নিসার আহমেদ
বাংলাদেশ, অর্থনীতির দিক থেকে বেশ ভালোই এগোচ্ছে, তবে একটা জিনিস মাঝে মাঝেই ভোগায়—মুল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম যখন নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যারা দেশের নীতি তৈরি করেন, সবাইকেই চিন্তায় পড়তে হয়। এই যে দাম বাড়ছে, এটাকে অনেকে "মুল্যস্ফীতি সিনড্রোম" বলেন। এখন প্রশ্ন হলো, একে কি সত্যিই আমাদের বাজারের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? সেটা জানতে হলে আমাদের দেখতে হবে বাংলাদেশের বাজারটা কীভাবে চলে, কী কারণে দাম বাড়ছে, আর সরকার বা আমরা কী করতে পারি।
বাজারের চেহারা
আমাদের বাজার কিন্তু একরকম নয়। এখানে যেমন আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, তেমনি আছে ছোটখাটো দোকানপাট আর পুরোনো দিনের হাটবাজার। বড় বড় শপিং মলগুলোতে হয়তো এক দামের দোকান, কিন্তু পাড়ার দোকানে বা বাজারে দরদাম করার সুযোগ থাকে। গ্রামগঞ্জে এখনো অনেক হাট বসে, যেখানে সরাসরি কৃষকরা তাদের জিনিস বিক্রি করতে আসেন। আবার, এখন অনলাইনেও অনেক কেনাকাটা হচ্ছে। এই সবকিছু মিলিয়েই আমাদের বাজার। একদিকে এটা ভালো যে বিভিন্ন ধরনের মানুষ এখানে ব্যবসা করে, কিন্তু এর ফলে অনেক সময় জিনিসপত্রের দাম ওঠানামা করে, আর কিছু মানুষ সুযোগ নেয়। যেমন, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বা ঈদের আগে কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়।
কিছু সমস্যা
কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা: চাল বা তেলের মতো জরুরি জিনিসগুলোর ব্যবসা কয়েকজন লোকের হাতে। তারা যা দাম ঠিক করে, সেটাই দিতে হয়। এটাকে সিন্ডিকেটও বলা হয়। ধরুন, কয়েকজন বড় চাল ব্যবসায়ী মিলে যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা চালের দাম বাড়াবে, তাহলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে শোনা যায় যে কিছু কোম্পানি তেল মজুত করে রাখে, যাতে বাজারে তেলের সংকট তৈরি হয় এবং তারা বেশি দামে তেল বিক্রি করতে পারে।
সরবরাহে ঝামেলা: গ্রাম থেকে শহরে জিনিস আসতে অনেক সময় লাগে, রাস্তাঘাটের সমস্যা আর ঠিকমতো সংরক্ষণের অভাবে অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে যায়। ধরুন, একজন কৃষক টমেটো চাষ করলেন। কিন্তু ভালো রাস্তা না থাকার কারণে সেই টমেটো শহরে আনতে তার অনেক সময় লেগে গেল। এর মধ্যে অনেক টমেটো নষ্ট হয়ে গেল। ফলে শহরে যখন সেই টমেটো বিক্রি হবে, তখন দাম বেশি হবে, কারণ কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবার, অনেক সময় দেখা যায় যে কোল্ড স্টোরেজের অভাবে আলু, পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।
নিয়মের অভাব: সরকারের নিয়মকানুন থাকলেও, সেগুলো সবসময় ঠিকভাবে মানা হয় না। ফলে অনেকে বেশি লাভের জন্য কারচুপি করে। ধরুন, সরকার একটা জিনিসের দাম ঠিক করে দিল। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী সেই নিয়ম না মেনে বেশি দামে বিক্রি করছে। অনেক সময় দেখা যায় যে ভেজাল জিনিস বিক্রি হচ্ছে, বা ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে
যদি আমরা গত কয়েক বছরের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে খাবার জিনিসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের খুব কষ্ট হয়।
বছর | মোট মূল্যবৃদ্ধি(%) | খাবারের দাম(%) | অন্যান্য জিনিসের দাম (%) | কারণ |
---|---|---|---|---|
২০২০ | ৫.৭ | ৬.৫ | ৪.৯ | করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল। মানুষ কাজ হারাচ্ছিল, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল,
ফলে চাহিদা কম থাকায় দাম তুলনামূলকভাবে কম ছিল। |
২০২১ | ৫.৬ | ৫.৮ | ৫.৩ | ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হচ্ছিল। কলকারখানা খুলতে শুরু করেছিল, মানুষ আবার কাজে
ফিরতে শুরু করেছিল, তাই চাহিদা বাড়ছিল। |
২০২২ | ৬.২ | ৭.৪ | ৫.১ | ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল। রাশিয়া আর ইউক্রেন
থেকে অনেক জিনিস আমদানি করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই বিশ্ববাজারে জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল। |
২০২৩ | ৯.০ | ১০.১ | ৭.২ | টাকার দাম কমে গিয়েছিল, তাই জিনিস কেনা কঠিন হয়ে যায়। ডলারের দাম বেড়ে
যাওয়ায় আমাদের বেশি টাকা খরচ করে জিনিস কিনতে হচ্ছিল। |
২০২৪ | ৮.৫ | ৯.৫ | ৭.০ | তেলের দামের কারণে সমস্যা হয়েছিল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে
যাওয়ায় আমাদের দেশেও দাম বেড়ে গিয়েছিল। |
সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
এই পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, আর এর পেছনে অনেক কারণ আছে।
কিছু উদাহরণ
চালের দাম: আমাদের দেশে চালের ফলন ভালো হলেও, মাঝে মাঝে দাম বেড়ে যায়। কারণ কিছু ব্যবসায়ী চাল কিনে মজুত করে রাখে, যাতে দাম বাড়লে বিক্রি করতে পারে। এটাকে অবৈধ মজুতদারি বলে। ধরুন, উত্তরাঞ্চলে যখন বন্যা হলো, তখন কিছু ব্যবসায়ী কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে চাল কিনে সেটা মজুত করে রাখল। যখন সারাদেশে চালের দাম বেড়ে গেল, তখন তারা সেই চাল বেশি দামে বিক্রি করে অনেক মুনাফা করলো। সাধারণ মানুষ তখন বেশি দামেই চাল কিনতে বাধ্য হলো। সরকার মাঝে মাঝে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না।
তেলের দাম: আমরা পাম তেল আর সয়াবিন তেল বাইরে থেকে কিনি। যখন অন্য দেশে দাম বাড়ে, তখন আমাদের দেশেও দাম বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে আমাদের দেশেও তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছিল। সরকার দাম কমানোর চেষ্টা করলেও, অনেক সময় কালোবাজারি হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের জন্য তেল মজুত করে রাখে, ফলে বাজারে সংকট তৈরি হয়।
জ্বালানির দাম: তেলের দাম বাড়লে সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে জিনিসপত্রের দাম—সবকিছু বেড়ে যায়। কারণ পরিবহন খরচ বেড়ে যায়।
সবজির দাম: বর্ষাকালে অনেক সময় সবজির দাম বেড়ে যায়। কারণ বৃষ্টির কারণে রাস্তা খারাপ হয়ে যায়, আর জিনিসপত্র ঠিকভাবে আনা-নেওয়া করা যায় না। এছাড়া, অনেক সময় দেখা যায় যে অতিবৃষ্টির কারণে সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যায়, আর দাম বেড়ে যায়।
সরকার কী করছে?
সরকার অনেক চেষ্টা করছে দাম কমানোর জন্য, কিন্তু কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
চেষ্টা | উদাহরণ | সমস্যা |
---|---|---|
দাম বেঁধে দেওয়া | তেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল | কালোবাজারি শুরু হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা লুকিয়ে তেল বিক্রি করত, বা বেশি দামে বিক্রি করত। |
ভর্তুকি দেওয়া | কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হয় | সবাই ঠিকভাবে পায় না। অনেক সময় দেখা যায় যে যারা গরিব কৃষক, তারা ভর্তুকির খবরই জানে না, বা কাগজপত্র জোগাড় করতে পারে না। |
কম দামে জিনিস বিক্রি | কম দামে জিনিস বিক্রি করা হয় | খুব কম মানুষ এর সুবিধা পায়। টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে জিনিস বিক্রি করা হয়, কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়, আর সবাই পায় না। |
ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো | ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে | অনেকে ব্যাংক থেকে লোন নেয় না, তাই লাভ হয় না। যারা ছোট ব্যবসায়ী, তারা সাধারণত মহাজনদের কাছ থেকে লোন নেয়, যাদের সুদের হার অনেক বেশি। |
অভিযান চালানো | রমজানে জিনিসপত্রের দাম কমাতে অভিযান চালানো হয় | দাম একটু কমলেও, পরে আবার বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে দাম কমায়, কিন্তু অভিযান শেষ হয়ে গেলে আবার দাম বাড়িয়ে দেয়। |
অনেক সময় দুর্নীতির কারণে সরকারের ভালো উদ্যোগগুলোও ভেস্তে যায়।
আমরা কী করতে পারি?
আমাদের কিছু জিনিসের দিকে নজর দিতে হবে:
বাইরের দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে: আমাদের নিজেদের দেশে বেশি করে পণ্য তৈরি করতে হবে। তাহলে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না। ধরুন, আমরা যদি বেশি করে পাট উৎপাদন করতে পারি, তাহলে আমাদের পলিথিনের ব্যাগ আমদানি করতে হবে না।
যারা ব্যবসা করে, তাদের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে, যাতে কেউ বেশি দাম না নিতে পারে: সরকারকে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে, এবং যারা বেশি দাম নেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, যাতে সহজে জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করা যায়: রাস্তাঘাট ভালো করতে হবে, এবং কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে জিনিসপত্র নষ্ট হওয়া কমবে, এবং দামও কমবে।
ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে: কৃষকরা যাতে সরাসরি অনলাইনে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে।
যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি, তাহলে হয়তো মুল্যস্ফীতিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। আমাদের সচেতন হতে হবে, এবং সরকারকে সাহায্য করতে হবে।
অন্য দেশ কী করছে?
পাশের দেশগুলো কীভাবে এই সমস্যা সামলায়, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। তারা হয়তো ভালো কিছু উপায় বের করেছে, যা আমাদের কাজে লাগতে পারে। যেমন, কিছু দেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য সবসময় মজুদ রাখে। আবার, কিছু দেশ সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে জিনিস কিনে ন্যায্য দামে বিক্রি করে।
শেষ কথা
মুল্যস্ফীতি আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা। এটা একদিনে ঠিক হবে না। তবে যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি, তাহলে ধীরে ধীরে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমাদের দরকার সঠিক পরিকল্পনা, চেষ্টা আর সৎ থাকা। সরকার, ব্যবসায়ী, কৃষক, সাধারণ মানুষ—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।
[লেখক ট্রেজারার, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ]
নিসার আহমেদ
বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশ, অর্থনীতির দিক থেকে বেশ ভালোই এগোচ্ছে, তবে একটা জিনিস মাঝে মাঝেই ভোগায়—মুল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম যখন নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যারা দেশের নীতি তৈরি করেন, সবাইকেই চিন্তায় পড়তে হয়। এই যে দাম বাড়ছে, এটাকে অনেকে "মুল্যস্ফীতি সিনড্রোম" বলেন। এখন প্রশ্ন হলো, একে কি সত্যিই আমাদের বাজারের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? সেটা জানতে হলে আমাদের দেখতে হবে বাংলাদেশের বাজারটা কীভাবে চলে, কী কারণে দাম বাড়ছে, আর সরকার বা আমরা কী করতে পারি।
বাজারের চেহারা
আমাদের বাজার কিন্তু একরকম নয়। এখানে যেমন আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, তেমনি আছে ছোটখাটো দোকানপাট আর পুরোনো দিনের হাটবাজার। বড় বড় শপিং মলগুলোতে হয়তো এক দামের দোকান, কিন্তু পাড়ার দোকানে বা বাজারে দরদাম করার সুযোগ থাকে। গ্রামগঞ্জে এখনো অনেক হাট বসে, যেখানে সরাসরি কৃষকরা তাদের জিনিস বিক্রি করতে আসেন। আবার, এখন অনলাইনেও অনেক কেনাকাটা হচ্ছে। এই সবকিছু মিলিয়েই আমাদের বাজার। একদিকে এটা ভালো যে বিভিন্ন ধরনের মানুষ এখানে ব্যবসা করে, কিন্তু এর ফলে অনেক সময় জিনিসপত্রের দাম ওঠানামা করে, আর কিছু মানুষ সুযোগ নেয়। যেমন, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বা ঈদের আগে কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়।
কিছু সমস্যা
কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা: চাল বা তেলের মতো জরুরি জিনিসগুলোর ব্যবসা কয়েকজন লোকের হাতে। তারা যা দাম ঠিক করে, সেটাই দিতে হয়। এটাকে সিন্ডিকেটও বলা হয়। ধরুন, কয়েকজন বড় চাল ব্যবসায়ী মিলে যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা চালের দাম বাড়াবে, তাহলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে শোনা যায় যে কিছু কোম্পানি তেল মজুত করে রাখে, যাতে বাজারে তেলের সংকট তৈরি হয় এবং তারা বেশি দামে তেল বিক্রি করতে পারে।
সরবরাহে ঝামেলা: গ্রাম থেকে শহরে জিনিস আসতে অনেক সময় লাগে, রাস্তাঘাটের সমস্যা আর ঠিকমতো সংরক্ষণের অভাবে অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে যায়। ধরুন, একজন কৃষক টমেটো চাষ করলেন। কিন্তু ভালো রাস্তা না থাকার কারণে সেই টমেটো শহরে আনতে তার অনেক সময় লেগে গেল। এর মধ্যে অনেক টমেটো নষ্ট হয়ে গেল। ফলে শহরে যখন সেই টমেটো বিক্রি হবে, তখন দাম বেশি হবে, কারণ কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবার, অনেক সময় দেখা যায় যে কোল্ড স্টোরেজের অভাবে আলু, পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।
নিয়মের অভাব: সরকারের নিয়মকানুন থাকলেও, সেগুলো সবসময় ঠিকভাবে মানা হয় না। ফলে অনেকে বেশি লাভের জন্য কারচুপি করে। ধরুন, সরকার একটা জিনিসের দাম ঠিক করে দিল। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী সেই নিয়ম না মেনে বেশি দামে বিক্রি করছে। অনেক সময় দেখা যায় যে ভেজাল জিনিস বিক্রি হচ্ছে, বা ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে
যদি আমরা গত কয়েক বছরের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে খাবার জিনিসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের খুব কষ্ট হয়।
বছর | মোট মূল্যবৃদ্ধি(%) | খাবারের দাম(%) | অন্যান্য জিনিসের দাম (%) | কারণ |
---|---|---|---|---|
২০২০ | ৫.৭ | ৬.৫ | ৪.৯ | করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল। মানুষ কাজ হারাচ্ছিল, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল,
ফলে চাহিদা কম থাকায় দাম তুলনামূলকভাবে কম ছিল। |
২০২১ | ৫.৬ | ৫.৮ | ৫.৩ | ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হচ্ছিল। কলকারখানা খুলতে শুরু করেছিল, মানুষ আবার কাজে
ফিরতে শুরু করেছিল, তাই চাহিদা বাড়ছিল। |
২০২২ | ৬.২ | ৭.৪ | ৫.১ | ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল। রাশিয়া আর ইউক্রেন
থেকে অনেক জিনিস আমদানি করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই বিশ্ববাজারে জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল। |
২০২৩ | ৯.০ | ১০.১ | ৭.২ | টাকার দাম কমে গিয়েছিল, তাই জিনিস কেনা কঠিন হয়ে যায়। ডলারের দাম বেড়ে
যাওয়ায় আমাদের বেশি টাকা খরচ করে জিনিস কিনতে হচ্ছিল। |
২০২৪ | ৮.৫ | ৯.৫ | ৭.০ | তেলের দামের কারণে সমস্যা হয়েছিল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে
যাওয়ায় আমাদের দেশেও দাম বেড়ে গিয়েছিল। |
সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
এই পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, আর এর পেছনে অনেক কারণ আছে।
কিছু উদাহরণ
চালের দাম: আমাদের দেশে চালের ফলন ভালো হলেও, মাঝে মাঝে দাম বেড়ে যায়। কারণ কিছু ব্যবসায়ী চাল কিনে মজুত করে রাখে, যাতে দাম বাড়লে বিক্রি করতে পারে। এটাকে অবৈধ মজুতদারি বলে। ধরুন, উত্তরাঞ্চলে যখন বন্যা হলো, তখন কিছু ব্যবসায়ী কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে চাল কিনে সেটা মজুত করে রাখল। যখন সারাদেশে চালের দাম বেড়ে গেল, তখন তারা সেই চাল বেশি দামে বিক্রি করে অনেক মুনাফা করলো। সাধারণ মানুষ তখন বেশি দামেই চাল কিনতে বাধ্য হলো। সরকার মাঝে মাঝে এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না।
তেলের দাম: আমরা পাম তেল আর সয়াবিন তেল বাইরে থেকে কিনি। যখন অন্য দেশে দাম বাড়ে, তখন আমাদের দেশেও দাম বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে আমাদের দেশেও তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছিল। সরকার দাম কমানোর চেষ্টা করলেও, অনেক সময় কালোবাজারি হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের জন্য তেল মজুত করে রাখে, ফলে বাজারে সংকট তৈরি হয়।
জ্বালানির দাম: তেলের দাম বাড়লে সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে জিনিসপত্রের দাম—সবকিছু বেড়ে যায়। কারণ পরিবহন খরচ বেড়ে যায়।
সবজির দাম: বর্ষাকালে অনেক সময় সবজির দাম বেড়ে যায়। কারণ বৃষ্টির কারণে রাস্তা খারাপ হয়ে যায়, আর জিনিসপত্র ঠিকভাবে আনা-নেওয়া করা যায় না। এছাড়া, অনেক সময় দেখা যায় যে অতিবৃষ্টির কারণে সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বাজারে সবজির সরবরাহ কমে যায়, আর দাম বেড়ে যায়।
সরকার কী করছে?
সরকার অনেক চেষ্টা করছে দাম কমানোর জন্য, কিন্তু কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
চেষ্টা | উদাহরণ | সমস্যা |
---|---|---|
দাম বেঁধে দেওয়া | তেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল | কালোবাজারি শুরু হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা লুকিয়ে তেল বিক্রি করত, বা বেশি দামে বিক্রি করত। |
ভর্তুকি দেওয়া | কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হয় | সবাই ঠিকভাবে পায় না। অনেক সময় দেখা যায় যে যারা গরিব কৃষক, তারা ভর্তুকির খবরই জানে না, বা কাগজপত্র জোগাড় করতে পারে না। |
কম দামে জিনিস বিক্রি | কম দামে জিনিস বিক্রি করা হয় | খুব কম মানুষ এর সুবিধা পায়। টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে জিনিস বিক্রি করা হয়, কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়, আর সবাই পায় না। |
ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো | ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে | অনেকে ব্যাংক থেকে লোন নেয় না, তাই লাভ হয় না। যারা ছোট ব্যবসায়ী, তারা সাধারণত মহাজনদের কাছ থেকে লোন নেয়, যাদের সুদের হার অনেক বেশি। |
অভিযান চালানো | রমজানে জিনিসপত্রের দাম কমাতে অভিযান চালানো হয় | দাম একটু কমলেও, পরে আবার বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে দাম কমায়, কিন্তু অভিযান শেষ হয়ে গেলে আবার দাম বাড়িয়ে দেয়। |
অনেক সময় দুর্নীতির কারণে সরকারের ভালো উদ্যোগগুলোও ভেস্তে যায়।
আমরা কী করতে পারি?
আমাদের কিছু জিনিসের দিকে নজর দিতে হবে:
বাইরের দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে: আমাদের নিজেদের দেশে বেশি করে পণ্য তৈরি করতে হবে। তাহলে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না। ধরুন, আমরা যদি বেশি করে পাট উৎপাদন করতে পারি, তাহলে আমাদের পলিথিনের ব্যাগ আমদানি করতে হবে না।
যারা ব্যবসা করে, তাদের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে, যাতে কেউ বেশি দাম না নিতে পারে: সরকারকে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে, এবং যারা বেশি দাম নেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, যাতে সহজে জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করা যায়: রাস্তাঘাট ভালো করতে হবে, এবং কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে জিনিসপত্র নষ্ট হওয়া কমবে, এবং দামও কমবে।
ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে: কৃষকরা যাতে সরাসরি অনলাইনে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে।
যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি, তাহলে হয়তো মুল্যস্ফীতিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। আমাদের সচেতন হতে হবে, এবং সরকারকে সাহায্য করতে হবে।
অন্য দেশ কী করছে?
পাশের দেশগুলো কীভাবে এই সমস্যা সামলায়, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। তারা হয়তো ভালো কিছু উপায় বের করেছে, যা আমাদের কাজে লাগতে পারে। যেমন, কিছু দেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য সবসময় মজুদ রাখে। আবার, কিছু দেশ সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে জিনিস কিনে ন্যায্য দামে বিক্রি করে।
শেষ কথা
মুল্যস্ফীতি আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা। এটা একদিনে ঠিক হবে না। তবে যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি, তাহলে ধীরে ধীরে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আমাদের দরকার সঠিক পরিকল্পনা, চেষ্টা আর সৎ থাকা। সরকার, ব্যবসায়ী, কৃষক, সাধারণ মানুষ—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।
[লেখক ট্রেজারার, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ]