আমার চাচাতো ভাই, বড় চাচা কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে। ’৬২ সালে আমরা ঢাকায় আসি এবং একই বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলাম। সে কারণে বড়দা (কাজী আনোয়ার হোসেন) কে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওঁনার অনেক কথা সবাই জানেন না। ১৯ জুলাই, ১৯৩৬ সালে তাঁর জন্ম। আর ১৯শে জানুয়ারি ২০২২ সালে অনন্তের পথে তাঁর যাত্রা।
সব সময়ই কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন কিছুটা ঘরকুনো এবং নিভৃতচারী কিন্তু কাজের বেলায় পারফেকশনিস্ট। ওনার মৃত্যুর পর সারা পৃথিবী থেকে সামাজিক মাধ্যমে এবং আমার কাছে যে শোক বার্তাগুলো এসেছে তার বেশীর ভাগেরই মূল কথা হল- কাজীদার কাছে আমরা ঋণী। প্রায় সবাই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে যখন বিপদে পড়েছিলেন বা আটকে গিয়েছিলেন তখন সেই সমস্যা থেকে তারা মুক্তিলাভ করেছিলেন মাসুদ রানার কথা চিন্তা করে। যখনই কেউ কোন বিপদে পড়েছেন তখন চিন্তা করেছেন মাসুদ রানা এ জায়গায় থাকলে কী করত। এবং এই চিন্তাই তাদের সহযোগিতা করেছে সফল হওয়ার জন্য। আমি জানিনা, মৃত্যুর পর আর কারো জন্য এরকম শোকাবার্তা ও পাঠক সম্মাননা আর কেউ পেয়েছেন কিনা।
শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সংগীত চর্চা করেছেন। বেতারে ও প্লেব্যাকে নিয়মিত গান করেছেন। বেতারে মূলত তিনি নজরুলসংগীত এবং আধুনিক গান পরিবেশন করতেন। সত্যি কথা বলতে, তাঁর সংগীত জগতটি মানুষের কাছে অতটা পরিচিত নয়, যতটা তাঁর লেখক সত্ত্বা।
তিনি ‘সুতরাং ছবিতে ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস বউ কথা কও সুরে যেন ডেকে যায়’ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা এবং সত্য সাহার সুরে এই গানটি গেয়েছিলেন। গানটির অংশবিশেষে আব্দুল আলীমও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে এটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় গান। উর্দু ছবি ‘তালশ’-এ তাঁর গাওয়া ‘ম্যায় হু রিক্সাওয়ালা বেচারা’ গানটিও অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘গোধূলিপ্রেম’ ছবিতে ‘হায় হায় আমায় কেউ চিনলো না’ গানটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
তিনি এক সময় চমৎকার বাঁশী বাজাতেন। স্প্যানিশ গিটারেও সুরের ঝংকার তুলতেন। কিন্তু বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত মহলে সুগায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তিনি বুঝেছিলেন শুধু গান নিয়ে তাঁর বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। তাই তিনি কী করা যায় ভেবে ভেবে বাবার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ধার নিয়ে প্রেস ব্যবসা শুরু করেন। এভাবেই বদলে যায় তাঁর পেশা ও নেশা। কিন্তু এই প্রেস ব্যবসাই তাঁর হাতে যেন লেখনীরও দায়ভার তুলে দিয়েছিল।
১৯৬৬ সালে ‘মাসুদ রানা’র প্রথম ও মৌলিক বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পায় এই বইটি। এরপর তরুণ প্রজন্মের পাঠকের কাছে ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রটি আইকন হয়ে ওঠে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ছয় দশক সময় ধরে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রায় পাঁচশ’ বই প্রকাশিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেন শুধু নিজে লিখে যাননি, তৈরি করেছেন অনেক নতুন লেখক। এই লেখকরাও তাদের লেখনীর জন্য ‘প্রিয় কাজীদা’র কাছে অকপটে ঋণ স্বীকার করেন। ‘মাসুদ রানা’, ‘কুয়াশা’র পাশাপাশি এখান থেকে বেরিয়েছে ধ্রুপদী বিদেশী সাহিত্যের সুলভ অনুবাদ। বিশ্বের সেরা উপন্যাসগুলি চমৎকার অনুবাদের কারণে এদেশের পাঠকরা পেপারব্যাকে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।
কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর বইয়ে যেসব দৃশ্যের বর্ণনা দিতেন তা ছিল নিখুঁত এবং অত্যন্ত সহজেই হৃদয় ছোঁয়া। পাঠক এগুলো পড়তে পড়তে দৃশ্যের ভিতর, বর্ণনার ভিতর এমনভাবে ঢুকে পরে যেন সে নিজেই ওখানে উপস্থিত।
কাজী আনোয়ার হোসেন যেভাবে থ্রিলার সিরিজ বের করে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বই পড়ায় আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন প্রায় ছয় দশক ধরে তা অবশ্যই এদেশের মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর মনে রাখবে।
মঙ্গলবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২২
আমার চাচাতো ভাই, বড় চাচা কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে। ’৬২ সালে আমরা ঢাকায় আসি এবং একই বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলাম। সে কারণে বড়দা (কাজী আনোয়ার হোসেন) কে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওঁনার অনেক কথা সবাই জানেন না। ১৯ জুলাই, ১৯৩৬ সালে তাঁর জন্ম। আর ১৯শে জানুয়ারি ২০২২ সালে অনন্তের পথে তাঁর যাত্রা।
সব সময়ই কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন কিছুটা ঘরকুনো এবং নিভৃতচারী কিন্তু কাজের বেলায় পারফেকশনিস্ট। ওনার মৃত্যুর পর সারা পৃথিবী থেকে সামাজিক মাধ্যমে এবং আমার কাছে যে শোক বার্তাগুলো এসেছে তার বেশীর ভাগেরই মূল কথা হল- কাজীদার কাছে আমরা ঋণী। প্রায় সবাই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে যখন বিপদে পড়েছিলেন বা আটকে গিয়েছিলেন তখন সেই সমস্যা থেকে তারা মুক্তিলাভ করেছিলেন মাসুদ রানার কথা চিন্তা করে। যখনই কেউ কোন বিপদে পড়েছেন তখন চিন্তা করেছেন মাসুদ রানা এ জায়গায় থাকলে কী করত। এবং এই চিন্তাই তাদের সহযোগিতা করেছে সফল হওয়ার জন্য। আমি জানিনা, মৃত্যুর পর আর কারো জন্য এরকম শোকাবার্তা ও পাঠক সম্মাননা আর কেউ পেয়েছেন কিনা।
শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সংগীত চর্চা করেছেন। বেতারে ও প্লেব্যাকে নিয়মিত গান করেছেন। বেতারে মূলত তিনি নজরুলসংগীত এবং আধুনিক গান পরিবেশন করতেন। সত্যি কথা বলতে, তাঁর সংগীত জগতটি মানুষের কাছে অতটা পরিচিত নয়, যতটা তাঁর লেখক সত্ত্বা।
তিনি ‘সুতরাং ছবিতে ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস বউ কথা কও সুরে যেন ডেকে যায়’ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা এবং সত্য সাহার সুরে এই গানটি গেয়েছিলেন। গানটির অংশবিশেষে আব্দুল আলীমও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে এটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় গান। উর্দু ছবি ‘তালশ’-এ তাঁর গাওয়া ‘ম্যায় হু রিক্সাওয়ালা বেচারা’ গানটিও অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘গোধূলিপ্রেম’ ছবিতে ‘হায় হায় আমায় কেউ চিনলো না’ গানটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
তিনি এক সময় চমৎকার বাঁশী বাজাতেন। স্প্যানিশ গিটারেও সুরের ঝংকার তুলতেন। কিন্তু বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত মহলে সুগায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তিনি বুঝেছিলেন শুধু গান নিয়ে তাঁর বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। তাই তিনি কী করা যায় ভেবে ভেবে বাবার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ধার নিয়ে প্রেস ব্যবসা শুরু করেন। এভাবেই বদলে যায় তাঁর পেশা ও নেশা। কিন্তু এই প্রেস ব্যবসাই তাঁর হাতে যেন লেখনীরও দায়ভার তুলে দিয়েছিল।
১৯৬৬ সালে ‘মাসুদ রানা’র প্রথম ও মৌলিক বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ প্রকাশ করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পায় এই বইটি। এরপর তরুণ প্রজন্মের পাঠকের কাছে ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রটি আইকন হয়ে ওঠে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ছয় দশক সময় ধরে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রায় পাঁচশ’ বই প্রকাশিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেন শুধু নিজে লিখে যাননি, তৈরি করেছেন অনেক নতুন লেখক। এই লেখকরাও তাদের লেখনীর জন্য ‘প্রিয় কাজীদা’র কাছে অকপটে ঋণ স্বীকার করেন। ‘মাসুদ রানা’, ‘কুয়াশা’র পাশাপাশি এখান থেকে বেরিয়েছে ধ্রুপদী বিদেশী সাহিত্যের সুলভ অনুবাদ। বিশ্বের সেরা উপন্যাসগুলি চমৎকার অনুবাদের কারণে এদেশের পাঠকরা পেপারব্যাকে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।
কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর বইয়ে যেসব দৃশ্যের বর্ণনা দিতেন তা ছিল নিখুঁত এবং অত্যন্ত সহজেই হৃদয় ছোঁয়া। পাঠক এগুলো পড়তে পড়তে দৃশ্যের ভিতর, বর্ণনার ভিতর এমনভাবে ঢুকে পরে যেন সে নিজেই ওখানে উপস্থিত।
কাজী আনোয়ার হোসেন যেভাবে থ্রিলার সিরিজ বের করে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বই পড়ায় আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন প্রায় ছয় দশক ধরে তা অবশ্যই এদেশের মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর মনে রাখবে।