alt

মুক্ত আলোচনা

হুদুড় দুর্গা : হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে সুপ্ত প্রতিবাদ

রাজিব শর্মা

: শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১

বাঙালির শ্রেষ্ঠ পূজা তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক অন্যতম মাহাত্ম্যপূর্ণ উৎসব এই দূর্গাপুজা। মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরাণ কথিত নানা অনুষঙ্গ। মহিষরূপী অসুরকে নিধনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গা অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির সূচনা করেন।

মার্ক-েয় পুরাণে কিংবা বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে শুম্ভ-নিশুম্ভ এবং অন্যান্য অসুরদের তা-বে অতিষ্ঠ হয়ে দেবকুল নিজ নিজ শক্তি দিয়ে গড়ে তোলেন অপরূপ সুন্দরী মহাশক্তি দেবী দুর্গাকে, তার হাতে ১০ জন দেবতা তুলে দেন ১০টি অস্ত্র। দেবীর রূপে কামাসক্ত হয়ে মহিষাসুর দেবীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে ক্রোধোন্মত্ত হন দেবী। ৯ দিন ধরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের পরে দেবী দুর্গা অসুরকে নিধন করেন। এই পৌরাণিক কাহিনী আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এই কাহিনীকে প্রশ্ন করে মহিষাসুর নিধনের সঙ্গে আর্য-অনার্য সংঘাতের প্রতিরূপ মিশিয়ে এই পশ্চিমবঙ্গেই দেবী দুর্গার পরিবর্তে পূজিত হন ‘হুদুড় দুর্গা’। পুরুলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকজন প্রতিভূ নিজেদের ‘অসুর’ জাতির সদস্য মনে করে তাদের পূর্বপুরুষের হত্যার দিন স্মরণ করে হুদুড় দুর্গার পূজার মাধ্যমে।

প্রকৃতপক্ষে দেবী দুর্গার আরাধনার পরিবর্তে অসুরের আরাধনা করেন পুরুলিয়া জেলার ভূমিপুত্র খেড়ওয়াল আদিবাসীরা। আর পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার এই অসুর পুজো ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। অসুর পূজাকে সমর্থন জানিয়ে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধকে দলিত ও তফসিলি উপজাতিদের ওপর আর্য-ব্রাহ্মণ্য সমাজের আধিপত্য স্থাপনের প্রয়াসের সঙ্গে মিলিয়ে এক বিরুদ্ধ-আন্দোলন তৈরি হয় ভারতের বুকে। প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন, ভারতের মর্মে মর্মে ধর্ম। সেখানে প্রথানুগ ধর্মাচারণের বিপ্রতীপে এই হুদুড় দুর্গা (hudur durg) যে কাউন্টার সংস্কৃতি তৈরি করল তা আশ্চর্যের বিষয়।

পুরুলিয়ার কাশীপুর থানার অন্তর্গত সোনাইজুরি গ্রামে অজিতপ্রসাদ হেমব্রম এবং তার সহকারী চারিয়ান মাহাতো দুজনে একসঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে গিয়ে শুরু করেন প্রথম এই হুদুড় দুর্গার পুজো। সময়টা ২০১১ সাল। পুরুলিয়ার খেরওয়াল সাঁওতাল গোষ্ঠীর প্রতিভূ হিসেবে এই দুই ব্যক্তি এই উৎসব শুরু করেন। দক্ষিণ ভারতে যেমন রামায়ণের নায়ক রাবণ অনার্য জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ, তেমনই এখানকার মানুষদের বিশ্বাসে দেবী দুর্গা খলনায়ক। ভাষাতত্ত্বের বিচারে ‘হুদুড়’ শব্দের অর্থ হলো ‘বজ্র’। আবার অন্য মতে এর অর্থ হলো ‘মেঘ’। আর অন্যদিকে ‘দুর্গা’ শব্দের অর্থ হলো ‘দুর্গ রক্ষা করেন যিনি’। ফলে লোকবিশ্বাসে এই হুদুড় দুর্গা ভূমিপুত্রদের মহিষাসুর।

দুর্গা শব্দটি স্ত্রী লিঙ্গবাচক হলেও এখানে তাকে পুংলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পেছনেই লুকিয়ে আছে এই জনগোষ্ঠীর আদিম পৌরাণিক উপকথা। সেই উপকথা অনুযায়ী, চাইচাম্পা গ্রামের রাজা ছিলেন এই হুদুড় দুর্গা তথা অসুর উপজাতির রাজা। বহিরাগত আর্যরা এখানকার নিরীহ আদিবাসীদের ওপর অত্যাচার করে জঙ্গল ও বিস্তীর্ণ ভূমির দখল নিতে এসেছিল। এর ফলেই আর্যশক্তি ও অনার্যদের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর্যরা বাহুবলে দড় না হলেও বুদ্ধি তাদের ছিল প্রখর। সেই বুদ্ধিতেই যখন কিছুতেই অনার্য অসুরদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিলেন না তারা, তখনই অপূর্ব সুন্দরী দেবীর রূপে দুর্গাকে পাঠান আর্যরা। তারা জানতেন যে, আদিম অসুর নারীর সম্মান অনেক উঁচ্চ। তাই কোনো নারীর বিরুদ্ধে অসুরেরা অস্ত্রধারণ করবেন না। এই দুর্বলতার সুযোগে মহিষাসুরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় আর্যরা। অনেকে আবার মনে করেন, ছলনা করে মহিষাসুরকে বিবাহ করেন দুর্গা এবং বিবাহের নবম দিনে তাকে হত্যা করেন তিনি। আর তাই নবমীর দিনেই খেরওয়াল উপজাতির মানুষ তাদের আদিপুরুষ মহিষাসুরকে স্মরণ করতে বিশেষ উৎসব পালন করে থাকে যাকে ‘দাশাই উৎসব’ বলা হয়। শিকার দিশম খেড়-ওয়াল বীর লাকচার কমিটির সদস্য অজিতপ্রসাদ হেমব্রম যিনি এই পুজোর উদ্যোক্তা, তার বিশ্বাস যে অন্যায় সমরে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে মহিষাসুরকে হত্যা করে আর্যার্বত গড়ে তোলে আর্যরা আর তার ফলেই নিজেদের সম্মান রক্ষায় পুরুষরা নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই নাচ করতে করতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েÑ আসাম, ওড়িশা, বাংলাদেশ এমনকি দক্ষিণ ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে তারা।

এই ‘অসুর’ নামে একটা বাস্তব উপজাতি গোষ্ঠী আজও এই উপজাতিদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে, ঝাড়খণ্ডের কোন কোন অংশে রয়েছে, আলিপুরদুয়ারে ‘অসুর’ নামে একটা গ্রামেরও সন্ধান পাওয়া যায়। অজিতপ্রসাদ হেমব্রমের প্রচলিত এই অসুরপূজার মধ্য দিয়ে হুদুড় দুর্গার সঙ্গে সিধু-কানহু-বীরসা মুণ্ডাকে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস করা হয়। দেবী দুর্গার বিপ্রতীপে অসুরের পুজোকে প্রচারিত করার মধ্যে তার বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল এ কথা সত্য এবং এই একই উদ্দেশ্যে দলিত সহায়ক গোষ্ঠীর উত্থানের পথ প্রসারিত করতে জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয় এই ‘হুদুড় দুর্গা’র সমর্থনে প্রচার ও প্রসার।

আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের কাউন্টার-সংস্কৃতি হিসেবেই উঠে এসেছিল এই হুদুড় দুর্গার উৎসব। তবে এর বহু আগে থেকেই ঐতিহ্যবাহিত হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে উপজাতিদের মধ্যে এই পুজোর প্রচলন ছিল। দুর্গাপুজার বদলে এই হুদুড় দুর্গাই ছিল ভারতীয় অনার্য সমাজের কাছে শুভ শক্তির প্রতিভূ দেবতা।

তবে অসুরদের সঙ্গে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে মিলিয়ে যে কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে হুদুড় দুর্গাকে কেন্দ্র করে তা প্রচলিত পুরাণসম্মত নয়। কোনো পুরাণেই দেবীর সঙ্গে অসুরের বিবাহের কথা বলা নেই। আবার খেরওয়ালদের বিশ্বাসে নিরস্ত্র অসুরকে যে অনৈতিকভাবে দেবী দুর্গা হত্যা করেছিলেন তাও কোন পুরাণে বলা নেই। বরং মার্ক-েয় পুরাণে দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের প্রবল সংগ্রামের কথাই বর্ণিত আছে। অসুরকে যে দলিত, অনার্য গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে এই কিংবদন্তিতে তাও পুরাণ অনুযায়ী ভ্রান্ত। কারণ মহিষাসুর হলেন পুরাণ মতে রম্ভাসুরের পুত্র। এই রম্ভাসুর আসলে কশ্যপ ঋষির পুত্র এবং ব্রহ্মাপুত্র মরীচির পুত্র হলেন এই কশ্যপ। ফলে বংশ পরম্পরায় মহিষাসুরের শরীরে ব্রহ্মার রক্ত বইছে। তাহলে সেই মহিষাসুর কীভাবেই বা অনার্য কিংবা অব্রাহ্মণ হতে পারেন তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এমনকি দুর্গাপূজায় আজও মহিষাসুরকে ব্রাহ্মণ মনে করেই উপবীত পরানো হয়। আবার প্রাচীনকালের দেবী মূর্তিতে অসুরের বদলে দেবীকে শুধু মহিষ নিধন করতেই দেখা যায়। দেবী ছিলেন মহিষমর্দিনী। এমনকি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে কোথাও মহিষাসুরের স্থান নেই।

কিন্তু এই মহিষের সঙ্গে গ্রামীণ কৃষি সংস্কৃতির একটা সূক্ষ্ম যোগাযোগ আছে। দূর্গাপুজার ১৫ দিন পরেই আদিবাসী সমাজে বাঁদনা নামের এক বিশেষ পরবে মহিষকে উপাস্য হিসেবে পুজো করা হয়। এত বিতর্কের মধ্যেও আদিবাসী সমাজের প্রতিভূ হিসেবে মহিষাসুরকে হুদুড় দুর্গা রূপে পুজো সাঁওতাল, ভীল, কোল, মুণ্ডা ইত্যাদি জনজাতির বহু মানুষের কাছে এক সুপ্ত প্রতিবাদ। ঠিক যেভাবে দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় আর্যদের নায়ক রামের পরিবর্তে রামায়ণের নায়ক হয়ে ওঠেন রাবণ যিনি অনার্য সভ্যতার প্রতীক, ঠিক একইভাবে আর্য মিথের দেবী দুর্গার বিপ্রতীপে অনার্য মিথে জন্ম নেন হুদুড় দুর্গা। জাতি-সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ এবং অতি হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধ স্বর হিসেবে এই পুজোকে সামনে রেখে অসুরের উপাসনার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্র একটি লিফলেটও বিলি করেছিল যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জলঘোলা অনেক হয়েছে। ভারত তথা বাংলার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিম-লে হুদুড় দুর্গা এক বিতর্কের নাম হলেও সুপ্রাচীন আদিবাসী সমাজের লোকবিশ্বাস এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আজও টিকে আছে।

[লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস্ট]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

হুদুড় দুর্গা : হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে সুপ্ত প্রতিবাদ

রাজিব শর্মা

শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১

বাঙালির শ্রেষ্ঠ পূজা তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক অন্যতম মাহাত্ম্যপূর্ণ উৎসব এই দূর্গাপুজা। মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গার পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরাণ কথিত নানা অনুষঙ্গ। মহিষরূপী অসুরকে নিধনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গা অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির সূচনা করেন।

মার্ক-েয় পুরাণে কিংবা বৃহদ্ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে শুম্ভ-নিশুম্ভ এবং অন্যান্য অসুরদের তা-বে অতিষ্ঠ হয়ে দেবকুল নিজ নিজ শক্তি দিয়ে গড়ে তোলেন অপরূপ সুন্দরী মহাশক্তি দেবী দুর্গাকে, তার হাতে ১০ জন দেবতা তুলে দেন ১০টি অস্ত্র। দেবীর রূপে কামাসক্ত হয়ে মহিষাসুর দেবীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে ক্রোধোন্মত্ত হন দেবী। ৯ দিন ধরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের পরে দেবী দুর্গা অসুরকে নিধন করেন। এই পৌরাণিক কাহিনী আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এই কাহিনীকে প্রশ্ন করে মহিষাসুর নিধনের সঙ্গে আর্য-অনার্য সংঘাতের প্রতিরূপ মিশিয়ে এই পশ্চিমবঙ্গেই দেবী দুর্গার পরিবর্তে পূজিত হন ‘হুদুড় দুর্গা’। পুরুলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকজন প্রতিভূ নিজেদের ‘অসুর’ জাতির সদস্য মনে করে তাদের পূর্বপুরুষের হত্যার দিন স্মরণ করে হুদুড় দুর্গার পূজার মাধ্যমে।

প্রকৃতপক্ষে দেবী দুর্গার আরাধনার পরিবর্তে অসুরের আরাধনা করেন পুরুলিয়া জেলার ভূমিপুত্র খেড়ওয়াল আদিবাসীরা। আর পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার এই অসুর পুজো ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। অসুর পূজাকে সমর্থন জানিয়ে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধকে দলিত ও তফসিলি উপজাতিদের ওপর আর্য-ব্রাহ্মণ্য সমাজের আধিপত্য স্থাপনের প্রয়াসের সঙ্গে মিলিয়ে এক বিরুদ্ধ-আন্দোলন তৈরি হয় ভারতের বুকে। প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন, ভারতের মর্মে মর্মে ধর্ম। সেখানে প্রথানুগ ধর্মাচারণের বিপ্রতীপে এই হুদুড় দুর্গা (hudur durg) যে কাউন্টার সংস্কৃতি তৈরি করল তা আশ্চর্যের বিষয়।

পুরুলিয়ার কাশীপুর থানার অন্তর্গত সোনাইজুরি গ্রামে অজিতপ্রসাদ হেমব্রম এবং তার সহকারী চারিয়ান মাহাতো দুজনে একসঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে গিয়ে শুরু করেন প্রথম এই হুদুড় দুর্গার পুজো। সময়টা ২০১১ সাল। পুরুলিয়ার খেরওয়াল সাঁওতাল গোষ্ঠীর প্রতিভূ হিসেবে এই দুই ব্যক্তি এই উৎসব শুরু করেন। দক্ষিণ ভারতে যেমন রামায়ণের নায়ক রাবণ অনার্য জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ, তেমনই এখানকার মানুষদের বিশ্বাসে দেবী দুর্গা খলনায়ক। ভাষাতত্ত্বের বিচারে ‘হুদুড়’ শব্দের অর্থ হলো ‘বজ্র’। আবার অন্য মতে এর অর্থ হলো ‘মেঘ’। আর অন্যদিকে ‘দুর্গা’ শব্দের অর্থ হলো ‘দুর্গ রক্ষা করেন যিনি’। ফলে লোকবিশ্বাসে এই হুদুড় দুর্গা ভূমিপুত্রদের মহিষাসুর।

দুর্গা শব্দটি স্ত্রী লিঙ্গবাচক হলেও এখানে তাকে পুংলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পেছনেই লুকিয়ে আছে এই জনগোষ্ঠীর আদিম পৌরাণিক উপকথা। সেই উপকথা অনুযায়ী, চাইচাম্পা গ্রামের রাজা ছিলেন এই হুদুড় দুর্গা তথা অসুর উপজাতির রাজা। বহিরাগত আর্যরা এখানকার নিরীহ আদিবাসীদের ওপর অত্যাচার করে জঙ্গল ও বিস্তীর্ণ ভূমির দখল নিতে এসেছিল। এর ফলেই আর্যশক্তি ও অনার্যদের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর্যরা বাহুবলে দড় না হলেও বুদ্ধি তাদের ছিল প্রখর। সেই বুদ্ধিতেই যখন কিছুতেই অনার্য অসুরদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিলেন না তারা, তখনই অপূর্ব সুন্দরী দেবীর রূপে দুর্গাকে পাঠান আর্যরা। তারা জানতেন যে, আদিম অসুর নারীর সম্মান অনেক উঁচ্চ। তাই কোনো নারীর বিরুদ্ধে অসুরেরা অস্ত্রধারণ করবেন না। এই দুর্বলতার সুযোগে মহিষাসুরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় আর্যরা। অনেকে আবার মনে করেন, ছলনা করে মহিষাসুরকে বিবাহ করেন দুর্গা এবং বিবাহের নবম দিনে তাকে হত্যা করেন তিনি। আর তাই নবমীর দিনেই খেরওয়াল উপজাতির মানুষ তাদের আদিপুরুষ মহিষাসুরকে স্মরণ করতে বিশেষ উৎসব পালন করে থাকে যাকে ‘দাশাই উৎসব’ বলা হয়। শিকার দিশম খেড়-ওয়াল বীর লাকচার কমিটির সদস্য অজিতপ্রসাদ হেমব্রম যিনি এই পুজোর উদ্যোক্তা, তার বিশ্বাস যে অন্যায় সমরে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে মহিষাসুরকে হত্যা করে আর্যার্বত গড়ে তোলে আর্যরা আর তার ফলেই নিজেদের সম্মান রক্ষায় পুরুষরা নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই নাচ করতে করতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েÑ আসাম, ওড়িশা, বাংলাদেশ এমনকি দক্ষিণ ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে তারা।

এই ‘অসুর’ নামে একটা বাস্তব উপজাতি গোষ্ঠী আজও এই উপজাতিদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে, ঝাড়খণ্ডের কোন কোন অংশে রয়েছে, আলিপুরদুয়ারে ‘অসুর’ নামে একটা গ্রামেরও সন্ধান পাওয়া যায়। অজিতপ্রসাদ হেমব্রমের প্রচলিত এই অসুরপূজার মধ্য দিয়ে হুদুড় দুর্গার সঙ্গে সিধু-কানহু-বীরসা মুণ্ডাকে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস করা হয়। দেবী দুর্গার বিপ্রতীপে অসুরের পুজোকে প্রচারিত করার মধ্যে তার বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল এ কথা সত্য এবং এই একই উদ্দেশ্যে দলিত সহায়ক গোষ্ঠীর উত্থানের পথ প্রসারিত করতে জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয় এই ‘হুদুড় দুর্গা’র সমর্থনে প্রচার ও প্রসার।

আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের কাউন্টার-সংস্কৃতি হিসেবেই উঠে এসেছিল এই হুদুড় দুর্গার উৎসব। তবে এর বহু আগে থেকেই ঐতিহ্যবাহিত হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে উপজাতিদের মধ্যে এই পুজোর প্রচলন ছিল। দুর্গাপুজার বদলে এই হুদুড় দুর্গাই ছিল ভারতীয় অনার্য সমাজের কাছে শুভ শক্তির প্রতিভূ দেবতা।

তবে অসুরদের সঙ্গে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে মিলিয়ে যে কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে হুদুড় দুর্গাকে কেন্দ্র করে তা প্রচলিত পুরাণসম্মত নয়। কোনো পুরাণেই দেবীর সঙ্গে অসুরের বিবাহের কথা বলা নেই। আবার খেরওয়ালদের বিশ্বাসে নিরস্ত্র অসুরকে যে অনৈতিকভাবে দেবী দুর্গা হত্যা করেছিলেন তাও কোন পুরাণে বলা নেই। বরং মার্ক-েয় পুরাণে দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের প্রবল সংগ্রামের কথাই বর্ণিত আছে। অসুরকে যে দলিত, অনার্য গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে এই কিংবদন্তিতে তাও পুরাণ অনুযায়ী ভ্রান্ত। কারণ মহিষাসুর হলেন পুরাণ মতে রম্ভাসুরের পুত্র। এই রম্ভাসুর আসলে কশ্যপ ঋষির পুত্র এবং ব্রহ্মাপুত্র মরীচির পুত্র হলেন এই কশ্যপ। ফলে বংশ পরম্পরায় মহিষাসুরের শরীরে ব্রহ্মার রক্ত বইছে। তাহলে সেই মহিষাসুর কীভাবেই বা অনার্য কিংবা অব্রাহ্মণ হতে পারেন তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এমনকি দুর্গাপূজায় আজও মহিষাসুরকে ব্রাহ্মণ মনে করেই উপবীত পরানো হয়। আবার প্রাচীনকালের দেবী মূর্তিতে অসুরের বদলে দেবীকে শুধু মহিষ নিধন করতেই দেখা যায়। দেবী ছিলেন মহিষমর্দিনী। এমনকি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে কোথাও মহিষাসুরের স্থান নেই।

কিন্তু এই মহিষের সঙ্গে গ্রামীণ কৃষি সংস্কৃতির একটা সূক্ষ্ম যোগাযোগ আছে। দূর্গাপুজার ১৫ দিন পরেই আদিবাসী সমাজে বাঁদনা নামের এক বিশেষ পরবে মহিষকে উপাস্য হিসেবে পুজো করা হয়। এত বিতর্কের মধ্যেও আদিবাসী সমাজের প্রতিভূ হিসেবে মহিষাসুরকে হুদুড় দুর্গা রূপে পুজো সাঁওতাল, ভীল, কোল, মুণ্ডা ইত্যাদি জনজাতির বহু মানুষের কাছে এক সুপ্ত প্রতিবাদ। ঠিক যেভাবে দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় আর্যদের নায়ক রামের পরিবর্তে রামায়ণের নায়ক হয়ে ওঠেন রাবণ যিনি অনার্য সভ্যতার প্রতীক, ঠিক একইভাবে আর্য মিথের দেবী দুর্গার বিপ্রতীপে অনার্য মিথে জন্ম নেন হুদুড় দুর্গা। জাতি-সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ এবং অতি হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধ স্বর হিসেবে এই পুজোকে সামনে রেখে অসুরের উপাসনার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্র একটি লিফলেটও বিলি করেছিল যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জলঘোলা অনেক হয়েছে। ভারত তথা বাংলার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিম-লে হুদুড় দুর্গা এক বিতর্কের নাম হলেও সুপ্রাচীন আদিবাসী সমাজের লোকবিশ্বাস এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আজও টিকে আছে।

[লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস্ট]

back to top