেশকে জাভার দখলমুক্ত করেন। খেমার রাজত্ব ৮০৫-১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাপটের সাথে টিকে ছিল। পঁচিশ জন রাজা এই সময়ে রাজত্ব করেন। তাঁরা ১ হাজারের অধিক মন্দির নির্মাণ করেন, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আংকর ওয়াট।
একাদশ শতাব্দীতে খেমার সাম্রাজ্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী সা¤্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। সাম্রাজ্যের সীমানা- পূর্বে চম্পা (মধ্যে ভিয়েতনাম), উত্তরে চীন, দক্ষিণে সাগর ও পূর্বে ব্রহ্মদেশ। দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতে আংকর ওয়াটের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লক্ষ ৫০ হাজার।
রাজা জয়বর্মন ক্ষমতায় এসে কম্বোডিয়ার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত টনলে সেপ হ্রদের উত্তরে হরিহরালয়ে প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র যশবর্মন রাজধানী স্থানান্তর করেন যশোধারাপুরে। এটি বর্তমানে আংকর ওয়াট নামে পরিচিত।
খেমার রাজাদের বৈশিষ্ট্য ছিল নিজেদের প্রিয় দেবতাদের নামে বা বাবা মায়ের নামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই খেমার রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ তো বটেই, সাথে প্রাসাদ রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। এইসময় ক্ষমতায় আসেন সূর্য্যবর্মন-২। প্রথমে নিজের ঘরকে ফেরালেন শৃঙ্খলার মধ্যে, তারপর আঘাত হানলেন চম্পা ও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে আংকর ওয়াট নির্মাণ শুরু করেন সূর্য্যবর্মন এবং সেটি ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। মন্দির নির্মাণ চলে ২৮ বছর ধরে।
আংকর ওয়াট দেখার জন্য ব্যাংকক থেকে সিয়াম রিপে গিয়েছিলাম বিমানে। সূর্যোদয় দেখবো, হোটেলের স্টাফরা জানালো আগের দিন গিয়ে টিকিট কেটে আনতে হবে। তারাই একটা টুকটুক (অটো) ঠিক করে দিল। আদতে একটা মোটর সাইকেলে চারজন বসতে পারে- এরকম ব্যবস্থা আছে। এই টুকটুক খুব সাশ্রয়ী। আংকর ওয়াট হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়, প্রায় ৮ কিলোমিটার। ফরাসি ধাঁচের শহর। রাস্তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে টিকিট কাউন্টারে চলে এলাম। এখানে যার যার টিকিট তাকেই করতে হয়। একদিনের জন্য প্রতি টিকিট ২০ ডলার। কাউন্টারে দাঁড়ালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি উঠে ও টিকিটে প্রিন্ট হয়ে যায়। আংকর ওয়াটে সূর্যোদয় দেখতে হলে রাত থাকতেই বের হতে হবে। যখন আংকর ওয়াটে পৌঁছলাম, তখনও রাতের আঁধার কাটেনি। অনেকের দেখাদেখি জলবেষ্টনীর ধারে গিয়ে বসলাম। অপেক্ষা করছি সূর্য্য ওঠার।
ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে আংকর ওয়াট। গম্বুজগুলো দূর থেকে মনে হচ্ছে এক লাইনে। গম্বুজের অবয়বের পিছনে ধীরে ধীরে লাল হয়ে আসছে আকাশ। আর দেরি নেই ভোরের আগমনের। কত দেশে কত নগরীতে সূর্যোদয় দেখেছি। সেই একই সূর্য্য। তারপরও প্রতিবারই এর অনুভূতি ভিন্ন ভৌগলিক ভিন্নতার কারণে, পারিপার্শ্বিকতার কারণে। আংকরের চূড়ার ওপর লাল টকটকে সূর্য্য।
পুরো নগরীর নাম আংকর ওয়াট আর এটা এখন এই মন্দিরের নামই হয়ে গেছে। যশোধারাপুরের এই মন্দিরের আদি নাম ছিল বরাহ বিষ্ণুলোক বা পরম বিষ্ণুলোক। পূর্বপুরুষের মন্দিরগুলো থেকে এই মন্দির ছিল ব্যতিক্রমী। সূর্য্যবর্মনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শৈব। কিন্তু তিনি প্রথা ভেঙ্গে এই মন্দির উৎসর্গ করেন শ্রীবিষ্ণুকে।
মন্দিরের মুখ পশ্চিমমুখি, ৪০২ একর জমির ওপর অবস্থিত। বাইরের দেওয়ালের দৈর্ঘ্য ১০২৫ মিটার ও প্রস্থ ৮০২ মিটার। দেওয়াল থেকে ৩০ মিটার দূরে চারিদিকে ১৯০ মিটার প্রশস্ত পানির পরিখা। পাথর দিয়ে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে। পরিখার ওপর পাথরের সেতু। সেতু পার হয়ে মাঠ। মাঠের দুইপাশে দুটি ছোট ছোট ঘর তৎকালে লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মন্দিরটির বৈশিষ্ট্য, পর্যায়ক্রমে তিনটি চারকোণা গ্যালারি। এই গ্যালারিগুলো উৎসর্গ করা হয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রাজাকে। প্রতি গ্যালারির মূল বিন্দুতে গোপুরম। আর ভিতরের দিকে চার কোণায় চারটি টাওয়ার। সবচেয়ে উঁচুটা মধ্যখানে। পুরো মন্দিরের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মন্দিরে প্রবেশপথে প্রথমেই চোখে পড়বে সাত মাথার নাগরাজ মূর্তি। সিঁড়ি বেয়ে একতলায় উঠলে বামদিকে অষ্টভূজ বিষ্ণু মূর্তি। ভিতরের একটি কক্ষে আছে বৌদ্ধ মূর্তি।
করিডোর দিয়ে বামে এগোলে দেওয়ালের গায়ে রামায়ণ, মহাভারতের গল্পের রিলিফ। সাথে সূর্য্যবর্মনের ছবিও। পুরো মন্দির কাঠামোর একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা আছে। যেমন: মেরু পর্বতের প্রতীক পঞ্চচূড়া, দেশ ও মহাসাগরের প্রতীক দেওয়াল ও পরিখা। সাধারণত দর্শনার্থীরা নিচতলায় প্রবেশের অধিকার পেতেন। উপরের তলাগুলোতে সিঁড়ি খুব খাড়া। সবচেয়ে উঁচুস্তরে আছে দেবতাদের জন্য কক্ষ।
পুরো দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্র। তিনতলা পর্যন্ত ঘুরে এসে এবার পিছনের দিকে এলাম। পিচঢালা রাস্তা। প্রাচীর সংলগ্ন এলাকায় গাছ-গাছালি। মন্দিরের সামনে ডানে ছোট একটি জলাশয়। এখান থেকে সবাই আংকর ওয়াটের ছবি তুলেন। টাকা দিলেই সাথে সাথে প্রিন্ট করে দিয়ে দিবে। এর সাথে আছে স্যুভেনির মার্কেট। সবকিছু পাওয়া যায়।
সূর্য্যবর্মন-২ এর মৃত্যুর পর জয়বর্মন-৭ পুরোনো রাজধানীর অদূরে আংকোর থম নামে নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। নগর পরিকল্পনা ছিল ম-লাকৃতি এবং এর ঠিক মধ্যখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় মন্দির ‘বেয়ন’। পুরো নগরী প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নগরীর চারিদিকে পানির পরিখা। নগরীর বর্তমান প্রবেশপথ দক্ষিণ দিকে। পরিখার ওপর পাথরের সেতু, দুই পাশে সমুদ্র মন্থনের মূর্তি। একপাশে দেবতারা, আরেক পাশে অসুর। দুই দলের হাতেই বাসুকী নাগ। সেতুর মাথায় তোরণ। তোরণের উপরিভাগে হাস্যময় মুখাবয়ব।
দূর থেকে মন্দিরের অনেকগুলো গম্বুজ দেখা যায়। এই মন্দিরে ৫০টি গম্বুজ ছিল। বর্তমানে আছে ৩৭টি। গর্ভগৃহে আছে শিবলিঙ্গ। কম্বোডিয়ার অনেক জায়গায় দেখেছি রাজশক্তির ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সাথে মন্দিরের দেবতাও পরিবর্তিত হয়। আংকর ওয়াট আকারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় হতে পারে, তবে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শৈল্পিক মন্দির ‘বেয়ন’। জয়বর্মন-৭ তাঁর মা-বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে তা প্রম ও প্রিয়া খান নামে আরো দুটি বিখ্যাত মন্দির নির্মাণ করেন।
বেয়নের উত্তর-পশ্চিম দিকে বুয়াফুন মন্দির। একাদশ শতাব্দীতে রাজা উদয়াদিত্যনারায়ণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পিরামিড আকারের মন্দিরটি শুরুতে শিব মন্দির ছিল। ১৫শ শতাব্দীতে এটা বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। তিন স্তরের এই স্থাপনাটি নরম মাটির ওপর বালি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে শুরু থেকেই এই মন্দির ভার নিতে পারেনি। নিজের ভারে নিজেই হেলে গেছে। রাস্তা থেকে মন্দিরের দিকে সোজা পাথর বাঁধানো পথ। এই পথ মাটি থেকে ৬-৭ ফুট উঁচু পিলার দিয়ে তৈরি। পথের উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রথমে ভিত্তি বানানো হয়। তারপর আরো দুইতলা। এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ- পশ্চিম দেওয়ালে অসম্পূর্ণ বিশালাকার শায়িত বুদ্ধমূর্তি, যার উচ্চতা ২৭ ফুট ও লম্বায় ২১০ ফুট।
বান্টেই-গ্রেই মন্দির মূল মন্দিরগুলো থেকে একটু দূরে, আংকর থম থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে। এই মন্দির দশম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিষ্ণুকুমার ও যজ্ঞবরাহ নামে দুই রাজ অমাত্য এই মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দির আকারে ছোট ও রাজধানী যশোধারাপুরের বাইরে। বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর নিয়ে গুচ্ছ মন্দির। উন্নত মানের গোলাপী পাথর দিয়ে নির্মিত স্থাপনা। মন্দিরের আসল নাম ত্রিভুবন মহেশ্বর। মন্দিরের বিভিন্ন ভবন ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতি নিবেদিত। বান্টেই-গ্রেই শৈল্পিক কারুকার্য্যরে জন্য বিখ্যাত। কোনও জায়গায় শিব পার্বতী কাহিনী, কোথাও হিরণ্যকশিপু বধ, আবার কোথাও রাবনের কৈলাস পর্বত তুলে নেওয়ার প্রচেষ্টার চিত্র অংকিত হয়েছে। দরজার চৌকাঠগুলো অসাধারণ অলংকরণে সুশোভিত। এই নান্দনিক কাজগুলো এত সূক্ষ্মভাবে করা যে, কোনও পুরুষালি হাত দিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই স্থানীয়রা নাম দিয়েছে বান্টেই গ্রেই অর্থাৎ মহিলাদের দুর্গ।
বেয়নের ২.৫ কিলোমিটার পূর্বে প্রি-খান। এক অনিন্দ্য সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির। ১১৯১ সালে এই জায়গায় জয়বর্মন-৭ আক্রমনকারী চামদের পরাজিত করেন। তিনি স্বর্গত পিতার উদ্দেশে এই মন্দির উৎসর্গ করেন ও জায়গার নাম রাখেন নগর-জয়শ্রী। পরে পবিত্র-তরবারী নামে এই মন্দির অভিহিত হয়। সমসাময়িক খেমার মন্দিরের মতো এর চারিদিকে পরিখা ও প্রতিরক্ষা প্রাচীর আছে। পাথরের দেওয়ালে প্রতি ৫০ মিটার পর পর ২.৫ মিটার উচ্চতার গরুড় মূর্তির রিলিফ ওয়ার্ক। এই মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশ পথ। প্রতিটিতেই গোপুরম তিনটি করে। প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে পাথরের দ্বারপাল তোরণের সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
তা-প্রম নির্মিত হয় ১১৮৬ সালে। আসল নাম রাজবিহার। তা-প্রম অর্থ পূর্বপুরুষ ব্রহ্মা। খেমার রাজ জয়বর্মন-৭ তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন এই মন্দির। এখানে ২৬০টি দেবতার মূর্তি ও ৬৯টি টাওয়ার ছিল। বর্তমানে শুধু ধ্বংসস্তূপ। জঙ্গলে ঢাকা ভগ্ন মন্দিরের অবশেষ দর্শনার্থীদের এক বিমূর্ত দর্শনের ভাবে নিমগ্ন করে।
বানটেই-কেদি ১২শ শতাব্দীর শেষভাগে জয়বর্মন-৭ দ্বারা নির্মিত। মূল নকশা স্টাইল তা-প্রম বা প্রি-খান এর মতো, কিন্তু আকারে অনেক ছোট। এই মন্দিরকে মঙ্কের দুর্গ বলা হয়। এটা বৌদ্ধ মন্দির। মন্দিরে সিংহ, পাঁচ মাথা বা সাত মাথার সর্পমূর্তি বা গরুড়ের চিত্র পাওয়া যায়। মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- চত্বরের ভিতরেই ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০০ মিটার প্রস্থের একটা জলাধার। যেখানে রাজপরিবারের সদস্যরা স্নান করতেন। জলাশয়ের মধ্যখানে ছোট একটা মন্দির। যেটা ধ্যান করার কাজে ব্যবহৃত হতো। চারিদিকে এখন ভগ্নস্তূপ।
আংকর থম নগরীর মধ্যেই ‘এলিফ্যান্ট টেরাস’ এর অবস্থান। এটা একটা দেওয়াল। সামনে উন্মুক্ত মাঠ। দেওয়ালের দৈর্ঘ্য ৩৫০ মিটার। একসময় এর ওপর কাঠের ঘর ছিল। কালের আবহে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখানেই রাজারা তাদের প্রজাদের দর্শন দিতেন, অভাব অভিযোগ শুনতেন। এই মঞ্চ থেকে রাজা তার যুদ্ধ ফেরত বিজয়ী সেনাবাহিনীকে অভ্যর্থনা জানাতেন। সামনের মাঠে সময়ে সময়ে মল্লযুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ, ঘোড়দৌড় এবং নৃত্য প্রদর্শনী হতো। এখানেও দেওয়ালের মধ্যখানে গরুড়, সিংহ সহ আরো বিভিন্ন হিন্দু মিথোলোজির গল্প কার্ভিং করা আছে। ডান-বামের সেকশনে খেমার মাহুতবাহি হাতীর কার্ভিং। তাই জায়গাটার নাম হয় এলিফ্যান্ট টেরাস। দেওয়ালের ভিতরে অজ¯্র অপ্সরা, গরুড়, খেমারদের কাহিনী চিত্রিত। মঞ্চের বিপরীত দিকে মাঠের ওপারে ১২টি টাওয়ার পুরো জায়গার শোভা বর্ধন করেছে।
প্রে-রুপ একটি পুরোনো মন্দির হলেও ব্যতিক্রমী। রাজা রাজেন্দ্রবর্মন ৯৬১ সালে আংকর থমের পূর্বে এটা নির্মাণ করেন। তিন স্তরবিশিষ্ট মন্দিরটির প্রবেশদ্বার পূর্বদিকে। এখানে ছয়টি টাওয়ার ছিল। মন্দিরটি শিব মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। লাল ইট, ল্যাটেরাইট ও লাল পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে। এই মন্দিরের প্রবেশপথে দুইপাশে দুটি ঘর আছে। কেউ বলে লাইব্রেরি আর কেউ বলে শব ঘর। শবদাহ করার পর ভস্ম নিয়ে মন্দিরের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করা হতো। তাই এটির স্থানীয় নাম প্রে রুপ অর্থাৎ দেহ পরিবর্তনের স্থান। ভূমি থেকে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায়। সিঁড়িগুলো বেশ চওড়া, মাথায় দূটি সিংহের মূর্তি। এছাড়াও এখানে অনেক মন্দির আছে।
১৪৩১ সাল থেকেই আংকরে খেমারদের প্রতিপত্তি কমতে থাকে। প্রতিবেশী শত্রুদের চাপে খেমার সা¤্রাজ্য হয়ে যায় বিলীন। যেহেতু রাজা নেই, মন্দিরেরও কদর নেই। তবে এখানকার মন্দিরের প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে বিমোহিত করবেই। আংকর ওয়াটে থাকার জায়গা নেই। সিয়াম রিপেই থাকতে হবে। বেড়ানোর জন্য টুকটুকই শ্রেয়। পুরো এলাকাজুড়ে রেস্টুরেন্ট ও ওয়াশরুম আছে। আংকর ওয়াট শুধু প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ নয় বরং এক উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন।
[লেখক: লে. কর্নেল (অব.); পর্যটক]
তপন মিত্র চৌধুরী
রোববার, ১৩ আগস্ট ২০২৩
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা কম্বোডিয়ার সিয়াম রিপ প্রদেশের আংকর ওয়াট (আঙ্করভাট)। আংকর অর্থ নগরী আর ওয়াট অর্থ মন্দির। অর্থাৎ মন্দিরের নগর।
রাজা জয়বর্মন-২ (৮০২-৮৩৫) খেমার রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তরুণ বয়সে তিনি জাভার শৈলেন্দ্র বংশের রাজসভায় থাকতেন। পরে বহু সংঘাত, জোট ও যুদ্ধের পর তিনি দেশকে জাভার দখলমুক্ত করেন। খেমার রাজত্ব ৮০৫-১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাপটের সাথে টিকে ছিল। পঁচিশ জন রাজা এই সময়ে রাজত্ব করেন। তাঁরা ১ হাজারের অধিক মন্দির নির্মাণ করেন, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আংকর ওয়াট।
একাদশ শতাব্দীতে খেমার সাম্রাজ্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী সা¤্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। সাম্রাজ্যের সীমানা- পূর্বে চম্পা (মধ্যে ভিয়েতনাম), উত্তরে চীন, দক্ষিণে সাগর ও পূর্বে ব্রহ্মদেশ। দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতে আংকর ওয়াটের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লক্ষ ৫০ হাজার।
রাজা জয়বর্মন ক্ষমতায় এসে কম্বোডিয়ার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত টনলে সেপ হ্রদের উত্তরে হরিহরালয়ে প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র যশবর্মন রাজধানী স্থানান্তর করেন যশোধারাপুরে। এটি বর্তমানে আংকর ওয়াট নামে পরিচিত।
খেমার রাজাদের বৈশিষ্ট্য ছিল নিজেদের প্রিয় দেবতাদের নামে বা বাবা মায়ের নামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই খেমার রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ তো বটেই, সাথে প্রাসাদ রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। এইসময় ক্ষমতায় আসেন সূর্য্যবর্মন-২। প্রথমে নিজের ঘরকে ফেরালেন শৃঙ্খলার মধ্যে, তারপর আঘাত হানলেন চম্পা ও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে আংকর ওয়াট নির্মাণ শুরু করেন সূর্য্যবর্মন এবং সেটি ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। মন্দির নির্মাণ চলে ২৮ বছর ধরে।
আংকর ওয়াট দেখার জন্য ব্যাংকক থেকে সিয়াম রিপে গিয়েছিলাম বিমানে। সূর্যোদয় দেখবো, হোটেলের স্টাফরা জানালো আগের দিন গিয়ে টিকিট কেটে আনতে হবে। তারাই একটা টুকটুক (অটো) ঠিক করে দিল। আদতে একটা মোটর সাইকেলে চারজন বসতে পারে- এরকম ব্যবস্থা আছে। এই টুকটুক খুব সাশ্রয়ী। আংকর ওয়াট হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়, প্রায় ৮ কিলোমিটার। ফরাসি ধাঁচের শহর। রাস্তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে টিকিট কাউন্টারে চলে এলাম। এখানে যার যার টিকিট তাকেই করতে হয়। একদিনের জন্য প্রতি টিকিট ২০ ডলার। কাউন্টারে দাঁড়ালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি উঠে ও টিকিটে প্রিন্ট হয়ে যায়। আংকর ওয়াটে সূর্যোদয় দেখতে হলে রাত থাকতেই বের হতে হবে। যখন আংকর ওয়াটে পৌঁছলাম, তখনও রাতের আঁধার কাটেনি। অনেকের দেখাদেখি জলবেষ্টনীর ধারে গিয়ে বসলাম। অপেক্ষা করছি সূর্য্য ওঠার।
ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে আংকর ওয়াট। গম্বুজগুলো দূর থেকে মনে হচ্ছে এক লাইনে। গম্বুজের অবয়বের পিছনে ধীরে ধীরে লাল হয়ে আসছে আকাশ। আর দেরি নেই ভোরের আগমনের। কত দেশে কত নগরীতে সূর্যোদয় দেখেছি। সেই একই সূর্য্য। তারপরও প্রতিবারই এর অনুভূতি ভিন্ন ভৌগলিক ভিন্নতার কারণে, পারিপার্শ্বিকতার কারণে। আংকরের চূড়ার ওপর লাল টকটকে সূর্য্য।
পুরো নগরীর নাম আংকর ওয়াট আর এটা এখন এই মন্দিরের নামই হয়ে গেছে। যশোধারাপুরের এই মন্দিরের আদি নাম ছিল বরাহ বিষ্ণুলোক বা পরম বিষ্ণুলোক। পূর্বপুরুষের মন্দিরগুলো থেকে এই মন্দির ছিল ব্যতিক্রমী। সূর্য্যবর্মনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শৈব। কিন্তু তিনি প্রথা ভেঙ্গে এই মন্দির উৎসর্গ করেন শ্রীবিষ্ণুকে।
মন্দিরের মুখ পশ্চিমমুখি, ৪০২ একর জমির ওপর অবস্থিত। বাইরের দেওয়ালের দৈর্ঘ্য ১০২৫ মিটার ও প্রস্থ ৮০২ মিটার। দেওয়াল থেকে ৩০ মিটার দূরে চারিদিকে ১৯০ মিটার প্রশস্ত পানির পরিখা। পাথর দিয়ে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে। পরিখার ওপর পাথরের সেতু। সেতু পার হয়ে মাঠ। মাঠের দুইপাশে দুটি ছোট ছোট ঘর তৎকালে লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মন্দিরটির বৈশিষ্ট্য, পর্যায়ক্রমে তিনটি চারকোণা গ্যালারি। এই গ্যালারিগুলো উৎসর্গ করা হয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রাজাকে। প্রতি গ্যালারির মূল বিন্দুতে গোপুরম। আর ভিতরের দিকে চার কোণায় চারটি টাওয়ার। সবচেয়ে উঁচুটা মধ্যখানে। পুরো মন্দিরের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মন্দিরে প্রবেশপথে প্রথমেই চোখে পড়বে সাত মাথার নাগরাজ মূর্তি। সিঁড়ি বেয়ে একতলায় উঠলে বামদিকে অষ্টভূজ বিষ্ণু মূর্তি। ভিতরের একটি কক্ষে আছে বৌদ্ধ মূর্তি।
করিডোর দিয়ে বামে এগোলে দেওয়ালের গায়ে রামায়ণ, মহাভারতের গল্পের রিলিফ। সাথে সূর্য্যবর্মনের ছবিও। পুরো মন্দির কাঠামোর একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা আছে। যেমন: মেরু পর্বতের প্রতীক পঞ্চচূড়া, দেশ ও মহাসাগরের প্রতীক দেওয়াল ও পরিখা। সাধারণত দর্শনার্থীরা নিচতলায় প্রবেশের অধিকার পেতেন। উপরের তলাগুলোতে সিঁড়ি খুব খাড়া। সবচেয়ে উঁচুস্তরে আছে দেবতাদের জন্য কক্ষ।
পুরো দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্র। তিনতলা পর্যন্ত ঘুরে এসে এবার পিছনের দিকে এলাম। পিচঢালা রাস্তা। প্রাচীর সংলগ্ন এলাকায় গাছ-গাছালি। মন্দিরের সামনে ডানে ছোট একটি জলাশয়। এখান থেকে সবাই আংকর ওয়াটের ছবি তুলেন। টাকা দিলেই সাথে সাথে প্রিন্ট করে দিয়ে দিবে। এর সাথে আছে স্যুভেনির মার্কেট। সবকিছু পাওয়া যায়।
সূর্য্যবর্মন-২ এর মৃত্যুর পর জয়বর্মন-৭ পুরোনো রাজধানীর অদূরে আংকোর থম নামে নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। নগর পরিকল্পনা ছিল ম-লাকৃতি এবং এর ঠিক মধ্যখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় মন্দির ‘বেয়ন’। পুরো নগরী প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নগরীর চারিদিকে পানির পরিখা। নগরীর বর্তমান প্রবেশপথ দক্ষিণ দিকে। পরিখার ওপর পাথরের সেতু, দুই পাশে সমুদ্র মন্থনের মূর্তি। একপাশে দেবতারা, আরেক পাশে অসুর। দুই দলের হাতেই বাসুকী নাগ। সেতুর মাথায় তোরণ। তোরণের উপরিভাগে হাস্যময় মুখাবয়ব।
দূর থেকে মন্দিরের অনেকগুলো গম্বুজ দেখা যায়। এই মন্দিরে ৫০টি গম্বুজ ছিল। বর্তমানে আছে ৩৭টি। গর্ভগৃহে আছে শিবলিঙ্গ। কম্বোডিয়ার অনেক জায়গায় দেখেছি রাজশক্তির ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সাথে মন্দিরের দেবতাও পরিবর্তিত হয়। আংকর ওয়াট আকারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় হতে পারে, তবে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শৈল্পিক মন্দির ‘বেয়ন’। জয়বর্মন-৭ তাঁর মা-বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে তা প্রম ও প্রিয়া খান নামে আরো দুটি বিখ্যাত মন্দির নির্মাণ করেন।
বেয়নের উত্তর-পশ্চিম দিকে বুয়াফুন মন্দির। একাদশ শতাব্দীতে রাজা উদয়াদিত্যনারায়ণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পিরামিড আকারের মন্দিরটি শুরুতে শিব মন্দির ছিল। ১৫শ শতাব্দীতে এটা বৌদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। তিন স্তরের এই স্থাপনাটি নরম মাটির ওপর বালি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে শুরু থেকেই এই মন্দির ভার নিতে পারেনি। নিজের ভারে নিজেই হেলে গেছে। রাস্তা থেকে মন্দিরের দিকে সোজা পাথর বাঁধানো পথ। এই পথ মাটি থেকে ৬-৭ ফুট উঁচু পিলার দিয়ে তৈরি। পথের উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রথমে ভিত্তি বানানো হয়। তারপর আরো দুইতলা। এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ- পশ্চিম দেওয়ালে অসম্পূর্ণ বিশালাকার শায়িত বুদ্ধমূর্তি, যার উচ্চতা ২৭ ফুট ও লম্বায় ২১০ ফুট।
বান্টেই-গ্রেই মন্দির মূল মন্দিরগুলো থেকে একটু দূরে, আংকর থম থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে। এই মন্দির দশম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিষ্ণুকুমার ও যজ্ঞবরাহ নামে দুই রাজ অমাত্য এই মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দির আকারে ছোট ও রাজধানী যশোধারাপুরের বাইরে। বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর নিয়ে গুচ্ছ মন্দির। উন্নত মানের গোলাপী পাথর দিয়ে নির্মিত স্থাপনা। মন্দিরের আসল নাম ত্রিভুবন মহেশ্বর। মন্দিরের বিভিন্ন ভবন ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতি নিবেদিত। বান্টেই-গ্রেই শৈল্পিক কারুকার্য্যরে জন্য বিখ্যাত। কোনও জায়গায় শিব পার্বতী কাহিনী, কোথাও হিরণ্যকশিপু বধ, আবার কোথাও রাবনের কৈলাস পর্বত তুলে নেওয়ার প্রচেষ্টার চিত্র অংকিত হয়েছে। দরজার চৌকাঠগুলো অসাধারণ অলংকরণে সুশোভিত। এই নান্দনিক কাজগুলো এত সূক্ষ্মভাবে করা যে, কোনও পুরুষালি হাত দিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই স্থানীয়রা নাম দিয়েছে বান্টেই গ্রেই অর্থাৎ মহিলাদের দুর্গ।
বেয়নের ২.৫ কিলোমিটার পূর্বে প্রি-খান। এক অনিন্দ্য সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির। ১১৯১ সালে এই জায়গায় জয়বর্মন-৭ আক্রমনকারী চামদের পরাজিত করেন। তিনি স্বর্গত পিতার উদ্দেশে এই মন্দির উৎসর্গ করেন ও জায়গার নাম রাখেন নগর-জয়শ্রী। পরে পবিত্র-তরবারী নামে এই মন্দির অভিহিত হয়। সমসাময়িক খেমার মন্দিরের মতো এর চারিদিকে পরিখা ও প্রতিরক্ষা প্রাচীর আছে। পাথরের দেওয়ালে প্রতি ৫০ মিটার পর পর ২.৫ মিটার উচ্চতার গরুড় মূর্তির রিলিফ ওয়ার্ক। এই মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশ পথ। প্রতিটিতেই গোপুরম তিনটি করে। প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে পাথরের দ্বারপাল তোরণের সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
তা-প্রম নির্মিত হয় ১১৮৬ সালে। আসল নাম রাজবিহার। তা-প্রম অর্থ পূর্বপুরুষ ব্রহ্মা। খেমার রাজ জয়বর্মন-৭ তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন এই মন্দির। এখানে ২৬০টি দেবতার মূর্তি ও ৬৯টি টাওয়ার ছিল। বর্তমানে শুধু ধ্বংসস্তূপ। জঙ্গলে ঢাকা ভগ্ন মন্দিরের অবশেষ দর্শনার্থীদের এক বিমূর্ত দর্শনের ভাবে নিমগ্ন করে।
বানটেই-কেদি ১২শ শতাব্দীর শেষভাগে জয়বর্মন-৭ দ্বারা নির্মিত। মূল নকশা স্টাইল তা-প্রম বা প্রি-খান এর মতো, কিন্তু আকারে অনেক ছোট। এই মন্দিরকে মঙ্কের দুর্গ বলা হয়। এটা বৌদ্ধ মন্দির। মন্দিরে সিংহ, পাঁচ মাথা বা সাত মাথার সর্পমূর্তি বা গরুড়ের চিত্র পাওয়া যায়। মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- চত্বরের ভিতরেই ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০০ মিটার প্রস্থের একটা জলাধার। যেখানে রাজপরিবারের সদস্যরা স্নান করতেন। জলাশয়ের মধ্যখানে ছোট একটা মন্দির। যেটা ধ্যান করার কাজে ব্যবহৃত হতো। চারিদিকে এখন ভগ্নস্তূপ।
আংকর থম নগরীর মধ্যেই ‘এলিফ্যান্ট টেরাস’ এর অবস্থান। এটা একটা দেওয়াল। সামনে উন্মুক্ত মাঠ। দেওয়ালের দৈর্ঘ্য ৩৫০ মিটার। একসময় এর ওপর কাঠের ঘর ছিল। কালের আবহে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখানেই রাজারা তাদের প্রজাদের দর্শন দিতেন, অভাব অভিযোগ শুনতেন। এই মঞ্চ থেকে রাজা তার যুদ্ধ ফেরত বিজয়ী সেনাবাহিনীকে অভ্যর্থনা জানাতেন। সামনের মাঠে সময়ে সময়ে মল্লযুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ, ঘোড়দৌড় এবং নৃত্য প্রদর্শনী হতো। এখানেও দেওয়ালের মধ্যখানে গরুড়, সিংহ সহ আরো বিভিন্ন হিন্দু মিথোলোজির গল্প কার্ভিং করা আছে। ডান-বামের সেকশনে খেমার মাহুতবাহি হাতীর কার্ভিং। তাই জায়গাটার নাম হয় এলিফ্যান্ট টেরাস। দেওয়ালের ভিতরে অজ¯্র অপ্সরা, গরুড়, খেমারদের কাহিনী চিত্রিত। মঞ্চের বিপরীত দিকে মাঠের ওপারে ১২টি টাওয়ার পুরো জায়গার শোভা বর্ধন করেছে।
প্রে-রুপ একটি পুরোনো মন্দির হলেও ব্যতিক্রমী। রাজা রাজেন্দ্রবর্মন ৯৬১ সালে আংকর থমের পূর্বে এটা নির্মাণ করেন। তিন স্তরবিশিষ্ট মন্দিরটির প্রবেশদ্বার পূর্বদিকে। এখানে ছয়টি টাওয়ার ছিল। মন্দিরটি শিব মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। লাল ইট, ল্যাটেরাইট ও লাল পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে। এই মন্দিরের প্রবেশপথে দুইপাশে দুটি ঘর আছে। কেউ বলে লাইব্রেরি আর কেউ বলে শব ঘর। শবদাহ করার পর ভস্ম নিয়ে মন্দিরের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করা হতো। তাই এটির স্থানীয় নাম প্রে রুপ অর্থাৎ দেহ পরিবর্তনের স্থান। ভূমি থেকে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায়। সিঁড়িগুলো বেশ চওড়া, মাথায় দূটি সিংহের মূর্তি। এছাড়াও এখানে অনেক মন্দির আছে।
১৪৩১ সাল থেকেই আংকরে খেমারদের প্রতিপত্তি কমতে থাকে। প্রতিবেশী শত্রুদের চাপে খেমার সা¤্রাজ্য হয়ে যায় বিলীন। যেহেতু রাজা নেই, মন্দিরেরও কদর নেই। তবে এখানকার মন্দিরের প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে বিমোহিত করবেই। আংকর ওয়াটে থাকার জায়গা নেই। সিয়াম রিপেই থাকতে হবে। বেড়ানোর জন্য টুকটুকই শ্রেয়। পুরো এলাকাজুড়ে রেস্টুরেন্ট ও ওয়াশরুম আছে। আংকর ওয়াট শুধু প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ নয় বরং এক উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন।
[লেখক: লে. কর্নেল (অব.); পর্যটক]