জাভেদ ইকবাল
বাংলাদেশে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন, অত্যাচার ও সহিংসতার কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা জাতীয় সীমারেখা নেই। এ সবই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত। বিশ্বজুড়ে আনুমানিক প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কোনো বিষয় নয়। আর বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ ধরনের সহিংসতা ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলে। যারা সহিংসতার শিকার হন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, মর্যাদা, নিরাপত্তাবোধ এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা গুরুতর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায়ও আক্রান্ত হন। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ, অনিরাপদ গর্ভপাত, যন্ত্রণাদায়ক ফিস্টুলা, এইচআইভিসহ যৌনবাহিত নানা রোগের সংক্রমণ। এছাড়া সহিংসতার কারণে নারীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে।
নারী ও অল্পবয়সী মেয়েদের ওপর নিপীড়নের নিকৃষ্টতম উদাহরণগুলোর একটি হচ্ছে বাল্যবিবাহ। যা মেয়ের জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যায়, প্রতি তিনজন নারীর একজন সহিংসতার শিকার। কোভিড-১৯ মহামারিতে সারাবিশ্বে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী ১৫-৪৯ বয়সী ২৪৩ মিলিয়ন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের শেষে অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ নারী অরুচিকর মন্তব্যেও শিকার হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে ৫৭ শতাংশ। ৪৮ শতাংশকে আপত্তিকর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গণপরিবহনে পুরুষ যাত্রী দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে ৪২ শতাংশ নারী। আর ২২ শতাংশ নারী ধর্ষিত হওয়ার ভয় নিয়ে চলাচল করছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এসডিজির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলকরণে বিশেষভাবে নির্ভরশীল কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছে। এসবের মধ্যে তৃতীয়, পঞ্চম ও ষোড়শ লক্ষ্য উল্লেখযোগ্য। তৃতীয় লক্ষ্য- সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা; পঞ্চম লক্ষ্য- জেন্ডার সমতা এবং নারী ও কিশোরীদের ক্ষমতায়ন। সেই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতার অবসানের আহ্বান; এবং লক্ষ্য ষোড়শ- শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন। জানা যায়, সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকা মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা বড় হয়ে সহিংস আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পরতে পারে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের আগে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বেশ কয়েকটি সনদ গ্রহণ করেছে, যেগুলো উন্নয়নের শর্ত হিসেবে নারী, অল্পবয়সী মেয়ে এবং শিশুদের প্রতি সহিংসতার নিরসনকে গুরুত্ব দেয়। এসব সনদের মধ্যে ১৯৪৫ : মানবাধিকার সনদ; ১৯৭৯ : নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা নির্মূল করার নীতিমালা (সিডও); ১৯৯০ : শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি); ১৯৯৪ : আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন এবং উন্নয়নের কর্ম পরিকল্পনা (আইসিপিডিপিওএ); ১৯৯৫ : বেইজিং কর্ম পরিকল্পনা; ২০০০ : সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি); ২০১৫ : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) উল্লেখযোগ্য।
যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জরুরি অবস্থায় সকলেরই সমস্যা বেড়ে যায় বিশেষ করে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও নিপীড়ন কয়েকগুণ বেশি হয়। যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য তাদেরকে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। এমনকি এ সময়টায় তারা পরিবারেও নির্যাতিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কখনো কখনো বাবা-মায়েরা ভয় থেকে নিরুপায় হয়ে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেন, যার ফলে তারা পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে রোজগারের জন্য কাজে পাঠানো হয় এবং কখনো কখনো তাদের পাচারও করা হয়। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছেলে বা পুরুষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু নারী ও কিশোরীরা অনেক গুণ বেশি ও অপূরণীয় ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। বাংলাদেশে করোনাকালে ঠিক তেমনটাই ঘটে চলেছে নারী ও শিশুদের বেলায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড় আর উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা।
উন্নয়ন, সভ্যতা, আধুনিকতা ও ডিজিটাল যুগের পরিবর্তস কথা বলার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বোঝা যায়। আবার সমাজকিভাবে একজন নারীকে কিভাবে দেখা হচ্ছে তা নারীর প্রতি সমাজের আচরণ থেকে বোঝা যায়। সমাজে কিছু শব্দ আছে, নির্লজ্জ কিংবা সম্ভম হারানো বলতে শুধু নারীকেই বোঝানো হয়। আমাদের সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সবাইকে মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এখানে শুধু সরকার নয়, সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে দেশে ইতোমধ্যে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৮নং আইন) প্রণয়ন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ সংশোধন করে ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদ-ের বিধান করা হয়েছে। এছাড়া নারী ও শিশু পাচার রোধে আইন, যৌতুক প্রতিরোধে আইন, এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের আশেপাশে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটলে সহায়তার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইনে ১০৯ ফোন করে প্রতিকার পেতে পারি।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সরকারের তথ্য অফিসগুলো এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর প্রত্যন্ত এলাকায় মাইকিং, উঠান বৈঠক, মহিলা সমাবেশের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রেখে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলা কোনো সহজ কাজ নয়। এ জন্য বহুমুখী কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য, এটা প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক মূল্যবোধ বদলাতে হবে। এ জন্যপুরুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। পুরুষেরাই নারীর পাশে দাঁড়াবেন এবং নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলবেন-এমনটাই প্রত্যাশা। তাহলেই নারী ও মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে হবে। শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে গড়ে উঠতে পারলে পরস্পর সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে কেউ নারীর প্রতি সহিংসতা করে পার পাবে না এবং এভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে। একই সঙ্গে নারী ও কিশোরীদের জন্য অব্যাহত বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং পারিবারিক নিরাপত্তা, বিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্র এবং প্রকাশ্য স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর প্রতি বিভিন্ন রকমের সহিংসতা দূর করতে নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। যদিও সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর একজন নারীর প্রয়োজনীয় আইনি ও চিকিৎসা সহায়তার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। নারী সহিংসতারোধ করতে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে ও সহিংসতা রোধে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতাকে না বলুন। বলতে হবে সবাইকে এবং তা সামাজিকভাবেই। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে এর চর্চা। শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চয়ই নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা রোধ করতে আমরা সক্ষম হব।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম বিষয়ক নিবন্ধ)
জাভেদ ইকবাল
বুধবার, ১৬ জুন ২০২১
বাংলাদেশে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন, অত্যাচার ও সহিংসতার কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক বা জাতীয় সীমারেখা নেই। এ সবই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত। বিশ্বজুড়ে আনুমানিক প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কোনো বিষয় নয়। আর বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ ধরনের সহিংসতা ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলে। যারা সহিংসতার শিকার হন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, মর্যাদা, নিরাপত্তাবোধ এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা গুরুতর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায়ও আক্রান্ত হন। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ, অনিরাপদ গর্ভপাত, যন্ত্রণাদায়ক ফিস্টুলা, এইচআইভিসহ যৌনবাহিত নানা রোগের সংক্রমণ। এছাড়া সহিংসতার কারণে নারীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে।
নারী ও অল্পবয়সী মেয়েদের ওপর নিপীড়নের নিকৃষ্টতম উদাহরণগুলোর একটি হচ্ছে বাল্যবিবাহ। যা মেয়ের জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যায়, প্রতি তিনজন নারীর একজন সহিংসতার শিকার। কোভিড-১৯ মহামারিতে সারাবিশ্বে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী ১৫-৪৯ বয়সী ২৪৩ মিলিয়ন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের শেষে অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ নারী অরুচিকর মন্তব্যেও শিকার হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে ৫৭ শতাংশ। ৪৮ শতাংশকে আপত্তিকর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গণপরিবহনে পুরুষ যাত্রী দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছে ৪২ শতাংশ নারী। আর ২২ শতাংশ নারী ধর্ষিত হওয়ার ভয় নিয়ে চলাচল করছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এসডিজির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলকরণে বিশেষভাবে নির্ভরশীল কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছে। এসবের মধ্যে তৃতীয়, পঞ্চম ও ষোড়শ লক্ষ্য উল্লেখযোগ্য। তৃতীয় লক্ষ্য- সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা; পঞ্চম লক্ষ্য- জেন্ডার সমতা এবং নারী ও কিশোরীদের ক্ষমতায়ন। সেই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতার অবসানের আহ্বান; এবং লক্ষ্য ষোড়শ- শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন। জানা যায়, সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকা মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা বড় হয়ে সহিংস আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পরতে পারে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের আগে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বেশ কয়েকটি সনদ গ্রহণ করেছে, যেগুলো উন্নয়নের শর্ত হিসেবে নারী, অল্পবয়সী মেয়ে এবং শিশুদের প্রতি সহিংসতার নিরসনকে গুরুত্ব দেয়। এসব সনদের মধ্যে ১৯৪৫ : মানবাধিকার সনদ; ১৯৭৯ : নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা নির্মূল করার নীতিমালা (সিডও); ১৯৯০ : শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি); ১৯৯৪ : আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন এবং উন্নয়নের কর্ম পরিকল্পনা (আইসিপিডিপিওএ); ১৯৯৫ : বেইজিং কর্ম পরিকল্পনা; ২০০০ : সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি); ২০১৫ : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) উল্লেখযোগ্য।
যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জরুরি অবস্থায় সকলেরই সমস্যা বেড়ে যায় বিশেষ করে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও নিপীড়ন কয়েকগুণ বেশি হয়। যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য তাদেরকে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। এমনকি এ সময়টায় তারা পরিবারেও নির্যাতিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কখনো কখনো বাবা-মায়েরা ভয় থেকে নিরুপায় হয়ে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেন, যার ফলে তারা পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে রোজগারের জন্য কাজে পাঠানো হয় এবং কখনো কখনো তাদের পাচারও করা হয়। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছেলে বা পুরুষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু নারী ও কিশোরীরা অনেক গুণ বেশি ও অপূরণীয় ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। বাংলাদেশে করোনাকালে ঠিক তেমনটাই ঘটে চলেছে নারী ও শিশুদের বেলায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড় আর উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা।
উন্নয়ন, সভ্যতা, আধুনিকতা ও ডিজিটাল যুগের পরিবর্তস কথা বলার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বোঝা যায়। আবার সমাজকিভাবে একজন নারীকে কিভাবে দেখা হচ্ছে তা নারীর প্রতি সমাজের আচরণ থেকে বোঝা যায়। সমাজে কিছু শব্দ আছে, নির্লজ্জ কিংবা সম্ভম হারানো বলতে শুধু নারীকেই বোঝানো হয়। আমাদের সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সবাইকে মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এখানে শুধু সরকার নয়, সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে দেশে ইতোমধ্যে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৮নং আইন) প্রণয়ন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ সংশোধন করে ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদ-ের বিধান করা হয়েছে। এছাড়া নারী ও শিশু পাচার রোধে আইন, যৌতুক প্রতিরোধে আইন, এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের আশেপাশে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটলে সহায়তার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইনে ১০৯ ফোন করে প্রতিকার পেতে পারি।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সরকারের তথ্য অফিসগুলো এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর প্রত্যন্ত এলাকায় মাইকিং, উঠান বৈঠক, মহিলা সমাবেশের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রেখে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলা কোনো সহজ কাজ নয়। এ জন্য বহুমুখী কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য, এটা প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক মূল্যবোধ বদলাতে হবে। এ জন্যপুরুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। পুরুষেরাই নারীর পাশে দাঁড়াবেন এবং নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলবেন-এমনটাই প্রত্যাশা। তাহলেই নারী ও মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে হবে। শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে গড়ে উঠতে পারলে পরস্পর সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে কেউ নারীর প্রতি সহিংসতা করে পার পাবে না এবং এভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে। একই সঙ্গে নারী ও কিশোরীদের জন্য অব্যাহত বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং পারিবারিক নিরাপত্তা, বিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্র এবং প্রকাশ্য স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর প্রতি বিভিন্ন রকমের সহিংসতা দূর করতে নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। যদিও সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর একজন নারীর প্রয়োজনীয় আইনি ও চিকিৎসা সহায়তার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। নারী সহিংসতারোধ করতে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে ও সহিংসতা রোধে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতাকে না বলুন। বলতে হবে সবাইকে এবং তা সামাজিকভাবেই। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে এর চর্চা। শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চয়ই নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা রোধ করতে আমরা সক্ষম হব।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম বিষয়ক নিবন্ধ)