alt

মুক্ত আলোচনা

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজার সুফল

নাজমুল হুদা খান

: শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২

রোজা ইসলাম ধর্মের মূল ৫টি স্তম্ভের অন্যতম। রমজানের পুরো মাসে আমরা সংযম, সহিষ্ণুতা, আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির অনুশীলন করে থাকি। এ সময়ে শুধু সুবহে সাদিক থেকে র্সূযাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকি তা নয়; সকল ধরনের পাপ কর্ম, পাপাচার ও অপরের অনিষ্ঠ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। উপরন্তু আমরা সারাদিন না খেয়ে থেকে দুঃখী, ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষের অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার কষ্টের সহমর্মি হতে শিখি। এ সময় আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্র মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা, যাকাত প্রদান প্রভৃতি কল্যাণকর কর্মকান্ডের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্বও পালন করে থাকি । রমজান মাসে আমরা মিথ্যা বলা, গীবত করা, দোষারোপ, অন্যের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার মত অপকর্ম পরিহার করে মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা লাভ করি। শারীরিকভাবে রোজার নানাবিধ সুফল রয়েছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রমজান মাসে রোজা রাখার ফলে দেহের বহু ইতিবাচক উন্নতি ঘটে, যথাঃ রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন কনিকা সমূহ ইতিবাচক পরিবর্তন, শরীরে ক্ষতিকারক চর্বি সমূহের হ্রাস, ওজন কমানো ও নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি এবং আয়ুষ্কাল বাড়া ইত্যাদি ।

শরীরের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণঃ রোজা থাকার ফলে আমাদের রক্তে চর্বি, ফ্যাটি এসিড, কোলেস্টেরল ইত্যাদির পরিমাণ কমে যায়। ফলে রক্তে চর্বির শতকরা হার ও HBA1c র পরিমাণ হ্রাস পায় এবং দেহে গ্লুকোজ বা সুগারের পরিমাণও কমে । এছাড়া রমজানে আমাদের ঘুমের চক্রের পরিবর্তন ঘটে; ফলশ্রুতিতে রক্তে লেপটিন, নিউরোপেপটাইড, ইনসুলিনের পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে এবং আমাদের শরীরের শক্তি উৎপাদন ও ব্যয় হ্রাস পায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্থূলতা আমাদের দেহের বহুবিধ অসংক্রামক রোগের কারণ। এছাড়া আমাদের চলাফেরা ও জীবনযাত্রায়ও ব্যাঘাত ঘটায়। রোজা দৈহিক স্থূলতার হ্রাস করে । সাধারণত রোজার ২য়/৩য় সপ্তাহেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শরীরের ওজন কমতে দেখা যায়।

দেহে ক্ষতিকারক চর্বি হ্রাস ও উপকারী চর্বি সংশ্লেষ বৃদ্ধিঃ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রমজান মাসে আমাদের রক্তের ক্ষতিকারক চর্বির উপাদান যথাঃ লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) এবং ভেরি লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের পরিমান হ্রাস পায়। অন্যদিকে আমাদের শরীরের সুরক্ষায় কাজ করে এমন চর্বির উপাদান যথাঃ হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (HDL) এর পরিমাণ বেড়ে যায়। উপরন্তু রোজা থাকার ফলে দেহের নানাবিধ রোগের কারণ ট্রাইগ্লিসারাইড, প্রদাহ ও জারণ প্রক্রিয়ার হরমোনগুলোও কমে; যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী।

রক্তের বিভিন্ন কণিকা ও উপাদানে পরিবর্তনঃ রোজা রাখার ফলে রক্তের বিভিন্ন কনিকা যথাঃ লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা, অনুচক্রিকা প্রভৃতির বৃদ্ধি ঘটে; যা আমাদের দেহকে সুরক্ষিত করে। অন্যদিকে প্রদাহ এবং প্রদাহের অনুঘটক রাসায়নিক উপাদান যথাঃ IL-1, IL-6, Tumor necrosis factor এর পরিমান হ্রাস পায়; যারা প্রকারান্তরে দেহে ক্যান্সারের অনুঘটক। সুতরাং রোজা ক্যান্সার প্রতিরোধেও কাজ করে।

হৃদরোগসমূহের হ্রাসঃ বহু গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, রোজা হৃদযন্ত্রের কোষসমূহের কার্যক্রমে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করে; যাতে আমাদের দেহে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। এ সময় রক্তের সুগার, চর্বি, ইনসুলিন, হৃদকম্পন, নাড়ির গতি লক্ষণীয়ভাবে হ্রাসের কারণে হৃদপিন্ডের বহুবিধ রোগ কমে এবং রক্তচাপ ও মানসিক চাপ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়; যা দেহের রক্তনালী, রক্ত ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রশমনে সহায়তা করে।

ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রশমনঃ রোজা শরীরের বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান কিংবা ক্যান্সার উৎপত্তির অনুঘটক যেমনঃ সাইটোকাইনসমূহ, লেপটিন, এডিপোনেকাটিন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ক্যান্সার উৎপত্তির সম্ভাবনাকে হ্রাস করে। এছাড়া আমাদের রক্তের IL-6, IL-1B, TNF-α কমায় যা শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি হিসেবে পরিচিত। রোজা শরীরে জাড়িত অক্সিজেনের বিভিন্ন অঙ্গাণু কমাতে সহায়তা করে এবং ক্যান্সারের আশঙ্কা কমায়।

প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালীকরণঃ রোজা একদিকে রক্তের বিভিন্ন রক্ত কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে; অপরপক্ষে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান IL-6, IL-IB, TNF-α, লিস্ফোসাইট, মনোসাইট প্রভৃতি কমায় ফলে পরোক্ষভাবে আমাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে।

স্নায়ু রোগ প্রতিরোধ ঃ গবেষণায় দেখা যায় যে,রোজা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকরী কোষ নিউরনসমূহকে সুরক্ষিত রাখে, ফলে বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুতন্ত্রের রোগ যেমনঃ আলজেহিমারস রোগ, স্ট্রোক প্রভৃতি রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়।

শরীরের প্রধান অঙ্গ সমূহের বিকল্প পুষ্টিঃ রমজানের রোজার সময় বিপাক প্রক্রিয়ায় রক্তের কিটোন বডির পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার ফলে যখন শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায়, তখন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যথাঃ হৃদপিন্ড, মস্তিষ্ক ও মাংস পেশী সমূহে এই কিটোন বডি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়ঃ রোজার সময় ঘুমের চক্রের পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার নানা দিক পরিবর্তন ঘটে। গবেষণালব্ধ তথ্যে দেখা যায় যে, এসব পরিবর্তনের ফলে শরীরে বিভিন্ন হরমোন ও এনজাইমেও পরিবর্তন ঘটে; স্টেরয়েড হরমোন, পিটুইটারি হরমোন, থাইরয়েড হরমোন, মেলাটোনিন প্রভৃতি অন্যতম। এদের সবকটি শরীরের বিপাক এবং শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত। রোজায় এসব হরমোনে পরিবর্তনের ফলে রক্তের সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই হ্রাস পায়। ফলে শরীরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

দেহের সুরক্ষা বৃদ্ধিঃ রোজার সময় আমাদের স্বাস্থ্যহানিকর বিভিন্ন কর্মকান্ড যথাঃ ধূমপানসহ নানাবিদ বদঅভ্যাস থেকে বিরত থাকি। এসব কারণে শরীরের ক্ষতিকারক বায়োমার্কার উৎপত্তি হ্রাস পায়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গসমূহ সুরক্ষিত থাকে।

আয়ুষ্কাল বাড়ায়ঃ রমজানে আমাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক সকল ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। দৈহিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, সামাজিক কল্যাণ ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে আমাদের শারীরিক সুস্থতার উন্নতি ঘটে এবং আমাদের আয়ুষ্কাল বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় মূলতঃ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক তিনটি উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, রোজা মানুষের স্বাস্থ্যের সবকটি বিভাগেই ইতিবাচক এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাই একজন সুস্থ মানুষের জন্য রোজা শুধু নিরাপদই নয়, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং অধিকতর সুরক্ষিতও করে। তবে যারা বিভিন্ন অসুখ বিসুখে আক্রান্ত এবং সারাদিন না খেয়ে থাকায় স্বাস্থ্যের অবনতি বা চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটতে পারে; তাদের রোজা থেকে বিরত থাকার বিধান রয়েছে। এমনকি গর্ভবতী মহিলা বা ভ্রমণে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের জন্যও রোজা থেকে অব্যাহতি প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।

[লেখক: সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজার সুফল

নাজমুল হুদা খান

শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২

রোজা ইসলাম ধর্মের মূল ৫টি স্তম্ভের অন্যতম। রমজানের পুরো মাসে আমরা সংযম, সহিষ্ণুতা, আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির অনুশীলন করে থাকি। এ সময়ে শুধু সুবহে সাদিক থেকে র্সূযাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকি তা নয়; সকল ধরনের পাপ কর্ম, পাপাচার ও অপরের অনিষ্ঠ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। উপরন্তু আমরা সারাদিন না খেয়ে থেকে দুঃখী, ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষের অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার কষ্টের সহমর্মি হতে শিখি। এ সময় আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্র মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা, যাকাত প্রদান প্রভৃতি কল্যাণকর কর্মকান্ডের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্বও পালন করে থাকি । রমজান মাসে আমরা মিথ্যা বলা, গীবত করা, দোষারোপ, অন্যের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার মত অপকর্ম পরিহার করে মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা লাভ করি। শারীরিকভাবে রোজার নানাবিধ সুফল রয়েছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রমজান মাসে রোজা রাখার ফলে দেহের বহু ইতিবাচক উন্নতি ঘটে, যথাঃ রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন কনিকা সমূহ ইতিবাচক পরিবর্তন, শরীরে ক্ষতিকারক চর্বি সমূহের হ্রাস, ওজন কমানো ও নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি এবং আয়ুষ্কাল বাড়া ইত্যাদি ।

শরীরের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণঃ রোজা থাকার ফলে আমাদের রক্তে চর্বি, ফ্যাটি এসিড, কোলেস্টেরল ইত্যাদির পরিমাণ কমে যায়। ফলে রক্তে চর্বির শতকরা হার ও HBA1c র পরিমাণ হ্রাস পায় এবং দেহে গ্লুকোজ বা সুগারের পরিমাণও কমে । এছাড়া রমজানে আমাদের ঘুমের চক্রের পরিবর্তন ঘটে; ফলশ্রুতিতে রক্তে লেপটিন, নিউরোপেপটাইড, ইনসুলিনের পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে এবং আমাদের শরীরের শক্তি উৎপাদন ও ব্যয় হ্রাস পায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্থূলতা আমাদের দেহের বহুবিধ অসংক্রামক রোগের কারণ। এছাড়া আমাদের চলাফেরা ও জীবনযাত্রায়ও ব্যাঘাত ঘটায়। রোজা দৈহিক স্থূলতার হ্রাস করে । সাধারণত রোজার ২য়/৩য় সপ্তাহেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শরীরের ওজন কমতে দেখা যায়।

দেহে ক্ষতিকারক চর্বি হ্রাস ও উপকারী চর্বি সংশ্লেষ বৃদ্ধিঃ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রমজান মাসে আমাদের রক্তের ক্ষতিকারক চর্বির উপাদান যথাঃ লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) এবং ভেরি লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের পরিমান হ্রাস পায়। অন্যদিকে আমাদের শরীরের সুরক্ষায় কাজ করে এমন চর্বির উপাদান যথাঃ হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (HDL) এর পরিমাণ বেড়ে যায়। উপরন্তু রোজা থাকার ফলে দেহের নানাবিধ রোগের কারণ ট্রাইগ্লিসারাইড, প্রদাহ ও জারণ প্রক্রিয়ার হরমোনগুলোও কমে; যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী।

রক্তের বিভিন্ন কণিকা ও উপাদানে পরিবর্তনঃ রোজা রাখার ফলে রক্তের বিভিন্ন কনিকা যথাঃ লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা, অনুচক্রিকা প্রভৃতির বৃদ্ধি ঘটে; যা আমাদের দেহকে সুরক্ষিত করে। অন্যদিকে প্রদাহ এবং প্রদাহের অনুঘটক রাসায়নিক উপাদান যথাঃ IL-1, IL-6, Tumor necrosis factor এর পরিমান হ্রাস পায়; যারা প্রকারান্তরে দেহে ক্যান্সারের অনুঘটক। সুতরাং রোজা ক্যান্সার প্রতিরোধেও কাজ করে।

হৃদরোগসমূহের হ্রাসঃ বহু গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, রোজা হৃদযন্ত্রের কোষসমূহের কার্যক্রমে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করে; যাতে আমাদের দেহে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। এ সময় রক্তের সুগার, চর্বি, ইনসুলিন, হৃদকম্পন, নাড়ির গতি লক্ষণীয়ভাবে হ্রাসের কারণে হৃদপিন্ডের বহুবিধ রোগ কমে এবং রক্তচাপ ও মানসিক চাপ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়; যা দেহের রক্তনালী, রক্ত ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রশমনে সহায়তা করে।

ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রশমনঃ রোজা শরীরের বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান কিংবা ক্যান্সার উৎপত্তির অনুঘটক যেমনঃ সাইটোকাইনসমূহ, লেপটিন, এডিপোনেকাটিন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ক্যান্সার উৎপত্তির সম্ভাবনাকে হ্রাস করে। এছাড়া আমাদের রক্তের IL-6, IL-1B, TNF-α কমায় যা শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি হিসেবে পরিচিত। রোজা শরীরে জাড়িত অক্সিজেনের বিভিন্ন অঙ্গাণু কমাতে সহায়তা করে এবং ক্যান্সারের আশঙ্কা কমায়।

প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালীকরণঃ রোজা একদিকে রক্তের বিভিন্ন রক্ত কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে; অপরপক্ষে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান IL-6, IL-IB, TNF-α, লিস্ফোসাইট, মনোসাইট প্রভৃতি কমায় ফলে পরোক্ষভাবে আমাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে।

স্নায়ু রোগ প্রতিরোধ ঃ গবেষণায় দেখা যায় যে,রোজা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকরী কোষ নিউরনসমূহকে সুরক্ষিত রাখে, ফলে বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুতন্ত্রের রোগ যেমনঃ আলজেহিমারস রোগ, স্ট্রোক প্রভৃতি রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়।

শরীরের প্রধান অঙ্গ সমূহের বিকল্প পুষ্টিঃ রমজানের রোজার সময় বিপাক প্রক্রিয়ায় রক্তের কিটোন বডির পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার ফলে যখন শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায়, তখন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যথাঃ হৃদপিন্ড, মস্তিষ্ক ও মাংস পেশী সমূহে এই কিটোন বডি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়ঃ রোজার সময় ঘুমের চক্রের পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার নানা দিক পরিবর্তন ঘটে। গবেষণালব্ধ তথ্যে দেখা যায় যে, এসব পরিবর্তনের ফলে শরীরে বিভিন্ন হরমোন ও এনজাইমেও পরিবর্তন ঘটে; স্টেরয়েড হরমোন, পিটুইটারি হরমোন, থাইরয়েড হরমোন, মেলাটোনিন প্রভৃতি অন্যতম। এদের সবকটি শরীরের বিপাক এবং শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত। রোজায় এসব হরমোনে পরিবর্তনের ফলে রক্তের সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই হ্রাস পায়। ফলে শরীরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

দেহের সুরক্ষা বৃদ্ধিঃ রোজার সময় আমাদের স্বাস্থ্যহানিকর বিভিন্ন কর্মকান্ড যথাঃ ধূমপানসহ নানাবিদ বদঅভ্যাস থেকে বিরত থাকি। এসব কারণে শরীরের ক্ষতিকারক বায়োমার্কার উৎপত্তি হ্রাস পায়, ফলে বিভিন্ন অঙ্গসমূহ সুরক্ষিত থাকে।

আয়ুষ্কাল বাড়ায়ঃ রমজানে আমাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক সকল ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। দৈহিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, সামাজিক কল্যাণ ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে আমাদের শারীরিক সুস্থতার উন্নতি ঘটে এবং আমাদের আয়ুষ্কাল বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় মূলতঃ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক তিনটি উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, রোজা মানুষের স্বাস্থ্যের সবকটি বিভাগেই ইতিবাচক এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাই একজন সুস্থ মানুষের জন্য রোজা শুধু নিরাপদই নয়, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং অধিকতর সুরক্ষিতও করে। তবে যারা বিভিন্ন অসুখ বিসুখে আক্রান্ত এবং সারাদিন না খেয়ে থাকায় স্বাস্থ্যের অবনতি বা চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটতে পারে; তাদের রোজা থেকে বিরত থাকার বিধান রয়েছে। এমনকি গর্ভবতী মহিলা বা ভ্রমণে রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের জন্যও রোজা থেকে অব্যাহতি প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।

[লেখক: সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

back to top