জ্যোতির্ময় ধর
কাপট্যবর্জিত মানবতাবাদী বাঙালি ভাবুকদের সারিতে কাজী আবদুল ওদুদ এক স্মরণীয় নাম। র্যাশনালিস্ট পন্ডিত আবদুল ওদুদ সাহিত্যিক ও সমালোচক হিসেবে সে-সময়ে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এই ধরনের ব্যক্তিত্ব সর্বদা যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়। ছাত্রজীবনেই ভারতবর্ষ পত্রিকার চৈত্র ১৩২৩ সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের বিরাজ বৌ উপন্যাসের সমালোচনামূলক প্রবন্ধ “বিরাজ বৌ” (চরিত্রবিবৃতি) প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যপ্রয়াস। ১৯১৮ সালে বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ “মীর পরিবার”, পরের বছর উপন্যাস ‘নদীবক্ষ’। মীর পরিবার পড়ে শরৎচন্দ্র ও শশাঙ্কমোহন সেন লেখককে উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আর নদীবক্ষে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা। ত্রিশ বছর বয়সে লেখা ওদুদের রবীন্দ্রনাথকাব্য পাঠ (১৩৩৩) পুস্তিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন “আমার রচনায় এমন সরস বিচারপূর্ণ সমাদর আর কারো হাতে লাভ করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও ভাষানৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে তা বিস্ময়কর। তোমার মতো পাঠক পাওয়া কবির পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয়।”
ওদুদের রচনার বড় আকর্ষণ বহু বিষয়ে তাঁর অনন্য মৌলিকতা। গতানুগতিক চিন্তাধারার অনুসরণ তিনি করেননি- নুতন করে ভেবেছেন আলোচ্য সব বিষয়েই। ফলে তাঁর রচনা অন্যের চিন্তাকে নাড়া দেয়, ভেঙে দেয় অনেক পূর্বধারণা, পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলে নুতন জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের এ যুগের চিন্তাশীলদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কাজী আবদুল ওদুদের স্থান প্রথম সারিতে। রচনার বৈচিত্র্যে ও গভীরতার দিক দিয়ে প্রবন্ধ-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ এই যুক্তি-বিচারের পথে জ্ঞানচর্চার একটু খানি ‘শিখা’ জ্বালাতে চেয়েছিল এবং এ প্রতিষ্ঠানের মতোই ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। আজকের দিনেও এ আদর্শের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। বুদ্ধি-বিচারকে বিসর্জন দিলে মানুষের অনেক আচরণই পশুর আচরণে গিয়ে ঠেকে। ওদুদের এই ভাবনা-চিন্তা যে কতটা সত্য, তা তো আমরা এখন এদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি।
কাজী আবদুর ওদুদের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার (বর্তমানে রাজবাড়ি জেলার অন্তর্গত) বাগমারা গ্রামে। কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। কাজী আবদুল ওদুদ কয়েকজন ছাত্রের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম হলের ইউনিয়ন কক্ষে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে “মুসিলম সাহিত্য সমাজ” নামের সংগঠনের। নামে “মুসলিম” শব্দটি থাকলেও এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ। এর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন- একজন ভাবুক, অন্যজন কর্মী। মুক্তবুদ্ধিতে চিন্তাচর্চা করতে গিয়ে সাহিত্য-সমাজের ওপর ঝড়-ঝাপটা যা এসেছিল তা এই দুজনকে কেন্দ্র করেই। ঢাকা অবস্থানকালে গল্প-উপন্যাস নাটিকা-প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনা মিলিয়ে আবদুল ওদুদের সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অন্য যাবতীয় গ্রন্থ কলকাতা যাওয়ার পর প্রকাশিত হয়।
বিপরীতধর্মী লেখক কাজী আবদুল ওদুদ যতখানি লেখেন তাঁর অনেক বেশি ভাবেন এবং লিখতে বসার আগেই তিনি সেই ভাবনা সেরে ফেলেন। এভাবে ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভাষাও গড়ে ওঠে, মনে মনেই চলতে থাকে তার মাজাঘষা। তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈলী এভাবেই রূপ গ্রহণ করে এবং তা যে সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব, এ বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহ থাকে না। আশ্চর্য, তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরক্ত পাঠক, রবীন্দ্রনাথের মুক্ত-বুদ্ধি ও সাহিত্যাদর্শের ঘনিষ্ঠ অনুসারী, শুধু রবীন্দ্রনাথের রচনাশৈলী থেকে তাঁর রচনাশৈলী সম্পূর্ণ পৃথক। তবে যে-দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল কাজী আবদুল ওদুদের জীবনদর্শনের বিরোধী। সে কারণে এবং নিজের চিন্তা চর্চার সুবিধার কথা ভেবে নিজের জন্মভূমি পূর্ব বাংলায় তিনি গেলেন না। অথচ এই অঞ্চলের যাদের জন্ম, দুই-একজন বাদে সবাই এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক পেশাজীবী-লেখক-সাংবাদিক অপশন দিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে যান। একমাত্র কন্যা ও দুই পুত্রের একজন তখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু ওদুদ কলকাতা না ছেড়ে আমৃত্যু এখানেই রয়ে গেলেন। শোনা যায় পাকিস্থানের একজন মন্ত্রী তাকে প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে গেলে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে। এই লোভনীয় প্রস্তাবও তাঁকে মোহগ্রস্থ করতে পারেনি। তাঁর প্রজ্ঞা তাঁকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছিল যে পাকিস্থানে তিনি টিকতে পারবেন না। পাকিস্থানে গেলে কবিগুরু গ্যেটে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বাংলার জাগরণ, ইত্যাদি অসামান্য বই লেখা সম্ভব হতো না। এত গল্প, উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক লিখেও যেন রবীন্দ্রনাথ মনের কথা মন খুলে বলতে পারেননি। প্রবন্ধের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যুক্তি-তর্কই প্রবন্ধের প্রাণ, তার জন্য বিচারবুদ্ধি ও মননশীলতা অপরিহার্য। ইউরোপীয় সাহিত্যেও এমন কোন মহৎ ভাবুক নেই, যিনি প্রবন্ধে নিজের মনের ভার লাঘব করতে চাননি। প্রবন্ধ কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্য নয়-পাঠক সংখ্যা চিরকালই বিরল।
ইউরোপের রেনেসাঁস শুধু ইউরোপের নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্যই স্মরণীয়। রেনেসাঁস বা নবজন্মের ফলে জাতীয় মনীষার কিভাবে বন্ধনমুক্তি ঘটে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জার্মান জাতি। তার পরিচয় দিতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর ‘কবিগুরু গ্যেটের’ অবতরণিকায় লিখেছেন-একটা দেশের বা জাতির নবজন্মে, প্রতিবিম্বিত যেন বসন্ত ও বর্ষাব নৈসর্গিক প্রাচুর্য। বসন্তের আগমনে দেখা দেয় গাছে নুতন পাতা, ডালে ডালে লাখো পাখির আনন্দগান, বর্ষায় দেখতে নদী নালা ভরে ওঠে নিরন্তর বর্ষণে ; একটা জাতির নবজন্মকালে তেমনি একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু স্রষ্টার আবির্ভাব ঘটে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে বাঙ্গালি সমাজেও রেনেসাঁস তথা নবজন্মের কিছুটা আভাস দেখা দিয়েছিল। ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল ধর্মান্দোলন তথা শাস্ত্রের নবতর ব্যাখ্যায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, সাহিত্যে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকলায় রবি বর্মা থেকে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা, ইতিহাসে রমেশ দত্ত, যদুনাথ সরকার, রমেশ মজুমদার, রাজনীতিতে ও দর্শনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন শীল, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়- এমনি আরো বহুদিকে।
ওদুদ বিশ্বাস করতেন- বুদ্ধির তথা মনের মুক্তি না ঘটলে অর্থাৎ অন্তরে যদি মানুষ মুক্ত-বুদ্ধি না হয় তাতে যে কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের সহায়ক না হয়ে, হয়ে পড়ে প্রবল বাধা। তাই রেনেসাঁস অর্থাৎ জাগ্রত চিত্ততা চাই। এই রেনেসাঁসের কিছু কিছু কথা আবদুল ওদুদের বিভিন্ন রচনায় রূপ পেয়েছে।
আলোচনার মাধ্যমে কাজী আবদুল ওদুদ বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছিলেন পাঠক সমীপে, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক। এই কৃতিত্বের একটা বড় অংশের দাবিদার তার ‘শ্বশতবঙ্গ’ গ্রন্থখানি। ‘নদীবক্ষে’ (১৯১৮) কাজী আবদুল ওদুদের বিখ্যাত উপন্যাস ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’ (১৯১৮)। রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৯২৭), নবপর্যায়েদ্বিতীয় খন্ড (১৯২৯), সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৯৩৬), আজকার কথা (১৯৪১), কবিগুরু গ্যেটে (১৯৪৬), শ্বশতবঙ্গ (১৯৫১), স্বাধীনতা দানের উপহার (১৯৫১), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-প্রথম খন্ড (১৯৫৫), বাংলার জাগরণ (১৯৫৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৯৬৬), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-দ্বিতীয় খন্ড (১৯৬৯) প্রভৃতি তার প্রকাশিত গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ একখানি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান। লেখক- প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি
[লেখক: প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি]
জ্যোতির্ময় ধর
শনিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২২
কাপট্যবর্জিত মানবতাবাদী বাঙালি ভাবুকদের সারিতে কাজী আবদুল ওদুদ এক স্মরণীয় নাম। র্যাশনালিস্ট পন্ডিত আবদুল ওদুদ সাহিত্যিক ও সমালোচক হিসেবে সে-সময়ে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এই ধরনের ব্যক্তিত্ব সর্বদা যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়। ছাত্রজীবনেই ভারতবর্ষ পত্রিকার চৈত্র ১৩২৩ সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের বিরাজ বৌ উপন্যাসের সমালোচনামূলক প্রবন্ধ “বিরাজ বৌ” (চরিত্রবিবৃতি) প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যপ্রয়াস। ১৯১৮ সালে বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ “মীর পরিবার”, পরের বছর উপন্যাস ‘নদীবক্ষ’। মীর পরিবার পড়ে শরৎচন্দ্র ও শশাঙ্কমোহন সেন লেখককে উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আর নদীবক্ষে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা। ত্রিশ বছর বয়সে লেখা ওদুদের রবীন্দ্রনাথকাব্য পাঠ (১৩৩৩) পুস্তিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন “আমার রচনায় এমন সরস বিচারপূর্ণ সমাদর আর কারো হাতে লাভ করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও ভাষানৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে তা বিস্ময়কর। তোমার মতো পাঠক পাওয়া কবির পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয়।”
ওদুদের রচনার বড় আকর্ষণ বহু বিষয়ে তাঁর অনন্য মৌলিকতা। গতানুগতিক চিন্তাধারার অনুসরণ তিনি করেননি- নুতন করে ভেবেছেন আলোচ্য সব বিষয়েই। ফলে তাঁর রচনা অন্যের চিন্তাকে নাড়া দেয়, ভেঙে দেয় অনেক পূর্বধারণা, পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলে নুতন জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের এ যুগের চিন্তাশীলদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কাজী আবদুল ওদুদের স্থান প্রথম সারিতে। রচনার বৈচিত্র্যে ও গভীরতার দিক দিয়ে প্রবন্ধ-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ এই যুক্তি-বিচারের পথে জ্ঞানচর্চার একটু খানি ‘শিখা’ জ্বালাতে চেয়েছিল এবং এ প্রতিষ্ঠানের মতোই ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। আজকের দিনেও এ আদর্শের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। বুদ্ধি-বিচারকে বিসর্জন দিলে মানুষের অনেক আচরণই পশুর আচরণে গিয়ে ঠেকে। ওদুদের এই ভাবনা-চিন্তা যে কতটা সত্য, তা তো আমরা এখন এদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি।
কাজী আবদুর ওদুদের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার (বর্তমানে রাজবাড়ি জেলার অন্তর্গত) বাগমারা গ্রামে। কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। কাজী আবদুল ওদুদ কয়েকজন ছাত্রের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম হলের ইউনিয়ন কক্ষে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে “মুসিলম সাহিত্য সমাজ” নামের সংগঠনের। নামে “মুসলিম” শব্দটি থাকলেও এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ। এর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন- একজন ভাবুক, অন্যজন কর্মী। মুক্তবুদ্ধিতে চিন্তাচর্চা করতে গিয়ে সাহিত্য-সমাজের ওপর ঝড়-ঝাপটা যা এসেছিল তা এই দুজনকে কেন্দ্র করেই। ঢাকা অবস্থানকালে গল্প-উপন্যাস নাটিকা-প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনা মিলিয়ে আবদুল ওদুদের সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অন্য যাবতীয় গ্রন্থ কলকাতা যাওয়ার পর প্রকাশিত হয়।
বিপরীতধর্মী লেখক কাজী আবদুল ওদুদ যতখানি লেখেন তাঁর অনেক বেশি ভাবেন এবং লিখতে বসার আগেই তিনি সেই ভাবনা সেরে ফেলেন। এভাবে ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভাষাও গড়ে ওঠে, মনে মনেই চলতে থাকে তার মাজাঘষা। তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈলী এভাবেই রূপ গ্রহণ করে এবং তা যে সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব, এ বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহ থাকে না। আশ্চর্য, তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুরক্ত পাঠক, রবীন্দ্রনাথের মুক্ত-বুদ্ধি ও সাহিত্যাদর্শের ঘনিষ্ঠ অনুসারী, শুধু রবীন্দ্রনাথের রচনাশৈলী থেকে তাঁর রচনাশৈলী সম্পূর্ণ পৃথক। তবে যে-দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল কাজী আবদুল ওদুদের জীবনদর্শনের বিরোধী। সে কারণে এবং নিজের চিন্তা চর্চার সুবিধার কথা ভেবে নিজের জন্মভূমি পূর্ব বাংলায় তিনি গেলেন না। অথচ এই অঞ্চলের যাদের জন্ম, দুই-একজন বাদে সবাই এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক পেশাজীবী-লেখক-সাংবাদিক অপশন দিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে যান। একমাত্র কন্যা ও দুই পুত্রের একজন তখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু ওদুদ কলকাতা না ছেড়ে আমৃত্যু এখানেই রয়ে গেলেন। শোনা যায় পাকিস্থানের একজন মন্ত্রী তাকে প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে গেলে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে। এই লোভনীয় প্রস্তাবও তাঁকে মোহগ্রস্থ করতে পারেনি। তাঁর প্রজ্ঞা তাঁকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছিল যে পাকিস্থানে তিনি টিকতে পারবেন না। পাকিস্থানে গেলে কবিগুরু গ্যেটে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বাংলার জাগরণ, ইত্যাদি অসামান্য বই লেখা সম্ভব হতো না। এত গল্প, উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, নাটক লিখেও যেন রবীন্দ্রনাথ মনের কথা মন খুলে বলতে পারেননি। প্রবন্ধের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যুক্তি-তর্কই প্রবন্ধের প্রাণ, তার জন্য বিচারবুদ্ধি ও মননশীলতা অপরিহার্য। ইউরোপীয় সাহিত্যেও এমন কোন মহৎ ভাবুক নেই, যিনি প্রবন্ধে নিজের মনের ভার লাঘব করতে চাননি। প্রবন্ধ কিন্তু জনপ্রিয় সাহিত্য নয়-পাঠক সংখ্যা চিরকালই বিরল।
ইউরোপের রেনেসাঁস শুধু ইউরোপের নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্যই স্মরণীয়। রেনেসাঁস বা নবজন্মের ফলে জাতীয় মনীষার কিভাবে বন্ধনমুক্তি ঘটে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জার্মান জাতি। তার পরিচয় দিতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর ‘কবিগুরু গ্যেটের’ অবতরণিকায় লিখেছেন-একটা দেশের বা জাতির নবজন্মে, প্রতিবিম্বিত যেন বসন্ত ও বর্ষাব নৈসর্গিক প্রাচুর্য। বসন্তের আগমনে দেখা দেয় গাছে নুতন পাতা, ডালে ডালে লাখো পাখির আনন্দগান, বর্ষায় দেখতে নদী নালা ভরে ওঠে নিরন্তর বর্ষণে ; একটা জাতির নবজন্মকালে তেমনি একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু স্রষ্টার আবির্ভাব ঘটে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে বাঙ্গালি সমাজেও রেনেসাঁস তথা নবজন্মের কিছুটা আভাস দেখা দিয়েছিল। ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল ধর্মান্দোলন তথা শাস্ত্রের নবতর ব্যাখ্যায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, সাহিত্যে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকলায় রবি বর্মা থেকে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা, ইতিহাসে রমেশ দত্ত, যদুনাথ সরকার, রমেশ মজুমদার, রাজনীতিতে ও দর্শনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন শীল, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়- এমনি আরো বহুদিকে।
ওদুদ বিশ্বাস করতেন- বুদ্ধির তথা মনের মুক্তি না ঘটলে অর্থাৎ অন্তরে যদি মানুষ মুক্ত-বুদ্ধি না হয় তাতে যে কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের সহায়ক না হয়ে, হয়ে পড়ে প্রবল বাধা। তাই রেনেসাঁস অর্থাৎ জাগ্রত চিত্ততা চাই। এই রেনেসাঁসের কিছু কিছু কথা আবদুল ওদুদের বিভিন্ন রচনায় রূপ পেয়েছে।
আলোচনার মাধ্যমে কাজী আবদুল ওদুদ বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছিলেন পাঠক সমীপে, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক। এই কৃতিত্বের একটা বড় অংশের দাবিদার তার ‘শ্বশতবঙ্গ’ গ্রন্থখানি। ‘নদীবক্ষে’ (১৯১৮) কাজী আবদুল ওদুদের বিখ্যাত উপন্যাস ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’ (১৯১৮)। রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৯২৭), নবপর্যায়েদ্বিতীয় খন্ড (১৯২৯), সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৯৩৬), আজকার কথা (১৯৪১), কবিগুরু গ্যেটে (১৯৪৬), শ্বশতবঙ্গ (১৯৫১), স্বাধীনতা দানের উপহার (১৯৫১), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-প্রথম খন্ড (১৯৫৫), বাংলার জাগরণ (১৯৫৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৯৬৬), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-দ্বিতীয় খন্ড (১৯৬৯) প্রভৃতি তার প্রকাশিত গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ একখানি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান। লেখক- প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি
[লেখক: প্রকৌশলী, জার্মান ইন্সটিটিউট অব অলটারনেটিভ এনার্জির বাংলাদেশ প্রতিনিধি]