রিয়াদ হোসেন
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় পানিতে ডুবে দুটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া শিশুরা হলো আয়শা খাতুন (৫) ও হাসান আলী (৪)। সম্পর্কে তারা খালাতো ভাইবোন। গত শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তারা বৃহস্পতিবার নানাবাড়ি মায়ের সাথে বেড়াতে আসে। তারা দু’জন খেলতে বের হয়। দীর্ঘক্ষণ পরও ফিরে না আসায় নানাবাড়ির লোকজন তাদের খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। বিকেলের দিকে পাশের একটি জলাশয়ে ওই দুজনকে ভাসতে দেখেন স্বজনেরা। উদ্ধার করে রায়গঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই দুই শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন।
বরিশাল জেলার গৌড়নদী উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। এ বছর মে মাসে তার বড় ছেলে পাঁচ বছর বয়সী শিশু লিমনকে হারায়। পানিতে ডুবে মারা যায় লিমন। ক্ষেতের কাজে ব্যস্ত ছিলেন হাবিবুর রহমান। লিমনের মা শাহনাজ বেগমও সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় ছেলের খেয়াল রাখতে পারেনি। বাড়ির সামান্য দূরেই বড় পুকুর। গরমের কারণে একা একাই পুকুরে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যায়। প্রতিবেশীসহ সবাই অনেক খোঁজাখুঁজি করেও লিমনকে পায়নি। লিমনের বাবা হাবিবুর রহমান পুকুরের এক কোনে লিমনের পায়ের স্যান্ডেল দেখে তার সন্দেহ হয়। তারপর পুকুর থেকে শিশু লিমনের লাশ তোলা হয়।
চিকিৎসা সেবার উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। প্রতিবছর বহু শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। গ্রামাঞ্চলে এটি একটি বড় সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ-এর তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু কোনো না কোনো আঘাতের কারণে মারা যায়। তারমধ্যে ১৮ হাজার শিশুই মারা যায় পানিতে ডুবে। পানিতে ডুবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি শিশুর মৃত্যু ঘটে। সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মারা এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু। এশিয়া মহাদেশে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায়।
আমাদের দেশ নদীমাতৃক। নদী নালার সাথেই আমাদের বসবাস। গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। শিশুকে একা রেখে মা-বাবা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে যান, তখনই ঘটে বিপত্তি। আইসিডিডিআরবি’র সমীক্ষায় জানা যায়, শতকরা ৬১ ভাগ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় দিনের প্রথম ভাগে। এ সময়টায় বিশেষ করে তাদের মায়েরা গৃহস্থালি এবং রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন। শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ শিশু মারা যায় নিকটবর্তী কোনো পুকুর কিংবা ডোবায় পড়ে। পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় বছরের মে থেকে অক্টোবর এ সময়ের মধ্যে। বর্ষার মৌসুমে নদী-নালা, ডোবা, পুকুর বর্ষা ও বৃষ্টির পানিতে ভরে থাকে। এ সময় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর শতকরা ৮২ ভাগ ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে এখনও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ বাড়ি অরক্ষিত থাকে। ফলে সহজেই শিশুরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে জলাশয়ের কাছে চলে যায়। অথচ পরিবারের সবার সচেতনতা অনেক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারে, রক্ষা করতে পারে আমাদের অনেক শিশুর প্রাণ।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি’র) গবেষণায় দেখা যায়, বরিশাল বিভাগের ২৪টি উপজেলায় ৬৭ শতাংশ শিশুর মৃত্যুই ঘটে পানিতে ডুবে এবং তা বাড়ির ১০০ মিটারের মধ্যে। একটু চোখের আড়াল হলেই ঘটে যেতে পারে বড় বিপদ। শিশুদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে সিআইপিআরবি বরিশাল বিভাগে গড়ে তুলেছে তিন হাজারেরও বেশি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সারা দেশে সাত লাখেরও বেশি শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু হারের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া একটি বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। দূর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং গবেষণা কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৬ সাল থেকে বরিশাল বিভাগে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফায়ার ও সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস এর সহায়তায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিভাগ জেলা, থানা ও গ্রামগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে একটি ঘরোয়া সার্ভের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ যেমন: হাম, ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এসকল রোগ প্রতিরোধে অনেক সাফল্য পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন আমাদের পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সচেতনতা এবং সাঁতার শেকার কোনো বিকল্প নেই।
সাঁতার জানা মানুষ নিজ জীবন সুরক্ষাসহ পানিতে ডুবে যাওয়া অপরকেও বাঁচাতে পারে। পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম ব্যবস্থা হচ্ছে সকল শিশুকে ৪ বছর বয়সের পর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সাঁতার শেখানো। রাজধানীতে অনেক সাঁতার শেখানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকার শীর্ষ স্থানীয় বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলসহ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সুইমিংপুল, জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্স মিরপুর, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়াসংস্থা, অফিসার্স ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুইমিংপুলসহ আরও অনেক সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব সাঁতার প্রশিক্ষাণ কেন্দ্রে সাঁতার শেখা বেশ ব্যয়বহুল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
গত ২০১৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল যে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এটি পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যায় বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি, কারণ বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এ সংশ্লিষ্ট পর্যাপ্ত সুবিধা এবং সরঞ্জামাদি নেই।
বাংলাদেশে শিশুর মৃত্যুঝুঁকির ঘটনা প্রতিরোধে অনেক কর্মসূচি থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ সমন্বিত কার্যক্রম খুবই সামান্য। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রতিরোধ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা। এক্ষেত্রে কলাকৌশলের পরিবর্তন এবং প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়ন ও পুনপ্রবর্তন করা। পরিবারে মা যদি ঘরকন্না ও গৃহস্থালির কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে শিশুর দায়িত্ব কাউকে না কাউকে দিতে হবে। সম্ভব হলে পুকুর, নালা, ডোবা এলাকায় যাওয়ার পথে বাউন্ডারি দিয়ে ফটকের ব্যবস্থা করে বাড়িটি শিশুর বসবাসের উপযোগী করতে হবে। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এই সমস্যা রোধকল্পে প্রত্যেকেরই সচেতন হতে হবে।
গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিশু গ্রাম্য পরিবেশ বড় হয়। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যা বহুল ব-দ্বীপ রাষ্ট্র। বর্ষাকালে নদী, খালবিল, ডোবা পানিতে ভর্তি থাকে। শিশুরা যখন তখন ডোবা বা পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া, খোলা মাঠে বন্ধুদের নিয়ে খেলা করা গ্রামের একটি শিশুর খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিটি পরিবারে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুকে সাঁতার শেখানো হলে ৯০ ভাগ দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। একটি শিশুর স্বাভাবিক ও নিরাপদে বড় করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। পরিবারে শিশু যাতে সুরক্ষিত থাকে সে ব্যাপারে বাবা-মা এবং সবাইকে সচেতন হতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)
রিয়াদ হোসেন
সোমবার, ২১ জুন ২০২১
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় পানিতে ডুবে দুটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া শিশুরা হলো আয়শা খাতুন (৫) ও হাসান আলী (৪)। সম্পর্কে তারা খালাতো ভাইবোন। গত শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তারা বৃহস্পতিবার নানাবাড়ি মায়ের সাথে বেড়াতে আসে। তারা দু’জন খেলতে বের হয়। দীর্ঘক্ষণ পরও ফিরে না আসায় নানাবাড়ির লোকজন তাদের খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। বিকেলের দিকে পাশের একটি জলাশয়ে ওই দুজনকে ভাসতে দেখেন স্বজনেরা। উদ্ধার করে রায়গঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই দুই শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন।
বরিশাল জেলার গৌড়নদী উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। এ বছর মে মাসে তার বড় ছেলে পাঁচ বছর বয়সী শিশু লিমনকে হারায়। পানিতে ডুবে মারা যায় লিমন। ক্ষেতের কাজে ব্যস্ত ছিলেন হাবিবুর রহমান। লিমনের মা শাহনাজ বেগমও সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় ছেলের খেয়াল রাখতে পারেনি। বাড়ির সামান্য দূরেই বড় পুকুর। গরমের কারণে একা একাই পুকুরে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যায়। প্রতিবেশীসহ সবাই অনেক খোঁজাখুঁজি করেও লিমনকে পায়নি। লিমনের বাবা হাবিবুর রহমান পুকুরের এক কোনে লিমনের পায়ের স্যান্ডেল দেখে তার সন্দেহ হয়। তারপর পুকুর থেকে শিশু লিমনের লাশ তোলা হয়।
চিকিৎসা সেবার উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। প্রতিবছর বহু শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। গ্রামাঞ্চলে এটি একটি বড় সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ-এর তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু কোনো না কোনো আঘাতের কারণে মারা যায়। তারমধ্যে ১৮ হাজার শিশুই মারা যায় পানিতে ডুবে। পানিতে ডুবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি শিশুর মৃত্যু ঘটে। সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মারা এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু। এশিয়া মহাদেশে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায়।
আমাদের দেশ নদীমাতৃক। নদী নালার সাথেই আমাদের বসবাস। গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। শিশুকে একা রেখে মা-বাবা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে যান, তখনই ঘটে বিপত্তি। আইসিডিডিআরবি’র সমীক্ষায় জানা যায়, শতকরা ৬১ ভাগ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় দিনের প্রথম ভাগে। এ সময়টায় বিশেষ করে তাদের মায়েরা গৃহস্থালি এবং রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন। শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ শিশু মারা যায় নিকটবর্তী কোনো পুকুর কিংবা ডোবায় পড়ে। পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় বছরের মে থেকে অক্টোবর এ সময়ের মধ্যে। বর্ষার মৌসুমে নদী-নালা, ডোবা, পুকুর বর্ষা ও বৃষ্টির পানিতে ভরে থাকে। এ সময় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর শতকরা ৮২ ভাগ ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে এখনও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ বাড়ি অরক্ষিত থাকে। ফলে সহজেই শিশুরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে জলাশয়ের কাছে চলে যায়। অথচ পরিবারের সবার সচেতনতা অনেক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারে, রক্ষা করতে পারে আমাদের অনেক শিশুর প্রাণ।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি’র) গবেষণায় দেখা যায়, বরিশাল বিভাগের ২৪টি উপজেলায় ৬৭ শতাংশ শিশুর মৃত্যুই ঘটে পানিতে ডুবে এবং তা বাড়ির ১০০ মিটারের মধ্যে। একটু চোখের আড়াল হলেই ঘটে যেতে পারে বড় বিপদ। শিশুদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে সিআইপিআরবি বরিশাল বিভাগে গড়ে তুলেছে তিন হাজারেরও বেশি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সারা দেশে সাত লাখেরও বেশি শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যু হারের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া একটি বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। দূর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং গবেষণা কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৬ সাল থেকে বরিশাল বিভাগে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফায়ার ও সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস এর সহায়তায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিভাগ জেলা, থানা ও গ্রামগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে একটি ঘরোয়া সার্ভের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ যেমন: হাম, ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এসকল রোগ প্রতিরোধে অনেক সাফল্য পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন আমাদের পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সচেতনতা এবং সাঁতার শেকার কোনো বিকল্প নেই।
সাঁতার জানা মানুষ নিজ জীবন সুরক্ষাসহ পানিতে ডুবে যাওয়া অপরকেও বাঁচাতে পারে। পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম ব্যবস্থা হচ্ছে সকল শিশুকে ৪ বছর বয়সের পর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সাঁতার শেখানো। রাজধানীতে অনেক সাঁতার শেখানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকার শীর্ষ স্থানীয় বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলসহ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সুইমিংপুল, জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্স মিরপুর, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়াসংস্থা, অফিসার্স ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুইমিংপুলসহ আরও অনেক সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব সাঁতার প্রশিক্ষাণ কেন্দ্রে সাঁতার শেখা বেশ ব্যয়বহুল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
গত ২০১৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল যে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এটি পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যায় বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি, কারণ বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এ সংশ্লিষ্ট পর্যাপ্ত সুবিধা এবং সরঞ্জামাদি নেই।
বাংলাদেশে শিশুর মৃত্যুঝুঁকির ঘটনা প্রতিরোধে অনেক কর্মসূচি থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ সমন্বিত কার্যক্রম খুবই সামান্য। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রতিরোধ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা। এক্ষেত্রে কলাকৌশলের পরিবর্তন এবং প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়ন ও পুনপ্রবর্তন করা। পরিবারে মা যদি ঘরকন্না ও গৃহস্থালির কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে শিশুর দায়িত্ব কাউকে না কাউকে দিতে হবে। সম্ভব হলে পুকুর, নালা, ডোবা এলাকায় যাওয়ার পথে বাউন্ডারি দিয়ে ফটকের ব্যবস্থা করে বাড়িটি শিশুর বসবাসের উপযোগী করতে হবে। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এই সমস্যা রোধকল্পে প্রত্যেকেরই সচেতন হতে হবে।
গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিশু গ্রাম্য পরিবেশ বড় হয়। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যা বহুল ব-দ্বীপ রাষ্ট্র। বর্ষাকালে নদী, খালবিল, ডোবা পানিতে ভর্তি থাকে। শিশুরা যখন তখন ডোবা বা পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া, খোলা মাঠে বন্ধুদের নিয়ে খেলা করা গ্রামের একটি শিশুর খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিটি পরিবারে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুকে সাঁতার শেখানো হলে ৯০ ভাগ দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। একটি শিশুর স্বাভাবিক ও নিরাপদে বড় করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। পরিবারে শিশু যাতে সুরক্ষিত থাকে সে ব্যাপারে বাবা-মা এবং সবাইকে সচেতন হতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)