নাজমুল হুদা খান
সারা বিশ্বে ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে অদ্যাবধী কোভিড-১৯ যুদ্ধে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৫ কোটির উপর , মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ৫১ লাখ। স্বাস্থ্যবিধি, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য প্রতিরোধ ব্যবস্থায় করোনাকে রুখে দিতে সচেষ্ট বিশ্বের সকল দেশ । কোভিড-১৯ এর এ পরিস্থিতিতে ১৪ নভেম্বর পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০২১। ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় যুগান্তকারী ঔষধ ইনসুলিন আবিষ্কারের জনক মি. ফ্রেডারিক ব্যান্টিং এর জন্মদিন স্মরণে প্রতিবছর এ দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (IDF) এর ডাকে ২০২১-২৩ সালের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছেঃ “ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরী নয়” বা ইংরেজীতে- Access to Diabetes Care: If not how, When? ডায়াবেটিস চিকিৎসার আধুনিক অস্ত্র ইনসুলিন আবিস্কারের প্রায় ১০০ বছর হতে চললেও এখনো বিশ্বের ৫০ ভাগ মানুষ জানেনা, তারা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত কিনা। বেশীর ভাগ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত দেশের মানুষ এখনও ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় অসচেতন; তাদের হাতের নাগালে পৌঁছেনি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮০ সালে পৃথিবীব্যাপী ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১১ কোটি হলেও, মাত্র তিন দশকের ব্যবধান অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ গুন অর্থাৎ প্রায় ৪৩ কোটিতে; বর্তমানে সে সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫৪ কোটিরও বেশী। ২০১৯ সালেই এ নীরব ঘাতক মৃত্যু ঘটিয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের । ডায়াবেটিস যুদ্ধে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৫ কোটি, ২০৪৫ সালে যার সংখ্যা ৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মৃত্যুর হার হিসেবে প্রতি ৫ সেকেন্ডে প্রান হারাচ্ছে ১ জন, বছরে প্রায় ৬৭ লাখ আক্রান্ত ব্যাক্তি। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৯ কোটির মধ্যে প্রি-ডায়াবেটিসের লক্ষন রয়েছে। আনুপাতিক হারে এর সংখ্যা প্রায় ৩ ঃ ১; অথচ এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষই জানেনা যে এক নিরব ঘাতক বাসা বাঁধতে যাচ্ছে তাদের দেহে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের জরীপে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৫ লাখ; সে হিসেবে ২০৪৮ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে দেড় কোটি। এর মধ্যে অর্ধেক ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসা সুবিধা পায় না । ফলে ডায়াবেটিস জটিলতায় ভুগছে প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী এবং এ রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে মোট আয়ের ১০ ভাগ।
মানবদেহে অগ্নাশয় থেকে নিসৃত ইনসুলিন হরমোন শরীরের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। কোন কারনে ইনসুলিন উৎপাদন কমে গেলে বা ত্রুটিপূর্ন ইনসুলিন তৈরী হলে কিংবা শরীরের কোষসমূহ ইনসুলিনে সাড়া না দিলেই বিপত্তি; রক্তে সুগারের পরিমান বেড়ে যায়, খালি পেটে এ মাত্রা যদি ৭ মিলিমোল/লি. বা তার বেশী থাকে, ধরে নিতে হবে শরীর ডায়াবেটিসের দিকে ঝুঁকছে। রোগীর ঘন ঘন পিপাসা, অতিরিক্ত ক্ষুদা মন্দা , ঘন ঘন প্রস্রাব এবং শরীরের ওজন কমে যেতে পারে । চোখে ঝাপসা দেখা , কাটা ছেড়া সহজে না শুকানো বা অবস বোধ করাও এ রোগের অন্যতম লক্ষন। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে। বাকী ৯০ ভাগই অসচেতন জীবনযাত্রার প্রভাবেই হয়ে থাকে । শুধুমাত্র স্থুলতা , শরীর চর্চার অভাব, খাবার দাবারে নিয়ন্ত্রনহীনতা, মানসিক দুশ্চিন্তা বা চাপই এ রোগের প্রধান প্রধান কারণ। জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমেই এ রোগের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রন সম্ভব।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন অংগ যথাঃ হৃদপিন্ড, চোখ, কিডনী, স্নায়ুতন্ত্র এবং রক্তনালী সমূহের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে থাকে। ডায়াবেটিসের কারনে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং স্ট্রোকে মৃত্যু বরণ করে। রক্ত চলাচল এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারীতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে শরীরের নিম্নাংগের পচন রোগের সৃষ্টি আক্রান্ত হয় এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পা কেটে পগুত্ব বরন করতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন চোখের রক্তনালীতে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং রোগীকে অন্ধত্ত্ব বরন করে থাকে। কিডনীর কর্মহীনতার অন্যতম কারনও ডায়াবেটিস।
ঐতিহাসিকভাবে ডায়াবেটিস পৃথিবীর অন্যতম পুরাতন ব্যাধি। খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৫০ সালে মিশরে এ রোগের বর্ননা পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে, ২০০ খ্রীষ্টাব্দে গ্রীক সভ্যতায় ডায়াবেটিস বা বহুমুত্র শব্দগুলো ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ৬০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে "মধুমেহ" নামে যে ব্যাধির বর্ননা পাওয়া যায়, তা ডায়াবেটিসেরই নামান্তর। ১০০০ খ্রীষ্ট্রাব্দে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক আবিসিনিয়া ডায়াবেটিস রোগ ও ব্যবস্থাপনার উপর বিশদ গবেষনা ও নির্দেশনা প্রনয়নে সাফল্য দেখান। ১৫০০ সালে সুইস চিকিৎসা বিজ্ঞানীগন, ১৬০০ সালে বৃটিশ চিকিৎসা শাস্ত্রে, ১৮০০ সালে ফ্রান্সে এ রোগের প্রকৃতি ও ক্ষতিক্ষর প্রভাব সম্মন্ধে বিস্তারিত জানা যায়। আঠার শতকের শেষ দিকে, ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানী বিজ্ঞানী অগ্নাশয়ের যে অংশ ইনসুলিন তৈরীতে ভূমিকা রাখে তা আবিস্কার করেন এবং তার নামানুসারে অগ্নাশয়ের সে অংশের নামকরন করা হয় আইলেটস এব ল্যাংগারহেনস। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দ্রুতই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার আধুনিক সব ঔষধ, ইনজেকশন ও রোগ নির্নয়ের সহজলভ্য যন্ত্রের আবিস্কার ও চালু হয়।
ডায়াবেটিস চিকিৎসার সবচেয়ে আধুনিক ইনসুলিনও আবিস্কার হয় আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর পূর্বে। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মি. ফ্রেডারিক ব্যান্টিং ৩ বছরের একনিষ্ঠ অধ্যাবসায় শেষে ১৯২৩ সালের অক্টোবর মাসে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় বিস্ময়কর সাফল্য ইনসুলিন আবিস্কার করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এত কিছুর পরও বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিস রোগী, প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে ১ জন মৃত্যুকে বরন করে নিচ্ছে। ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে ব্যয় হচ্ছে বছরে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার । শুধু তাই নয় কোভিড মহামারীতে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুবরনকারীদের মধ্যে ৪০ ভাগই ডায়াবেটিস রোগী। আমেরিকার হিস্পানিক জনগোষ্টীর মধ্যে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। তাদের মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের ৫০ ভাগই মৃত্যুবরন করে। আফ্রিকায় ২০ শতাংশ, ইউরোপে ২০-৩০ শতাংশ, চীনে ৪০ শতাংশ মৃত্যুবরনকারী করোনার রোগীই ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত ছিল। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করোনা রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ৪ গুন বেশী। বাংলাদেশে করোনায় ৭৫ ভাগ মৃত্যুর জন্য ডায়াবেটিস অনুঘটক হসেবে কাজ করে বলে প্রমান মিলে।
এছাড়া করোনা আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের উপসর্গে তীব্রতা , হাসপাতালমূখীতা, আইসিইউ ব্যবহার, সংক্রমন বৃদ্ধি, আক্রমনে তীব্রতা এবং সর্বোপরি মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর করতে করোনা অতিমারির সহযোগী হিসেবে ভুমিকা রেখেছে ডায়াবেটিস। এ ঘাতক রোগ করোনা রোগীর শর্করা পরিপাক, প্রদাহ, প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ও ইলেক্ট্রোলাইটস সমূহের ভারসাম্য বিনষ্ট করে শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রকে অকার্যকর করে তোলে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের অতিরিক্ত সুগার করোনা সংক্রমনের গতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। করোনা আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীর দেহে সাইটোকাইন ঝড় সৃষ্টি এবং শরীরের প্রতিরোধী কোষসমূহের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে রোগীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।
তাই ডায়াবেটিস অতিমারি রুখতে সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে, স্থুলতা কমাতে হবে, শরীর চর্চা বৃদ্ধিসহ মানসিক চাপ ও দূশ্চিন্তামুক্ত থাকার সকল প্রচেষ্টা গ্রহন করতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদেরকে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহন, নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ ও মনিটরিং, খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রন, নিয়মানুবর্তিতা এবং মানসিক চিন্তামুক্ত থাকার বিষয়ে উদ্ভুদ্ধ করে তুলতে হবে। ডায়াবেটিস ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ব্যাক্তিদের স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন, নিয়মিত শরীর চর্চায় উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। তবেই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য সফলতায় পর্যবসিত হবে।
[লেখক: সহকারী পরিচালক , কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]
নাজমুল হুদা খান
শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১
সারা বিশ্বে ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে অদ্যাবধী কোভিড-১৯ যুদ্ধে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৫ কোটির উপর , মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ৫১ লাখ। স্বাস্থ্যবিধি, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য প্রতিরোধ ব্যবস্থায় করোনাকে রুখে দিতে সচেষ্ট বিশ্বের সকল দেশ । কোভিড-১৯ এর এ পরিস্থিতিতে ১৪ নভেম্বর পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০২১। ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় যুগান্তকারী ঔষধ ইনসুলিন আবিষ্কারের জনক মি. ফ্রেডারিক ব্যান্টিং এর জন্মদিন স্মরণে প্রতিবছর এ দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (IDF) এর ডাকে ২০২১-২৩ সালের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছেঃ “ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরী নয়” বা ইংরেজীতে- Access to Diabetes Care: If not how, When? ডায়াবেটিস চিকিৎসার আধুনিক অস্ত্র ইনসুলিন আবিস্কারের প্রায় ১০০ বছর হতে চললেও এখনো বিশ্বের ৫০ ভাগ মানুষ জানেনা, তারা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত কিনা। বেশীর ভাগ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত দেশের মানুষ এখনও ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় অসচেতন; তাদের হাতের নাগালে পৌঁছেনি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮০ সালে পৃথিবীব্যাপী ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১১ কোটি হলেও, মাত্র তিন দশকের ব্যবধান অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ গুন অর্থাৎ প্রায় ৪৩ কোটিতে; বর্তমানে সে সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫৪ কোটিরও বেশী। ২০১৯ সালেই এ নীরব ঘাতক মৃত্যু ঘটিয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের । ডায়াবেটিস যুদ্ধে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৫ কোটি, ২০৪৫ সালে যার সংখ্যা ৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মৃত্যুর হার হিসেবে প্রতি ৫ সেকেন্ডে প্রান হারাচ্ছে ১ জন, বছরে প্রায় ৬৭ লাখ আক্রান্ত ব্যাক্তি। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুক্তরাষ্ট্রে ৩৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৯ কোটির মধ্যে প্রি-ডায়াবেটিসের লক্ষন রয়েছে। আনুপাতিক হারে এর সংখ্যা প্রায় ৩ ঃ ১; অথচ এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষই জানেনা যে এক নিরব ঘাতক বাসা বাঁধতে যাচ্ছে তাদের দেহে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের জরীপে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৫ লাখ; সে হিসেবে ২০৪৮ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে দেড় কোটি। এর মধ্যে অর্ধেক ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসা সুবিধা পায় না । ফলে ডায়াবেটিস জটিলতায় ভুগছে প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী এবং এ রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে মোট আয়ের ১০ ভাগ।
মানবদেহে অগ্নাশয় থেকে নিসৃত ইনসুলিন হরমোন শরীরের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। কোন কারনে ইনসুলিন উৎপাদন কমে গেলে বা ত্রুটিপূর্ন ইনসুলিন তৈরী হলে কিংবা শরীরের কোষসমূহ ইনসুলিনে সাড়া না দিলেই বিপত্তি; রক্তে সুগারের পরিমান বেড়ে যায়, খালি পেটে এ মাত্রা যদি ৭ মিলিমোল/লি. বা তার বেশী থাকে, ধরে নিতে হবে শরীর ডায়াবেটিসের দিকে ঝুঁকছে। রোগীর ঘন ঘন পিপাসা, অতিরিক্ত ক্ষুদা মন্দা , ঘন ঘন প্রস্রাব এবং শরীরের ওজন কমে যেতে পারে । চোখে ঝাপসা দেখা , কাটা ছেড়া সহজে না শুকানো বা অবস বোধ করাও এ রোগের অন্যতম লক্ষন। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে। বাকী ৯০ ভাগই অসচেতন জীবনযাত্রার প্রভাবেই হয়ে থাকে । শুধুমাত্র স্থুলতা , শরীর চর্চার অভাব, খাবার দাবারে নিয়ন্ত্রনহীনতা, মানসিক দুশ্চিন্তা বা চাপই এ রোগের প্রধান প্রধান কারণ। জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমেই এ রোগের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রন সম্ভব।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন অংগ যথাঃ হৃদপিন্ড, চোখ, কিডনী, স্নায়ুতন্ত্র এবং রক্তনালী সমূহের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে থাকে। ডায়াবেটিসের কারনে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং স্ট্রোকে মৃত্যু বরণ করে। রক্ত চলাচল এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারীতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে শরীরের নিম্নাংগের পচন রোগের সৃষ্টি আক্রান্ত হয় এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পা কেটে পগুত্ব বরন করতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন চোখের রক্তনালীতে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং রোগীকে অন্ধত্ত্ব বরন করে থাকে। কিডনীর কর্মহীনতার অন্যতম কারনও ডায়াবেটিস।
ঐতিহাসিকভাবে ডায়াবেটিস পৃথিবীর অন্যতম পুরাতন ব্যাধি। খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৫০ সালে মিশরে এ রোগের বর্ননা পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে, ২০০ খ্রীষ্টাব্দে গ্রীক সভ্যতায় ডায়াবেটিস বা বহুমুত্র শব্দগুলো ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ৬০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে "মধুমেহ" নামে যে ব্যাধির বর্ননা পাওয়া যায়, তা ডায়াবেটিসেরই নামান্তর। ১০০০ খ্রীষ্ট্রাব্দে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক আবিসিনিয়া ডায়াবেটিস রোগ ও ব্যবস্থাপনার উপর বিশদ গবেষনা ও নির্দেশনা প্রনয়নে সাফল্য দেখান। ১৫০০ সালে সুইস চিকিৎসা বিজ্ঞানীগন, ১৬০০ সালে বৃটিশ চিকিৎসা শাস্ত্রে, ১৮০০ সালে ফ্রান্সে এ রোগের প্রকৃতি ও ক্ষতিক্ষর প্রভাব সম্মন্ধে বিস্তারিত জানা যায়। আঠার শতকের শেষ দিকে, ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানী বিজ্ঞানী অগ্নাশয়ের যে অংশ ইনসুলিন তৈরীতে ভূমিকা রাখে তা আবিস্কার করেন এবং তার নামানুসারে অগ্নাশয়ের সে অংশের নামকরন করা হয় আইলেটস এব ল্যাংগারহেনস। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দ্রুতই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার আধুনিক সব ঔষধ, ইনজেকশন ও রোগ নির্নয়ের সহজলভ্য যন্ত্রের আবিস্কার ও চালু হয়।
ডায়াবেটিস চিকিৎসার সবচেয়ে আধুনিক ইনসুলিনও আবিস্কার হয় আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর পূর্বে। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মি. ফ্রেডারিক ব্যান্টিং ৩ বছরের একনিষ্ঠ অধ্যাবসায় শেষে ১৯২৩ সালের অক্টোবর মাসে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় বিস্ময়কর সাফল্য ইনসুলিন আবিস্কার করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এত কিছুর পরও বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিস রোগী, প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে ১ জন মৃত্যুকে বরন করে নিচ্ছে। ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে ব্যয় হচ্ছে বছরে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার । শুধু তাই নয় কোভিড মহামারীতে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুবরনকারীদের মধ্যে ৪০ ভাগই ডায়াবেটিস রোগী। আমেরিকার হিস্পানিক জনগোষ্টীর মধ্যে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। তাদের মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের ৫০ ভাগই মৃত্যুবরন করে। আফ্রিকায় ২০ শতাংশ, ইউরোপে ২০-৩০ শতাংশ, চীনে ৪০ শতাংশ মৃত্যুবরনকারী করোনার রোগীই ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত ছিল। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করোনা রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ৪ গুন বেশী। বাংলাদেশে করোনায় ৭৫ ভাগ মৃত্যুর জন্য ডায়াবেটিস অনুঘটক হসেবে কাজ করে বলে প্রমান মিলে।
এছাড়া করোনা আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের উপসর্গে তীব্রতা , হাসপাতালমূখীতা, আইসিইউ ব্যবহার, সংক্রমন বৃদ্ধি, আক্রমনে তীব্রতা এবং সর্বোপরি মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর করতে করোনা অতিমারির সহযোগী হিসেবে ভুমিকা রেখেছে ডায়াবেটিস। এ ঘাতক রোগ করোনা রোগীর শর্করা পরিপাক, প্রদাহ, প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ও ইলেক্ট্রোলাইটস সমূহের ভারসাম্য বিনষ্ট করে শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রকে অকার্যকর করে তোলে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের অতিরিক্ত সুগার করোনা সংক্রমনের গতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। করোনা আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীর দেহে সাইটোকাইন ঝড় সৃষ্টি এবং শরীরের প্রতিরোধী কোষসমূহের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে রোগীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।
তাই ডায়াবেটিস অতিমারি রুখতে সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে, স্থুলতা কমাতে হবে, শরীর চর্চা বৃদ্ধিসহ মানসিক চাপ ও দূশ্চিন্তামুক্ত থাকার সকল প্রচেষ্টা গ্রহন করতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদেরকে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহন, নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ ও মনিটরিং, খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রন, নিয়মানুবর্তিতা এবং মানসিক চিন্তামুক্ত থাকার বিষয়ে উদ্ভুদ্ধ করে তুলতে হবে। ডায়াবেটিস ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ব্যাক্তিদের স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন, নিয়মিত শরীর চর্চায় উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। তবেই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য সফলতায় পর্যবসিত হবে।
[লেখক: সহকারী পরিচালক , কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]