alt

মুক্ত আলোচনা

শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

শারফুদ্দিন আহমেদ

: বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২১

শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ বাংলাদেশের দক্ষিণের বিভাগীয় শহর বরিশাল এর দক্ষিণ আলেকান্দা এলাকায় অবস্থিত চিকিৎসা বিষয়ক উচ্চ শিক্ষা দানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। সরাসরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়; যা বর্তমানে দেশের একটি অন্যতম প্রধান চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি পুরানো আটটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে অন্যতম।

১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর থেকে এই মেডিক্যাল কলেজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে এতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। স্থাপনকালীন এর নাম ছির বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ যা পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে বরিশালের মহান নেতা শের-ই-বাংলা (বাংলার বাঘ) নামে খ্যাত আবুল কাশেম ফজলুল হকের নামে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ নামকরণ করা হয়। এদেশের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা এবং জনগণের স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক উন্নতিকল্পে দক্ষিণ বাংলার আপামর জনসাধারণের জন্য নির্মিত বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ আজ থেকে ৫৩ বছর আগে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু করে। শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয় জনসেবা আর সমাজ বিনির্মাণেও এই মেডিক্যাল কলেজের আছে অসামান্য ইতিহাস। ৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯৬ এর ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং ১/১১ পরবর্তী সকল গণ অসন্তোষ্ট ও আন্দোলন সমূহে এই মেডিক্যাল কলেজের ও এখানে অধ্যায়নরত অনেক ছাত্রছাত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা সর্বজন বিদিত।

মাত্র ৫০ জন ছাত্র নিয়ে যে মেডিক্যাল এর যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে এখন প্রতিবছর দুইশত এর অধিক ছাত্র-ছাত্রী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়। এই বিদ্যাপিঠ হতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে প্রায় ১০০০ চিকিৎসক দেশ বিদেশে কর্মরত আছে। প্রায় ২৫০০ চিকিৎসক স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে দেশ বিদেশে শিক্ষকতায় ও গবেষণায় জড়িত আছে। সামগ্রিকভাবে এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে যে পরিমাণ মানসম্পন্ন চিকিৎসক প্রয়োজন তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই মেডিক্যাল কলেজ থেকে উঠে আসে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের কথা চিন্তা করে দেশব্যাপী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করে মানুষের মৌলিক অধিকার তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি তিনি চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণীতে উন্নতি করে তাদের মর্যাদাকে আরও উপর পর্যায়ে নিয়ে যান। পিতার পদাংক অনুসরণ করে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছেন তা দেশের মধ্যে ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশংসা অর্জন করে ও অনেক দেশে এটা মডেল হিসেবে গৃহিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার পাঁচশত কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে।

প্রতিটি ডাক্তারের জীবনে তার মেডিক্যাল ক্যাম্পাস যেন তার আঁতুড়ঘর। সেই ঘরে তার জন্ম হয়, তারপর একদিন হয়ত স্ফুলিঙ্গের মত উড়ে যায়। আরও বিশাল থেকে বিশালতার ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই ঘরের গন্ধ আলো বাতাস আর ভালবাসা সে বয়ে বেড়ায়। সময় বাড়ে, চামড়া ঝুলে পড়ে, চুলে পাক ধরে, অনুভূতি আরো প্রগাঢ় হয়। আমৃত্যু ভালবাসার এ জাল ছিন্ন হয় না।

জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দময় সময় পার করেছি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৭৫ সালে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হই।

অসাবধানে শুরুতেই একটি ভুল করি। বাবা যাবার সময় বললেন পানির দেশে গিয়ে বিপদে পড়বো কিনা। আমি বলে ফেলি সমস্যা হবে না। আমি কি আর ছোট আছি নাকি? বাবা মাইন্ড করলেন, বুঝতে পারলাম। তখন বুঝিনি এখন বুঝতে পারি ছেলে-মেয়ে যত বড়ই হোক না কেন মা-বাবার কাছে কখনোই বড় হয় না।

বরিশাল মেডিক্যাল গিয়ে দেখি বিশাল দালান কোঠা। কোনটার কাজ তখনও শেষ হয়নি। কোথায় যাই, কার কাছে যাই। আমাকে রিসিভ করলেন তখনকার সেক্রেটারী। বললেন সিনিয়র কারও সাথে শেয়ারে থাকতে। কর্ণেল আনোয়ার আমার রুমমেট ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হয়ে অবসর গ্রহন করেন। অনেক ভাল ভাল শিক্ষকের সান্নিধ্য পাই। যেমন সিদ্দিকুল্লাহ স্যার, নায়েব আলী স্যার, শাহ আবদুর রহমান স্যার, আমিনুল আসলাম স্যার, আনিস স্যার, আজিজুর রহমান স্যার (গাইনী), এনাটমির ক্যাপ্টেন সিরাজুল ইসলাম ও ইউনুস আলী স্যার প্রমুখ।

একবার ময়মনসিংহে এডুকেশনের উপর সেমিনার হবে। প্রতি ব্যাচ থেকে একজন করে প্রতিনিধি যাবে। সিদ্দিকুল্লাহ স্যার কেনো জানি আমাকে সিলেক্ট করলেন। পরে আমি অবশ্য হারুন স্যারের কাছে কার্ড ফাইনালে অনার্স পাই। ইয়াং শিক্ষকরা আমাদের খুব ভালবাসতেন। লুৎফর রহমান এবং অর্থোপেডিকসের মোর্শেদ সাহেব লেকচারার ছিলেন। লুৎফর রহমান সাহেব এডিজি হয়ে রিটায়ার করেন।

হোস্টেল ডাইনিং এর পাতলা ডাল, ভর্তা আর মোল্লার কেন্টিনের নাস্তা পরোটা, ডিম ভাজি মনে পড়ে। মোল্লা সাহেব আর বেঁচে নেই কিন্তু তার চেহারা এখনও মনে পড়ে। আরেকটা আকর্ষন ছিল হোস্টেলের মাসিক ফিস্ট। বেশ ভাল ভাল খাবার থাকত ফিস্টে। শেষ হত মিষ্টি আর পান দিয়ে। আমরা এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।

আবদুর রহমান স্যার আর আমিনুল ইসলাম স্যারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে পড়াতেন আর প্রতি পনের মিনিট পর পর ছোট একটি জোক বলতেন যাতে ছাত্ররা বোরিং ফিল না করে। বর্তমানে আমিও ক্লাস নিতে এ প্রাকটিস করি। বক্তৃতা দিতাম। সবাই আমার বক্তৃতা পছন্দ করত। একদিন হয়েছে কি আমার বক্তৃতার পর আর কেউ বক্তৃতা দিচ্ছেনা। তখন হালিম সাইদা নামের আমার ক্লাসমেট বক্তৃতা দিলে সবাই বলল মহিলা শারফুদ্দিন বক্তৃতা দিচ্ছে।

আমরা খেলাধুলা করতাম। দৌড়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে একমাত্র সমাজ কল্যাণ সম্পাদক হলাম। টি.আই.এম.এ. ফারুক ভাইয়ের উদ্যোগে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতি প্রায় সারা বছর সক্রিয় থাকত। তিনি বিসিপিএস এর সেক্রেটারীরও দায়িত্ব পালন করেছেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। প্রতি বছর ইফতার মাহফিল, ঈদ পুনর্মিলনী এবং পিকনিক হয়। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের অনেক পরের ব্যাচের ছাত্ররা এলেও দলমত নির্বিশেষে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। সবার সহযোগিতায় প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ট্রাস্ট করেছে। এখানে সবার সদস্য হওয়া উচিত। যেকোন সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করতে হবে। ঐক্যের বিকল্প নাই।

স্মৃতির আয়নায় যখন সেই সময়ে নিজের অবয়ব দেখতে পাই বুকের ভিতর ব্যাখ্যাতীত এক আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।

শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে থেকে পাশ করা চিকিৎসক, যিনি দেশে বা বিদেশে আছেন তাঁরা সকলেই সুনামের সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল, ভাইস চ্যান্সেলর, ডাইরেক্টর সহ ডিন ও চেয়ারম্যান হিসাবে অনেকেই দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসাবে এই মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় আমি গর্বিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবেও এই মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। চক্ষু চিকিৎসক সমিতি, অর্থোপেডিক্স, গাইনী, সার্জারী, ইএনটি ও বিসিপিএস সহ বিভিন্ন এসোসিয়েশন ও সোসাইটিতে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকবৃন্দ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এই মেডিক্যাল কলেজের একজন হিসাবে পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আজকের এই মহান মিলনমেলায় আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে এই মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকগণ অধিকহারে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজে তাদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করবেন।

কত আনন্দ বেদনা সুখ দুঃখের সাথে মিশে আছে এই ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসে কাটানো সেই সোনালী দিনগুলোয় কী এক মায়া জড়িয়ে আছে। অমলিন সেই স্মৃতি হৃদয়ের মনিকোঠায় জাগ্রত থাকবে আমৃত্যু।

[লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

শারফুদ্দিন আহমেদ

বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২১

শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ বাংলাদেশের দক্ষিণের বিভাগীয় শহর বরিশাল এর দক্ষিণ আলেকান্দা এলাকায় অবস্থিত চিকিৎসা বিষয়ক উচ্চ শিক্ষা দানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। সরাসরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়; যা বর্তমানে দেশের একটি অন্যতম প্রধান চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি পুরানো আটটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে অন্যতম।

১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর থেকে এই মেডিক্যাল কলেজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে এতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। স্থাপনকালীন এর নাম ছির বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ যা পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে বরিশালের মহান নেতা শের-ই-বাংলা (বাংলার বাঘ) নামে খ্যাত আবুল কাশেম ফজলুল হকের নামে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ নামকরণ করা হয়। এদেশের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা এবং জনগণের স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক উন্নতিকল্পে দক্ষিণ বাংলার আপামর জনসাধারণের জন্য নির্মিত বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ আজ থেকে ৫৩ বছর আগে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু করে। শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয় জনসেবা আর সমাজ বিনির্মাণেও এই মেডিক্যাল কলেজের আছে অসামান্য ইতিহাস। ৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯৬ এর ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং ১/১১ পরবর্তী সকল গণ অসন্তোষ্ট ও আন্দোলন সমূহে এই মেডিক্যাল কলেজের ও এখানে অধ্যায়নরত অনেক ছাত্রছাত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা সর্বজন বিদিত।

মাত্র ৫০ জন ছাত্র নিয়ে যে মেডিক্যাল এর যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে এখন প্রতিবছর দুইশত এর অধিক ছাত্র-ছাত্রী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়। এই বিদ্যাপিঠ হতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে প্রায় ১০০০ চিকিৎসক দেশ বিদেশে কর্মরত আছে। প্রায় ২৫০০ চিকিৎসক স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে দেশ বিদেশে শিক্ষকতায় ও গবেষণায় জড়িত আছে। সামগ্রিকভাবে এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে যে পরিমাণ মানসম্পন্ন চিকিৎসক প্রয়োজন তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই মেডিক্যাল কলেজ থেকে উঠে আসে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের কথা চিন্তা করে দেশব্যাপী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করে মানুষের মৌলিক অধিকার তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি তিনি চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণীতে উন্নতি করে তাদের মর্যাদাকে আরও উপর পর্যায়ে নিয়ে যান। পিতার পদাংক অনুসরণ করে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছেন তা দেশের মধ্যে ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশংসা অর্জন করে ও অনেক দেশে এটা মডেল হিসেবে গৃহিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার পাঁচশত কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে।

প্রতিটি ডাক্তারের জীবনে তার মেডিক্যাল ক্যাম্পাস যেন তার আঁতুড়ঘর। সেই ঘরে তার জন্ম হয়, তারপর একদিন হয়ত স্ফুলিঙ্গের মত উড়ে যায়। আরও বিশাল থেকে বিশালতার ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই ঘরের গন্ধ আলো বাতাস আর ভালবাসা সে বয়ে বেড়ায়। সময় বাড়ে, চামড়া ঝুলে পড়ে, চুলে পাক ধরে, অনুভূতি আরো প্রগাঢ় হয়। আমৃত্যু ভালবাসার এ জাল ছিন্ন হয় না।

জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দময় সময় পার করেছি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৭৫ সালে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হই।

অসাবধানে শুরুতেই একটি ভুল করি। বাবা যাবার সময় বললেন পানির দেশে গিয়ে বিপদে পড়বো কিনা। আমি বলে ফেলি সমস্যা হবে না। আমি কি আর ছোট আছি নাকি? বাবা মাইন্ড করলেন, বুঝতে পারলাম। তখন বুঝিনি এখন বুঝতে পারি ছেলে-মেয়ে যত বড়ই হোক না কেন মা-বাবার কাছে কখনোই বড় হয় না।

বরিশাল মেডিক্যাল গিয়ে দেখি বিশাল দালান কোঠা। কোনটার কাজ তখনও শেষ হয়নি। কোথায় যাই, কার কাছে যাই। আমাকে রিসিভ করলেন তখনকার সেক্রেটারী। বললেন সিনিয়র কারও সাথে শেয়ারে থাকতে। কর্ণেল আনোয়ার আমার রুমমেট ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হয়ে অবসর গ্রহন করেন। অনেক ভাল ভাল শিক্ষকের সান্নিধ্য পাই। যেমন সিদ্দিকুল্লাহ স্যার, নায়েব আলী স্যার, শাহ আবদুর রহমান স্যার, আমিনুল আসলাম স্যার, আনিস স্যার, আজিজুর রহমান স্যার (গাইনী), এনাটমির ক্যাপ্টেন সিরাজুল ইসলাম ও ইউনুস আলী স্যার প্রমুখ।

একবার ময়মনসিংহে এডুকেশনের উপর সেমিনার হবে। প্রতি ব্যাচ থেকে একজন করে প্রতিনিধি যাবে। সিদ্দিকুল্লাহ স্যার কেনো জানি আমাকে সিলেক্ট করলেন। পরে আমি অবশ্য হারুন স্যারের কাছে কার্ড ফাইনালে অনার্স পাই। ইয়াং শিক্ষকরা আমাদের খুব ভালবাসতেন। লুৎফর রহমান এবং অর্থোপেডিকসের মোর্শেদ সাহেব লেকচারার ছিলেন। লুৎফর রহমান সাহেব এডিজি হয়ে রিটায়ার করেন।

হোস্টেল ডাইনিং এর পাতলা ডাল, ভর্তা আর মোল্লার কেন্টিনের নাস্তা পরোটা, ডিম ভাজি মনে পড়ে। মোল্লা সাহেব আর বেঁচে নেই কিন্তু তার চেহারা এখনও মনে পড়ে। আরেকটা আকর্ষন ছিল হোস্টেলের মাসিক ফিস্ট। বেশ ভাল ভাল খাবার থাকত ফিস্টে। শেষ হত মিষ্টি আর পান দিয়ে। আমরা এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।

আবদুর রহমান স্যার আর আমিনুল ইসলাম স্যারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে পড়াতেন আর প্রতি পনের মিনিট পর পর ছোট একটি জোক বলতেন যাতে ছাত্ররা বোরিং ফিল না করে। বর্তমানে আমিও ক্লাস নিতে এ প্রাকটিস করি। বক্তৃতা দিতাম। সবাই আমার বক্তৃতা পছন্দ করত। একদিন হয়েছে কি আমার বক্তৃতার পর আর কেউ বক্তৃতা দিচ্ছেনা। তখন হালিম সাইদা নামের আমার ক্লাসমেট বক্তৃতা দিলে সবাই বলল মহিলা শারফুদ্দিন বক্তৃতা দিচ্ছে।

আমরা খেলাধুলা করতাম। দৌড়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে একমাত্র সমাজ কল্যাণ সম্পাদক হলাম। টি.আই.এম.এ. ফারুক ভাইয়ের উদ্যোগে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতি প্রায় সারা বছর সক্রিয় থাকত। তিনি বিসিপিএস এর সেক্রেটারীরও দায়িত্ব পালন করেছেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। প্রতি বছর ইফতার মাহফিল, ঈদ পুনর্মিলনী এবং পিকনিক হয়। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের অনেক পরের ব্যাচের ছাত্ররা এলেও দলমত নির্বিশেষে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। সবার সহযোগিতায় প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ট্রাস্ট করেছে। এখানে সবার সদস্য হওয়া উচিত। যেকোন সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করতে হবে। ঐক্যের বিকল্প নাই।

স্মৃতির আয়নায় যখন সেই সময়ে নিজের অবয়ব দেখতে পাই বুকের ভিতর ব্যাখ্যাতীত এক আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।

শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজে থেকে পাশ করা চিকিৎসক, যিনি দেশে বা বিদেশে আছেন তাঁরা সকলেই সুনামের সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল, ভাইস চ্যান্সেলর, ডাইরেক্টর সহ ডিন ও চেয়ারম্যান হিসাবে অনেকেই দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসাবে এই মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় আমি গর্বিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবেও এই মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। চক্ষু চিকিৎসক সমিতি, অর্থোপেডিক্স, গাইনী, সার্জারী, ইএনটি ও বিসিপিএস সহ বিভিন্ন এসোসিয়েশন ও সোসাইটিতে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকবৃন্দ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এই মেডিক্যাল কলেজের একজন হিসাবে পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আজকের এই মহান মিলনমেলায় আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে এই মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকগণ অধিকহারে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজে তাদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করবেন।

কত আনন্দ বেদনা সুখ দুঃখের সাথে মিশে আছে এই ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসে কাটানো সেই সোনালী দিনগুলোয় কী এক মায়া জড়িয়ে আছে। অমলিন সেই স্মৃতি হৃদয়ের মনিকোঠায় জাগ্রত থাকবে আমৃত্যু।

[লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top