মাহমুদুল হাছান
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস বিশ্বের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। দিনটি উদযাপনের পিছনে রয়েছে বহু সাধনা ও আত্মত্যাগ। ১৯৩৯ সালের শেষদিকে স্বাধীন চেকোস্লোভাকিয়া প্রজাতন্ত্রের দাবিতে ও জান অপলেটাল এবং শ্রমিক ভ্যাক্লাভ সেদেলেকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ নভেম্বর বিক্ষোভ জমায়েত কর্মসূচী গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হলে জার্মান নাৎসি বাহিনী সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘিরে ফেলে নয় জন ছাত্রনেতা ও প্রফেসরকে হত্যা করে এবং ১২০০ ছাত্রকে শচসেনহাউসনে (Sachsenhausen) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে সেখানে বন্দি করে রাখে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে ছাত্রদের সংগ্রামী মানসিকতাকে কুর্ণিশ করার জন্য এবং আরও নানা ক্ষেত্রে তাদের কর্মতৎপরতা, প্রতিভা ও মেধাকে সম্মান জানানোর জন্যই মূলত এ দিবসটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। ১৯৪১ সালে লন্ডনের আন্তর্জাতিক ছাত্র সংস্থা এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ১৭ নভেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই বিশেষ দিনটিতে ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন সভা-সম্মেলনের আয়োজন করে বিভিন্নরকম প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে এ দিনে। এমনকি খাদ্য, পানীয় সহযোগে উৎসবের আয়োজনও করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাত্র দিবস কেন্দ্রিক লেখালেখি কিংবা ছবির সাহায্যে এই দিনটি সম্পর্কে নানা তথ্য জানানো হয় জনসাধারণকে এবং দিনটির গুরুত্ব কতখানি সে বিষয়েও মানুষকে সচেতন করে তোলা হয়। বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র ও গ্রিসে দিনটি জাতীয় ছুটির দিন হিসাবেও পালিত হয়।
শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ। দেশ ও জাতির যে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন ও স্বাধিকার অর্জনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষালাভের জন্য বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে যে পরিশ্রম এবং লড়াই করতে হয়, অবশেষে তা দেশের উন্নতিতেই কাজে লাগে। পড়াশুনার জন্য পদে পদে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় কত ছাত্রকে। এ সংগ্রাম সাধনা ছাত্রজীবনের সঙ্গে একীভূত হয়ে আছে। এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, অন্যায়ের প্রতিবাদে ছাত্রদের সক্রিয় অবদানের কথাও উল্লেখযোগ্য।
এই বছর আন্তর্জাতিক ছাত্র দিবস-২০২১ এর থিম বা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল "মানুষ, উদ্ভিদ, সমৃদ্ধি এবং শান্তির জন্য শিক্ষা" (Learning for People, Plant, Prosperity and Peace)। এ থিমের পিছনে উদ্দেশ্য হলো; সমস্ত ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করা যাতে তারা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারে এবং কেন্দ্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস আমাদের জন্য বিশ্বের শিক্ষার্থীদের সম্মান জানানোর উপযুক্ত সুযোগ। বিশ্বের সব কোণ থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মজীবনের লক্ষ্য অর্জন এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন করতে কঠোর পরিশ্রম করে থাকে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের পরিবার ত্যাগ করে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জায়গা পেতে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করে, যা তাদের একটি উন্নত জীবন পেতে এবং তাদের প্রিয়জনদের জন্য সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এটি এমন কিছু যা আমাদের অবশ্যই সম্মান করা এবং উদযাপন করা উচিত।
যদিও ছাত্রজীবন প্রত্যেকের জন্য কঠিন, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে আন্তর্জাতিক ছাত্ররা বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে রয়েছে হোমসিকনেস, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, মুদ্রার পার্থক্য, আর্থিক সমস্যা এবং ভাষা প্রয়োগ প্রতিবন্ধকতা। যেখানে অনেক স্থানীয় শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনায় এবং নতুন বন্ধু তৈরিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়, সেখানে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের নানাবিধ বাধা অতিক্রম করতে হয়। যখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের দেখতে বাড়িতে যেতে সক্ষম হয়, তখন বিদেশী শিক্ষার্থীদের এই বিলাসিতা থাকে না। এছাড়াও, অনেক স্থানীয় শিক্ষার্থী ছাত্র ঋণ এবং অনুদানের আকারে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে, যা প্রবাসী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা পাওয়া সম্ভব হয় না। আবার কিছু দেশে যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মজুরি কম, সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন দেশে আর্থিকভাবে মানিয়ে নেওয়া একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এটি তাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে তারা ভালো গ্রেড অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে কিনা, সেখানে তাদেরকে পড়ার ব্যয়ভার বহন করতে অর্থ উপার্জনের পিছনে ছুটতে হয়। এই সবগুলিই শিক্ষার্থীর কাঁধে অতিরিক্ত চাপ। সুতরাং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উদযাপনে শিক্ষার্থীদেরকে এ বিষয়ের প্রতি সচেতনতা তৈরি করা উচিত।
তাই এ দিনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সমর্থন ও সম্মান দেখান এবং তাদের এই দিনটি সম্পর্কে সচেতন করুন যাতে তারা আন্তর্জাতিক ছাত্র দিবসে এটিকে ছড়িয়ে দিতে এবং উপভোগ করতে পারে। এই দিনে শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি উদযাপন করে এবং এর সাথে সাথে তারা কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে, যেখানে তারা নিজেদের উন্নতির বিষয় নিয়ে কথা বলে এবং নানাবিধ সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। সেখানে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নির্দেশনাও রয়েছে। সুতরাং দিনটি উদযাপন করতে আমাদের শিক্ষার্থীদের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা কর্তব্যঃ
• বিশ্ব শিক্ষার্থী দিবস হল বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বহুসংস্কৃতি, বৈচিত্র্য এবং সহযোগিতার উদযাপন। শিক্ষার্থীরা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজগুলি প্রদর্শন করে শিক্ষাঙ্গনে একত্রিত হয়ে তাদের পারস্পরিক সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা আলোচনার আয়োজন করতে পারে।
• শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিশ্যত ক্যারিয়ার কিভাবে তৈরি করবে, তাদের জীবন কিভাবে কাটবে বা তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করে তারা দেশের জন্য কি করতে পারবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারে। তাদের শিক্ষা যেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে এগিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে সেদিকে একটি দিক নির্দেশনা প্রস্তুত করতে পারে।
• পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার ভূমিকা তুলে ধরে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে। শিক্ষাই সকলে সফলতার সোপান এবং শিক্ষাই দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান মাধ্যম, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে।
• এটি ঐতিহ্যগতভাবে ধারণ করা বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছে যে, শিক্ষকতা সব পেশার মধ্যে সবচেয়ে মহৎ এবং আগামী দিনের নাগরিক তৈরির বিশাল দায়িত্ব কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য শিক্ষকদের সমর্থন অতি প্রয়োজন। এ দিবস উপলক্ষ্যে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকদের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনের দীক্ষা গ্রহন করতে হবে।
• শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা সামাজিক আঙ্গিনায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে নানাবিধ ক্যাম্পেইন ও জাগরণ তৈরি করতে হবে। সকলের মাঝে এ বার্তা পৌঁছাতে হবে যে, তাদের জীবনকে উন্নত করার একমাত্র উপায় হল শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমেই সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী থেকে শিশুদেরকে সমাজের মূল স্রোতের অংশ হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
• শিক্ষার প্রতি জনমত গঠন করে শিক্ষার্থীদেরকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। এ দিবসে এ সত্যটি তুলে ধরতে হবে যে উন্নত জীবন ও ভালোভাবে বেচে থাকতে সুন্দর স্বাস্থ্যের কোন বিকল্প নেই।
• আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সামাজিক সম্প্রীতি অর্জনের জন্য পারস্পরিক ভেদাভেদ ভূলে গিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ তৈরি করা শিক্ষার্থীদের নৈতিক দ্বায়িত্ব। এলক্ষ্যে আমাদের শিক্ষকদেরকে ধন্যবাদ জানাতে হবে যে তারা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে সে পথেই পরিচালিত করছেন।
• দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষার্থীদেরকে জাগিয়ে তোলার এক মহান ব্রত পালন করতে হবে এ দিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এ মেরুদন্ডকে শক্ত করে দেশ সেবার মহান আদর্শ আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে ধারণ করতে হবে।
• আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে তাদেরকে পারস্পরিক সোহাগ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসাপূর্ণ শুভেচ্ছা পাঠানো যেতে পারে। এ দিবস পালনের মাধ্যমে সবাইকে এ মর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যে শিক্ষার্থীরা সবাই এক ও লক্ষ্য অর্জনে সকলে অভিন্ন। কিভাবে একে অন্যকে সাহায্য করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া হতে পারে এ দিবসের আরেকটি উদ্দেশ্য।
• শিক্ষা কেবল নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, এটি মানুষ, প্রকৃতি ও পশুপাখির স্বার্থ রক্ষাও একটি বড় কাজ। শিক্ষার্থীদেরকে এ শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে যে তাদের শিক্ষা যেন সকলের কল্যানে ব্যবহৃত হতে পারে। দেশের সম্পদ সংরক্ষণ, সমৃদ্ধি অর্জন এবং গোটা পৃথিবীর সুখ-শান্তি রক্ষার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরকে মনোনিবেশ করতে হবে।
মোটকথা, বছর ঘুরে যখন ১৭ নভেম্বর আবার আমাদের শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থিত হয় নতুন কোন থিম নিয়ে, তখন শিক্ষার্থিদেরকে জাগিয়ে তোলে নতুন কোন প্রতিজ্ঞা পূরণে। ২০২১ এর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবসও এসেছে এমন এক শান্তি ও সম্মৃদ্ধির বার্তা নিয়ে। তাই, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে শিক্ষার্থীদেরকে যুগোপযোগী তথ্য-প্রযুক্তি ও কলা-কৌশলে এগিয়ে আসতে হবে, যা জাতির কল্যানে বয়ে আনতে পারে এক ঐতিহ্যবাহী উন্নয়ন। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সারা বিশ্বে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা যেন দ্রুত পুষিয়ে আনা যায় সেদিকে আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরকে আরো বেশি দ্বায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আজকের শিক্ষার্থী আমাদের আগামীর ভবিশ্যত। সুতরাং শিক্ষার্থীদেরকে সযত্নে লালন করা, তাদের পড়া-লেখার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা, তাদেরকে বহুজাতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিক্ষার্থীদেরকে আদর্শের উজ্জ্বল মূর্ত প্রতিক হওয়ার কাজে দীক্ষিত হওয়াই হোক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উদযাপনের অন্যতম শিক্ষা - এটি মোদের প্রার্থনা।
[লেখক:প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক]
মাহমুদুল হাছান
মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ২০২১
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস বিশ্বের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। দিনটি উদযাপনের পিছনে রয়েছে বহু সাধনা ও আত্মত্যাগ। ১৯৩৯ সালের শেষদিকে স্বাধীন চেকোস্লোভাকিয়া প্রজাতন্ত্রের দাবিতে ও জান অপলেটাল এবং শ্রমিক ভ্যাক্লাভ সেদেলেকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ নভেম্বর বিক্ষোভ জমায়েত কর্মসূচী গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হলে জার্মান নাৎসি বাহিনী সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘিরে ফেলে নয় জন ছাত্রনেতা ও প্রফেসরকে হত্যা করে এবং ১২০০ ছাত্রকে শচসেনহাউসনে (Sachsenhausen) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে সেখানে বন্দি করে রাখে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে ছাত্রদের সংগ্রামী মানসিকতাকে কুর্ণিশ করার জন্য এবং আরও নানা ক্ষেত্রে তাদের কর্মতৎপরতা, প্রতিভা ও মেধাকে সম্মান জানানোর জন্যই মূলত এ দিবসটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। ১৯৪১ সালে লন্ডনের আন্তর্জাতিক ছাত্র সংস্থা এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ১৭ নভেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই বিশেষ দিনটিতে ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন সভা-সম্মেলনের আয়োজন করে বিভিন্নরকম প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে এ দিনে। এমনকি খাদ্য, পানীয় সহযোগে উৎসবের আয়োজনও করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাত্র দিবস কেন্দ্রিক লেখালেখি কিংবা ছবির সাহায্যে এই দিনটি সম্পর্কে নানা তথ্য জানানো হয় জনসাধারণকে এবং দিনটির গুরুত্ব কতখানি সে বিষয়েও মানুষকে সচেতন করে তোলা হয়। বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র ও গ্রিসে দিনটি জাতীয় ছুটির দিন হিসাবেও পালিত হয়।
শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ। দেশ ও জাতির যে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন ও স্বাধিকার অর্জনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষালাভের জন্য বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে যে পরিশ্রম এবং লড়াই করতে হয়, অবশেষে তা দেশের উন্নতিতেই কাজে লাগে। পড়াশুনার জন্য পদে পদে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় কত ছাত্রকে। এ সংগ্রাম সাধনা ছাত্রজীবনের সঙ্গে একীভূত হয়ে আছে। এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, অন্যায়ের প্রতিবাদে ছাত্রদের সক্রিয় অবদানের কথাও উল্লেখযোগ্য।
এই বছর আন্তর্জাতিক ছাত্র দিবস-২০২১ এর থিম বা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল "মানুষ, উদ্ভিদ, সমৃদ্ধি এবং শান্তির জন্য শিক্ষা" (Learning for People, Plant, Prosperity and Peace)। এ থিমের পিছনে উদ্দেশ্য হলো; সমস্ত ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করা যাতে তারা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারে এবং কেন্দ্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস আমাদের জন্য বিশ্বের শিক্ষার্থীদের সম্মান জানানোর উপযুক্ত সুযোগ। বিশ্বের সব কোণ থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মজীবনের লক্ষ্য অর্জন এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন করতে কঠোর পরিশ্রম করে থাকে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের পরিবার ত্যাগ করে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জায়গা পেতে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করে, যা তাদের একটি উন্নত জীবন পেতে এবং তাদের প্রিয়জনদের জন্য সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এটি এমন কিছু যা আমাদের অবশ্যই সম্মান করা এবং উদযাপন করা উচিত।
যদিও ছাত্রজীবন প্রত্যেকের জন্য কঠিন, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে আন্তর্জাতিক ছাত্ররা বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে রয়েছে হোমসিকনেস, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, মুদ্রার পার্থক্য, আর্থিক সমস্যা এবং ভাষা প্রয়োগ প্রতিবন্ধকতা। যেখানে অনেক স্থানীয় শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনায় এবং নতুন বন্ধু তৈরিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়, সেখানে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের নানাবিধ বাধা অতিক্রম করতে হয়। যখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের দেখতে বাড়িতে যেতে সক্ষম হয়, তখন বিদেশী শিক্ষার্থীদের এই বিলাসিতা থাকে না। এছাড়াও, অনেক স্থানীয় শিক্ষার্থী ছাত্র ঋণ এবং অনুদানের আকারে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে, যা প্রবাসী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা পাওয়া সম্ভব হয় না। আবার কিছু দেশে যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মজুরি কম, সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন দেশে আর্থিকভাবে মানিয়ে নেওয়া একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এটি তাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে তারা ভালো গ্রেড অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে কিনা, সেখানে তাদেরকে পড়ার ব্যয়ভার বহন করতে অর্থ উপার্জনের পিছনে ছুটতে হয়। এই সবগুলিই শিক্ষার্থীর কাঁধে অতিরিক্ত চাপ। সুতরাং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উদযাপনে শিক্ষার্থীদেরকে এ বিষয়ের প্রতি সচেতনতা তৈরি করা উচিত।
তাই এ দিনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সমর্থন ও সম্মান দেখান এবং তাদের এই দিনটি সম্পর্কে সচেতন করুন যাতে তারা আন্তর্জাতিক ছাত্র দিবসে এটিকে ছড়িয়ে দিতে এবং উপভোগ করতে পারে। এই দিনে শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি উদযাপন করে এবং এর সাথে সাথে তারা কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে, যেখানে তারা নিজেদের উন্নতির বিষয় নিয়ে কথা বলে এবং নানাবিধ সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। সেখানে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নির্দেশনাও রয়েছে। সুতরাং দিনটি উদযাপন করতে আমাদের শিক্ষার্থীদের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা কর্তব্যঃ
• বিশ্ব শিক্ষার্থী দিবস হল বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বহুসংস্কৃতি, বৈচিত্র্য এবং সহযোগিতার উদযাপন। শিক্ষার্থীরা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজগুলি প্রদর্শন করে শিক্ষাঙ্গনে একত্রিত হয়ে তাদের পারস্পরিক সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা আলোচনার আয়োজন করতে পারে।
• শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিশ্যত ক্যারিয়ার কিভাবে তৈরি করবে, তাদের জীবন কিভাবে কাটবে বা তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করে তারা দেশের জন্য কি করতে পারবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারে। তাদের শিক্ষা যেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে এগিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে সেদিকে একটি দিক নির্দেশনা প্রস্তুত করতে পারে।
• পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার ভূমিকা তুলে ধরে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে। শিক্ষাই সকলে সফলতার সোপান এবং শিক্ষাই দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান মাধ্যম, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে।
• এটি ঐতিহ্যগতভাবে ধারণ করা বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছে যে, শিক্ষকতা সব পেশার মধ্যে সবচেয়ে মহৎ এবং আগামী দিনের নাগরিক তৈরির বিশাল দায়িত্ব কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য শিক্ষকদের সমর্থন অতি প্রয়োজন। এ দিবস উপলক্ষ্যে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকদের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনের দীক্ষা গ্রহন করতে হবে।
• শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা সামাজিক আঙ্গিনায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে নানাবিধ ক্যাম্পেইন ও জাগরণ তৈরি করতে হবে। সকলের মাঝে এ বার্তা পৌঁছাতে হবে যে, তাদের জীবনকে উন্নত করার একমাত্র উপায় হল শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমেই সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী থেকে শিশুদেরকে সমাজের মূল স্রোতের অংশ হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
• শিক্ষার প্রতি জনমত গঠন করে শিক্ষার্থীদেরকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। এ দিবসে এ সত্যটি তুলে ধরতে হবে যে উন্নত জীবন ও ভালোভাবে বেচে থাকতে সুন্দর স্বাস্থ্যের কোন বিকল্প নেই।
• আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সামাজিক সম্প্রীতি অর্জনের জন্য পারস্পরিক ভেদাভেদ ভূলে গিয়ে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ তৈরি করা শিক্ষার্থীদের নৈতিক দ্বায়িত্ব। এলক্ষ্যে আমাদের শিক্ষকদেরকে ধন্যবাদ জানাতে হবে যে তারা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে সে পথেই পরিচালিত করছেন।
• দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষার্থীদেরকে জাগিয়ে তোলার এক মহান ব্রত পালন করতে হবে এ দিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এ মেরুদন্ডকে শক্ত করে দেশ সেবার মহান আদর্শ আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে ধারণ করতে হবে।
• আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে তাদেরকে পারস্পরিক সোহাগ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসাপূর্ণ শুভেচ্ছা পাঠানো যেতে পারে। এ দিবস পালনের মাধ্যমে সবাইকে এ মর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যে শিক্ষার্থীরা সবাই এক ও লক্ষ্য অর্জনে সকলে অভিন্ন। কিভাবে একে অন্যকে সাহায্য করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া হতে পারে এ দিবসের আরেকটি উদ্দেশ্য।
• শিক্ষা কেবল নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, এটি মানুষ, প্রকৃতি ও পশুপাখির স্বার্থ রক্ষাও একটি বড় কাজ। শিক্ষার্থীদেরকে এ শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে যে তাদের শিক্ষা যেন সকলের কল্যানে ব্যবহৃত হতে পারে। দেশের সম্পদ সংরক্ষণ, সমৃদ্ধি অর্জন এবং গোটা পৃথিবীর সুখ-শান্তি রক্ষার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরকে মনোনিবেশ করতে হবে।
মোটকথা, বছর ঘুরে যখন ১৭ নভেম্বর আবার আমাদের শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থিত হয় নতুন কোন থিম নিয়ে, তখন শিক্ষার্থিদেরকে জাগিয়ে তোলে নতুন কোন প্রতিজ্ঞা পূরণে। ২০২১ এর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবসও এসেছে এমন এক শান্তি ও সম্মৃদ্ধির বার্তা নিয়ে। তাই, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে শিক্ষার্থীদেরকে যুগোপযোগী তথ্য-প্রযুক্তি ও কলা-কৌশলে এগিয়ে আসতে হবে, যা জাতির কল্যানে বয়ে আনতে পারে এক ঐতিহ্যবাহী উন্নয়ন। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সারা বিশ্বে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা যেন দ্রুত পুষিয়ে আনা যায় সেদিকে আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরকে আরো বেশি দ্বায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আজকের শিক্ষার্থী আমাদের আগামীর ভবিশ্যত। সুতরাং শিক্ষার্থীদেরকে সযত্নে লালন করা, তাদের পড়া-লেখার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা, তাদেরকে বহুজাতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিক্ষার্থীদেরকে আদর্শের উজ্জ্বল মূর্ত প্রতিক হওয়ার কাজে দীক্ষিত হওয়াই হোক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উদযাপনের অন্যতম শিক্ষা - এটি মোদের প্রার্থনা।
[লেখক:প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক]