সংগীত কুমার
মির্জাপুর শাহী মসজিদ
বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়। এখান থেকে হিমালয়ের অন্যতম শৃঙ্গ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখা যায় বলে এ জেলা ‘হিমালয় কন্যা’ নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি দৃশ্যপট, নদী, চা-বাগান আর ইতিহাসের এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে এখানে। এই জেলার বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন, তার মধ্যে অন্যতম হলো মির্জাপুর শাহী মসজিদ। প্রায় চারশ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদ শুধু ধর্মীয় স্থাপনাই নয়, বরং আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন।
মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রতœতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন, মির্জাপুর শাহী মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে ঐতিহাসিক মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, মালিক উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মালিক উদ্দিন মির্জাপুর গ্রামও প্রতিষ্ঠা করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক জনৈক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
মসজিদের মধ্যবর্তী দরজার উপরে পারসিয়ান ভাষায় খোদাইকৃত একটি শিলালিপি থেকে প্রতœতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, মোগল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিলো।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৫ ফুট। এক সারিতে স্থাপিত তিনটি গম্বুজ তার মোগলীয় বৈশিষ্ট্যের অন্যতম উদাহরণ। গম্বুজগুলোর শীর্ষবিন্দু ক্রমহ্রাসমান বেল্টযুক্ত এবং মসজিদের চার কোণে রয়েছে চারটি নকশা খচিত সুচিকন মিনার। এছাড়া সামনের দেয়ালে দরজার দুই পাশে গম্বুজের সাথে সমন্বয় রেখে নির্মিত হয়েছে আরো দুটি ক্ষুদ্র মিনার। এই মিনারের দেয়াল সংযুক্ত অংশ বর্গাকার। একই রকমের দুটি ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার রয়েছে পশ্চিম দেয়ালেও।
চুন ও সুড়কি দিয়ে তৈরি মির্জাপুর শাহী মসজিদের সামনের দেয়ালে রয়েছে সুশোভন লতাপাতা ও ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ টেরাকোটা নকশাখচিত মাঝারি আকৃতির তিনটি দরজা। তিনটি দরজাতেই ছাদ ও দরজার উপরিভাগের মাঝামাঝি স্থানে বাইরের দিকে উভয় পাশে ঢালু তোরণ আকৃতির একটি অতিরিক্ত স্ফীত অংশ সংযুক্ত হওয়ায়, অলঙ্করণ বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে নতুনত্ব। দেয়ালে লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা, আরবিতে খোদাইকৃত আয়াত ও পোড়ামাটির ফলকের নিপুণ ব্যবহার দেখা যায় এ মসজিদে।
মসজিদের মূল ভবনের সামনে রয়েছে একটি আয়াতাকার বড় পাকা আঙিনা। আঙিনার উপরিভাগ উন্মুক্ত। আঙিনার বাইরে রয়েছে একটি সুদৃশ্য পাকা তোরণ। তোরণটির নির্মাণ কৌশলও অপূর্ব। এতে রয়েছে খিলান করা অন্তঃপ্রবিষ্ট দরজা, উভয় পাশে খাঁজ করা স্তম্ভ এবং ঢাল ও অর্ধ বৃত্তাকার, নাতিদীর্ঘ একটি গম্বুজ।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর প্রায় দুইশ বছর আগে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। মুলুক উদ্দীন বা মালেক উদ্দীন নামের একজন ব্যক্তি এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি হুগলির এক মসজিদের ইমামের মাধ্যমে ইরান থেকে কারিগর এনে এই মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেন। যার কারণে মসজিদের অলঙ্করণে পারস্য ও মোগল রীতির সম্মিলন লক্ষ্য করা যায়।
শিল্প সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন এই মসজিদের সর্বত্র ইসলামী টেরাকোটা ফুল, পোড়ামাটির ফলক ও লতাপাতার নকশায় পরিপূর্ণ। মসজিদে ব্যবহৃত ইটগুলো রক্তবর্ণ ও অলঙ্কৃত; যা বর্তমান সময়ের ইটের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি ছোট কবরস্থান। স্থানীয়রা মনে করেন, এখানে ‘শাহ সাহেব’ নামে পরিচিত একজন আউলিয়ার কবর রয়েছে।
মির্জাপুর শাহী মসজিদটি শুধু পঞ্চগড়বাসীর গর্ব নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্থাপত্যধারার এক অমূল্য রতœ। এ মসজিদ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাক্ষ্য বহন করছে মোগল স্থাপত্যের।
পর্যটনপ্রেমী ও ইতিহাস অনুরাগীদের জন্য এটি হতে পারে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। তবে যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচারের অভাবে এই মসজিদটির গুরুত্ব অনেকটাই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত এটি সংরক্ষণ ও পর্যটনবান্ধব উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]
সংগীত কুমার
মির্জাপুর শাহী মসজিদ
বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়। এখান থেকে হিমালয়ের অন্যতম শৃঙ্গ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখা যায় বলে এ জেলা ‘হিমালয় কন্যা’ নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি দৃশ্যপট, নদী, চা-বাগান আর ইতিহাসের এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে এখানে। এই জেলার বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন, তার মধ্যে অন্যতম হলো মির্জাপুর শাহী মসজিদ। প্রায় চারশ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদ শুধু ধর্মীয় স্থাপনাই নয়, বরং আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন।
মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রতœতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন, মির্জাপুর শাহী মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে ঐতিহাসিক মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, মালিক উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মালিক উদ্দিন মির্জাপুর গ্রামও প্রতিষ্ঠা করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক জনৈক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
মসজিদের মধ্যবর্তী দরজার উপরে পারসিয়ান ভাষায় খোদাইকৃত একটি শিলালিপি থেকে প্রতœতত্ত্ববিদগণ মনে করেন, মোগল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিলো।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৫ ফুট। এক সারিতে স্থাপিত তিনটি গম্বুজ তার মোগলীয় বৈশিষ্ট্যের অন্যতম উদাহরণ। গম্বুজগুলোর শীর্ষবিন্দু ক্রমহ্রাসমান বেল্টযুক্ত এবং মসজিদের চার কোণে রয়েছে চারটি নকশা খচিত সুচিকন মিনার। এছাড়া সামনের দেয়ালে দরজার দুই পাশে গম্বুজের সাথে সমন্বয় রেখে নির্মিত হয়েছে আরো দুটি ক্ষুদ্র মিনার। এই মিনারের দেয়াল সংযুক্ত অংশ বর্গাকার। একই রকমের দুটি ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার রয়েছে পশ্চিম দেয়ালেও।
চুন ও সুড়কি দিয়ে তৈরি মির্জাপুর শাহী মসজিদের সামনের দেয়ালে রয়েছে সুশোভন লতাপাতা ও ইসলামী ঐতিহ্যপূর্ণ টেরাকোটা নকশাখচিত মাঝারি আকৃতির তিনটি দরজা। তিনটি দরজাতেই ছাদ ও দরজার উপরিভাগের মাঝামাঝি স্থানে বাইরের দিকে উভয় পাশে ঢালু তোরণ আকৃতির একটি অতিরিক্ত স্ফীত অংশ সংযুক্ত হওয়ায়, অলঙ্করণ বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে নতুনত্ব। দেয়ালে লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা, আরবিতে খোদাইকৃত আয়াত ও পোড়ামাটির ফলকের নিপুণ ব্যবহার দেখা যায় এ মসজিদে।
মসজিদের মূল ভবনের সামনে রয়েছে একটি আয়াতাকার বড় পাকা আঙিনা। আঙিনার উপরিভাগ উন্মুক্ত। আঙিনার বাইরে রয়েছে একটি সুদৃশ্য পাকা তোরণ। তোরণটির নির্মাণ কৌশলও অপূর্ব। এতে রয়েছে খিলান করা অন্তঃপ্রবিষ্ট দরজা, উভয় পাশে খাঁজ করা স্তম্ভ এবং ঢাল ও অর্ধ বৃত্তাকার, নাতিদীর্ঘ একটি গম্বুজ।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর প্রায় দুইশ বছর আগে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। মুলুক উদ্দীন বা মালেক উদ্দীন নামের একজন ব্যক্তি এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি হুগলির এক মসজিদের ইমামের মাধ্যমে ইরান থেকে কারিগর এনে এই মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেন। যার কারণে মসজিদের অলঙ্করণে পারস্য ও মোগল রীতির সম্মিলন লক্ষ্য করা যায়।
শিল্প সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন এই মসজিদের সর্বত্র ইসলামী টেরাকোটা ফুল, পোড়ামাটির ফলক ও লতাপাতার নকশায় পরিপূর্ণ। মসজিদে ব্যবহৃত ইটগুলো রক্তবর্ণ ও অলঙ্কৃত; যা বর্তমান সময়ের ইটের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি ছোট কবরস্থান। স্থানীয়রা মনে করেন, এখানে ‘শাহ সাহেব’ নামে পরিচিত একজন আউলিয়ার কবর রয়েছে।
মির্জাপুর শাহী মসজিদটি শুধু পঞ্চগড়বাসীর গর্ব নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্থাপত্যধারার এক অমূল্য রতœ। এ মসজিদ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাক্ষ্য বহন করছে মোগল স্থাপত্যের।
পর্যটনপ্রেমী ও ইতিহাস অনুরাগীদের জন্য এটি হতে পারে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। তবে যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচারের অভাবে এই মসজিদটির গুরুত্ব অনেকটাই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত এটি সংরক্ষণ ও পর্যটনবান্ধব উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]