alt

মুক্ত আলোচনা

বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা অক্ষয়কুমার দত্ত

জ্যোতির্ময় ধর

: রোববার, ০৭ নভেম্বর ২০২১

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত যারা চিন্তায় ও কর্মে যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রামমোহন,ডিরোজিও,ডিরোজিও শিষ্যবর্গ এবং বিদ্যাসাগরের নাম সর্বজন স্বীকৃত। এঁদের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) অপেক্ষাকৃত উপেক্ষিত। অক্ষয়কুমার ছিলেন বুদ্ধিবাদী তাত্ত্বিক এবং তাত্ত্বিক চিন্তার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান মনস্কতা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি সুনির্দিষ্ট স্বাতন্ত্র্য দান করেছিলো। কি তাঁর পরিচয় দেব ? তিনি ছিলেন একাধারে বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রনেতা, কলমে ছিল তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি, যার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত “দিগদর্শন ও “তত্ত্ববোধিনী”পত্রিকায়। বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান সাহিত্যের জন্মদাতা, তাঁকে সাবালকত্ব দেওয়া অর্থাৎ বাংলায় চিন্তাশীল ভাব প্রকাশের সাবলীল “বাংলা গদ্য” তাঁর হাত ধরেই দেখেছিল আলোর মুখ। অক্ষয়কুমার দত্তের সবচেয়ে বড় গুন হল বক্তব্যের স্পষ্টতা ও যৌক্তিক বাঁধুনি। ওই গুণে তাঁর গদ্য এখনো আদরণীয়। উদাহরণ স্বরূপ তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে নেওয়া যেতে পারেঃ “এতদ্দেশীয় লোকে সংস্কৃত বচন শুনিলেই তাহাতে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করেন এবং তদ্বিরুদ্ধ বাক্য প্রত্যয় সিদ্ধ হইলেও অবিশ্বাস করিয়া থাকেন।আমাদিগের এই বিষম কুসংস্কার মহানর্থের মূল হয়েছে। তাহা পরিত্যাগ না করিলে কোন ক্রমেই আমাদের মঙ্গল নাই। পূর্বে যেমন ভারতবর্ষীয় পণ্ডিতেরা স্ব স্ব বুদ্ধি পরিচালন পূর্বক জ্যোতিষাদি কয়েকটি বিদ্যার সৃষ্টি করে সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সেইরূপ যবনাদি অন্যান্য জাতীয় পণ্ডিতেরাও স্ব স্ব ভাষায় বিবিধ বিদ্যা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এক্ষণকার ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা আপনাদিগের অসাধারণ বুদ্ধিবলে ঐ সকল বিদ্যার যেরূপ উন্নতি করেছেন, তার সহিত তুলনা করে দেখলে, সংস্কৃত জ্যোতিষাদিকে অতি সামান্য বোধ হয় ।

তাঁর বিজ্ঞান রচনাতেই প্রথম পাওয়া যায় প্রসাদগুণ, যার অভাব থাকলে কোন রচনাই পাঠ যোগ্যতা অর্জন করে না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও অক্ষয়কুমারঃ তত্ত্ববোধিনী সভা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ৬ অক্টোবর ১৮৩৯। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।এই সভার মুখপাত্র ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার। ১৯৪০ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’-সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে এবং দেবেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভার (১৮৩৯) সদস্য হন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের পাশাপাশি এখানে বিজ্ঞান, সমাজ, দর্শন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয়ে নানা প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি উক্ত পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই পত্রিকা পরিচালনা করার জন্য একটি সমিতি গঠন করা হয়।অক্ষয় কুমার দত্ত এঁদের একজন ছিলেন। এই সূত্রে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, আনন্দকৃষ্ণ বসু, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ তৎকালীন বিখ্যাত মনীষীদের সংস্পর্শে আসেন। দীর্ঘ বারো বছর সেই পত্রিকা সম্পাদনা করে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মুখপত্রকে প্রায় একক উদ্যোগে অক্ষয় কুমার করে তুললেন সেকালের এক বিশিষ্ট মুক্তচিন্তার সাময়িকপত্রে।

এখানে উল্লেখ্য যে তত্ত্ববোধিনী সভায় প্রথম থেকেই দুটো স্বতন্ত্র চিন্তাধারার সংঘাত ছিল। একদিকে ছিল বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাসী যুক্তিবাদ-বিরোধী ভাবনাচিন্তা,অন্যাদিকে বেদ বেদান্ত বা যেকোন শাস্ত্রীয় বচনের অভ্রান্ততায় অবিশ্বাসী,আধুনিক বিজ্ঞান-পন্থী ভাবধারা,যার বর্ষামুখ ছিলেন বিস্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁর সুদীর্ঘ বারো বছরের “তত্ত্ববোধিনী“ পত্রিকা সম্পাদনা কাল বাঙ্গালীর মননচর্চার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তিনি শিক্ষিত বাঙ্গালীর চিন্তাধারায় একটা আরোহবাদী যুক্তিশীলতার বাতাবরণ তৈরি করেন এবং পদার্থ বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত ও প্রচুর লেখা লেখেন এবং ঐ ধরনের লেখার উপযোগী গদ্য –কাঠামো রচনা করে দেন। তিনি প্রথম তৎকালীন সময়ে বেদের অভ্রান্ততাকে চ্যালেঞ্জ করেন।

১৮৪১ সালটি হল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য রচনার একটি মাইলফলক। কেননা, এই বছরেই প্রকাশিত হল অক্ষয় কুমার দত্তের লেখা বই “ভূগোল”। বাংলা ভাষায় এই প্রথম একটি বিজ্ঞান সংক্রান্ত বই লেখা হল, যা সাধারণ মানুষের কাছে বেশ সহজবোধ্য হল। উল্লেখ্য এই ভূগোল বইটার লেখাগুলো তাঁর সম্পাদিত “দিগদর্শন” পত্রিকায় পর্ব আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয় কুমারের আগে যাঁরা লিখেছিলেন, সেগুলির সবই প্রায় ভাষার জটিলতাদোষে দুষ্ট ছিল, খানিকটা দুর্বোধ্য ছিল এবং অযথা তথ্যে ঠাসা ছিল, যার অধিকাংশই কৃত্রিমতায় পর্যবসিত ছিল। অক্ষয় কুমারই প্রথম, যিনি ইঊরোপীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে আমাদের মতো করে বাংলা ভাষায় সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করলেন তার “ভূগোল”’ গ্রন্থের মাধ্যমে। তাঁর কৃতিত্ব এই যে, তিনি বিজ্ঞান সংক্রান্ত যত লেখা লিখেছিলেন তা কিন্তু অনুবাদ নয়, অনুকরণও নয়, অনুসরণ করেছেন মাত্র, নিজের ভাবনা-চিন্তা,অধিগতবিদ্যা, মেধা দিয়ে লেখাগুলি আমাদের উপহার দিয়েছেন। “পদার্থবিদ্যা” এই শিরোনামে পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনা শুরু করলেন অক্ষয় কুমার দত্ত “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়” ১৭৬৯ আষাঢ় সংখ্যা (৫৪ সংখ্যা) থেকে ধারাবাহিকভাবে। প্রথম পর্বে ‘জ্যোতিষ’ শিরোনামে শুরু হয়েছে এই ধারাবাহিক। এরপর একে একে এল জড় ও জড়ের গুণ’, ‘চৌম্বকাকর্ষণ’, বাষ্পীভবন, ঘনীভবন, কাঠিন্য’ স্থিতিস্থাপকতা, ঘাতসহত্ব’ ভঙ্গপ্রবণতা, গতির নিয়ম’ পেণ্ডুলাম’ ইত্যাদি নানান বিষয়। সত্যি বলতে কি বাংলা ভাষায় এমনভাবে বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলিকে আলোচনা করা হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। ফলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা শক্তিশালী হল অক্ষয়কুমারের স্পর্শে। এইসব লেখাই ‘পদার্থবিদ্যা’ নামে ১৮৫৬ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল। বাংলায় লেখা পদার্থবিজ্ঞানের ১৫৪ পৃষ্ঠার প্রথম পাঠ্যপুস্তক। এর পর তিনি বাঙ্গালীদের উপহার দিতে থাকলেন একের পর এক পাঠ্য পুস্তক চারুপাঠ ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড, সেকালের সর্বাধিক বিক্রিত বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্য পুস্তক। আর তাঁর লেখা বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার সে সময়কার শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত তরুণ মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

প্রাচ্যের নানা সূত্র আরবি-পারসিক থেকে যুক্তিবাদের প্রথম পাঠ নেন রামমোহন। পরবর্তীকালে তার পরিচয় হয় সংস্কৃত বৌদ্ধ, জৈন, কবীর-নানক ও ইওরোপীয় যুক্তিবাদী ঘরানার সঙ্গে। ধর্মের সঙ্গে যুক্তিবাদকে মিলিয়েই পথ হাটেন তিনি। একই কথা খাটে বিদ্যাসাগরের বেলায়। অন্যদিকে, রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮২০-৮৬ নিজেকে শাস্ত্র বা দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। গোড়া থেকেই তার ঝোক ছিল বিজ্ঞানে। পুরাকাহিনী নয়, ‘জগতের অপরিবর্তনীয় স্বাভাবিক নিয়ম’ জানার আগ্রহ তাকে টেনেছে। তাই ওরিয়েন্টাল সেমিনারি-তে হার্ডম্যান জেফ্রয়-এর কাছে গ্রিক, লাতিন, হিরু, ফরাসি আর জার্মান শেখার পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোল নিয়ে অক্ষয়কুমারের আগ্রহ জাগে। ইওরোপীয় দর্শন ছাড়াও তখন বাঙলায় সদ্য বিজ্ঞানশিক্ষা শুরু হয়েছে: আইজাক নিউটন ১৬৪২-১৭২৬ এর গতিসূত্র ও সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ, জগত সম্বন্ধে এক নতুন ধারণার হদিশ দিয়েছে জিজ্ঞাসুদের। ইস্কুলের গন্ডি পেরনোর আগেই ইউক্লিডীয় জ্যাতিতির প্রথম চার অধ্যায় ও প্রাথমিক বীজগণিত শেখেন অক্ষয়কুমার: পরেও সমানভাবে চললো গণিত ও পদার্থবিদ্যার চর্চা। রাধাকান্ত দেবের গ্রন্থাগার ছিল তার প্রধান সহায়। সেখানেই ত্রিকোণামিতি,শঙ্কু-বিভাগ কণিক-সেকশন, ক্যালকুলাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাকৃতিক ভূগোলের পাঠ নিলেন অক্ষয়কুমার।

অক্ষয়কুমার এর বেদের অভ্রান্ততাকে চ্যালেঞ্জ করে এসব লেখা “তত্ত্ববোধিনী” পত্রিকার মালিক, বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাসী, দেবেন্দ্রনাথ ভাল চোখে দেখতেন না। একবার রাজনারায়ণ বসুর একটি বক্তৃতা দেবেন্দ্রনাথ “তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় ছাপতে চান, কিন্তু পত্রিকার গ্রন্থাধ্যক্ষরা সেটি বাতিল করেন। রাজনারায়ণকে একটি চিঠি লিখে তখন নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ: এ বক্তৃতা আমার বন্ধুদিগের মধ্যে যাহারা শুনিলেন তাহারাই পরিতৃপ্ত হইবেন: কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে সভার গ্রন্থাধ্যেক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাক্ষধর্ম্ম প্রচারের সুবিধা নাই। অক্ষয়কুমারকে অবশ্য বহিষ্কার করতে হয়নি: অসুস্থতার জন্যে তিনি নিজেই ব্রাক্ষদের সভার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন ১৮৫৫-র মাঝামাঝি। এর আগেই কলকাতার ছাত্র-যুবকদের মধ্যে অক্ষয়কুমারের মৌখিক বীজগণিতের সমীকরণটি প্রচন্ড সাড়া জাগায়:

পরিশ্রম=শস্য

পরিশ্রম + প্রার্থনা= শস্য

সুতরাং প্রার্থনা = ০

পুরো কোলকাতার বিদ্যত সমাজ এতে স্তম্ভিত হয়ে যায়- এ প্রসঙ্গে অক্ষয়কুমার বলেন “বিশুদ্ধবুদ্ধি বিজ্ঞানবিৎ লোকের পক্ষে যাহা অতি বোধ-সুলভ,তাহা এদেশীয় লোকদের নতুন বোধ হইলো এটি বড় দুঃখের বিষয়।

রামমোহন-বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয়কুমারের ওপরও বিস্তর প্রভাব ফেলেছিল ফ্রানসিস বেকন-এ প্রত্যক্ষবাদ ও আরোহবাদী তর্কবিদ্যা। বলা যায়, তাকে নিরীশ্বরবাদের দিকে আর এক ধাপ এগোতে সাহায্য করেন বেকন। প্রাচীন ভারতের আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ অক্ষয়কুমারের অমূল্য কীর্তি। সেখানেই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বেকনীয় তর্করীতি। পদার্থবিদ্যা ও ভূগোলের এলাকা পেরিয়ে অক্ষয়কুমার ক্রমে চলে যান ইতিহাসের মৌলিক গবেষণায়। দেখার বিষয়,তার ইহিহাসচর্চা ছিল বস্তুনিষ্ঠ: তার স্বদেমপ্রেমে প্রশ্রয় পায়নি হিন্দু পুনরুত্থানবাদ।প্রাচীন ভারতীয়দের কীর্তি তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছেন অক্ষয়কুমার। “ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায় ও প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার” বই দুটি অক্ষয়কুমারের অন্যতম মৌলিক গবেষণা। বিশেষ করে অক্ষয় কুমারের শ্রেষ্ঠ গবেষণামূলক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। আধুনিক শিক্ষার পরিভাষায় বহুল ব্যবহৃত ফিল্ড-স্টাডি বিষয়টি যে সমাজবিজ্ঞান চর্চায় কতদূর পৌঁছতে পারে এই অক্ষয় গ্রন্থের দুই খণ্ড তার অনুপম দৃষ্টান্ত।

একজন দার্শনিক, তিনি যে ই হোন ইতিহাসের ধারা বদলাতে পারেন না, তার জন্যে একইসঙ্গে দরকার অনুকূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সে কথা অক্ষয়কুমার সম্ভবত বুঝতেন না। ভারতে জৈবিকভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান না হওয়ায় বিজ্ঞানমনস্কতা এখানে মূলস্রোত হতে পারেনি : বিশেষত উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ায় ধর্মীয় ও ভাববাদী ধ্যাধারণার জিৎ হয়েছে। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্য বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল বাঙলার কিছু যুবকের। সেই পুজি নিয়েই তার অক্লান্তভাবে লড়েছিলেন একদিকে সাম্রাজ্যবাদী অপশাসন, আর অন্যদিকে দেশের পিছিয়ে-পড়া সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শর বিরুদ্ধে। এক বিকল্প বিশ্ববীক্ষার হদিশ দিয়েছিল রামমোহন-বিদ্যাসগর-অক্ষয়কুমারের ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্য ছাড়িয়ে যায় দেশ কালের সীমানা।তাই ভাস্কর আর্য্যভট্ট গৌতম কণাদ-এর পাশাপাশি নিউটন লাপ্লাস বেকন এর থিওরি অনায়াসে অক্ষয়কুমারের শাস্ত্র হয়ে ওঠে।

ভারতীয় দর্শনের বিচারেও অক্ষয়কুমারের যুক্তিবাদী দুষ্টিভঙ্গি বজায় ছিল একইরকম। ষড়দর্শনের আলোচনায় তার প্রধান উৎসাহ হলো: বেদ ও ঈশ্বর বিরোধিতা। মনে রাখা জরুরী, কোথাও কোথাও বাড়তি উৎসাহর পাশাপাশি দার্শনিক মতগুলির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সরব হয়েছেন তিনি। যেমন: “অন্যান্য দর্শনকার অপেক্ষা কর্নাদের জড় পদাথের জ্ঞানানুশীলনের সমধিক প্রবৃত্তি জম্মে দেখা যাইতেছে। তিনি পরমাণুবাদ সংস্থাপন করিয়া সে বিষয়ের সূত্রপাত করেন। মেঘ,বিদ্যুৎ, বজ্রাঘাত, ভূমিকম্প, বৃক্ষের রসসঞ্চরণ, করকা ও হিমশিলা, চৌম্বকাকর্ষণ, জড়ের সংযোগবিভগাদি গুণ ও গত্যাদি ক্রিয়া প্রভৃতি নানা ব্যাপার তাহার চিত্তাকর্ষণ হয়। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে সূত্রপাতেই অবশেষ হইল, কিন্তু বর্দ্ধিত, পুষ্পিত ও ফলিত হইল না। কালক্রমে সে সৌভাগ্য বেকন, সোন্ত ও হাম্বোলটের জন্মভুমিতে গিয়া প্রকাশিত ও প্রাদুর্ভূত হইয়া ইঠল। তথাপি আমাদের চরক, আর্য্যভট্টাদির পদকমলে বারবার নমস্কার।

শুধু তা-ই-নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও লোকাচারের সমালোচনায় ও অক্ষয়কুমার সমান মুখর। ধর্মের নামে কুসংস্কার ও হানাহানি নিয়ে বারবার তিনি মুখ খুলেছেন। এমনকি, ধর্ম ও মোক্ষলাভের সাধনাকে অক্ষয়কুমার ‘মানসিক রোগ’ বলেও চিহ্নিত করেন। মনে রাখা জরুরি, অক্ষয়কুমার দত্তর চিন্তাভাবনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তনও ঘটেছিল। যৌক্তিক অজ্ঞেয়বাদের পর ধ্র“ববাদ প্রভাবিত করেছিল তাকে। ইওরোপে সতেরো শতকে বেকন থেকে যে-বস্তুবাদী ধ্যানধারণার সূচনা হয়েছিল তা উনিশ শতকের প্রথমভাগে অগুস্ত কোত (১৭৯৮-১৮৫৭) এর ধ্র“ব বাদ নিয়ে আগ্রহ বাড়ে। এমনকি, দি ইন্ডিয়ান পজিটিবিস্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিরেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বলা যায়, বিজ্ঞান চেতনা ও সমাজবদলের আকাঙ্খা থেকেই কোত-এর দর্শনের প্রতি অক্ষয়কুমার ও অন্যান্য আগুয়ান বাঙালির উৎসাহ জাগে। তাই অক্ষয়কুমার বলতে পারেন: রত্ন গর্ভা ইয়ুরোপে দুই কালে যেরূপ দুইটি অমূল্যরত্ন প্রসব করিয়াছেন, সেরূপ আর কস্মিনকালে কুত্রাপি হয় নাই। বেকন ও কোস্ত, দুই ভূ-খন্ডের উপর দুই সূর্য্য ।

আগেই বলেছি: সামাজিক ক্ষেত্রেও নিজের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন অক্ষয়কুমার। লক্ষ্য করার বিষয়: অক্ষয়কুমারের মতে সৎ ধর্মের আওতায় আসে ভালো বাসস্থান, স্বাস্থ্য, আচার-ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পরোপকার, বাল্য-বহু-বার্ধক্য বিবাহ রোধ, স্বামী-স্ত্রীর সমমনোভাব, নারী-শিক্ষা, সন্তান ও বাবা-মার প্রতি কর্তব্য ইত্যাদির মতো বিষয়।

অক্ষয়কুমার দত্তর কাছে যুক্তিবাদ স্রেফ বিদ্যাজগতে আটকে থাকেনি তা হয়ে উঠেছিল বিশ্ববীক্ষার ভিত্তি। অক্ষয় কুমার মনে করতেন, মানুষের হিতসাধন করাই পরমেশ্বরের যথার্থ উপাসনা। জ্ঞানসাধক অক্ষয় কুমার বস্তুবাদী হিসেবে, ধর্ম বিষয়ে কথা বলার সময় যুক্তির পথ ধরে চলতেন। আসলে পৃথিবীতে প্রচলিত কোনা ধর্মই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। নিজের বই বিক্রির উপার্জিত অর্থে তিনি তাঁর বাসভবনে গড়ে তুলেছিলেন ভূ- তাত্ত্বিক সংগ্রহ শালা। এটা প্রথম বাংলায় ব্যাক্তিগত ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহ শালা। মৃত্যুর পর তাঁর উপার্জিত অর্থ বিজ্ঞান চর্চায় দান করে যান। করার নেই? লেখক- প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি

[লেখক: প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা অক্ষয়কুমার দত্ত

জ্যোতির্ময় ধর

রোববার, ০৭ নভেম্বর ২০২১

উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত যারা চিন্তায় ও কর্মে যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রামমোহন,ডিরোজিও,ডিরোজিও শিষ্যবর্গ এবং বিদ্যাসাগরের নাম সর্বজন স্বীকৃত। এঁদের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) অপেক্ষাকৃত উপেক্ষিত। অক্ষয়কুমার ছিলেন বুদ্ধিবাদী তাত্ত্বিক এবং তাত্ত্বিক চিন্তার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান মনস্কতা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি সুনির্দিষ্ট স্বাতন্ত্র্য দান করেছিলো। কি তাঁর পরিচয় দেব ? তিনি ছিলেন একাধারে বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক প্রনেতা, কলমে ছিল তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি, যার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত “দিগদর্শন ও “তত্ত্ববোধিনী”পত্রিকায়। বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান সাহিত্যের জন্মদাতা, তাঁকে সাবালকত্ব দেওয়া অর্থাৎ বাংলায় চিন্তাশীল ভাব প্রকাশের সাবলীল “বাংলা গদ্য” তাঁর হাত ধরেই দেখেছিল আলোর মুখ। অক্ষয়কুমার দত্তের সবচেয়ে বড় গুন হল বক্তব্যের স্পষ্টতা ও যৌক্তিক বাঁধুনি। ওই গুণে তাঁর গদ্য এখনো আদরণীয়। উদাহরণ স্বরূপ তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে নেওয়া যেতে পারেঃ “এতদ্দেশীয় লোকে সংস্কৃত বচন শুনিলেই তাহাতে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করেন এবং তদ্বিরুদ্ধ বাক্য প্রত্যয় সিদ্ধ হইলেও অবিশ্বাস করিয়া থাকেন।আমাদিগের এই বিষম কুসংস্কার মহানর্থের মূল হয়েছে। তাহা পরিত্যাগ না করিলে কোন ক্রমেই আমাদের মঙ্গল নাই। পূর্বে যেমন ভারতবর্ষীয় পণ্ডিতেরা স্ব স্ব বুদ্ধি পরিচালন পূর্বক জ্যোতিষাদি কয়েকটি বিদ্যার সৃষ্টি করে সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সেইরূপ যবনাদি অন্যান্য জাতীয় পণ্ডিতেরাও স্ব স্ব ভাষায় বিবিধ বিদ্যা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এক্ষণকার ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা আপনাদিগের অসাধারণ বুদ্ধিবলে ঐ সকল বিদ্যার যেরূপ উন্নতি করেছেন, তার সহিত তুলনা করে দেখলে, সংস্কৃত জ্যোতিষাদিকে অতি সামান্য বোধ হয় ।

তাঁর বিজ্ঞান রচনাতেই প্রথম পাওয়া যায় প্রসাদগুণ, যার অভাব থাকলে কোন রচনাই পাঠ যোগ্যতা অর্জন করে না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও অক্ষয়কুমারঃ তত্ত্ববোধিনী সভা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ৬ অক্টোবর ১৮৩৯। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।এই সভার মুখপাত্র ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার। ১৯৪০ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’-সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে এবং দেবেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভার (১৮৩৯) সদস্য হন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের পাশাপাশি এখানে বিজ্ঞান, সমাজ, দর্শন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয়ে নানা প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি উক্ত পত্রিকার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই পত্রিকা পরিচালনা করার জন্য একটি সমিতি গঠন করা হয়।অক্ষয় কুমার দত্ত এঁদের একজন ছিলেন। এই সূত্রে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, আনন্দকৃষ্ণ বসু, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ তৎকালীন বিখ্যাত মনীষীদের সংস্পর্শে আসেন। দীর্ঘ বারো বছর সেই পত্রিকা সম্পাদনা করে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মুখপত্রকে প্রায় একক উদ্যোগে অক্ষয় কুমার করে তুললেন সেকালের এক বিশিষ্ট মুক্তচিন্তার সাময়িকপত্রে।

এখানে উল্লেখ্য যে তত্ত্ববোধিনী সভায় প্রথম থেকেই দুটো স্বতন্ত্র চিন্তাধারার সংঘাত ছিল। একদিকে ছিল বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাসী যুক্তিবাদ-বিরোধী ভাবনাচিন্তা,অন্যাদিকে বেদ বেদান্ত বা যেকোন শাস্ত্রীয় বচনের অভ্রান্ততায় অবিশ্বাসী,আধুনিক বিজ্ঞান-পন্থী ভাবধারা,যার বর্ষামুখ ছিলেন বিস্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁর সুদীর্ঘ বারো বছরের “তত্ত্ববোধিনী“ পত্রিকা সম্পাদনা কাল বাঙ্গালীর মননচর্চার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তিনি শিক্ষিত বাঙ্গালীর চিন্তাধারায় একটা আরোহবাদী যুক্তিশীলতার বাতাবরণ তৈরি করেন এবং পদার্থ বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত ও প্রচুর লেখা লেখেন এবং ঐ ধরনের লেখার উপযোগী গদ্য –কাঠামো রচনা করে দেন। তিনি প্রথম তৎকালীন সময়ে বেদের অভ্রান্ততাকে চ্যালেঞ্জ করেন।

১৮৪১ সালটি হল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য রচনার একটি মাইলফলক। কেননা, এই বছরেই প্রকাশিত হল অক্ষয় কুমার দত্তের লেখা বই “ভূগোল”। বাংলা ভাষায় এই প্রথম একটি বিজ্ঞান সংক্রান্ত বই লেখা হল, যা সাধারণ মানুষের কাছে বেশ সহজবোধ্য হল। উল্লেখ্য এই ভূগোল বইটার লেখাগুলো তাঁর সম্পাদিত “দিগদর্শন” পত্রিকায় পর্ব আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয় কুমারের আগে যাঁরা লিখেছিলেন, সেগুলির সবই প্রায় ভাষার জটিলতাদোষে দুষ্ট ছিল, খানিকটা দুর্বোধ্য ছিল এবং অযথা তথ্যে ঠাসা ছিল, যার অধিকাংশই কৃত্রিমতায় পর্যবসিত ছিল। অক্ষয় কুমারই প্রথম, যিনি ইঊরোপীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে আমাদের মতো করে বাংলা ভাষায় সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করলেন তার “ভূগোল”’ গ্রন্থের মাধ্যমে। তাঁর কৃতিত্ব এই যে, তিনি বিজ্ঞান সংক্রান্ত যত লেখা লিখেছিলেন তা কিন্তু অনুবাদ নয়, অনুকরণও নয়, অনুসরণ করেছেন মাত্র, নিজের ভাবনা-চিন্তা,অধিগতবিদ্যা, মেধা দিয়ে লেখাগুলি আমাদের উপহার দিয়েছেন। “পদার্থবিদ্যা” এই শিরোনামে পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনা শুরু করলেন অক্ষয় কুমার দত্ত “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়” ১৭৬৯ আষাঢ় সংখ্যা (৫৪ সংখ্যা) থেকে ধারাবাহিকভাবে। প্রথম পর্বে ‘জ্যোতিষ’ শিরোনামে শুরু হয়েছে এই ধারাবাহিক। এরপর একে একে এল জড় ও জড়ের গুণ’, ‘চৌম্বকাকর্ষণ’, বাষ্পীভবন, ঘনীভবন, কাঠিন্য’ স্থিতিস্থাপকতা, ঘাতসহত্ব’ ভঙ্গপ্রবণতা, গতির নিয়ম’ পেণ্ডুলাম’ ইত্যাদি নানান বিষয়। সত্যি বলতে কি বাংলা ভাষায় এমনভাবে বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলিকে আলোচনা করা হয়েছে, যা আগে দেখা যায়নি। ফলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা শক্তিশালী হল অক্ষয়কুমারের স্পর্শে। এইসব লেখাই ‘পদার্থবিদ্যা’ নামে ১৮৫৬ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হল। বাংলায় লেখা পদার্থবিজ্ঞানের ১৫৪ পৃষ্ঠার প্রথম পাঠ্যপুস্তক। এর পর তিনি বাঙ্গালীদের উপহার দিতে থাকলেন একের পর এক পাঠ্য পুস্তক চারুপাঠ ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড, সেকালের সর্বাধিক বিক্রিত বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্য পুস্তক। আর তাঁর লেখা বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার সে সময়কার শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত তরুণ মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

প্রাচ্যের নানা সূত্র আরবি-পারসিক থেকে যুক্তিবাদের প্রথম পাঠ নেন রামমোহন। পরবর্তীকালে তার পরিচয় হয় সংস্কৃত বৌদ্ধ, জৈন, কবীর-নানক ও ইওরোপীয় যুক্তিবাদী ঘরানার সঙ্গে। ধর্মের সঙ্গে যুক্তিবাদকে মিলিয়েই পথ হাটেন তিনি। একই কথা খাটে বিদ্যাসাগরের বেলায়। অন্যদিকে, রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮২০-৮৬ নিজেকে শাস্ত্র বা দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। গোড়া থেকেই তার ঝোক ছিল বিজ্ঞানে। পুরাকাহিনী নয়, ‘জগতের অপরিবর্তনীয় স্বাভাবিক নিয়ম’ জানার আগ্রহ তাকে টেনেছে। তাই ওরিয়েন্টাল সেমিনারি-তে হার্ডম্যান জেফ্রয়-এর কাছে গ্রিক, লাতিন, হিরু, ফরাসি আর জার্মান শেখার পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোল নিয়ে অক্ষয়কুমারের আগ্রহ জাগে। ইওরোপীয় দর্শন ছাড়াও তখন বাঙলায় সদ্য বিজ্ঞানশিক্ষা শুরু হয়েছে: আইজাক নিউটন ১৬৪২-১৭২৬ এর গতিসূত্র ও সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ, জগত সম্বন্ধে এক নতুন ধারণার হদিশ দিয়েছে জিজ্ঞাসুদের। ইস্কুলের গন্ডি পেরনোর আগেই ইউক্লিডীয় জ্যাতিতির প্রথম চার অধ্যায় ও প্রাথমিক বীজগণিত শেখেন অক্ষয়কুমার: পরেও সমানভাবে চললো গণিত ও পদার্থবিদ্যার চর্চা। রাধাকান্ত দেবের গ্রন্থাগার ছিল তার প্রধান সহায়। সেখানেই ত্রিকোণামিতি,শঙ্কু-বিভাগ কণিক-সেকশন, ক্যালকুলাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাকৃতিক ভূগোলের পাঠ নিলেন অক্ষয়কুমার।

অক্ষয়কুমার এর বেদের অভ্রান্ততাকে চ্যালেঞ্জ করে এসব লেখা “তত্ত্ববোধিনী” পত্রিকার মালিক, বেদের অভ্রান্ততায় বিশ্বাসী, দেবেন্দ্রনাথ ভাল চোখে দেখতেন না। একবার রাজনারায়ণ বসুর একটি বক্তৃতা দেবেন্দ্রনাথ “তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় ছাপতে চান, কিন্তু পত্রিকার গ্রন্থাধ্যক্ষরা সেটি বাতিল করেন। রাজনারায়ণকে একটি চিঠি লিখে তখন নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ: এ বক্তৃতা আমার বন্ধুদিগের মধ্যে যাহারা শুনিলেন তাহারাই পরিতৃপ্ত হইবেন: কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে সভার গ্রন্থাধ্যেক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাক্ষধর্ম্ম প্রচারের সুবিধা নাই। অক্ষয়কুমারকে অবশ্য বহিষ্কার করতে হয়নি: অসুস্থতার জন্যে তিনি নিজেই ব্রাক্ষদের সভার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন ১৮৫৫-র মাঝামাঝি। এর আগেই কলকাতার ছাত্র-যুবকদের মধ্যে অক্ষয়কুমারের মৌখিক বীজগণিতের সমীকরণটি প্রচন্ড সাড়া জাগায়:

পরিশ্রম=শস্য

পরিশ্রম + প্রার্থনা= শস্য

সুতরাং প্রার্থনা = ০

পুরো কোলকাতার বিদ্যত সমাজ এতে স্তম্ভিত হয়ে যায়- এ প্রসঙ্গে অক্ষয়কুমার বলেন “বিশুদ্ধবুদ্ধি বিজ্ঞানবিৎ লোকের পক্ষে যাহা অতি বোধ-সুলভ,তাহা এদেশীয় লোকদের নতুন বোধ হইলো এটি বড় দুঃখের বিষয়।

রামমোহন-বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয়কুমারের ওপরও বিস্তর প্রভাব ফেলেছিল ফ্রানসিস বেকন-এ প্রত্যক্ষবাদ ও আরোহবাদী তর্কবিদ্যা। বলা যায়, তাকে নিরীশ্বরবাদের দিকে আর এক ধাপ এগোতে সাহায্য করেন বেকন। প্রাচীন ভারতের আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ অক্ষয়কুমারের অমূল্য কীর্তি। সেখানেই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বেকনীয় তর্করীতি। পদার্থবিদ্যা ও ভূগোলের এলাকা পেরিয়ে অক্ষয়কুমার ক্রমে চলে যান ইতিহাসের মৌলিক গবেষণায়। দেখার বিষয়,তার ইহিহাসচর্চা ছিল বস্তুনিষ্ঠ: তার স্বদেমপ্রেমে প্রশ্রয় পায়নি হিন্দু পুনরুত্থানবাদ।প্রাচীন ভারতীয়দের কীর্তি তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছেন অক্ষয়কুমার। “ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায় ও প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার” বই দুটি অক্ষয়কুমারের অন্যতম মৌলিক গবেষণা। বিশেষ করে অক্ষয় কুমারের শ্রেষ্ঠ গবেষণামূলক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। আধুনিক শিক্ষার পরিভাষায় বহুল ব্যবহৃত ফিল্ড-স্টাডি বিষয়টি যে সমাজবিজ্ঞান চর্চায় কতদূর পৌঁছতে পারে এই অক্ষয় গ্রন্থের দুই খণ্ড তার অনুপম দৃষ্টান্ত।

একজন দার্শনিক, তিনি যে ই হোন ইতিহাসের ধারা বদলাতে পারেন না, তার জন্যে একইসঙ্গে দরকার অনুকূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সে কথা অক্ষয়কুমার সম্ভবত বুঝতেন না। ভারতে জৈবিকভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান না হওয়ায় বিজ্ঞানমনস্কতা এখানে মূলস্রোত হতে পারেনি : বিশেষত উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ায় ধর্মীয় ও ভাববাদী ধ্যাধারণার জিৎ হয়েছে। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্য বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল বাঙলার কিছু যুবকের। সেই পুজি নিয়েই তার অক্লান্তভাবে লড়েছিলেন একদিকে সাম্রাজ্যবাদী অপশাসন, আর অন্যদিকে দেশের পিছিয়ে-পড়া সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শর বিরুদ্ধে। এক বিকল্প বিশ্ববীক্ষার হদিশ দিয়েছিল রামমোহন-বিদ্যাসগর-অক্ষয়কুমারের ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্য ছাড়িয়ে যায় দেশ কালের সীমানা।তাই ভাস্কর আর্য্যভট্ট গৌতম কণাদ-এর পাশাপাশি নিউটন লাপ্লাস বেকন এর থিওরি অনায়াসে অক্ষয়কুমারের শাস্ত্র হয়ে ওঠে।

ভারতীয় দর্শনের বিচারেও অক্ষয়কুমারের যুক্তিবাদী দুষ্টিভঙ্গি বজায় ছিল একইরকম। ষড়দর্শনের আলোচনায় তার প্রধান উৎসাহ হলো: বেদ ও ঈশ্বর বিরোধিতা। মনে রাখা জরুরী, কোথাও কোথাও বাড়তি উৎসাহর পাশাপাশি দার্শনিক মতগুলির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সরব হয়েছেন তিনি। যেমন: “অন্যান্য দর্শনকার অপেক্ষা কর্নাদের জড় পদাথের জ্ঞানানুশীলনের সমধিক প্রবৃত্তি জম্মে দেখা যাইতেছে। তিনি পরমাণুবাদ সংস্থাপন করিয়া সে বিষয়ের সূত্রপাত করেন। মেঘ,বিদ্যুৎ, বজ্রাঘাত, ভূমিকম্প, বৃক্ষের রসসঞ্চরণ, করকা ও হিমশিলা, চৌম্বকাকর্ষণ, জড়ের সংযোগবিভগাদি গুণ ও গত্যাদি ক্রিয়া প্রভৃতি নানা ব্যাপার তাহার চিত্তাকর্ষণ হয়। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে সূত্রপাতেই অবশেষ হইল, কিন্তু বর্দ্ধিত, পুষ্পিত ও ফলিত হইল না। কালক্রমে সে সৌভাগ্য বেকন, সোন্ত ও হাম্বোলটের জন্মভুমিতে গিয়া প্রকাশিত ও প্রাদুর্ভূত হইয়া ইঠল। তথাপি আমাদের চরক, আর্য্যভট্টাদির পদকমলে বারবার নমস্কার।

শুধু তা-ই-নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও লোকাচারের সমালোচনায় ও অক্ষয়কুমার সমান মুখর। ধর্মের নামে কুসংস্কার ও হানাহানি নিয়ে বারবার তিনি মুখ খুলেছেন। এমনকি, ধর্ম ও মোক্ষলাভের সাধনাকে অক্ষয়কুমার ‘মানসিক রোগ’ বলেও চিহ্নিত করেন। মনে রাখা জরুরি, অক্ষয়কুমার দত্তর চিন্তাভাবনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তনও ঘটেছিল। যৌক্তিক অজ্ঞেয়বাদের পর ধ্র“ববাদ প্রভাবিত করেছিল তাকে। ইওরোপে সতেরো শতকে বেকন থেকে যে-বস্তুবাদী ধ্যানধারণার সূচনা হয়েছিল তা উনিশ শতকের প্রথমভাগে অগুস্ত কোত (১৭৯৮-১৮৫৭) এর ধ্র“ব বাদ নিয়ে আগ্রহ বাড়ে। এমনকি, দি ইন্ডিয়ান পজিটিবিস্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিরেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বলা যায়, বিজ্ঞান চেতনা ও সমাজবদলের আকাঙ্খা থেকেই কোত-এর দর্শনের প্রতি অক্ষয়কুমার ও অন্যান্য আগুয়ান বাঙালির উৎসাহ জাগে। তাই অক্ষয়কুমার বলতে পারেন: রত্ন গর্ভা ইয়ুরোপে দুই কালে যেরূপ দুইটি অমূল্যরত্ন প্রসব করিয়াছেন, সেরূপ আর কস্মিনকালে কুত্রাপি হয় নাই। বেকন ও কোস্ত, দুই ভূ-খন্ডের উপর দুই সূর্য্য ।

আগেই বলেছি: সামাজিক ক্ষেত্রেও নিজের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন অক্ষয়কুমার। লক্ষ্য করার বিষয়: অক্ষয়কুমারের মতে সৎ ধর্মের আওতায় আসে ভালো বাসস্থান, স্বাস্থ্য, আচার-ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পরোপকার, বাল্য-বহু-বার্ধক্য বিবাহ রোধ, স্বামী-স্ত্রীর সমমনোভাব, নারী-শিক্ষা, সন্তান ও বাবা-মার প্রতি কর্তব্য ইত্যাদির মতো বিষয়।

অক্ষয়কুমার দত্তর কাছে যুক্তিবাদ স্রেফ বিদ্যাজগতে আটকে থাকেনি তা হয়ে উঠেছিল বিশ্ববীক্ষার ভিত্তি। অক্ষয় কুমার মনে করতেন, মানুষের হিতসাধন করাই পরমেশ্বরের যথার্থ উপাসনা। জ্ঞানসাধক অক্ষয় কুমার বস্তুবাদী হিসেবে, ধর্ম বিষয়ে কথা বলার সময় যুক্তির পথ ধরে চলতেন। আসলে পৃথিবীতে প্রচলিত কোনা ধর্মই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। নিজের বই বিক্রির উপার্জিত অর্থে তিনি তাঁর বাসভবনে গড়ে তুলেছিলেন ভূ- তাত্ত্বিক সংগ্রহ শালা। এটা প্রথম বাংলায় ব্যাক্তিগত ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহ শালা। মৃত্যুর পর তাঁর উপার্জিত অর্থ বিজ্ঞান চর্চায় দান করে যান। করার নেই? লেখক- প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি

[লেখক: প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি]

back to top