alt

মুক্ত আলোচনা

মাটি দূষণ ও প্রতিকার ভাবনা

জান্নাতুল মাওয়া নাজ

: সোমবার, ০৫ জুলাই ২০২১

মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আর এ উদ্ভিদ তথা গাছ তাদের পুষ্টির জন্য মাটির ওপর নির্ভর করে। গাছ তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান (খনিজ পদার্থ) মাটি থেকে সংগ্রহ করে। তাই মাটি ছাড়া আমাদের খাদ্যের কোন বিকল্প ব্যবস্থা সম্ভব নয়।

মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের যে সব বস্তুর প্রয়োজন হয় তার সবগুলোরই উৎস মাটি। আমরা মাটিকে আমাদের জীবনের একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মনে করে থাকি। তবে মানুষের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে এ মাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তথা মাটি দূষিত হচ্ছে।

মাটি দূষণ বলতে বুঝায়- মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহের সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর। অবাঞ্ছিত পদার্থ বলতে সেসব উপাদানকে বুঝায়, যা মাটির নেতিবাচক রূপান্তর ঘটায়।

মাটিদূষণ পরিবেশ দূষণের একটি প্রধান অংশ। নগরায়ণ ও ব্যাপকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মাটিদূষণের প্রধান কারণ। মাটি দূষণের প্রধান কারণগুলো হলো-

১। ভূমি ক্ষয়

২। রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ

৩। অপরিকল্পিত নগরায়ণ

৪। অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন

৫। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ

৬। চিংড়ি চাষ ও

৭। অনিয়ন্ত্রিত কৃষি কাজ।

নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো-

১। ভূমি ক্ষয়

ভূমি ক্ষয়ের প্রধান কারণ বৃষ্টি ও বায়ু প্রবাহ। ভূমি ক্ষয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় যখন মানুষ নির্বিচারে গাছপালা কেটে বন উজাড় করে, তৃণভূমিতে চাষাবাদ শুরু করে এবং মাটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে গাছপালা কেটে ফেলে, ফলে মাটি আলগা হয়, তখন বাতাস সহজে মাটি উড়িয়ে নিয়ে ভূমি ক্ষয় ঘটায়। এছাড়া বৃষ্টির পানি দ্বারা উন্মুক্ত স্থানের ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। এভাবে ভূমি ক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর পলির। জমি চাষের ফলে ভূমি ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়, কেননা জমি চাষের ফলে মাটি আলগা হয় তখন বৃষ্টির পানি ও বায়ুপ্রবাহ সহজেই একস্থানের মাটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে। এ ধরনের উৎস থেকে সাধারণত সবচেয়ে বেশি পলি এসে থাকে। এছাড়া কিছু পলি আসে এমন মাটি থেকে যেখানে কোন গাছপালা নেই।

২। রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ

শিল্প কলকারখানা থেকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয়। এছাড়া গ্রাম বা শহরের গৃহস্থালী বর্জ্য ও নাগরিক বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্তূপ করা হয়। এ সমস্ত বর্জ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থসহ রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণু থাকে, যা বর্জ্য স্তূপকৃত স্থান ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানকে দূষিত করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে- ঢাকা শহরের হাজারীবাগের ট্যানারির কথা। এক হিসাবে দেখা গেছে এখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৯০০০ ঘন-মিটার পানিতে প্রায় তিন শতাধিক বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দ্রবীভূত অবস্থায় বের হচ্ছে। নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে এ তরল বর্জ্যরে অম্ল ও ক্ষারত্বের তারতম্য যথাক্রমে ১.৫ থেকে ১৩.০ ঢ়য মাত্রায় থাকে। এ তরল বর্জ্য ট্যানারি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিকে মারাত্মক দূষিত করেছে, ফলে এ এলাকার মাটিতে জন্মানো ঘাস পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

৩। অপরিকল্পিত নগরায়ণ

বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্বের জনসংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের শহরমুখী বসবাস। এ কারণে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের শহরের জনসংখ্যা ঘনত্ব দিন দিন বাড়ছে। ১৯৫০ সালের পরবর্তী ৩৫ বছরে বিশ্বে শহরবাসী লোকের সংখ্যা ১.২৫ বিলিয়ন (১২৫ কোটি) থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিনগুণ হয়েছে। অধিকতর উন্নত দেশসমূহে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে তা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপক সংখ্যক শহরবাসীর চাহিদা পূরণার্থে শহরে গড়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত পাকা-বাড়ি, সুউচ্চ ফ্ল্যাট বাড়ি এবং যেখানে সেখানে শিল্প কলকারখানা। এভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প কলকারখানা ও ফ্ল্যাট বাড়ি উঠাতে দূষিত হচ্ছে শহুরে পরিবেশ। এমনিভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়তে ভেঙে পড়ছে শহরের বর্জ্য নিষ্কাশন ও পয়ঃনিষ্কাশন। এসব বর্জ্য দ্বারা শহরাঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি, পানি, বাতাস দূষিত হচ্ছে।

৪। অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃক্ষ কর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান রাস্তাঘাট, কলকারখানা তৈরি করতে বনভূমি ও কৃষিজমি ব্যবহার করা হয়, ফলে বনভূমিতে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং মাটি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। মাটি উন্মুক্ত হওয়ায় মৃত্রিকাক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে মাটি তার পুষ্টি উপাদান হারাচ্ছে, তথা মাটি দূষণ ঘটছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেখানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

৫। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ। যেমন- ফারাক্কা বাঁধ

ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে এবং নদীতে স্রোত কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের লোনা পানি অধিক ভিতরে প্রবেশ করছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে মাটির লবণাক্ততাজনিত মাটি দূষণ শুরু হয়ে গেছে।

৬। চিংড়ি চাষ

চিংড়ি বাংলাদেশের একটি মূল্যবান রপ্তানিযোগ্য সম্পদ। এ কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সাতক্ষীরা, খুলনা ও কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। চিংড়ি চাষে অনেক দিন লোনা পানিবদ্ধ অবস্থায় থাকে বলে, লবণাক্ততাজনিত মাটি দূষণ ঘটে।

৭। কৃষি কর্মকাণ্ড

কৃষি কাজে অধিক ফসল ফলনের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছিটানো হয়, এর দ্বারা মাটি দূষণ ঘটে। যে কোন কৃষি কাজই মাটির পুষ্টি উপাদান নষ্ট করে থাকে। মাটি চাষাবাদের সময় মাটি আলগা হয়ে পড়ে এবং মাটি ক্ষয়ের মাধ্যমে মাটি দূষণ ঘটে। এছাড়া জমি চাষকালে মাটির কাঠামো নষ্ট হয়। মাটির কাঠামো (বুনট) নষ্ট হলে গাছ জন্মাতে অসুবিধা হয়।

মাটি দূষণের ফল

১। ভূমি ক্ষয়ের ফলে ভূমির উপরিভাগ থেকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান অন্যত্র সরে যায়, ফলে উক্ত জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, যা গাছ-পালা জন্মানোর অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং উক্ত এলাকা ক্রমান্বয়ে বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ে।

২। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ মাটিকে দূষিত করে, ফলে সে এলাকায় কোন উদ্ভিদ ও প্রাণী জন্মাতে পারে না।

৩। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি মাটি দূষণ ঘটে, যা মানুষসহ অন্যান্য জীবের বসবাসের অনুপোযোগী হয়। এর দ্বারা মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।

৪। ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধনের ফলে ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সেখানে গাছপালা জন্মাবার পরিবেশ নষ্ট হয়, যা মরুকরণকে প্রভাবিত করে।

৫। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো নদীতে পানির স্রোত হ্রাস পেয়েছে এবং নদীগুলো দিন দিন তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। এর দ্বারা নদী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি দূষণের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

৬। চিংড়ি চাষের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাটি লবণাক্ততাজনিত দূষণের স্বীকার হচ্ছে। ফলে সে এলাকার মাটির ঘাস পর্যন্ত মরে যাচ্ছে।

৭। কৃষি কর্মকাণ্ডের সময় অপরিকল্পিত চাষাবাদ, রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমি তার উর্বরতা হারাচ্ছে। এজন্য জমি থেকে ফসল উৎপাদন হার পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।

মাটির দূষণ নিয়ন্ত্রণ

১। আলগা মাটি সহজে ক্ষয় হয়ে থাকে। এজন্য আলগা মাটিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘাস বা অন্যান্য উদ্ভিদ লাগানা উচিত।

২। ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন বন্ধ করা প্রয়োজন। গাছ কাটার প্রয়োজন হলে পাশাপাশি গাছ লাগাবার উদ্যোগ নিতে হবে।

৩। নগর বা গ্রামের গৃহস্থালীর বর্জ্য ও সুয়ারেজ বর্জ্য স্থানান্তরের পূর্বে পরিশোধিত (ৎবপুপষরহম) করে নিতে হবে।

৪। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে।

৫। চিংড়ি চাষের বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

৬। কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য ভূমি, জলাশয় বা নদীতে নির্গমনের পূর্বে পরিশোধন করতে হবে।

৭। জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার, জীবাণু সার ব্যবহার করতে হবে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে শীম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মানো যেতে পারে।

৮। জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে জৈব প্রক্রিয়ায় কীটপতঙ্গ দমন করা যেতে পারে। তাছাড়া জমিতে পর্যায়ক্রমে ফসল চাষাবাদ করলে কীটপতঙ্গের আক্রমণ হ্রাস পায়।

৯। মাটি দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহ সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর; মাটির এ অবস্থাকে মাটি দূষণ বলে। বিভিন্ন কারণে মাটি দূষণ ঘটতে পারে, যথা- ভূমি ক্ষয়, রাসায়নিক দ্রব্য বা বর্জ্যরে স্তূপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন, ফারাক্কা বাঁধ, চিংড়ি চাষ ও কৃষি কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। পৃথিবীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক বসবাস উপযোগী করার জন্য মাটি দূষণ রোধ জরুরি।

[লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দ্য এনভায়রনমেন্ট রিভিউ ম্যাগাজিন]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

মাটি দূষণ ও প্রতিকার ভাবনা

জান্নাতুল মাওয়া নাজ

সোমবার, ০৫ জুলাই ২০২১

মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আর এ উদ্ভিদ তথা গাছ তাদের পুষ্টির জন্য মাটির ওপর নির্ভর করে। গাছ তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান (খনিজ পদার্থ) মাটি থেকে সংগ্রহ করে। তাই মাটি ছাড়া আমাদের খাদ্যের কোন বিকল্প ব্যবস্থা সম্ভব নয়।

মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের যে সব বস্তুর প্রয়োজন হয় তার সবগুলোরই উৎস মাটি। আমরা মাটিকে আমাদের জীবনের একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মনে করে থাকি। তবে মানুষের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে এ মাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তথা মাটি দূষিত হচ্ছে।

মাটি দূষণ বলতে বুঝায়- মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহের সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর। অবাঞ্ছিত পদার্থ বলতে সেসব উপাদানকে বুঝায়, যা মাটির নেতিবাচক রূপান্তর ঘটায়।

মাটিদূষণ পরিবেশ দূষণের একটি প্রধান অংশ। নগরায়ণ ও ব্যাপকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মাটিদূষণের প্রধান কারণ। মাটি দূষণের প্রধান কারণগুলো হলো-

১। ভূমি ক্ষয়

২। রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ

৩। অপরিকল্পিত নগরায়ণ

৪। অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন

৫। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ

৬। চিংড়ি চাষ ও

৭। অনিয়ন্ত্রিত কৃষি কাজ।

নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো-

১। ভূমি ক্ষয়

ভূমি ক্ষয়ের প্রধান কারণ বৃষ্টি ও বায়ু প্রবাহ। ভূমি ক্ষয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় যখন মানুষ নির্বিচারে গাছপালা কেটে বন উজাড় করে, তৃণভূমিতে চাষাবাদ শুরু করে এবং মাটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে গাছপালা কেটে ফেলে, ফলে মাটি আলগা হয়, তখন বাতাস সহজে মাটি উড়িয়ে নিয়ে ভূমি ক্ষয় ঘটায়। এছাড়া বৃষ্টির পানি দ্বারা উন্মুক্ত স্থানের ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। এভাবে ভূমি ক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয় প্রচুর পলির। জমি চাষের ফলে ভূমি ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়, কেননা জমি চাষের ফলে মাটি আলগা হয় তখন বৃষ্টির পানি ও বায়ুপ্রবাহ সহজেই একস্থানের মাটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে। এ ধরনের উৎস থেকে সাধারণত সবচেয়ে বেশি পলি এসে থাকে। এছাড়া কিছু পলি আসে এমন মাটি থেকে যেখানে কোন গাছপালা নেই।

২। রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ

শিল্প কলকারখানা থেকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বর্জ্য হিসেবে নির্গত হয়। এছাড়া গ্রাম বা শহরের গৃহস্থালী বর্জ্য ও নাগরিক বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্তূপ করা হয়। এ সমস্ত বর্জ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থসহ রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন জীবাণু থাকে, যা বর্জ্য স্তূপকৃত স্থান ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানকে দূষিত করে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে- ঢাকা শহরের হাজারীবাগের ট্যানারির কথা। এক হিসাবে দেখা গেছে এখান থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৯০০০ ঘন-মিটার পানিতে প্রায় তিন শতাধিক বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দ্রবীভূত অবস্থায় বের হচ্ছে। নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে এ তরল বর্জ্যরে অম্ল ও ক্ষারত্বের তারতম্য যথাক্রমে ১.৫ থেকে ১৩.০ ঢ়য মাত্রায় থাকে। এ তরল বর্জ্য ট্যানারি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিকে মারাত্মক দূষিত করেছে, ফলে এ এলাকার মাটিতে জন্মানো ঘাস পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

৩। অপরিকল্পিত নগরায়ণ

বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্বের জনসংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এরই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের শহরমুখী বসবাস। এ কারণে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের শহরের জনসংখ্যা ঘনত্ব দিন দিন বাড়ছে। ১৯৫০ সালের পরবর্তী ৩৫ বছরে বিশ্বে শহরবাসী লোকের সংখ্যা ১.২৫ বিলিয়ন (১২৫ কোটি) থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিনগুণ হয়েছে। অধিকতর উন্নত দেশসমূহে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে তা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপক সংখ্যক শহরবাসীর চাহিদা পূরণার্থে শহরে গড়ে উঠছে অনিয়ন্ত্রিত পাকা-বাড়ি, সুউচ্চ ফ্ল্যাট বাড়ি এবং যেখানে সেখানে শিল্প কলকারখানা। এভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিল্প কলকারখানা ও ফ্ল্যাট বাড়ি উঠাতে দূষিত হচ্ছে শহুরে পরিবেশ। এমনিভাবে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়তে ভেঙে পড়ছে শহরের বর্জ্য নিষ্কাশন ও পয়ঃনিষ্কাশন। এসব বর্জ্য দ্বারা শহরাঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি, পানি, বাতাস দূষিত হচ্ছে।

৪। অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃক্ষ কর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান রাস্তাঘাট, কলকারখানা তৈরি করতে বনভূমি ও কৃষিজমি ব্যবহার করা হয়, ফলে বনভূমিতে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং মাটি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। মাটি উন্মুক্ত হওয়ায় মৃত্রিকাক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে মাটি তার পুষ্টি উপাদান হারাচ্ছে, তথা মাটি দূষণ ঘটছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেখানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

৫। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ। যেমন- ফারাক্কা বাঁধ

ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে এবং নদীতে স্রোত কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের লোনা পানি অধিক ভিতরে প্রবেশ করছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে মাটির লবণাক্ততাজনিত মাটি দূষণ শুরু হয়ে গেছে।

৬। চিংড়ি চাষ

চিংড়ি বাংলাদেশের একটি মূল্যবান রপ্তানিযোগ্য সম্পদ। এ কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা সাতক্ষীরা, খুলনা ও কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। চিংড়ি চাষে অনেক দিন লোনা পানিবদ্ধ অবস্থায় থাকে বলে, লবণাক্ততাজনিত মাটি দূষণ ঘটে।

৭। কৃষি কর্মকাণ্ড

কৃষি কাজে অধিক ফসল ফলনের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছিটানো হয়, এর দ্বারা মাটি দূষণ ঘটে। যে কোন কৃষি কাজই মাটির পুষ্টি উপাদান নষ্ট করে থাকে। মাটি চাষাবাদের সময় মাটি আলগা হয়ে পড়ে এবং মাটি ক্ষয়ের মাধ্যমে মাটি দূষণ ঘটে। এছাড়া জমি চাষকালে মাটির কাঠামো নষ্ট হয়। মাটির কাঠামো (বুনট) নষ্ট হলে গাছ জন্মাতে অসুবিধা হয়।

মাটি দূষণের ফল

১। ভূমি ক্ষয়ের ফলে ভূমির উপরিভাগ থেকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান অন্যত্র সরে যায়, ফলে উক্ত জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, যা গাছ-পালা জন্মানোর অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং উক্ত এলাকা ক্রমান্বয়ে বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ে।

২। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ মাটিকে দূষিত করে, ফলে সে এলাকায় কোন উদ্ভিদ ও প্রাণী জন্মাতে পারে না।

৩। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি মাটি দূষণ ঘটে, যা মানুষসহ অন্যান্য জীবের বসবাসের অনুপোযোগী হয়। এর দ্বারা মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।

৪। ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধনের ফলে ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সেখানে গাছপালা জন্মাবার পরিবেশ নষ্ট হয়, যা মরুকরণকে প্রভাবিত করে।

৫। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো নদীতে পানির স্রোত হ্রাস পেয়েছে এবং নদীগুলো দিন দিন তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। এর দ্বারা নদী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটি দূষণের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

৬। চিংড়ি চাষের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাটি লবণাক্ততাজনিত দূষণের স্বীকার হচ্ছে। ফলে সে এলাকার মাটির ঘাস পর্যন্ত মরে যাচ্ছে।

৭। কৃষি কর্মকাণ্ডের সময় অপরিকল্পিত চাষাবাদ, রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমি তার উর্বরতা হারাচ্ছে। এজন্য জমি থেকে ফসল উৎপাদন হার পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।

মাটির দূষণ নিয়ন্ত্রণ

১। আলগা মাটি সহজে ক্ষয় হয়ে থাকে। এজন্য আলগা মাটিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘাস বা অন্যান্য উদ্ভিদ লাগানা উচিত।

২। ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন বন্ধ করা প্রয়োজন। গাছ কাটার প্রয়োজন হলে পাশাপাশি গাছ লাগাবার উদ্যোগ নিতে হবে।

৩। নগর বা গ্রামের গৃহস্থালীর বর্জ্য ও সুয়ারেজ বর্জ্য স্থানান্তরের পূর্বে পরিশোধিত (ৎবপুপষরহম) করে নিতে হবে।

৪। অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে।

৫। চিংড়ি চাষের বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

৬। কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য ভূমি, জলাশয় বা নদীতে নির্গমনের পূর্বে পরিশোধন করতে হবে।

৭। জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার, জীবাণু সার ব্যবহার করতে হবে। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে শীম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মানো যেতে পারে।

৮। জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে জৈব প্রক্রিয়ায় কীটপতঙ্গ দমন করা যেতে পারে। তাছাড়া জমিতে পর্যায়ক্রমে ফসল চাষাবাদ করলে কীটপতঙ্গের আক্রমণ হ্রাস পায়।

৯। মাটি দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহ সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর; মাটির এ অবস্থাকে মাটি দূষণ বলে। বিভিন্ন কারণে মাটি দূষণ ঘটতে পারে, যথা- ভূমি ক্ষয়, রাসায়নিক দ্রব্য বা বর্জ্যরে স্তূপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন, ফারাক্কা বাঁধ, চিংড়ি চাষ ও কৃষি কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। পৃথিবীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক বসবাস উপযোগী করার জন্য মাটি দূষণ রোধ জরুরি।

[লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দ্য এনভায়রনমেন্ট রিভিউ ম্যাগাজিন]

back to top