কাজী সালমান শীশ
আমার দাদা কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের সকল স্মৃতিই মুখে মুখে শুনে বা লেখা পড়ে জানা, কারণ আমার জন্মের অর্ধ যুগ পূর্বে তিনি পরলোকবাসী হন। প্রথমত দাদী, আব্বা, চাচা ও ফুপুদের কাছে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার কথা। পরবর্তী সময়ে পড়েছি ব্যক্তি ইদরিস সম্পর্কে বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক লেখা, তাঁর রচিত প্রবন্ধ, গল্প, অনূদিত উপন্যাস ও নাটক। সুযোগ পেয়েছি তাঁর প্রকাশিত রচনাবলীর প্রচ্ছদ আঁকার। একজন কাছের মানুষের সরাসরি সান্নিধ্য না পেয়ে তাঁর সম্পর্কে লেখা আমার পক্ষে কঠিন; তবুও তাঁর ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীর মাসে চেষ্টা করছি অন্তত তথ্য সম্বলিত একটি লেখা রচনার।
১৯০৬ সালের ১১ই নভেম্বর রংপুরের মুন্সীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। তিনি বি.এ. পাশ করেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে, এরপর কলকাতা যাত্রা। কলকাতার রিপন কলেজে আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করলেও তা অসামাপ্তই থেকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার পর শুরু হয় তাঁর পেশাগত জীবন। কলকাতায় অবস্থানকালে ১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন। এরপর ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে সাপ্তাহিক মিল্লাত ও দৈনিক ইত্তেহাদে যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
দেশভাগের পর কাজী মোহাম্মদ ইদরিস সপরিবারে ফিরে আসেন পূর্ববঙ্গে, বর্তমান বাংলাদেশে। ১৯৫০-১৯৬০ সময়কালে ঢাকায় অবস্থান করেন এবং দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদও সাপ্তাহিক পূর্বদেশে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। এরপর সম্পাদনা করেন দৈনিক ইত্তেহাদ, অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু, সাপ্তাহিক যুগবাণী পত্রিকা সমূহ। তৎকালীন সময়ের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক পত্রিকাগুলোতে তিনি কাজ করে গেছেন সাবলীলভাবে, কিন্তু কখনোই বেশি সময় এক জায়গায় মন বসাতে পারেননি। বাঁধা-ধরা পেশাগত কাজে আপস করে চলা তাঁর মত আদর্শবান মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না,তাই চাকরি ছেড়েছেন বহুবার। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পরিবারকে আর্থিক অনটনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে সেই অস্বচ্ছলতা কখনোই তাঁদের সেভাবে স্পর্শ করেনি। আর্থিক উন্নতির থেকে আদর্শগত উৎকর্ষতা যে অনেক বড় বিষয়Ñ সেটা তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যই অনুধাবন করতে পারতেন। সেই যুগে তাঁর চারপাশের খাঁটি মানুষ, বন্ধুবান্ধব ও স্ত্রী কাজী আজিজা ইদরিসের মানসিক সহায়তা এর নেপথ্যে কাজ করে গেছে, সন্দেহ নেই।
বাম রাজনীতির সাথে সর্বদাযুক্ত কাজী মোহাম্মদ ইদরিস সাংবাদিক হিসেবে নির্ভীকতার সাথে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি হলেও তাঁর সত্যিকারের প্রতিভা লুকিয়ে ছিল জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যকর্মে। জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার আগ্রহ থেকেই সম্ভবত তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হন। তাঁর অনূদিত উপন্যাসের মধ্যে- পীত নদীর বাঁকে (১৯৫৯), নটীর প্রেম (১৯৬০), অন্তঃশীলা (১৯৬৮) ও নাটকের মধ্যে স্ট্রিন্ডবার্গের সাতটি নাটক (১৯৮৭) গ্রন্থগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গত শতাব্দীর সৎ, জ্ঞানী, প্রতিভাধর ও অন্তর্মুখী বাঙালীদের অনেকের সম্পর্কেই বর্তমান প্রজন্ম জানে না। একজন পাশ্চাত্যের লেখক বা সাংবাদিক সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে সহজেই তথ্য জানা যায়, যা বাংলাদেশের বাস্তবতায় দুষ্কর। সেজন্য দাদার গ্রন্থগুলোর প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে ছোট করে উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি।
১৯৯৫ সালে, দাদার মৃত্যুর দুই দশক পর তাঁর সন্তানদের উদ্দ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘কাজী মোহাম্মদ ইদরিস স্মারকগ্রন্থ’। সেখানেস্থান পায় ৪৪টি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। রণেশ দাশগুপ্ত, সুফিয়া কামাল, কামাল লোহানী, শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, রফিকুন নবী থেকে শুরু করে নানা গুণীজনদের লেখা সেখানে রয়েছে।পারিবারিকভাবে বইটি প্রকাশ করতে বহুদিন ধরে কাজ করতে দেখেছি আমার আব্বা ও ছোট চাচাকে। বইটি তাঁর স্ত্রী কাজী আজিজা ইদরিস ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ করেন বলে সরাসরি কোনো প্রকাশনীর নাম সেখানে উল্লেখ নেই, তবে গ্রন্থটির পরিবেশক শাগবাগস্থ জনান্তিক প্রকাশনীতে বইটি মিলবে। দৈনিক সংবাদের দীর্ঘদিনের সম্পাদক সন্তোষ গুপ্ত বইটি সম্পাদনা করেন। আদর্শবান রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিস সম্পর্কে জানতে স্মারকগ্রন্থটি আদর্শ।
দাদার মৃত্যুর পাঁচ দশক পরে তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প ও নাটক নিয়ে নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে দুই খ-ের গ্রন্থ ‘কাজী মোহাম্মদ ইদরিস রচনাবলী’। প্রকাশনা ডটকম থেকে প্রকাশিত বই দুইটি সম্পাদনা করেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী মোহাম্মদ শীশ।
মানুষটি ১৯৭৫ সালের ২২শে মার্চ এই ভুবনের মায়া ছেড়ে চলে যান। তাঁর লেখনীর ইতিবাচক দ্যুতিসুপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে, সাংবাদিকতায়, সাহিত্যে ও অসংখ্য মানুষের মূল্যবোধে। একসময় সকলকেই বিদায় নিয়ে ফিরে যেতে হয় প্রকৃতির কাছে, প্রকৃতির নিয়মে। রয়ে যায় নীতির প্রশ্নে আপসহীন মানুষদের কর্মের রেশ যুগের পর যুগ ধরে।অনন্তে মিলিয়ে যাওয়াআমার দাদার পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকীতেতাঁকেস্মরণ করছি তাঁরইআদর্শের একটা বিন্দুর ওপর দাঁড়িয়ে।
[লেখক: চিত্রকর ও চলচ্চিত্র শিক্ষক]
কাজী সালমান শীশ
শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
আমার দাদা কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের সকল স্মৃতিই মুখে মুখে শুনে বা লেখা পড়ে জানা, কারণ আমার জন্মের অর্ধ যুগ পূর্বে তিনি পরলোকবাসী হন। প্রথমত দাদী, আব্বা, চাচা ও ফুপুদের কাছে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার কথা। পরবর্তী সময়ে পড়েছি ব্যক্তি ইদরিস সম্পর্কে বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক লেখা, তাঁর রচিত প্রবন্ধ, গল্প, অনূদিত উপন্যাস ও নাটক। সুযোগ পেয়েছি তাঁর প্রকাশিত রচনাবলীর প্রচ্ছদ আঁকার। একজন কাছের মানুষের সরাসরি সান্নিধ্য না পেয়ে তাঁর সম্পর্কে লেখা আমার পক্ষে কঠিন; তবুও তাঁর ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীর মাসে চেষ্টা করছি অন্তত তথ্য সম্বলিত একটি লেখা রচনার।
১৯০৬ সালের ১১ই নভেম্বর রংপুরের মুন্সীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কাজী মোহাম্মদ ইদরিস। তিনি বি.এ. পাশ করেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে, এরপর কলকাতা যাত্রা। কলকাতার রিপন কলেজে আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করলেও তা অসামাপ্তই থেকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার পর শুরু হয় তাঁর পেশাগত জীবন। কলকাতায় অবস্থানকালে ১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন। এরপর ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে সাপ্তাহিক মিল্লাত ও দৈনিক ইত্তেহাদে যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
দেশভাগের পর কাজী মোহাম্মদ ইদরিস সপরিবারে ফিরে আসেন পূর্ববঙ্গে, বর্তমান বাংলাদেশে। ১৯৫০-১৯৬০ সময়কালে ঢাকায় অবস্থান করেন এবং দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদও সাপ্তাহিক পূর্বদেশে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। এরপর সম্পাদনা করেন দৈনিক ইত্তেহাদ, অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু, সাপ্তাহিক যুগবাণী পত্রিকা সমূহ। তৎকালীন সময়ের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক পত্রিকাগুলোতে তিনি কাজ করে গেছেন সাবলীলভাবে, কিন্তু কখনোই বেশি সময় এক জায়গায় মন বসাতে পারেননি। বাঁধা-ধরা পেশাগত কাজে আপস করে চলা তাঁর মত আদর্শবান মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না,তাই চাকরি ছেড়েছেন বহুবার। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পরিবারকে আর্থিক অনটনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে সেই অস্বচ্ছলতা কখনোই তাঁদের সেভাবে স্পর্শ করেনি। আর্থিক উন্নতির থেকে আদর্শগত উৎকর্ষতা যে অনেক বড় বিষয়Ñ সেটা তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যই অনুধাবন করতে পারতেন। সেই যুগে তাঁর চারপাশের খাঁটি মানুষ, বন্ধুবান্ধব ও স্ত্রী কাজী আজিজা ইদরিসের মানসিক সহায়তা এর নেপথ্যে কাজ করে গেছে, সন্দেহ নেই।
বাম রাজনীতির সাথে সর্বদাযুক্ত কাজী মোহাম্মদ ইদরিস সাংবাদিক হিসেবে নির্ভীকতার সাথে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি হলেও তাঁর সত্যিকারের প্রতিভা লুকিয়ে ছিল জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যকর্মে। জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার আগ্রহ থেকেই সম্ভবত তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হন। তাঁর অনূদিত উপন্যাসের মধ্যে- পীত নদীর বাঁকে (১৯৫৯), নটীর প্রেম (১৯৬০), অন্তঃশীলা (১৯৬৮) ও নাটকের মধ্যে স্ট্রিন্ডবার্গের সাতটি নাটক (১৯৮৭) গ্রন্থগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গত শতাব্দীর সৎ, জ্ঞানী, প্রতিভাধর ও অন্তর্মুখী বাঙালীদের অনেকের সম্পর্কেই বর্তমান প্রজন্ম জানে না। একজন পাশ্চাত্যের লেখক বা সাংবাদিক সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে সহজেই তথ্য জানা যায়, যা বাংলাদেশের বাস্তবতায় দুষ্কর। সেজন্য দাদার গ্রন্থগুলোর প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে ছোট করে উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি।
১৯৯৫ সালে, দাদার মৃত্যুর দুই দশক পর তাঁর সন্তানদের উদ্দ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘কাজী মোহাম্মদ ইদরিস স্মারকগ্রন্থ’। সেখানেস্থান পায় ৪৪টি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। রণেশ দাশগুপ্ত, সুফিয়া কামাল, কামাল লোহানী, শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, রফিকুন নবী থেকে শুরু করে নানা গুণীজনদের লেখা সেখানে রয়েছে।পারিবারিকভাবে বইটি প্রকাশ করতে বহুদিন ধরে কাজ করতে দেখেছি আমার আব্বা ও ছোট চাচাকে। বইটি তাঁর স্ত্রী কাজী আজিজা ইদরিস ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ করেন বলে সরাসরি কোনো প্রকাশনীর নাম সেখানে উল্লেখ নেই, তবে গ্রন্থটির পরিবেশক শাগবাগস্থ জনান্তিক প্রকাশনীতে বইটি মিলবে। দৈনিক সংবাদের দীর্ঘদিনের সম্পাদক সন্তোষ গুপ্ত বইটি সম্পাদনা করেন। আদর্শবান রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিস সম্পর্কে জানতে স্মারকগ্রন্থটি আদর্শ।
দাদার মৃত্যুর পাঁচ দশক পরে তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প ও নাটক নিয়ে নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে দুই খ-ের গ্রন্থ ‘কাজী মোহাম্মদ ইদরিস রচনাবলী’। প্রকাশনা ডটকম থেকে প্রকাশিত বই দুইটি সম্পাদনা করেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী মোহাম্মদ শীশ।
মানুষটি ১৯৭৫ সালের ২২শে মার্চ এই ভুবনের মায়া ছেড়ে চলে যান। তাঁর লেখনীর ইতিবাচক দ্যুতিসুপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে, সাংবাদিকতায়, সাহিত্যে ও অসংখ্য মানুষের মূল্যবোধে। একসময় সকলকেই বিদায় নিয়ে ফিরে যেতে হয় প্রকৃতির কাছে, প্রকৃতির নিয়মে। রয়ে যায় নীতির প্রশ্নে আপসহীন মানুষদের কর্মের রেশ যুগের পর যুগ ধরে।অনন্তে মিলিয়ে যাওয়াআমার দাদার পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকীতেতাঁকেস্মরণ করছি তাঁরইআদর্শের একটা বিন্দুর ওপর দাঁড়িয়ে।
[লেখক: চিত্রকর ও চলচ্চিত্র শিক্ষক]