alt

মুক্ত আলোচনা

নির্মোহ দুই মানুষ

আসফাক বীন রহমান

: বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২

গায়ক জেমসের ‘বাবা কতদিন দেখিনি তোমায় ,বলে না কেউ তোমার মতো খোকা কাছে আয় “গানটির কথার মত আজ আমার অবস্থা । আজ ৩০ জানুয়ারি আমার আব্বা মরহুম আব্দুর রহমান সাহেবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী । মৃত্যুর আগের দিন রাতেও রাত আড়াইটা পর্যন্ত আব্বার সাথে বসে কত আলাপ করেছি ।পরিচিত বিভিন্ন মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে তাদের খবরা-খবর জানতে চেয়েছেন। আব্বা 2000 সালে এলপিআর এ যান মহাপরিচালক (গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ,তথ্য মন্ত্রণালয়) হিসেবে ।শেষ এক থেকে দেড় বছর উনি শুধু একটা ফোন নাম্বার মনে রাখতে পারতেন। আমি বাসার বাইরে কিংবা হাসপাতালে গেলেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরপর আমার খবর নিতেন ,ঠিকমতো পৌঁছেছি কিনা ,বাসার বাবুরা অর্থাৎ আমার ছেলে মেয়েরা কোন দুষ্টামি করছে না ,আমি কখন আসব ।এর আগে উনার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল টেলিফোন ।প্রতিদিন ওনার টেলিফোন ডায়েরি থেকে এক এক করে বিভিন্ন জনকে ফোন করে তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। মাঝে মাঝে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বলতেন ও অনেক কষ্টে আছে চুপ করে এটা পৌঁছে দিও ।হাসপাতালে আমাদের গ্রামের দুঃস্থ কেউ ভর্তি হলে আমাকে তাদের ব্যাপারে ডাক্তারদের সাথে খোঁজখবর করা ,অর্থনৈতিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিতেন ।প্রায় 40 বছর ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ হৃদযন্ত্র এর বাইপাস অপারেশন আব্বাকে যতটুকু কাবু করেছিল ,পারকিনসন রোগ তাঁকে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল করে দেয় ।তারপরও উনার খাবার বাছাই করে খাওয়া এবং মনের জোরে আমরা এবং আমার সিনিয়র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ প্রফেসর তারিফ করতেন।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গেলে উনি সেদিন বাসায় না আসা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকতেন। আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে বলতেন ,জালশুকা- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবাই ভালো আছেতো ? উনি চাকুরী জীবনে সততার সাথে চাকুরী করেছেন। আমরা স্কুল,কলেজ, মেডিকেল জীবনে বিভিন্ন সরকারের সময় উনার সততার পরিচয় দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উনার বন্ধুদের অনেকে বিভিন্ন সরকারে মন্ত্রী, এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ওনাদের মাধ্যমে নিজে লাভবান হবার চেষ্টা করেননি। আমার মনে আছে, এক শুক্রবার সকালে যখন আমরা নাস্তা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন একটি টেলিফোন আসে। আমি রিসিভ করার পর বিপরীত দিক থেকে এটা রহমান সাহেবের বাসার নাম্বার কিনা জানতে চাওয়া হয় ।আমরা দুই ভাই কোন ক্লাসে , কোন স্কুলে পড়ি জানতে চেয়ে অপরপ্রান্তের আঙ্কেল বলেন, তোমার বাবাকে দাও। পরবর্তীতে আব্বা ফোন ধরার পর ওনার উচ্ছ্বাস দেখে বুঝতে পারি নিশ্চয়ই আব্বার ভার্সিটি জীবনের কোন বন্ধু ফোন করেছেন। ফোন রাখার সময় আব্বা কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলেন, আমি সরকারি চাকরি করি ;তাই সরকারি প্রসিডিউর মেনেই দরখাস্ত করেছি। ঘটনা হচ্ছে, আজিমপুর কলোনীতে একটা সময় ডি /ই টাইপের বাসা ছিল ।অনেকদিন ধরে বড় বাসার জন্য আব্বা চেষ্টা করছিলেন এবং দরখাস্ত দেন। একটা সময় দরখাস্ত এর কপি পূর্ত-মন্ত্রীর কাছে পৌঁছালে উনি দরখাস্ত হতে আব্বার ফোন সংগ্রহ করেন এবং আমাদের বাসায় ফোন করেন ।আব্বাকে বন্ধুসুলভ ভৎসনা করে বলেন ,আমি থাকতে তোর এত দরখাস্ত এবং সময় নষ্টের কি দরকার ? তোর আজিমপুর না গ্রীনরোড কোন বাসা লাগবে আমাকে বল ।আব্বা বলেন সিরিয়াল অনুযায়ী যখন আমার ডাক আসবে তখনই ইউ ম্যা গিভ ইট ।বন্ধুদের কাছে বন্ধু ,কিন্তু সেই বন্ধু যদি মন্ত্রী হন সেক্ষেত্রে ইংরেজিতে কথা বলতেন। পরবর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী যিনি আব্বার রুমমেট ছিলেন;তার কাছে আমার পোস্টিং এর ব্যাপারে এবং আজিমপুর কলোনিতে বাসা আমার নামে ডাইভার্ট করার ব্যাপারে আমাদের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আব্বাকে বলে রাজি করাতে পারেন নাই। ছোটবেলায় সেই আঙ্কেলের বাসায় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের আসা যাওয়া ছিল। আজিমপুর কলোনির ভিতর একটি কমিউনিটি সেন্টারে আব্বার আরেক বন্ধুর ছেলের বিয়ের দাওয়াতে দেখলাম তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার সাথে বন্ধুসুলভ খুনসুটি (উনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী)।

সরকারি ট্রেনিংএ তিন মাস অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন সেই ৮২সনে ।তখন বেশ কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান কর্মকর্তা উনাকে সেই দেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন ।আব্বা এককথায় নাকচ করেন।

নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস আসলেই আব্বা অস্থির হয়ে বলতেন , “তোমার এসিআর এর কাগজপত্র ঠিক করেছ? ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দাও, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দাও, ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কবে শুরু হবে” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আশ্বস্ত করে বলতাম ,আগে এফসিপিএস- এমডি দেই, আস্তে-ধীরে ওগুলো হবে।

একটা সময় আজিমপুর কলোনিতে আমার মেজ খালা ও আমরা থাকতাম ।প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো ।সন্ধ্যাবেলায় খালু আমাদের পড়াশোনার হাল-হকিকত নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। আমাদের দুই ভাই ও খালাতো ভাই -বোনদের একসাথে বসিয়ে অংক ,জ্যামিতি ধরতেন , বলতেন গাধাগুলো কিছু পারেনা ।আব্বাকে ইন্সিস্ট করে বলতেন, এই আব্দুর রহমান এদের কিছু ইংরেজি গ্রামার ধরোতো। আমরা আড়ালে-আবডালে ওনাদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বলতাম। উনারা সন্ধ্যার পর যত্ন করে আমাদের পড়া দিতেন ,পড়া আদায়ের চেষ্টা করতেন ।এই “গাধা”দের একজন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ।আমরা এখনো মাঝে মাঝে খালাতো ভাই বোনেরা এক হলে সেই দিনগুলোর কথা মনে করি , আর আফসোস করি সে মায়া আর স্বার্থহীন শুভকামনার মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো ।

আমরা দুই ভাই খুব দুষ্টামি করতাম ।এজন্য আব্বা প্রতি সকালে আমাদের ইংরেজি পড়া দিয়ে যেতেন ,সন্ধ্যায় পড়া ধরতেন ।মাঝে মাঝে পিঠে তবলা এর বোল পড়তো। গ্রীষ্মের ছুটি, মেট্রিক পরীক্ষার ছুটি, রোজার ছুটি, বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি ইত্যাদি লং টার্ম ছুটি ছিল আমাদের। এই ছুটিগুলোর মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রায় দুই থেকে আড়াই মাস সময় আমরা আমাদের দাদা বাড়ি, নানাবাড়িতে সময় কাটাতে যেতাম। গ্রামের বাড়িতে ছিল না কারেন্ট ,রাতে মশার কামড় এর খুব জ্বালাতন ।ওই একটাই ছিলো গ্রামে থাকার নেগেটিভ পয়েন্ট ।বাকী সবকিছুই পজেটিভ পজেটিভ।

সকালে আম্মা- দাদি চা-বিস্কিট হাতে ধরিয়ে দাদার কাছে পৌঁছে দিতে বলতেন। দাদা ইজি চেয়ারে বসে দুই দিন আগের আব্বার পাঠানো পত্রিকা পড়তেন, আর আশপাশের বাড়ি ও গ্রামের ছাত্রদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন আর পড়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতেন। দাদা আব্দুর রউফ সাহেব মারা যান বিশে জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে ।১৯৬৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিরেক্টর হিসেবে অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে চলে আসেন আজিমপুর কলোনী ও ঢাকার মায়া ত্যাগ করে ।আব্বা তখন ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র দাদা মরহুম আব্দুর রউফ সাহেব কে ধানমন্ডিতে দেয়া সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্লট এর আবেদন এবং প্লট গ্রহণের জন্য অনেক অনুরোধ করার পরও শুধুমাত্র এলাকার মানুষের টানে,শিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যুৎহীন জালশুকার পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠা করেন, আশেপাশে বিভিন্ন গ্রামের স্কুলগুলোতে সহায়তা ও ধরে ধরে গরিব ঘরের শিক্ষিত -অর্ধ শিক্ষিত ছেলেদের সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিমাঞ্চলে নবীনগরের বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে উনার উপকার ও সততার কথা যখন আমাকে বলেন, তখন উনাদের জন্য গর্বে বুক উঁচু হয় আর ওই মানুষদের ছায়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় চোখ হয় আদ্র।

দাদা অবসর গ্রহণ করার পর গ্রামে এসে একটি ময়ূরপঙ্খী গয়না নৌকা তৈরি করেন এবং পার্মানেন্ট বেতনভুক্ত দুইজন মাঝি নিয়োগ দেন ।শীতে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার আর বর্ষায় বড় বড় বোয়াল ,আইর মাছ ধরা ছিল ওনার শখ।

আমরা বাড়িতে গেলে আম্মা প্রতিদিন আমাদের দুই ভাইয়ের এক ভাইকে দাদার সাথে থাকতে বলতেন ।দাদা কথা কম বলতেন; বলতেন, “বড় হলে সাইন্টিস্ট হবি, শামসুদ্দিন সাহেব কি এখনো তোদের স্কুলের হেড মাস্টার?” আমরা অবাক হয়ে যেতাম, কোথায় গন্ডগ্রাম জালশুকা আর কোথায় ঢাকার আজিমপুর এর তৎকালীন বিখ্যাত স্কুল ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক - এই যোগ সূত্র টা কি ?একদিন ঢাকায় যখন আমাদের আজিমপুর কলোনির বাসায় দাদা আসলেন ,তখন আব্বাকে বললেন চলো রহমান আমার আগের বাসা দেখে আসি ।আমরা তিন পুরুষ আজিমপুর কলোনির ৩৯ নম্বর বিল্ডিং এর বি নাম্বার বাসায় নক করি ।আসলে এই বাসায় সরকারি চাকুরি কালীন সময় দাদা ছিলেন, এখান থেকেই সরকারি সফরে পৃথিবীর ২৭টি দেশ সফর করেন ,আব্বা এখান থেকেই ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে যেতেন ।

আব্বা ‘ইনসাফ’ কথাটাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করতেন ‘ভেতর পরিষ্কার’। উনি মনের মধ্যে যে বিশ্বাসটা রাখতেন,সেটা মুখেও প্রকাশ করতেন। কোন রকম রাখলাম নাই। বিষয়টি নিয়ে আম্মা খুব টেনশন করতেন। আব্বা ছিলেন ব্যক্তিত্ববান এবং মিতব্যয়ী। লেখাপড়ার উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। আমি এমডি কোর্সে ভর্তির পর বেশ কবার পরীক্ষায় খারাপ করি এবং একইসাথে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলীর কারণে পড়াশোনা শেষ করার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। আব্বা আমাকে পাশে বসিয়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস যোগাতেন,বলতেন-এই উচ্চতর ডিগ্রীটাই হচ্ছে তোমার শক্তি ;এটা দিয়ে অসহায় ও দুঃস্থ মানুষকে জান দিয়ে সেবা করবে।

বলতেন, “লোভ করবে না ,যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো।” দাদা বলতেন , “সৎ থাকবে, মানুষের সাথে মিলে- মিশে থাকবে।”

সেপ্টেম্বর -অক্টোবর থেকেই মনের মধ্যে কি যেন নাই ,কি যেন নাই ভাব। ডিসেম্বর পার হয়ে জানুয়ারিতে যখন আমার কলিগরা এসিআর ফরম নিয়ে ছুটাছুটি শুরু করলেন তখন হাহাকার উঠে মনে, কে আমাকে মনে করিয়ে দিবেন তোমার এসিআর ফরম পূরণ করো, দরকারী কাগজ গুলো কে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিবেন ,কে বলবেন, “আসো বাবা কথা বলি।”

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক , শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

নির্মোহ দুই মানুষ

আসফাক বীন রহমান

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২

গায়ক জেমসের ‘বাবা কতদিন দেখিনি তোমায় ,বলে না কেউ তোমার মতো খোকা কাছে আয় “গানটির কথার মত আজ আমার অবস্থা । আজ ৩০ জানুয়ারি আমার আব্বা মরহুম আব্দুর রহমান সাহেবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী । মৃত্যুর আগের দিন রাতেও রাত আড়াইটা পর্যন্ত আব্বার সাথে বসে কত আলাপ করেছি ।পরিচিত বিভিন্ন মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে তাদের খবরা-খবর জানতে চেয়েছেন। আব্বা 2000 সালে এলপিআর এ যান মহাপরিচালক (গণযোগাযোগ অধিদপ্তর ,তথ্য মন্ত্রণালয়) হিসেবে ।শেষ এক থেকে দেড় বছর উনি শুধু একটা ফোন নাম্বার মনে রাখতে পারতেন। আমি বাসার বাইরে কিংবা হাসপাতালে গেলেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরপর আমার খবর নিতেন ,ঠিকমতো পৌঁছেছি কিনা ,বাসার বাবুরা অর্থাৎ আমার ছেলে মেয়েরা কোন দুষ্টামি করছে না ,আমি কখন আসব ।এর আগে উনার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল টেলিফোন ।প্রতিদিন ওনার টেলিফোন ডায়েরি থেকে এক এক করে বিভিন্ন জনকে ফোন করে তাদের কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। মাঝে মাঝে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বলতেন ও অনেক কষ্টে আছে চুপ করে এটা পৌঁছে দিও ।হাসপাতালে আমাদের গ্রামের দুঃস্থ কেউ ভর্তি হলে আমাকে তাদের ব্যাপারে ডাক্তারদের সাথে খোঁজখবর করা ,অর্থনৈতিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিতেন ।প্রায় 40 বছর ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ হৃদযন্ত্র এর বাইপাস অপারেশন আব্বাকে যতটুকু কাবু করেছিল ,পারকিনসন রোগ তাঁকে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল করে দেয় ।তারপরও উনার খাবার বাছাই করে খাওয়া এবং মনের জোরে আমরা এবং আমার সিনিয়র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ প্রফেসর তারিফ করতেন।

আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গেলে উনি সেদিন বাসায় না আসা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকতেন। আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে বলতেন ,জালশুকা- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবাই ভালো আছেতো ? উনি চাকুরী জীবনে সততার সাথে চাকুরী করেছেন। আমরা স্কুল,কলেজ, মেডিকেল জীবনে বিভিন্ন সরকারের সময় উনার সততার পরিচয় দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উনার বন্ধুদের অনেকে বিভিন্ন সরকারে মন্ত্রী, এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ওনাদের মাধ্যমে নিজে লাভবান হবার চেষ্টা করেননি। আমার মনে আছে, এক শুক্রবার সকালে যখন আমরা নাস্তা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন একটি টেলিফোন আসে। আমি রিসিভ করার পর বিপরীত দিক থেকে এটা রহমান সাহেবের বাসার নাম্বার কিনা জানতে চাওয়া হয় ।আমরা দুই ভাই কোন ক্লাসে , কোন স্কুলে পড়ি জানতে চেয়ে অপরপ্রান্তের আঙ্কেল বলেন, তোমার বাবাকে দাও। পরবর্তীতে আব্বা ফোন ধরার পর ওনার উচ্ছ্বাস দেখে বুঝতে পারি নিশ্চয়ই আব্বার ভার্সিটি জীবনের কোন বন্ধু ফোন করেছেন। ফোন রাখার সময় আব্বা কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলেন, আমি সরকারি চাকরি করি ;তাই সরকারি প্রসিডিউর মেনেই দরখাস্ত করেছি। ঘটনা হচ্ছে, আজিমপুর কলোনীতে একটা সময় ডি /ই টাইপের বাসা ছিল ।অনেকদিন ধরে বড় বাসার জন্য আব্বা চেষ্টা করছিলেন এবং দরখাস্ত দেন। একটা সময় দরখাস্ত এর কপি পূর্ত-মন্ত্রীর কাছে পৌঁছালে উনি দরখাস্ত হতে আব্বার ফোন সংগ্রহ করেন এবং আমাদের বাসায় ফোন করেন ।আব্বাকে বন্ধুসুলভ ভৎসনা করে বলেন ,আমি থাকতে তোর এত দরখাস্ত এবং সময় নষ্টের কি দরকার ? তোর আজিমপুর না গ্রীনরোড কোন বাসা লাগবে আমাকে বল ।আব্বা বলেন সিরিয়াল অনুযায়ী যখন আমার ডাক আসবে তখনই ইউ ম্যা গিভ ইট ।বন্ধুদের কাছে বন্ধু ,কিন্তু সেই বন্ধু যদি মন্ত্রী হন সেক্ষেত্রে ইংরেজিতে কথা বলতেন। পরবর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী যিনি আব্বার রুমমেট ছিলেন;তার কাছে আমার পোস্টিং এর ব্যাপারে এবং আজিমপুর কলোনিতে বাসা আমার নামে ডাইভার্ট করার ব্যাপারে আমাদের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আব্বাকে বলে রাজি করাতে পারেন নাই। ছোটবেলায় সেই আঙ্কেলের বাসায় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের আসা যাওয়া ছিল। আজিমপুর কলোনির ভিতর একটি কমিউনিটি সেন্টারে আব্বার আরেক বন্ধুর ছেলের বিয়ের দাওয়াতে দেখলাম তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার সাথে বন্ধুসুলভ খুনসুটি (উনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী)।

সরকারি ট্রেনিংএ তিন মাস অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন সেই ৮২সনে ।তখন বেশ কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান কর্মকর্তা উনাকে সেই দেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন ।আব্বা এককথায় নাকচ করেন।

নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস আসলেই আব্বা অস্থির হয়ে বলতেন , “তোমার এসিআর এর কাগজপত্র ঠিক করেছ? ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দাও, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দাও, ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কবে শুরু হবে” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আশ্বস্ত করে বলতাম ,আগে এফসিপিএস- এমডি দেই, আস্তে-ধীরে ওগুলো হবে।

একটা সময় আজিমপুর কলোনিতে আমার মেজ খালা ও আমরা থাকতাম ।প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো ।সন্ধ্যাবেলায় খালু আমাদের পড়াশোনার হাল-হকিকত নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। আমাদের দুই ভাই ও খালাতো ভাই -বোনদের একসাথে বসিয়ে অংক ,জ্যামিতি ধরতেন , বলতেন গাধাগুলো কিছু পারেনা ।আব্বাকে ইন্সিস্ট করে বলতেন, এই আব্দুর রহমান এদের কিছু ইংরেজি গ্রামার ধরোতো। আমরা আড়ালে-আবডালে ওনাদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বলতাম। উনারা সন্ধ্যার পর যত্ন করে আমাদের পড়া দিতেন ,পড়া আদায়ের চেষ্টা করতেন ।এই “গাধা”দের একজন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ।আমরা এখনো মাঝে মাঝে খালাতো ভাই বোনেরা এক হলে সেই দিনগুলোর কথা মনে করি , আর আফসোস করি সে মায়া আর স্বার্থহীন শুভকামনার মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো ।

আমরা দুই ভাই খুব দুষ্টামি করতাম ।এজন্য আব্বা প্রতি সকালে আমাদের ইংরেজি পড়া দিয়ে যেতেন ,সন্ধ্যায় পড়া ধরতেন ।মাঝে মাঝে পিঠে তবলা এর বোল পড়তো। গ্রীষ্মের ছুটি, মেট্রিক পরীক্ষার ছুটি, রোজার ছুটি, বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি ইত্যাদি লং টার্ম ছুটি ছিল আমাদের। এই ছুটিগুলোর মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রায় দুই থেকে আড়াই মাস সময় আমরা আমাদের দাদা বাড়ি, নানাবাড়িতে সময় কাটাতে যেতাম। গ্রামের বাড়িতে ছিল না কারেন্ট ,রাতে মশার কামড় এর খুব জ্বালাতন ।ওই একটাই ছিলো গ্রামে থাকার নেগেটিভ পয়েন্ট ।বাকী সবকিছুই পজেটিভ পজেটিভ।

সকালে আম্মা- দাদি চা-বিস্কিট হাতে ধরিয়ে দাদার কাছে পৌঁছে দিতে বলতেন। দাদা ইজি চেয়ারে বসে দুই দিন আগের আব্বার পাঠানো পত্রিকা পড়তেন, আর আশপাশের বাড়ি ও গ্রামের ছাত্রদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন আর পড়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতেন। দাদা আব্দুর রউফ সাহেব মারা যান বিশে জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে ।১৯৬৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিরেক্টর হিসেবে অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে চলে আসেন আজিমপুর কলোনী ও ঢাকার মায়া ত্যাগ করে ।আব্বা তখন ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র দাদা মরহুম আব্দুর রউফ সাহেব কে ধানমন্ডিতে দেয়া সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্লট এর আবেদন এবং প্লট গ্রহণের জন্য অনেক অনুরোধ করার পরও শুধুমাত্র এলাকার মানুষের টানে,শিক্ষা প্রসারের জন্য বিদ্যুৎহীন জালশুকার পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, পোস্ট অফিস প্রতিষ্ঠা করেন, আশেপাশে বিভিন্ন গ্রামের স্কুলগুলোতে সহায়তা ও ধরে ধরে গরিব ঘরের শিক্ষিত -অর্ধ শিক্ষিত ছেলেদের সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিমাঞ্চলে নবীনগরের বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে উনার উপকার ও সততার কথা যখন আমাকে বলেন, তখন উনাদের জন্য গর্বে বুক উঁচু হয় আর ওই মানুষদের ছায়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় চোখ হয় আদ্র।

দাদা অবসর গ্রহণ করার পর গ্রামে এসে একটি ময়ূরপঙ্খী গয়না নৌকা তৈরি করেন এবং পার্মানেন্ট বেতনভুক্ত দুইজন মাঝি নিয়োগ দেন ।শীতে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার আর বর্ষায় বড় বড় বোয়াল ,আইর মাছ ধরা ছিল ওনার শখ।

আমরা বাড়িতে গেলে আম্মা প্রতিদিন আমাদের দুই ভাইয়ের এক ভাইকে দাদার সাথে থাকতে বলতেন ।দাদা কথা কম বলতেন; বলতেন, “বড় হলে সাইন্টিস্ট হবি, শামসুদ্দিন সাহেব কি এখনো তোদের স্কুলের হেড মাস্টার?” আমরা অবাক হয়ে যেতাম, কোথায় গন্ডগ্রাম জালশুকা আর কোথায় ঢাকার আজিমপুর এর তৎকালীন বিখ্যাত স্কুল ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক - এই যোগ সূত্র টা কি ?একদিন ঢাকায় যখন আমাদের আজিমপুর কলোনির বাসায় দাদা আসলেন ,তখন আব্বাকে বললেন চলো রহমান আমার আগের বাসা দেখে আসি ।আমরা তিন পুরুষ আজিমপুর কলোনির ৩৯ নম্বর বিল্ডিং এর বি নাম্বার বাসায় নক করি ।আসলে এই বাসায় সরকারি চাকুরি কালীন সময় দাদা ছিলেন, এখান থেকেই সরকারি সফরে পৃথিবীর ২৭টি দেশ সফর করেন ,আব্বা এখান থেকেই ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে যেতেন ।

আব্বা ‘ইনসাফ’ কথাটাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করতেন ‘ভেতর পরিষ্কার’। উনি মনের মধ্যে যে বিশ্বাসটা রাখতেন,সেটা মুখেও প্রকাশ করতেন। কোন রকম রাখলাম নাই। বিষয়টি নিয়ে আম্মা খুব টেনশন করতেন। আব্বা ছিলেন ব্যক্তিত্ববান এবং মিতব্যয়ী। লেখাপড়ার উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। আমি এমডি কোর্সে ভর্তির পর বেশ কবার পরীক্ষায় খারাপ করি এবং একইসাথে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলীর কারণে পড়াশোনা শেষ করার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। আব্বা আমাকে পাশে বসিয়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস যোগাতেন,বলতেন-এই উচ্চতর ডিগ্রীটাই হচ্ছে তোমার শক্তি ;এটা দিয়ে অসহায় ও দুঃস্থ মানুষকে জান দিয়ে সেবা করবে।

বলতেন, “লোভ করবে না ,যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকো।” দাদা বলতেন , “সৎ থাকবে, মানুষের সাথে মিলে- মিশে থাকবে।”

সেপ্টেম্বর -অক্টোবর থেকেই মনের মধ্যে কি যেন নাই ,কি যেন নাই ভাব। ডিসেম্বর পার হয়ে জানুয়ারিতে যখন আমার কলিগরা এসিআর ফরম নিয়ে ছুটাছুটি শুরু করলেন তখন হাহাকার উঠে মনে, কে আমাকে মনে করিয়ে দিবেন তোমার এসিআর ফরম পূরণ করো, দরকারী কাগজ গুলো কে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিবেন ,কে বলবেন, “আসো বাবা কথা বলি।”

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক , শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ]

back to top