alt

মুক্ত আলোচনা

বাংলাদেশে ফল উৎপাদন ও সম্ভাবনাময় বিদেশি ফল

কবির হোসেন

: বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট ২০২১

খাদ্য তালিকায় ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ২২০ থেকে ২৫০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। দেহে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের অন্যতম উৎস ফল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবমতে, গত বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৮৮৩.৪২ মিলিয়ন (৮৮ কোটি ৩০ লাখ ৪২ হাজার) টন ফল উৎপন্ন হয়। এ সময়ে বাংলাদেশে ৭২৯২৮০ হেক্টর জমিতে ১২.১৫ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার) টন ফল উৎপাদন হয়। আমাদের দেশে ফলের মধ্যে আমের উৎপাদন শীর্ষে প্রায় ১৮৯৮৫০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ২৪৬৮০০০ টন। কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পেঁপে, কলা ও কুলের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে চীন ফল উৎপাদনে শীর্ষে (২৮%) এবং ভারত ২য় অবস্থানে।

সারা বিশ্বে কমবেশী ২০০০ ধরনের ফল আছে। বাংলাদেশে ৭২ ধরনের ফলের আবাদ হয়। গত দুই দশকের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে ১১% থেকে ১২% ফলের উৎপাদন বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি আম। নতুন নতুন জাতের পেঁপে, কলা, পেয়ারা, লিচু, কমলা, মাল্টা, আমের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ হেক্টরপ্রতি ফল উৎপাদনে বিশ্বে ১ম, কাঁঠালে ২য়, আমে ৭ম, পেয়ারায় ৮ম এবং মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম অবস্থান।

দেশি ফল আবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু বিদেশি ফল আমাদের দেশে আবাদের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু এবং মাটি চাষ উপযোগীর কারণে অনেক বিদেশি ফলের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং, বিএডিসি, বিএআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোক্তা, বেসরকারি নার্সারি বিদেশি ফল চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছে।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প বিদেশ থেকে ১৩টি বিদেশি ফল গাছের চারা ও কলম দেশে আমদানি করে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করেছে। উল্লেখযোগ্য বিদেশি ফল হলো- ড্রাগন ফল, রামবুটান, এভোকাডো, আরবী খেজুর, খাটো জাতের নারিকেল, পারসিমন, আলুবোখারা, লংগন, ম্যাংগোস্টিন, টক আতা, কোকো ও কাজুবাদাম। আঠাবিহীন কাঁঠাল, বল সুন্দরী ও বীজ শূন্য কুল, থাই পেয়ারার জাত সম্প্রসারণে প্রকল্পটি কাজ করছে। বর্ণিত ফলের চারা ও কলম থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে আনা হয়েছে।

ড্রাগন ফল : ভিয়েতনামের জাতীয় ফল এবং বিশ্ব উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান। এ ফলের উৎপত্তি মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো। রাতে ফুল ফোঁটে সকালে বন্ধ হয়। অনিন্দ্য সুন্দর এ ফুলকে রাতের রানী বলে। পার্বত্য অঞ্চল, নরসিংদী, ঢাকা, রাজশাহী, বরেন্দ্র অঞ্চল, বৃহত্তর যশোর, চুয়াডাংগা, ঝিনেদাসহ সারাদেশে এর আবাদ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গত বছর ২৮০ হেক্টর জমিতে ২৯৪০ টন ড্রাগন ফল উৎপন্ন হয়। গোলাপী, লাল, হলুদ ও সাদা রঙের ড্রাগনের জাত আছে। বারি ড্রাগন-১ গোলাপী জাতের কাটিং হটিকালচার সেন্টার ও বিভিন্ন নার্সারিতে পাওয়া যায়।

স্ট্রবেরি : এ ফলের উৎপত্তিস্থল উত্তর আমেরিকা ও চিলি। শীত কালের ফল। বিশ্বে স্ট্রবেরি উৎপাদনে চীন শীর্ষে। দেশের পার্বত্য এলাকা, রাজশাহী, গাজীপুর, ঢাকাসহ সারা দেশে এর চাষ বৃদ্ধি হচ্ছে। কৃষি বিভাগ, অভিজ্ঞ চাষি ও গবেষকদের পরামর্শে চাষ করলে বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। দেশে গত বছর ৬৪ হেক্টর জমিতে ২৮৬ টন উৎপন্ন হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ চারা উৎপাদন করে চাষি পর্যায়ে সরবরাহ করছে।

মাল্টা ও কমলা : হিমালয়ের পাদদেশে আসাম, মায়ানমার এবং চীন মাল্টা এবং কমলার উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। চীন এ দুটি ফল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ। বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, যশোর, চুয়াডাংগা, ময়মনসিংহ, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও, টাংগাইলসহ সারা দেশেই দুটি ফলের চাষ হচ্ছে। বারি মাল্টা-১ যা পয়সা মাল্টা নামে অধিক পরিচিত সারা দেশে ব্যাপকভাবে আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে। বারি কমলা-১, দার্জিলিং, ছাতক জাতসহ নানিয়ারচরের শ্বলেশ্বরী কমলার জাতগুলোর চাষ সারা দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। হর্টিকালচার সেন্টারে কলম পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত বছর ২৫৫০ হেক্টর জমিতে ১৭৮০০ টন মাল্টা, ৪০৮০ হেক্টর জমিতে ৪৬৫২২ টন কমলা উৎপন্ন হয়।

রামবুটান : মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম রামবুটানের উৎপত্তি। রাঙ্গামাটি, নরসিংদী, গাজীপুর, বরেন্দ্র অঞ্চল এলাকায় চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে রামবুটানের কলম সংগ্রহ করে গাজীপুরের মৌচাক, দিনাজপুর, আসাদগেট, রংপুর, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বরিশাল, যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজিত করা হয়েছে। মাতৃগাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে। এ ফলটি দেশে দ্রুত সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করা য়ায়। দেশে ১১ হেক্টর জমিতে রামবুটান চাষ হয়েছে।

এভোকাডো : উৎপত্তি মধ্য-আমেরিকা এবং মেক্সিকো। মেক্সিকোতে সবচেয়ে বেশি এভোকাডো উৎপন্ন হয়। সারা দেশে ১০ হেক্টর জমিতে এ ফল চাষ হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চল, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, রাজবাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরে এর আবাদ হচ্ছে। সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করা হয়েছে। আগামীতে এর চাষ দ্রুত সম্প্রসারণ হবে আশা করা যায়।

আরবি খেজুর : সৌদি আরবের জাতীয় ফল। পারস্য উপসাগর তীরবর্তী এলাকা ইরাক অঞ্চল এ ফলের উৎপত্তি। খেজুর উৎপাদনে মিশর ১ম, সৌদি আরব ২য় এবং ইরান ৩য়। বাংলাদেশে খেজুরের আবাদ বাড়ছে। ভালুকা, চাটমোহরে ব্যক্তি উদ্দ্যোগে সাফল্যজনকভাবে খেজুরের বাগান হয়েছে। বাংলাদেশে আজওয়া, মরিয়ম, শুক্কারী ও হলুদ জাতের সৌদি খেজুর চাষ উপযোগী। হর্টিকালচার সেন্টারসমুহে মাতৃগাছ রোপণ করা হয়েছে এবং পর্যাপ্ত খেজুরের ফলন হয়েছে। দেশে ১০ হেক্টর জমিতে সৌদী খেজুর চাষ হয়েছে।

খাটোজাতের নারিকেল : নারিকেলের উৎপত্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বে নারিকেল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়া শীর্ষে। গত বছর বাংলাদেশে ৪৭০০০ হেক্টর জমিতে ৬.৬০ লাখ টন নারিকেল উৎপন্ন হয়। ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ ১০ হাজার খাটো ওপি জাতের নারিকেল চারা সরকারীভাবে সংগ্রহ করে চাষী পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। ওপি জাত- সিয়াম গ্রীন, সিয়াম ব্লো, সিয়াম গার্ডেন এবং সিয়াম ইয়েলো। তৎসময়ে বরিশালের রহমতপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ৮০০ চারা রোপণ করে খাটো জাতের নারিকেলের মাতৃবাগান করা হয়। মাতৃগাছে পর্যাপ্ত নারিকেল ধরেছে এবং চারা উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। ভারতের কেরালা থেকে হাইব্রীড খাটো জাতের ডিজে-সম্পূর্ণ ৭০০০টি চারা এনে বিতরণ করা হয়েছে। সঠিক পরিচর্যা করলে ৩ থেকে সাড়ে ৩ বছরের গাছে ফল আসে।

পার্সিমন ও ম্যাংগোস্টিন : দুটি ফলই গাব জাতীয় ফল। পার্সিমনকে সৃষ্টিকর্তার খাবার বলা হয় এবং জাপানের জাতীয় ফল। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফল দুটি চাষ উপযোগী। নাটোরে ব্যক্তি উদ্যোগে পার্সিমনের বাগান হয়েছে এবং ভাল ফলন হয়েছে। সরকারী হর্টিকালচার সেন্টারে পার্সিমন ও ম্যাংগোস্টিনের মাতৃগাছে ফল ধরেছে। চারা কলম তৈরীর কাজ চলমান আছে।

কাজু বাদাম : বাংলাদেশে কাজু বাদাম চাষের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ের ঢালুতে এর ফলন ভাল হয়। চাষ সম্প্রসারণের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি পযায়ে একটি প্রকল্প কাজ শুরু করেছে।

বিদেশি ফল চাষের বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অভিজ্ঞ চাষির পরামর্শে চাষ করলে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে। সঠিক নিয়মে পরিচযা না করলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিয্যতে দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলের গাছ সারা বছর ফল সরবরাহ দেবে; যা আমাদের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বাংলাদেশে ফল উৎপাদন ও সম্ভাবনাময় বিদেশি ফল

কবির হোসেন

বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট ২০২১

খাদ্য তালিকায় ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ২২০ থেকে ২৫০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। দেহে পুষ্টি উপাদান সরবরাহের অন্যতম উৎস ফল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবমতে, গত বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৮৮৩.৪২ মিলিয়ন (৮৮ কোটি ৩০ লাখ ৪২ হাজার) টন ফল উৎপন্ন হয়। এ সময়ে বাংলাদেশে ৭২৯২৮০ হেক্টর জমিতে ১২.১৫ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার) টন ফল উৎপাদন হয়। আমাদের দেশে ফলের মধ্যে আমের উৎপাদন শীর্ষে প্রায় ১৮৯৮৫০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ২৪৬৮০০০ টন। কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পেঁপে, কলা ও কুলের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে চীন ফল উৎপাদনে শীর্ষে (২৮%) এবং ভারত ২য় অবস্থানে।

সারা বিশ্বে কমবেশী ২০০০ ধরনের ফল আছে। বাংলাদেশে ৭২ ধরনের ফলের আবাদ হয়। গত দুই দশকের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে ১১% থেকে ১২% ফলের উৎপাদন বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি আম। নতুন নতুন জাতের পেঁপে, কলা, পেয়ারা, লিচু, কমলা, মাল্টা, আমের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ হেক্টরপ্রতি ফল উৎপাদনে বিশ্বে ১ম, কাঁঠালে ২য়, আমে ৭ম, পেয়ারায় ৮ম এবং মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম অবস্থান।

দেশি ফল আবাদের পাশাপাশি বেশ কিছু বিদেশি ফল আমাদের দেশে আবাদের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু এবং মাটি চাষ উপযোগীর কারণে অনেক বিদেশি ফলের আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং, বিএডিসি, বিএআরআই, বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোক্তা, বেসরকারি নার্সারি বিদেশি ফল চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছে।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প বিদেশ থেকে ১৩টি বিদেশি ফল গাছের চারা ও কলম দেশে আমদানি করে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করেছে। উল্লেখযোগ্য বিদেশি ফল হলো- ড্রাগন ফল, রামবুটান, এভোকাডো, আরবী খেজুর, খাটো জাতের নারিকেল, পারসিমন, আলুবোখারা, লংগন, ম্যাংগোস্টিন, টক আতা, কোকো ও কাজুবাদাম। আঠাবিহীন কাঁঠাল, বল সুন্দরী ও বীজ শূন্য কুল, থাই পেয়ারার জাত সম্প্রসারণে প্রকল্পটি কাজ করছে। বর্ণিত ফলের চারা ও কলম থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে আনা হয়েছে।

ড্রাগন ফল : ভিয়েতনামের জাতীয় ফল এবং বিশ্ব উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান। এ ফলের উৎপত্তি মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো। রাতে ফুল ফোঁটে সকালে বন্ধ হয়। অনিন্দ্য সুন্দর এ ফুলকে রাতের রানী বলে। পার্বত্য অঞ্চল, নরসিংদী, ঢাকা, রাজশাহী, বরেন্দ্র অঞ্চল, বৃহত্তর যশোর, চুয়াডাংগা, ঝিনেদাসহ সারাদেশে এর আবাদ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে গত বছর ২৮০ হেক্টর জমিতে ২৯৪০ টন ড্রাগন ফল উৎপন্ন হয়। গোলাপী, লাল, হলুদ ও সাদা রঙের ড্রাগনের জাত আছে। বারি ড্রাগন-১ গোলাপী জাতের কাটিং হটিকালচার সেন্টার ও বিভিন্ন নার্সারিতে পাওয়া যায়।

স্ট্রবেরি : এ ফলের উৎপত্তিস্থল উত্তর আমেরিকা ও চিলি। শীত কালের ফল। বিশ্বে স্ট্রবেরি উৎপাদনে চীন শীর্ষে। দেশের পার্বত্য এলাকা, রাজশাহী, গাজীপুর, ঢাকাসহ সারা দেশে এর চাষ বৃদ্ধি হচ্ছে। কৃষি বিভাগ, অভিজ্ঞ চাষি ও গবেষকদের পরামর্শে চাষ করলে বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। দেশে গত বছর ৬৪ হেক্টর জমিতে ২৮৬ টন উৎপন্ন হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ চারা উৎপাদন করে চাষি পর্যায়ে সরবরাহ করছে।

মাল্টা ও কমলা : হিমালয়ের পাদদেশে আসাম, মায়ানমার এবং চীন মাল্টা এবং কমলার উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। চীন এ দুটি ফল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ। বাংলাদেশের সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, যশোর, চুয়াডাংগা, ময়মনসিংহ, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও, টাংগাইলসহ সারা দেশেই দুটি ফলের চাষ হচ্ছে। বারি মাল্টা-১ যা পয়সা মাল্টা নামে অধিক পরিচিত সারা দেশে ব্যাপকভাবে আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে। বারি কমলা-১, দার্জিলিং, ছাতক জাতসহ নানিয়ারচরের শ্বলেশ্বরী কমলার জাতগুলোর চাষ সারা দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। হর্টিকালচার সেন্টারে কলম পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত বছর ২৫৫০ হেক্টর জমিতে ১৭৮০০ টন মাল্টা, ৪০৮০ হেক্টর জমিতে ৪৬৫২২ টন কমলা উৎপন্ন হয়।

রামবুটান : মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম রামবুটানের উৎপত্তি। রাঙ্গামাটি, নরসিংদী, গাজীপুর, বরেন্দ্র অঞ্চল এলাকায় চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে থাইল্যান্ড থেকে রামবুটানের কলম সংগ্রহ করে গাজীপুরের মৌচাক, দিনাজপুর, আসাদগেট, রংপুর, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বরিশাল, যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজিত করা হয়েছে। মাতৃগাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে। এ ফলটি দেশে দ্রুত সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করা য়ায়। দেশে ১১ হেক্টর জমিতে রামবুটান চাষ হয়েছে।

এভোকাডো : উৎপত্তি মধ্য-আমেরিকা এবং মেক্সিকো। মেক্সিকোতে সবচেয়ে বেশি এভোকাডো উৎপন্ন হয়। সারা দেশে ১০ হেক্টর জমিতে এ ফল চাষ হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চল, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, রাজবাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরে এর আবাদ হচ্ছে। সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারে মাতৃগাছ সৃজন করা হয়েছে। আগামীতে এর চাষ দ্রুত সম্প্রসারণ হবে আশা করা যায়।

আরবি খেজুর : সৌদি আরবের জাতীয় ফল। পারস্য উপসাগর তীরবর্তী এলাকা ইরাক অঞ্চল এ ফলের উৎপত্তি। খেজুর উৎপাদনে মিশর ১ম, সৌদি আরব ২য় এবং ইরান ৩য়। বাংলাদেশে খেজুরের আবাদ বাড়ছে। ভালুকা, চাটমোহরে ব্যক্তি উদ্দ্যোগে সাফল্যজনকভাবে খেজুরের বাগান হয়েছে। বাংলাদেশে আজওয়া, মরিয়ম, শুক্কারী ও হলুদ জাতের সৌদি খেজুর চাষ উপযোগী। হর্টিকালচার সেন্টারসমুহে মাতৃগাছ রোপণ করা হয়েছে এবং পর্যাপ্ত খেজুরের ফলন হয়েছে। দেশে ১০ হেক্টর জমিতে সৌদী খেজুর চাষ হয়েছে।

খাটোজাতের নারিকেল : নারিকেলের উৎপত্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বে নারিকেল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়া শীর্ষে। গত বছর বাংলাদেশে ৪৭০০০ হেক্টর জমিতে ৬.৬০ লাখ টন নারিকেল উৎপন্ন হয়। ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ ১০ হাজার খাটো ওপি জাতের নারিকেল চারা সরকারীভাবে সংগ্রহ করে চাষী পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। ওপি জাত- সিয়াম গ্রীন, সিয়াম ব্লো, সিয়াম গার্ডেন এবং সিয়াম ইয়েলো। তৎসময়ে বরিশালের রহমতপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ৮০০ চারা রোপণ করে খাটো জাতের নারিকেলের মাতৃবাগান করা হয়। মাতৃগাছে পর্যাপ্ত নারিকেল ধরেছে এবং চারা উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। ভারতের কেরালা থেকে হাইব্রীড খাটো জাতের ডিজে-সম্পূর্ণ ৭০০০টি চারা এনে বিতরণ করা হয়েছে। সঠিক পরিচর্যা করলে ৩ থেকে সাড়ে ৩ বছরের গাছে ফল আসে।

পার্সিমন ও ম্যাংগোস্টিন : দুটি ফলই গাব জাতীয় ফল। পার্সিমনকে সৃষ্টিকর্তার খাবার বলা হয় এবং জাপানের জাতীয় ফল। বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফল দুটি চাষ উপযোগী। নাটোরে ব্যক্তি উদ্যোগে পার্সিমনের বাগান হয়েছে এবং ভাল ফলন হয়েছে। সরকারী হর্টিকালচার সেন্টারে পার্সিমন ও ম্যাংগোস্টিনের মাতৃগাছে ফল ধরেছে। চারা কলম তৈরীর কাজ চলমান আছে।

কাজু বাদাম : বাংলাদেশে কাজু বাদাম চাষের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ের ঢালুতে এর ফলন ভাল হয়। চাষ সম্প্রসারণের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি পযায়ে একটি প্রকল্প কাজ শুরু করেছে।

বিদেশি ফল চাষের বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অভিজ্ঞ চাষির পরামর্শে চাষ করলে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে। সঠিক নিয়মে পরিচযা না করলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিয্যতে দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলের গাছ সারা বছর ফল সরবরাহ দেবে; যা আমাদের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর]

back to top