alt

মুক্ত আলোচনা

তথ্য আমার অধিকার, জানা আছে কী সবার’- প্রেক্ষিত পর্যালোচনা

মরতুজা আহমদ

: মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

যাত্রা শুরুর এক যুগ পূর্তিতে এহেন শিরোনাম দেখে পাঠকমাত্রই আত্মসমালোচনা করার ও আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেবেন। কেননা, এক যুগ যে কত লম্বা সময় তা কবি সৌগতবর্মন বা অভিজিৎ দাসের প্রেম ও বিরহের কবিতা পড়লেই উপলব্ধি করা যায়। আর মূলত, যুগপূর্তিকে কেন্দ্র করে এবার এটিই আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে।

হ্যাঁ, এবারই আমাদের তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তথ্য কমিশনের যুগপূর্তি হয়েছে। নিঃসন্দেহে এক যুগেও দেশের তাবৎ জনগণ তথ্যে তার অধিকার বা মালিকানা সম্পর্কে জানতে পারেনি, যারা জানে তাদের অনেকেই স্পষ্ট বোঝে না, বুঝলেও তার জীবনমান উন্নয়নে তা প্রয়োগ করে না বা করতে পারে না। এখনও সাধারণের ধারণা, তথ্যের মালিক রাষ্ট্র বা সরকার তথা আইনের ভাষায় কর্তৃপক্ষ। এটা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বিষয়, সর্বসাধারণ জানবে ততটুকুই, কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশে যতটুকু, যেভাবে জানাবে। আবার অনেকের ধারণা, এগুলো উন্নত বিশ^ বা পশি^মাদের বিষয়। অন্যদিকে, তথ্য যারা দেবেন বা যাদের কাছে জনগণের তথ্য আছে তাদের অনেকের এক যুগেও তথ্য গোপন রাখার সংস্কৃতি বা মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গী বদলায়নি, গোপনীয়তার বেড়াজালে আটকে আছেন।

২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২৮ সেপ্টেম্বর তথ্য জানার অধিকার হিসেবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ইউনেস্কো এবং ২০১৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটিকে ‘International Day for Universal Access to Information’ অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক সার্বজনীন তথ্যে অভিগম্যতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে দেশে দেশে পালিত হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হলো, সব মানুষের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ আইনটি পাশের মাধ্যমেই সব নাগরিকের তথ্য চাওয়া, পাওয়ার, প্রয়োজনীয় সব তথ্যে সাবলীল প্রবেশের এবং এর প্রয়োগে উপকারভোগী হওয়ার আবশ্যিক ও আইনি স্বীকৃতি লাভ করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পথ রচিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকাশের পথ সুগম হয়েছে। তাই যুগপূর্তিতে এর বাস্তবায়ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ জনস্বার্থেই প্রয়োজন।

পৃথিবীতে তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এর পেছনে অনেক দ্বন্দের ইতিহাস রয়েছে। তবে তথ্য জানার ধারণাটি মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই পৃথিবীতে বিরাজমান। আবার সাধারণ মানুষের অধিকার বঞ্চনার ইতিহাসের মতোই তথ্য বঞ্চনার পুরনো ইতিহাস রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে সমাজে শ্রেণী বিভাজন হয়েছে সে পর্যায়ে ক্ষমতাবানরা সাধারণ মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে। তাদের বিত্তবৈভব, সম্পদ-স্বাচ্ছন্দ ও ক্ষমতাকে নিরাপদ রেখেছে। আবার সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে তখন থেকেই জনগণের জানার অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে, তাই গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে Press freedom ও তথ্য অধিকারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। পঞ্চদশ শতকে যান্ত্রিক প্রেস আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে যেন বিপ্লব ঘটল। পুস্তক, সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনার বিস্তার ঘটতে থাকল। ছাপানো পুস্তক হাতে হাতে চলে গেল। ফলে বিভিন্ন ধারণা, চিন্তা, ভাব, বিশ্বাস ও অনুভূতিরও দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকল। ক্ষমতাবান কোন কোন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ এগুলোকে সত্যিকার Challenge মনে করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিবেচনায় প্রত্যেক্ষভাবে প্রকাশনায় হস্তক্ষেপ শুরু করলো।

তৎকালীন ব্রিটিশ একটি আইনে শর্ত দেয়া হলো যে, কোন বই প্রকাশের জন্য সরকারের পূর্ব অনুমতি নিতে হবে। আন্দোলন শুরু হলো। তথ্য অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ১৬৪৪ সালেই বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও বুদ্ধিজীবী John Milton তার Areopagetica বইতে কালজয়ী উক্তি করলেন : ‘Give me the liberty to know, to utter and to argue freely according to conscience, above all liberties. এভাবে ইউরোপজুড়েই তথ্য ও প্রেসের স্বাধীনতার আন্দোলন চলতে থাকল।

আজ থেকে প্রায় আড়াইশত বছর পূর্বে ফিনল্যান্ডের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ফিনিসীয় যাজক Anders Chydenius তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন শুরু করে দেন। তিনি বলেন, মানুষ তার প্রয়োজনে যা চায় তা কীভাবে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে- তা তাকে জানাতে হবে। ফিনল্যান্ড তখন সুইডেনের আওতাভুক্ত ছিল। Anders Chydenius সুইডেনের সংসদে বিল উপস্থাপন করেন। পাস হয় সুইডেনের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আইন ১৭৬৬ সনে। এ আইনের মাধ্যমে সুইডিশ জনগণকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট অথবা প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। বিনামূল্যে এবং দ্রুত তথ্য দিতে সরকারকে বাধ্য করা হয়। নাগরিকের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে এটাই বিশ্বের প্রথম আইন।

তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তথ্য জানার অধিকারকে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স, ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম অর্জন ছিল Liberty।

অন্যদিকে, u.S সংবিধান প্রণেতারা ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১ সনে U.S Bill of Rights-এর First Amendment করে Press Freedom-এর স্বাধীনতা সংরক্ষণ করেন। যেখানে বলা হয়

‘Congress shall make no law.......abridging the freedom of speech or the press.’

পুরো ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে যখন এভাবে মানুষের তথ্যে অভিগম্যতা ও তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন পাকভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশের উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৫৭-তে পলাশীর প্রান্তরে যখন স্বাধীনতা অস্তমিত হচ্ছিল, জনগণ তখন ঘরে বসে হাততালি দিয়ে বলাবলি করছিল, ‘রাজায় রাজায় লেগেছে যুদ্ধ, দেখি কে হারে কে জেতে।’ তথ্য জানার স্বাধীনতা দূরের কথা, পরাধীনতার ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হচ্ছিল এতদাঞ্চল। শাসকরা ঢোল পিটিয়ে দয়া পরবশে যেটুকু তথ্য জনগণকে দিত সেটুকুই তার পাওনা বলে সাধারণ মানুষের সন্তুষ্টি ছিল। অধিকন্তু, ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ১৯২৩ সালে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ জারির কারণে তথ্য গোপনের সংস্কৃতি পাকাপোক্ত হয়ে গেল। শাসক বা কর্তৃপক্ষের তথ্যের ওপর একচ্ছত্র মালিকানা বা তথ্য গোপনের সংস্কৃতির ষোলকলা পূর্ণ হলো। Alexander SelKirk-এর মতো ব্রিটিশ শাসকদের ভাবনা প্রবল হলো, ‘I am monarch of all I survey, My right there is none to dispute.’ পাকিস্তান আমলেও এর তেমন উন্নতি ঘটলো না।

এদিকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলো। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে রেজল্যুশনের মাধ্যমে তথ্য অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলা হলো, ‘Freedom of information is a fundamental right and is the touchstone of all the freedom to which United Nations is consecrated.’ পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পত্র (UDHR) জারি হয়। ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে তথ্যের স্বাধীনতাকে সার্বজনীন মানবাধিকার হিসেবে সুষ্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এটি অন্যতম ঘটনা। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৬ সালে গৃহীত জাতিসংঘের ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি’র (ICCPR) অন্তর্ভুক্ত করে তথ্য অধিকারকে আরও সুসংহত করা হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন। জনগণকে সব ক্ষমতার মালিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। সংবিধানে মানুষের সব মৌলিক অধিকারের সঙ্গে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অধিকার তথা তথ্য অধিকারকে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবেই তিনি প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ অর্থাৎ বিশ^সভার সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটান। সংবিধানের সে শক্তিতে ভর করে পরবর্তীতে মানবাধিকার কর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, একাডেমিসিয়ান, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তথ্য অধিকার বিষয়ে আইনের খসড়া তৈরি হয়। ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ হয়। ২০০৮ সালেই জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করে। ২০০৯ এর ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইনটি পাস করে, গেজেট প্রকাশ ও কার্যকর করে এবং কমিশন গঠন করে। সে থেকে বাংলাদেশে জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তাদের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনি স্বীকৃতি পায়।

বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ একটি আধুনিক, অনন্য ও প্রাগ্রসর আইন। এই আইনের মাধ্যমে বিরাজমান বিভিন্ন নীতি-আদর্শ ও চেতনায় Paradigm Shift হয়েছে। এই আইনে, জনগণ কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে; কর্তৃপক্ষের কাজের, সেবার ও বাজেটের হিসাব চায়; অন্যান্য আইনে কর্তৃপক্ষ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এই আইনের মূল দর্শন হলো ‘Disclosure is rule, secrecy is exception’. অন্যদিকে দীর্ঘ প্রচলিত ‘Official Secrets Act’-এর দর্শন ‘Secrecy is rule, disclosure is exception’। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা শতাব্দীপ্রাচীন। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ মতে উভয় বিচারের ক্ষেত্রে যিনি আদালতে বিচারপ্রার্থী, Burden of proof তারই। ফৌজদারি ব্যবস্থায় যতক্ষণ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হবে, ততক্ষণ আসামি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন। তথ্য কমিশন তথ্য অধিকার আইনমতে একটি Quasi-Judicial Court. কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে সংক্ষুব্ধ কোন নাগরিক তথ্য কমিশনে অভিযোগ করলে কমিশন কর্তৃপক্ষ বা তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করবেন, এই আদালতে Burden of proof কর্তৃপক্ষ বা ক্ষেত্রমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার, আবেদনকারী বা অভিযোগকারীর নহে। অন্য কথায় বিচারপ্রার্থীর নহে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেই বা কর্তৃপক্ষকে, না পারলে জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের আদেশ বা বিভাগীয় মামলার সুপারিশ তার বিরুদ্ধে হতে পারে। এই যে জনগণ তথা নাগরিককে আইনি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের ওপর সে ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সাধারণ মানুষ কী সেভাবে প্রস্তুত হয়েছে ? তাছাড়া তৃণমূল থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তথ্য স্বাক্ষরতার অভাব প্রকটভাবে বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে, শত বছরের গোপনীয়তার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত কর্তৃপক্ষের কী রাতারাতি সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চাহিবামাত্র তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সব তথ্য সুর সুর করে দিয়ে দেয়ার বা অবারিত করে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে পুরোপুরি তৈরি আছে? তদুপরি যার দুর্নীতির অভ্যাস মজ্জাগত, তিনি তথ্য গোপনের বা বিকৃতির প্রাণান্ত চেষ্টা করে থাকেন, ধরা পড়ার ভয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড় পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। এমনকি সৎ বলে কথিত এমন অনেক কর্মকর্তার মধ্যেও দেখা যায় চিরাচরিত ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবল বাসনা, তথ্য গোপনের উদগ্র প্রচেষ্টা।

এ সব কারণে অনেক বোদ্ধা আমাদের আইনটিকে আধুনিক ও প্রাগ্রসর বলে মনে করেন। আইনের মূল চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বা একে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য সাধারণ মানুষ বা কর্তৃপক্ষের কিছুটা সময়ের প্রয়োজন আছে বৈকি।

তবে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত আইনটির বাস্তবায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। অর্জনও নেহায়েৎ কম নয়। তথ্যপ্রাপ্তি, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, প্রকাশ, প্রচার, অভিযোগ দায়ের, নিষ্পত্তি ইত্যাদি-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিধি, প্রবিধি, নির্দেশিকা, সহায়িকা ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে। সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষে ৪২,৪৫০ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব কার্যালয়ে বিকল্প দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও আপিল কর্মকর্তা নিয়োজিত হয়েছে। তথ্য কমিশন হতে কেন্দ্র ও সব জেলা ছাড়াও শুধু উপজেলা পর্যায়েই জনউদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান ৫০৪টি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ৫০৬টি এবং যথেষ্ট সংখ্যায় মতবিনিময় সভা, সেমিনার সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এ ধরণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার; স্কুল, কলেজের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তকরণ ইত্যাদি হয়েছে। কেন্দ্রসহ, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালিত হয়। জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে সরকার সব শ্রেণী-পেশার ব্যক্তির সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট ToRসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা অর্থাৎ চার স্তরে কমিটি গঠন করে দিয়েছে। তাছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ অচঅ (Annual Performance Agreement) বাস্তবায়নে বাধ্যতামূলকভাবে জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার আওতায় তথ্যে অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণে তৃণমূল পর্যন্ত ইন্টারনেটের সমন্বিত নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন, অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের আওতায় সারাদেশে স্থাপিত প্রায় ৫০০০ ইউনিয়ন/পৌর ডিজিটাল সেন্টার তৃণমূলে তথ্য সেবা দিচ্ছে। তথ্যপ্রাপ্তি, সহজ ও নিশ্চিতকরণে ওয়েবসাইট স্থাপন ও সিটিজেন চার্টার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়েবপোর্টাল রয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন পরিষদসহ দেশের প্রায় সব সরকারি কার্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ওয়েবসাইট খুললেই দেখা যায় তথ্যে মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের পথ নির্দেশনাবিষয়ক একটি কর্নার রয়েছে। স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের সব মাধ্যমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ঘরে বসেই তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে এবং উন্নয়নের মহাসড়কে প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে। তার ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি জাতিসংঘে এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।

করোনা সংকটের শুরুতেই তথ্য কমিশন ভার্চুয়াল শুনানি কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। কোন পক্ষকেই ঢাকায় তথ্য কমিশনে সশরীরে হাজির হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে অর্থ বা সময় যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি বিড়ম্বনা এড়ানো যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে তথ্য কমিশনে ১৭১টি অভিযোগের শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। তন্মধ্যে ১৬৪টি অভিযোগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমকে আর বেগবান করা হবে এবং সব স্তরেই চালু করা হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল নির্বাচনী মেনোফেস্টোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করে তার নবগঠিত সরকার ২০০৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস ও কার্যকর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণ মহান সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে, করোনা সংকট ছাড়াও সময়ে সময়ে ভিডিও কনফারেন্স বা প্রেস কনফারেন্স করে এবং মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলোচিত ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বিষয়ে নিয়মিত প্রেসব্রিফিং-এর মাধ্যমে জাতির সামনে স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশের উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সচিব সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বিষয়টি পুনঃব্যক্ত করে বিভিন্ন অনুশাসন দিয়েছেন। উল্লেখ্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য অধিকার আইন একটি বিশেষ হাতিয়ার। সম্প্রতি মাননীয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী কয়েকটি অনুষ্ঠানে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিকল্পে স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ এবং তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। এভাবে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের সম্মানিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সব শ্রেণী-পেশার লোকজনকে নিয়ে জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়নকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে পারলে তথ্যে সার্বজনীন অভিগম্যতা দ্রুত নিশ্চিত হবে। বিশেষত, সাধারণ নাগরিকের তথ্যে মালিকানাবোধ তৈরি হবে; তথ্য প্রদানে অনাগ্রহী বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীরা আরও সচেতন, দক্ষ ও জনগণের প্রতি ইতিবাচক ও সংবেদনশীল হবেন। সব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হবে, আস্থার সম্পর্

ক সুদৃঢ় হবে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান আরও সুসংহত হবে।

লেখক : প্রধান তথ্য কমিশনার

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

তথ্য আমার অধিকার, জানা আছে কী সবার’- প্রেক্ষিত পর্যালোচনা

মরতুজা আহমদ

মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

যাত্রা শুরুর এক যুগ পূর্তিতে এহেন শিরোনাম দেখে পাঠকমাত্রই আত্মসমালোচনা করার ও আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেবেন। কেননা, এক যুগ যে কত লম্বা সময় তা কবি সৌগতবর্মন বা অভিজিৎ দাসের প্রেম ও বিরহের কবিতা পড়লেই উপলব্ধি করা যায়। আর মূলত, যুগপূর্তিকে কেন্দ্র করে এবার এটিই আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে।

হ্যাঁ, এবারই আমাদের তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তথ্য কমিশনের যুগপূর্তি হয়েছে। নিঃসন্দেহে এক যুগেও দেশের তাবৎ জনগণ তথ্যে তার অধিকার বা মালিকানা সম্পর্কে জানতে পারেনি, যারা জানে তাদের অনেকেই স্পষ্ট বোঝে না, বুঝলেও তার জীবনমান উন্নয়নে তা প্রয়োগ করে না বা করতে পারে না। এখনও সাধারণের ধারণা, তথ্যের মালিক রাষ্ট্র বা সরকার তথা আইনের ভাষায় কর্তৃপক্ষ। এটা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বিষয়, সর্বসাধারণ জানবে ততটুকুই, কর্তৃপক্ষ দয়াপরবশে যতটুকু, যেভাবে জানাবে। আবার অনেকের ধারণা, এগুলো উন্নত বিশ^ বা পশি^মাদের বিষয়। অন্যদিকে, তথ্য যারা দেবেন বা যাদের কাছে জনগণের তথ্য আছে তাদের অনেকের এক যুগেও তথ্য গোপন রাখার সংস্কৃতি বা মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গী বদলায়নি, গোপনীয়তার বেড়াজালে আটকে আছেন।

২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২৮ সেপ্টেম্বর তথ্য জানার অধিকার হিসেবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ইউনেস্কো এবং ২০১৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটিকে ‘International Day for Universal Access to Information’ অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক সার্বজনীন তথ্যে অভিগম্যতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে দেশে দেশে পালিত হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হলো, সব মানুষের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ আইনটি পাশের মাধ্যমেই সব নাগরিকের তথ্য চাওয়া, পাওয়ার, প্রয়োজনীয় সব তথ্যে সাবলীল প্রবেশের এবং এর প্রয়োগে উপকারভোগী হওয়ার আবশ্যিক ও আইনি স্বীকৃতি লাভ করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পথ রচিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকাশের পথ সুগম হয়েছে। তাই যুগপূর্তিতে এর বাস্তবায়ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ জনস্বার্থেই প্রয়োজন।

পৃথিবীতে তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এর পেছনে অনেক দ্বন্দের ইতিহাস রয়েছে। তবে তথ্য জানার ধারণাটি মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই পৃথিবীতে বিরাজমান। আবার সাধারণ মানুষের অধিকার বঞ্চনার ইতিহাসের মতোই তথ্য বঞ্চনার পুরনো ইতিহাস রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে সমাজে শ্রেণী বিভাজন হয়েছে সে পর্যায়ে ক্ষমতাবানরা সাধারণ মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে। তাদের বিত্তবৈভব, সম্পদ-স্বাচ্ছন্দ ও ক্ষমতাকে নিরাপদ রেখেছে। আবার সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে তখন থেকেই জনগণের জানার অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে, তাই গণতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে Press freedom ও তথ্য অধিকারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। পঞ্চদশ শতকে যান্ত্রিক প্রেস আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে যেন বিপ্লব ঘটল। পুস্তক, সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনার বিস্তার ঘটতে থাকল। ছাপানো পুস্তক হাতে হাতে চলে গেল। ফলে বিভিন্ন ধারণা, চিন্তা, ভাব, বিশ্বাস ও অনুভূতিরও দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকল। ক্ষমতাবান কোন কোন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ এগুলোকে সত্যিকার Challenge মনে করে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিবেচনায় প্রত্যেক্ষভাবে প্রকাশনায় হস্তক্ষেপ শুরু করলো।

তৎকালীন ব্রিটিশ একটি আইনে শর্ত দেয়া হলো যে, কোন বই প্রকাশের জন্য সরকারের পূর্ব অনুমতি নিতে হবে। আন্দোলন শুরু হলো। তথ্য অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ১৬৪৪ সালেই বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও বুদ্ধিজীবী John Milton তার Areopagetica বইতে কালজয়ী উক্তি করলেন : ‘Give me the liberty to know, to utter and to argue freely according to conscience, above all liberties. এভাবে ইউরোপজুড়েই তথ্য ও প্রেসের স্বাধীনতার আন্দোলন চলতে থাকল।

আজ থেকে প্রায় আড়াইশত বছর পূর্বে ফিনল্যান্ডের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ফিনিসীয় যাজক Anders Chydenius তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন শুরু করে দেন। তিনি বলেন, মানুষ তার প্রয়োজনে যা চায় তা কীভাবে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে- তা তাকে জানাতে হবে। ফিনল্যান্ড তখন সুইডেনের আওতাভুক্ত ছিল। Anders Chydenius সুইডেনের সংসদে বিল উপস্থাপন করেন। পাস হয় সুইডেনের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আইন ১৭৬৬ সনে। এ আইনের মাধ্যমে সুইডিশ জনগণকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট অথবা প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। বিনামূল্যে এবং দ্রুত তথ্য দিতে সরকারকে বাধ্য করা হয়। নাগরিকের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে এটাই বিশ্বের প্রথম আইন।

তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তথ্য জানার অধিকারকে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স, ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম অর্জন ছিল Liberty।

অন্যদিকে, u.S সংবিধান প্রণেতারা ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১ সনে U.S Bill of Rights-এর First Amendment করে Press Freedom-এর স্বাধীনতা সংরক্ষণ করেন। যেখানে বলা হয়

‘Congress shall make no law.......abridging the freedom of speech or the press.’

পুরো ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে যখন এভাবে মানুষের তথ্যে অভিগম্যতা ও তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন পাকভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশের উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৫৭-তে পলাশীর প্রান্তরে যখন স্বাধীনতা অস্তমিত হচ্ছিল, জনগণ তখন ঘরে বসে হাততালি দিয়ে বলাবলি করছিল, ‘রাজায় রাজায় লেগেছে যুদ্ধ, দেখি কে হারে কে জেতে।’ তথ্য জানার স্বাধীনতা দূরের কথা, পরাধীনতার ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হচ্ছিল এতদাঞ্চল। শাসকরা ঢোল পিটিয়ে দয়া পরবশে যেটুকু তথ্য জনগণকে দিত সেটুকুই তার পাওনা বলে সাধারণ মানুষের সন্তুষ্টি ছিল। অধিকন্তু, ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ১৯২৩ সালে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ জারির কারণে তথ্য গোপনের সংস্কৃতি পাকাপোক্ত হয়ে গেল। শাসক বা কর্তৃপক্ষের তথ্যের ওপর একচ্ছত্র মালিকানা বা তথ্য গোপনের সংস্কৃতির ষোলকলা পূর্ণ হলো। Alexander SelKirk-এর মতো ব্রিটিশ শাসকদের ভাবনা প্রবল হলো, ‘I am monarch of all I survey, My right there is none to dispute.’ পাকিস্তান আমলেও এর তেমন উন্নতি ঘটলো না।

এদিকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলো। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে রেজল্যুশনের মাধ্যমে তথ্য অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলা হলো, ‘Freedom of information is a fundamental right and is the touchstone of all the freedom to which United Nations is consecrated.’ পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পত্র (UDHR) জারি হয়। ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে তথ্যের স্বাধীনতাকে সার্বজনীন মানবাধিকার হিসেবে সুষ্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এটি অন্যতম ঘটনা। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৬ সালে গৃহীত জাতিসংঘের ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি’র (ICCPR) অন্তর্ভুক্ত করে তথ্য অধিকারকে আরও সুসংহত করা হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন। জনগণকে সব ক্ষমতার মালিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। সংবিধানে মানুষের সব মৌলিক অধিকারের সঙ্গে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অধিকার তথা তথ্য অধিকারকে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবেই তিনি প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ অর্থাৎ বিশ^সভার সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটান। সংবিধানের সে শক্তিতে ভর করে পরবর্তীতে মানবাধিকার কর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, একাডেমিসিয়ান, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তথ্য অধিকার বিষয়ে আইনের খসড়া তৈরি হয়। ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ হয়। ২০০৮ সালেই জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন বৃহৎ দলগুলোর মধ্যে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করে। ২০০৯ এর ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইনটি পাস করে, গেজেট প্রকাশ ও কার্যকর করে এবং কমিশন গঠন করে। সে থেকে বাংলাদেশে জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তাদের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনি স্বীকৃতি পায়।

বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ একটি আধুনিক, অনন্য ও প্রাগ্রসর আইন। এই আইনের মাধ্যমে বিরাজমান বিভিন্ন নীতি-আদর্শ ও চেতনায় Paradigm Shift হয়েছে। এই আইনে, জনগণ কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে; কর্তৃপক্ষের কাজের, সেবার ও বাজেটের হিসাব চায়; অন্যান্য আইনে কর্তৃপক্ষ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এই আইনের মূল দর্শন হলো ‘Disclosure is rule, secrecy is exception’. অন্যদিকে দীর্ঘ প্রচলিত ‘Official Secrets Act’-এর দর্শন ‘Secrecy is rule, disclosure is exception’। আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা শতাব্দীপ্রাচীন। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ মতে উভয় বিচারের ক্ষেত্রে যিনি আদালতে বিচারপ্রার্থী, Burden of proof তারই। ফৌজদারি ব্যবস্থায় যতক্ষণ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হবে, ততক্ষণ আসামি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন। তথ্য কমিশন তথ্য অধিকার আইনমতে একটি Quasi-Judicial Court. কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে সংক্ষুব্ধ কোন নাগরিক তথ্য কমিশনে অভিযোগ করলে কমিশন কর্তৃপক্ষ বা তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করবেন, এই আদালতে Burden of proof কর্তৃপক্ষ বা ক্ষেত্রমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার, আবেদনকারী বা অভিযোগকারীর নহে। অন্য কথায় বিচারপ্রার্থীর নহে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেই বা কর্তৃপক্ষকে, না পারলে জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের আদেশ বা বিভাগীয় মামলার সুপারিশ তার বিরুদ্ধে হতে পারে। এই যে জনগণ তথা নাগরিককে আইনি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের ওপর সে ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সাধারণ মানুষ কী সেভাবে প্রস্তুত হয়েছে ? তাছাড়া তৃণমূল থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তথ্য স্বাক্ষরতার অভাব প্রকটভাবে বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে, শত বছরের গোপনীয়তার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত কর্তৃপক্ষের কী রাতারাতি সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চাহিবামাত্র তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সব তথ্য সুর সুর করে দিয়ে দেয়ার বা অবারিত করে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে পুরোপুরি তৈরি আছে? তদুপরি যার দুর্নীতির অভ্যাস মজ্জাগত, তিনি তথ্য গোপনের বা বিকৃতির প্রাণান্ত চেষ্টা করে থাকেন, ধরা পড়ার ভয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড় পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। এমনকি সৎ বলে কথিত এমন অনেক কর্মকর্তার মধ্যেও দেখা যায় চিরাচরিত ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবল বাসনা, তথ্য গোপনের উদগ্র প্রচেষ্টা।

এ সব কারণে অনেক বোদ্ধা আমাদের আইনটিকে আধুনিক ও প্রাগ্রসর বলে মনে করেন। আইনের মূল চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বা একে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য সাধারণ মানুষ বা কর্তৃপক্ষের কিছুটা সময়ের প্রয়োজন আছে বৈকি।

তবে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত আইনটির বাস্তবায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। অর্জনও নেহায়েৎ কম নয়। তথ্যপ্রাপ্তি, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, প্রকাশ, প্রচার, অভিযোগ দায়ের, নিষ্পত্তি ইত্যাদি-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিধি, প্রবিধি, নির্দেশিকা, সহায়িকা ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে। সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষে ৪২,৪৫০ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব কার্যালয়ে বিকল্প দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও আপিল কর্মকর্তা নিয়োজিত হয়েছে। তথ্য কমিশন হতে কেন্দ্র ও সব জেলা ছাড়াও শুধু উপজেলা পর্যায়েই জনউদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান ৫০৪টি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ৫০৬টি এবং যথেষ্ট সংখ্যায় মতবিনিময় সভা, সেমিনার সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এ ধরণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার; স্কুল, কলেজের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তকরণ ইত্যাদি হয়েছে। কেন্দ্রসহ, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালিত হয়। জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে সরকার সব শ্রেণী-পেশার ব্যক্তির সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট ToRসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা অর্থাৎ চার স্তরে কমিটি গঠন করে দিয়েছে। তাছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ অচঅ (Annual Performance Agreement) বাস্তবায়নে বাধ্যতামূলকভাবে জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার আওতায় তথ্যে অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণে তৃণমূল পর্যন্ত ইন্টারনেটের সমন্বিত নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন, অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের আওতায় সারাদেশে স্থাপিত প্রায় ৫০০০ ইউনিয়ন/পৌর ডিজিটাল সেন্টার তৃণমূলে তথ্য সেবা দিচ্ছে। তথ্যপ্রাপ্তি, সহজ ও নিশ্চিতকরণে ওয়েবসাইট স্থাপন ও সিটিজেন চার্টার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়েবপোর্টাল রয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন পরিষদসহ দেশের প্রায় সব সরকারি কার্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ওয়েবসাইট খুললেই দেখা যায় তথ্যে মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের পথ নির্দেশনাবিষয়ক একটি কর্নার রয়েছে। স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের সব মাধ্যমকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ঘরে বসেই তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে এবং উন্নয়নের মহাসড়কে প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে। তার ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি জাতিসংঘে এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।

করোনা সংকটের শুরুতেই তথ্য কমিশন ভার্চুয়াল শুনানি কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। কোন পক্ষকেই ঢাকায় তথ্য কমিশনে সশরীরে হাজির হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে অর্থ বা সময় যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি বিড়ম্বনা এড়ানো যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে তথ্য কমিশনে ১৭১টি অভিযোগের শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। তন্মধ্যে ১৬৪টি অভিযোগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমকে আর বেগবান করা হবে এবং সব স্তরেই চালু করা হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল নির্বাচনী মেনোফেস্টোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করে তার নবগঠিত সরকার ২০০৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস ও কার্যকর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণ মহান সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে, করোনা সংকট ছাড়াও সময়ে সময়ে ভিডিও কনফারেন্স বা প্রেস কনফারেন্স করে এবং মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলোচিত ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বিষয়ে নিয়মিত প্রেসব্রিফিং-এর মাধ্যমে জাতির সামনে স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশের উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সচিব সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বিষয়টি পুনঃব্যক্ত করে বিভিন্ন অনুশাসন দিয়েছেন। উল্লেখ্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য অধিকার আইন একটি বিশেষ হাতিয়ার। সম্প্রতি মাননীয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী কয়েকটি অনুষ্ঠানে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিকল্পে স্ব-প্রণোদিত তথ্য প্রকাশ এবং তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। এভাবে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের সম্মানিত জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সব শ্রেণী-পেশার লোকজনকে নিয়ে জনগণের তথ্য অধিকার বাস্তবায়নকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে পারলে তথ্যে সার্বজনীন অভিগম্যতা দ্রুত নিশ্চিত হবে। বিশেষত, সাধারণ নাগরিকের তথ্যে মালিকানাবোধ তৈরি হবে; তথ্য প্রদানে অনাগ্রহী বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীরা আরও সচেতন, দক্ষ ও জনগণের প্রতি ইতিবাচক ও সংবেদনশীল হবেন। সব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হবে, আস্থার সম্পর্

ক সুদৃঢ় হবে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান আরও সুসংহত হবে।

লেখক : প্রধান তথ্য কমিশনার

back to top