alt

মুক্ত আলোচনা

গবেষণাতেই মিলবে জটিল রোগের সঠিক সমাধান

মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

: মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য গবেষণা কর্মের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তনি যথার্থই বলেছেন, গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। গবেষণা যাতে জনগণের কল্যাণে কাজে আসে তিনি সেদিকে দৃষ্টি দিতে বলেছেন। বিশেষতঃ চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবা প্রদানকারী নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক ও ছাত্রছাত্রীদের বেশি করে গবেষণার প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই অনুধাবন শতভাগ সঠিক। চিকিৎসা পেশাসহ স্বাস্থ্য খাতকে সমৃদ্ধ করতে এবং রোগীদের নিত্যনতুন অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গবেষণার কোন বিকল্প নেই।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো চিকিৎসা ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে তাদের সুগঠিত চিকিৎসা গবেষণার অবকাঠামো। নতুন রোগ, রোগের জীবাণু, রোগ আক্রান্তের প্রক্রিয়া, রোগের চিকিৎসা, কার্যকরী ওষুধ, ওষুধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি আবিষ্কার ও তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো সব সময় কয়েক ধাপ এগিয়ে। যার মূলে রয়েছে তাদের গবেষণাক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক মনোভাব। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এর জন্য চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণার বিশেষ প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বে আবিষ্কৃত চিকিৎসা পদ্ধতি বা ব্যবস্থা আমাদের এই ভৌগলিক অবস্থানের জনগণের ওপর কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার জন্য চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা অত্যন্ত জরুরি।

আশার কথা হলো, বর্তমান জনকল্যাণমুখী সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গবেষণা খাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌলিক গবেষণা ও মানোন্নয়নের জন্য এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছেন। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। এমনই এক প্রেক্ষপটে ২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় গবেষণা দিবস ২০২১ উদযাপিত হচ্ছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে এই মহতী দিবসের শুভ উদ্বোধন করবেন। যে সময়ে এই গবেষণা দিবস উদযাপিত হচ্ছে তা দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক ও ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার জন্য গবেষণা মঞ্জুরি প্রদান করা হচ্ছে। শুধু চিকিৎসাসেবা বা উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা প্রদান নয় বরং গবেষণা কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও এই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ৫৮টি বিভাগ। এমডি, এমএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিপ্লোমাসহ প্রায় ১০০টি পোস্ট গ্রাজুয়েট বিষয় চালু আছে। এরমধ্যে ৬২টি হলো রেসিডেন্সি কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৪৬টি। দেশীয় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও উচ্চতর মেডিকেল ডিগ্রি অর্জনের জন্য লেখাপড়া করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি কোর্সে মেডিকেল শিক্ষা পাঠ্যক্রমে রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে নবীন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার পাশাপাশি গবেষণা বিষায়ক দক্ষতা অর্জন এবং যে কোন গবেষণায় নেতৃত্বদানে উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে স্বতন্ত্র সেল গঠন করা হয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রকফেলার ফাউন্ডেশন, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস, সিএমএইচ, ইউনিসেফ, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা রোটারি ক্লাব অব মেট্রোপলিটন, যুক্তরাষ্ট্রের হাইল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার, ইউএসএইড, সেভ দ্য চিলড্রেন, জন হপকিন্স, শিকাগো ইউনিভার্সিটি, মাহিদোল বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার নভেল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অসংক্রামক রোগ (নন কমিউনিকেবল ডিজিস) গবেষণায় আঞ্চলিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম অর্থায়নে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, রকেফেলার ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। আমি গবেষণা সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও এই ভাইরাসের কারণে সমগ্র বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। তবে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কিছুটা কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে বিশ্ববাসী কিছুটা স্বস্তির মধ্যে রয়েছে। তবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা থেকে আরোগ্যলাভের জন্য কার্যকরী চূড়ান্ত ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে এক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। প্রকৃতপক্ষে গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব জটিল জটিল রোগ প্রতিরোধ ও আরোগ্যলাভের পথ খুঁজে পাওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কোভিড-১৯-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং এর উপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে মোট সংক্রমণের ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯ এর টিকা গ্রহীতাদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফলে টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে এবং এই গবেষণার ফলাফলটিও প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও প্রায় অর্ধশত কোভিড বিষয়ে গবেষণার ফলাফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এথেকেই এটা স্পষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা সেবার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা কার্যক্রমকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললেই নয়। প্রতিদিন প্রায় আট হাজার রোগী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে সেবা নিয়ে থাকেন। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কারণ করোনাভাইরাস ছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানও অব্যাহত রাখতে হয়। এ পর্যন্ত ফিভার ক্লিনিকে প্রায় সোয়া লাখ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। ল্যাবরেটরিতে প্রায় ২ লাখ রোগীর করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। করোনা সেন্টার ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কোভিড ফিল্ড হাসপাতালে প্রায় ১৫ হাজার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় লাখেরও বেশি প্রথম ডোজ এবং ১ লাখেরও বেশি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। অব্যাহত রাখা হয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমও।

দেশবাসীকে একটি আগাম সুখবর দিয়ে রাখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার ৭০০ শয্যাবিশিষ্ট সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের নির্মাণসহ অন্যান্য কার্যক্রম দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যে হাসপাতালটি চালু হলে সেটা হবে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি বড় সাফল্য এবং একই সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাকে অনেকখানিই ত্বরান্বিত করবে।

জ্ঞান ভিত্তিক, বিজ্ঞান মনষ্ক, দক্ষ ও মানবিক জাতি বিনির্মাণই আমাদের বর্তমান লক্ষ্য।

[লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]

পলিথিনের পাপ, প্রকৃতির প্রতিশোধ

হারিয়ে যাওয়া অভিযোগকৃত চেকের মামলা

জার্মানীতে এসবি ৬২ সম্মেলন : বাংলাদেশের নজর অর্থায়নের ন্যায্যতায়

ছবি

শতবর্ষ পরেও যার প্রয়োজন ফুরোয় না : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আদিবাসী মুণ্ডা ভাষার বাঁচার আর্তনাদ

মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা : এক হারানো সম্ভাবনার খোঁজে

বিশ্ব রেড ক্রস দিবস

আত্মরক্ষার খালি-হাতের ইতিহাস ও আধুনিক বিস্তার

বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর : সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ

ছবি

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস “বিজয় বসন্ত“গ্রন্থের লেখক

পয়লা বৈশাখ : বাঙালির সংহতি চেতনার সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কমরেড রূপনারায়ণ রায়

সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা

রেসলিং

কোটা সমাচার

বাজেট ২০২৪-২৫: তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা শুরু হোক এবার

সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: উন্নত ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়

ছবি

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

tab

মুক্ত আলোচনা

গবেষণাতেই মিলবে জটিল রোগের সঠিক সমাধান

মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য গবেষণা কর্মের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তনি যথার্থই বলেছেন, গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। গবেষণা যাতে জনগণের কল্যাণে কাজে আসে তিনি সেদিকে দৃষ্টি দিতে বলেছেন। বিশেষতঃ চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবা প্রদানকারী নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক ও ছাত্রছাত্রীদের বেশি করে গবেষণার প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই অনুধাবন শতভাগ সঠিক। চিকিৎসা পেশাসহ স্বাস্থ্য খাতকে সমৃদ্ধ করতে এবং রোগীদের নিত্যনতুন অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গবেষণার কোন বিকল্প নেই।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলো চিকিৎসা ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে তাদের সুগঠিত চিকিৎসা গবেষণার অবকাঠামো। নতুন রোগ, রোগের জীবাণু, রোগ আক্রান্তের প্রক্রিয়া, রোগের চিকিৎসা, কার্যকরী ওষুধ, ওষুধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি আবিষ্কার ও তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো সব সময় কয়েক ধাপ এগিয়ে। যার মূলে রয়েছে তাদের গবেষণাক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক মনোভাব। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এর জন্য চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণার বিশেষ প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বে আবিষ্কৃত চিকিৎসা পদ্ধতি বা ব্যবস্থা আমাদের এই ভৌগলিক অবস্থানের জনগণের ওপর কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠার জন্য চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা অত্যন্ত জরুরি।

আশার কথা হলো, বর্তমান জনকল্যাণমুখী সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গবেষণা খাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌলিক গবেষণা ও মানোন্নয়নের জন্য এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছেন। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। এমনই এক প্রেক্ষপটে ২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় গবেষণা দিবস ২০২১ উদযাপিত হচ্ছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে এই মহতী দিবসের শুভ উদ্বোধন করবেন। যে সময়ে এই গবেষণা দিবস উদযাপিত হচ্ছে তা দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক ও ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার জন্য গবেষণা মঞ্জুরি প্রদান করা হচ্ছে। শুধু চিকিৎসাসেবা বা উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা প্রদান নয় বরং গবেষণা কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও এই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ৫৮টি বিভাগ। এমডি, এমএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিপ্লোমাসহ প্রায় ১০০টি পোস্ট গ্রাজুয়েট বিষয় চালু আছে। এরমধ্যে ৬২টি হলো রেসিডেন্সি কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৪৬টি। দেশীয় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও উচ্চতর মেডিকেল ডিগ্রি অর্জনের জন্য লেখাপড়া করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি কোর্সে মেডিকেল শিক্ষা পাঠ্যক্রমে রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে নবীন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার পাশাপাশি গবেষণা বিষায়ক দক্ষতা অর্জন এবং যে কোন গবেষণায় নেতৃত্বদানে উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে স্বতন্ত্র সেল গঠন করা হয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রকফেলার ফাউন্ডেশন, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস, সিএমএইচ, ইউনিসেফ, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা রোটারি ক্লাব অব মেট্রোপলিটন, যুক্তরাষ্ট্রের হাইল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার, ইউএসএইড, সেভ দ্য চিলড্রেন, জন হপকিন্স, শিকাগো ইউনিভার্সিটি, মাহিদোল বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার নভেল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অসংক্রামক রোগ (নন কমিউনিকেবল ডিজিস) গবেষণায় আঞ্চলিক কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম অর্থায়নে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, রকেফেলার ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। আমি গবেষণা সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও এই ভাইরাসের কারণে সমগ্র বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। তবে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কিছুটা কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে বিশ্ববাসী কিছুটা স্বস্তির মধ্যে রয়েছে। তবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা থেকে আরোগ্যলাভের জন্য কার্যকরী চূড়ান্ত ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে এক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। প্রকৃতপক্ষে গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব জটিল জটিল রোগ প্রতিরোধ ও আরোগ্যলাভের পথ খুঁজে পাওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কোভিড-১৯-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং এর উপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে মোট সংক্রমণের ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯ এর টিকা গ্রহীতাদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এই গবেষণার ফলাফলে টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে এবং এই গবেষণার ফলাফলটিও প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও প্রায় অর্ধশত কোভিড বিষয়ে গবেষণার ফলাফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এথেকেই এটা স্পষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা সেবার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা কার্যক্রমকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে দু’একটি কথা না বললেই নয়। প্রতিদিন প্রায় আট হাজার রোগী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে সেবা নিয়ে থাকেন। ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কারণ করোনাভাইরাস ছাড়াও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানও অব্যাহত রাখতে হয়। এ পর্যন্ত ফিভার ক্লিনিকে প্রায় সোয়া লাখ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। ল্যাবরেটরিতে প্রায় ২ লাখ রোগীর করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। করোনা সেন্টার ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কোভিড ফিল্ড হাসপাতালে প্রায় ১৫ হাজার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় লাখেরও বেশি প্রথম ডোজ এবং ১ লাখেরও বেশি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। অব্যাহত রাখা হয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমও।

দেশবাসীকে একটি আগাম সুখবর দিয়ে রাখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার ৭০০ শয্যাবিশিষ্ট সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের নির্মাণসহ অন্যান্য কার্যক্রম দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যে হাসপাতালটি চালু হলে সেটা হবে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি বড় সাফল্য এবং একই সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাকে অনেকখানিই ত্বরান্বিত করবে।

জ্ঞান ভিত্তিক, বিজ্ঞান মনষ্ক, দক্ষ ও মানবিক জাতি বিনির্মাণই আমাদের বর্তমান লক্ষ্য।

[লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ, কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top