আসফাক বীন রহমান
ইমন -- তুই চুরুটটা দিবি কি না বল ?
আবুল -- না ! দিতাম ক্যারে ? কষ্ট কইরা সরাইছি কি তুমরারে দিবার লাইগ্যা ?
সুমন -- দাঁড়া ! আম্মা আসুক ,তোর খবর কইরা দিমু !
আবুল -- আমি তুমরার খবর কইরা দিমু ! হালাম্মা ইস্কুল থেইক্যা আইলে !
চোরাই চুরুট নিয়ে আমরা দুই ভাই ও বাসার সাহায্যকারী আবুল হোসেনের মধ্যে ব্যাপক বাহাস চলছে । বড় ফুফা অফিসের কাজে এসেছেন । আজকে একটার পর একটা দান মারছে আবুইল্যা।
সকালে বাসায় আসার পরপরই বড়ফুপা আমাদের তিনজনকে লাইন ধরে দাঁড় করান । একজনের পর একজনের চোখের নিচে পর্যবেক্ষণ করে দু ফোঁটা করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ জিহ্বার উপর ছেড়ে দিচ্ছেন । জিব্বাটা বেশ জ্বলে উঠছে । এই ওষুধ খাওয়ার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রত্যেকের হাতে সাতটি করে চিনির গোল গোল দানা দিচ্ছেন । টপ করে মুখে চালান দিয়ে ফুপার কাছে আবার হাত পাততেই আরো দু’তিনটি দানা সরবরাহ করেন ।
বড় ফুফা মোস্তাক সাহেব পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট । উনি মাঝে মাঝে অফিস ও ইনস্টিটিউটের কাজে ঢাকায় আসেন । উনার শখ হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা । খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও রাশভারী হবার কারণে রোগীরা ওনার কাছে যেতে ভয় পান । কিন্তু আমাদের ব্যাপার আলাদা । ফুপা আমাদের বাসায় এলে উনার আশেপাশে ঘুরঘুর করি চিনির গোল্লা খাবার জন্য । নানান রকম বাহানা থাকে । আজকে ফুপা নিজে থেকে ডাক্তারি করে মাত্র একবার আমাদের ঔষুধ দিয়েছেন । এরপর আবুল আরও তিনবার এবং আমরা দুই ভাই একবার করে চিনির গোল্লা খেয়ে এসেছি ।
আবুল সুস্বাস্থ্যবান । সে কোন তিনটি রোগের কথা বলে ঔষুধ খেলো, আমরা অনেক গবেষণা করেও পেলাম না । ইমন একবার পেট ব্যাথা এবং আমি পা ব্যথার কমপ্লেন দিয়ে ফুফার ঔষুধ খেলাম ।কিন্তু ,আবুইল্যা কি কি রোগ বললো- সেটা জিজ্ঞেস করলে মুচকি মুচকি হাসে ।শেষপর্যন্ত ফুফাতো ভাই এনাম ভাইয়ের কাছে আবুলের নামে অতিরিক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাবার অভিযোগ দায়ের করি । চতুর্থবারে ফুপার কাছ থেকে ফেল মেরে আমাদেরকে দোষারোপ করতে থাকে আবুল। ফুপা আবুলকে ভয় দেখিয়েছেন অতিরিক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেলে রং কালো হয়ে যায় । এনাম ভাই আরও একটি কম্প্লিকেশন জানালেন-কারো কারো লেজও গজাতে পারে ।
আবুল বারবার বিরক্তি নিয়ে বলতে লাগলো-- “দুর ! তুমরার লাইগ্যা আমার চোখটা ঠিক হইল না ।”
আবুলের একচোখ লক্ষ্মীটেরা । এটা নিয়ে সে সবসময় কষ্টের মধ্যে থাকে । বিকেলে আমাদের সাথে সেও মাঠে খেলতে যায় । বন্ধুরা দুষ্টামি করে ‘ডেড়ব্যাটারি’ বলে । আবুল সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মতো চোখের কারুকার্য দেখিয়ে স্লো-মোশনে দৌড়ে যে কোন গাছের মগডালে উঠে যেতে পারতো । সেখান থেকে টারজানের মতো করে ও -ও -ও বলে চিৎকার দেয় ; আবার বুকের মধ্যে দুমদুম করে কিলও দেয় । সবাই আবুলকে হিংসা করে, তার মতো গাছের এত উঁচুতে আর কেউ উঠতে পারে না ।
বড়ফুপার একটা ‘সাত রাজার ধন মানিক’ হোমিওপ্যাথিক বাক্স ছিল । মেইড ইন জার্মানি । প্রতিবার ঢাকায় এলে নিউমার্কেটের জালালাবাদ হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসী ও নিউ লাইফ ফার্মেসী থেকে জার্মানির তৈরি সবচেয়ে ভালো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে যেতেন । আমরা ততোদিনে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ- এর সিতারা হোমিও হল এর ডাক্তারসাহেবের কল্যাণে নাক্স ভোমিকা , আর্নিকা ওষুধের নাম ও কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হয়ে গেছি । ফুপার কাছে আমাদের জ্ঞানের বহর উন্মোচন করলে উনি ভবিষ্যতে ওনার শখের পেশার দু-তিনজন উত্তরসূরী পেয়ে খুশি হোন । আর উনি খুশি মানে আমাদের জন্য হোমিওপ্যাথিক চিনির গুল্লি ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালাইশ্রীপাড়ার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ জয়চন্দ্রের নাম তখন জেলা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আগরতলা পর্যন্ত চলে গেছে । আম্মা আর্টসের ছাত্রী ছিলেন । কিন্তু , আশেপাশে শত শত ডাক্তার (!) থাকায় উনিও নিরাপদ ঔষুধ হিসেবে তিন-চারটি হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনের নাম জেনে আমাদের সর্দি, জ্বর ,পেটব্যথায় এগুলো এপ্লাই করতেন । কঠোর নজরদারি থাকার পরও প্রায়ই আম্মার ভান্ডারের হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি থেকে চিনির দানাগুলো গায়েব হয়ে যেতো ।
বড়ফুপা কর্মোদ্যোগী মানুষ ছিলেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পি,টি ইনস্টিটিউটের বিশাল কম্পাউন্ডে প্রতিবার আমাদের জন্য বিষ্ময় থাকতো । উনি ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টাক্রুজ ইউনিভার্সিটিতে শুধু প্রাইমারী এডুকেশনের উপর কোর্সই সম্পন্ন করেননি একইসাথে তৎকালীন আমেরিকার অনেক আধুনিক প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ করেন এইদেশে । উনি তেলাপিয়ার চাষ করে আশির দশকের প্রথমদিকে এলাকায় নাড়া ফেলে দেন ।ডোবার নীচে পলিথিন বিছিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় থাইল্যান্ডের তেলাপিয়া চাষের পদ্ধতি দেখতে পদস্থ কর্মকর্তা ও আগ্রহী মানুষেরা পিটি ইনস্টিটিউটের ভীড় জমাতো । ঢাকার নিউ মার্কেটের বিশেষ যত্নের টুকরীতে গাজর দেখতাম । সেই গাজর প্রথমবার চাষ করে সফল হওয়ার পর আমাদের ঢাকার আজিমপুরের বাসায় পাঠানোর পর ব্যাপারটা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল । আমাদের ধারণা ছিল শুধু ডেনমার্ক, আমেরিকা - রাশিয়া ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও গাজর উৎপাদন করা যায় না । ব্যাপক আগ্রহ দেখালে এনাম ভাই সহজভাবে বলে দেন - তোমরা ‘মুলা গাছ’ দেখেছো ? গাজরও একইরকমভাবে মাটি থেকে বের হয় । পার্থক্য একটি সাদা, আর অন্যটি লালচে কমলা রঙের ।
বিকেলে বা সন্ধ্যায় যেকোনো সময় পিটি ইনস্টিটিউটের ফুপুর বাসা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনমুখী অথবা ঢাকামুখী ট্রেনের লম্বা হুইসেলের আওয়াজে আমরা উতলা হয়ে উঠতাম । দৌঁড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখার অপেক্ষায় থাকতাম । সামনের পুনিয়াউটের ধানক্ষেত পার হয়ে কলা বাগানের সারির ভেতর দিয়ে ঝমঝমাঝম শব্দ তুলে ট্রেন- মালগাড়ী চলে যেতো। গুনতাম , কয়টা করে বগি আছে ? মালগাড়ির জন্য ৩১ বা ৩২ টি বগি আর যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য নয় কিংবা দশটি বগি থাকতো । সন্ধ্যার পর কালিবাড়ী মোড় থেকে কাজীপাড়া ঈদগাহ হয়ে মোড়াইল,পুনিয়াউট ,পৈরতলা পুরো এলাকাটাই নির্জন হয়ে যেতো । পৌরসভার একটা বা দুইটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এই পরিবেশকে আরো রহস্যময় করে তুলতো । মাঝে মাঝে শিয়ালের চিৎকার ভীতির সঞ্চার করতো। বড় ফুপুর হাতের ডিমের হালুয়া খেয়ে পকেটভর্তি গোলাপি ,নীল, হলুদ চক নিয়ে নানাবাড়ীর দিকে ফিরতাম । কালিবাড়ীর দিকে ঈদগাহ পেরোলেই বাম দিকে পর পর কয়েকটি ডোবা আর ডানদিকে একটা পুরানো আমলের বাড়ির সামনে জোড়া পাম গাছ বড় ফুপুর বাসায় যাওয়ার ল্যান্ডমার্ক । অনেক দূর থেকে একটা দুইটা রিক্সার টুংটাং শব্দ আর চলন্ত হারিকেনের আলো মনে সাহস যোগাতো ।
অবশেষে চুরুট নিয়ে আমাদের তিনজন একটা চুক্তিতে আসায় পারস্পরিক হুমকি-ধামকি বন্ধ হলো । চুক্তি অনুযায়ী ছোট থেকে বড় সবাই একবার করে চুরুটে টান দিবে আর আবুইল্যা চুরুট চুরির পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিবারে দুটি করে টান দিবে । ফুপাকে কখনোই একবারে পুরো চুরুট খেতে দেখিনি । ফুপার এই চুরুট স্পেশাল । খয়েরী এই চুরুটের গায়ে লাল একটি স্টীকার । হাভানা চুরুট । একসাথে ২০টি কি ৩০টি চুরুট সেলোফেনের কাগজে প্যাক করা থাকে ।এটি কিনতে এনাম ভাই গুলিস্তানের দিকে কোন একটি দোকানে যেতেন ।
তিনতলার স্বপন ভাইদের বাসায় একটি ওয়েস্টার্ন ছবির পোস্টারে ক্লিন্ট ইস্টউড হাতে যেভাবে সিগার ধরে দাঁড়ায় ঠিক সেই একই ভঙ্গিমায় ইমন চুরুট ধরে পার্ট নিয়ে একটা টান দিতেই কাশতে কাশতে মেঝেতে পরে গেলো ; আবুল এটা নিয়ে খোঁচা দেওয়ার পর আমি ধরালাম । মাথা হঠাৎ করে চক্কর দিয়ে আমিও মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম । আবুল একটা টান দিয়ে চুপচাপ মাটিতে বসে গেলো,চুরুটটি নিভিয়ে থম মেরে বসে রইলো ।বোঝা যাচ্ছে ,আবুল হোসেনও ফেইল । কয়দিন আগে মিষ্টি খালারা আবুধাবি থেকে আসার পর খালুর রথম্যান সিগারেটের একটি প্যাকেট সরিয়ে ফেলেছিলো আবুল। চুপেচাপে টয়লেটে গিয়ে পুরোটিই সাবাড় করে দিয়েছিলো । একদিন হাতেনাতে ধরায় আমাদেরকে একটা করে টান দেওয়ার সুযোগ দেয় । মনে হচ্ছিলো, মুখের ভেতর গরম কি যেনো একটা ভাঁপ ও তীব্র দুর্গন্ধ । এটা কিভাবে লোকজন মজা করে খায় ?
বিড়ি-সিগারেটখেকো লোকজন অসংখ্য দেখতাম । শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের কানে গোঁজা থাকতো বিড়ি । মাঝে মাঝে কানের উপর থেকে নামিয়ে ম্যাচবক্স জ্বালিয়ে সুখটান দিতো । ‘আবুল বিড়ি’ ছিলো বিখ্যাত।
অর্থনৈতিকভাবে আরেক ধাপ ওপরের মানুষ ফিল্টার ছাড়া সিগারেট খেতো। বগা,সিজার, স্টার ,ক্যাপস্টান এসব সিগারেট বহুল সমাদৃত । এরচেয়ে আরো উপরের পার্টি ফিল্টার সিগারেট ফুকতেন ।
ফাইভ ফিফটি ফাইভ, গোল্ড লীফ , গোল্ড ফ্ল্যাক ছিলো খুব চালু আইটেম । আর যারা বিদেশ থেকে আসতেন - তারা নিয়ে আসতেন বেনসন , রথম্যান, মোর সিগারেট ।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি সাবালক পুরুষ মানুষ হুক্কা টানতেন । এখন হুক্কার খুব একটা চল দেখতে পাই না । হুক্কার মধ্যেও আশরাফ-আতরাফ ভাগ করা ছিলো । নারিকেলের পুরো খোলটাকে কালো রং করে এর উপরে কাঠের তৈরি একটা ফাঁকা টিউব ফিট করে দেয়া হতো । খোল ভর্তি পানি থাকতো । এই টিউবের উপরে থাকতো কল্কি । সেই কল্কিতে আরো দুটো অংশ - একটা জ্বালানি ‘টিক্কা’ অন্যটি তামুক ( মূল তামাক ) । টিক্কা জ্বালিয়ে এর উপরে তামুক ঠেসেঠুসে দিয়ে নারকেলের একটা ফুটায় জোরে টান দিলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তামাকের ধোঁয়া পানি পার হয়ে সেবনকারী মুখে চলে আসতো । একবার টিক্কা জ্বালালে তিন-চারজন কৃষক একজনের পর একজন হাত বদল করে হুক্কা পান করতো । আশরাফ শ্রেণির হুক্কাগুলো মেটালের তৈরি । হুক্কার ফুটার
অংশ থেকে একটি রাবারের টিউব দুই তিন ফুট দূরের সেবনকারীর ঠোঁট পর্যন্ত চলে গেছে । খুব আয়েশ করে আশরাফ শ্রেণীর লোকজন হূক্কায় টান দিতেন -- আম-জনতা জুলজুল নেত্রে তাকিয়ে থাকতেন; যদি তাদেরকে একটু শরীক করেন ! এতে সামাজিকভাবে একটু আপগ্রেডেশন হবে ।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর।]
আসফাক বীন রহমান
মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০২২
ইমন -- তুই চুরুটটা দিবি কি না বল ?
আবুল -- না ! দিতাম ক্যারে ? কষ্ট কইরা সরাইছি কি তুমরারে দিবার লাইগ্যা ?
সুমন -- দাঁড়া ! আম্মা আসুক ,তোর খবর কইরা দিমু !
আবুল -- আমি তুমরার খবর কইরা দিমু ! হালাম্মা ইস্কুল থেইক্যা আইলে !
চোরাই চুরুট নিয়ে আমরা দুই ভাই ও বাসার সাহায্যকারী আবুল হোসেনের মধ্যে ব্যাপক বাহাস চলছে । বড় ফুফা অফিসের কাজে এসেছেন । আজকে একটার পর একটা দান মারছে আবুইল্যা।
সকালে বাসায় আসার পরপরই বড়ফুপা আমাদের তিনজনকে লাইন ধরে দাঁড় করান । একজনের পর একজনের চোখের নিচে পর্যবেক্ষণ করে দু ফোঁটা করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ জিহ্বার উপর ছেড়ে দিচ্ছেন । জিব্বাটা বেশ জ্বলে উঠছে । এই ওষুধ খাওয়ার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রত্যেকের হাতে সাতটি করে চিনির গোল গোল দানা দিচ্ছেন । টপ করে মুখে চালান দিয়ে ফুপার কাছে আবার হাত পাততেই আরো দু’তিনটি দানা সরবরাহ করেন ।
বড় ফুফা মোস্তাক সাহেব পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট । উনি মাঝে মাঝে অফিস ও ইনস্টিটিউটের কাজে ঢাকায় আসেন । উনার শখ হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা । খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও রাশভারী হবার কারণে রোগীরা ওনার কাছে যেতে ভয় পান । কিন্তু আমাদের ব্যাপার আলাদা । ফুপা আমাদের বাসায় এলে উনার আশেপাশে ঘুরঘুর করি চিনির গোল্লা খাবার জন্য । নানান রকম বাহানা থাকে । আজকে ফুপা নিজে থেকে ডাক্তারি করে মাত্র একবার আমাদের ঔষুধ দিয়েছেন । এরপর আবুল আরও তিনবার এবং আমরা দুই ভাই একবার করে চিনির গোল্লা খেয়ে এসেছি ।
আবুল সুস্বাস্থ্যবান । সে কোন তিনটি রোগের কথা বলে ঔষুধ খেলো, আমরা অনেক গবেষণা করেও পেলাম না । ইমন একবার পেট ব্যাথা এবং আমি পা ব্যথার কমপ্লেন দিয়ে ফুফার ঔষুধ খেলাম ।কিন্তু ,আবুইল্যা কি কি রোগ বললো- সেটা জিজ্ঞেস করলে মুচকি মুচকি হাসে ।শেষপর্যন্ত ফুফাতো ভাই এনাম ভাইয়ের কাছে আবুলের নামে অতিরিক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাবার অভিযোগ দায়ের করি । চতুর্থবারে ফুপার কাছ থেকে ফেল মেরে আমাদেরকে দোষারোপ করতে থাকে আবুল। ফুপা আবুলকে ভয় দেখিয়েছেন অতিরিক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেলে রং কালো হয়ে যায় । এনাম ভাই আরও একটি কম্প্লিকেশন জানালেন-কারো কারো লেজও গজাতে পারে ।
আবুল বারবার বিরক্তি নিয়ে বলতে লাগলো-- “দুর ! তুমরার লাইগ্যা আমার চোখটা ঠিক হইল না ।”
আবুলের একচোখ লক্ষ্মীটেরা । এটা নিয়ে সে সবসময় কষ্টের মধ্যে থাকে । বিকেলে আমাদের সাথে সেও মাঠে খেলতে যায় । বন্ধুরা দুষ্টামি করে ‘ডেড়ব্যাটারি’ বলে । আবুল সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মতো চোখের কারুকার্য দেখিয়ে স্লো-মোশনে দৌড়ে যে কোন গাছের মগডালে উঠে যেতে পারতো । সেখান থেকে টারজানের মতো করে ও -ও -ও বলে চিৎকার দেয় ; আবার বুকের মধ্যে দুমদুম করে কিলও দেয় । সবাই আবুলকে হিংসা করে, তার মতো গাছের এত উঁচুতে আর কেউ উঠতে পারে না ।
বড়ফুপার একটা ‘সাত রাজার ধন মানিক’ হোমিওপ্যাথিক বাক্স ছিল । মেইড ইন জার্মানি । প্রতিবার ঢাকায় এলে নিউমার্কেটের জালালাবাদ হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসী ও নিউ লাইফ ফার্মেসী থেকে জার্মানির তৈরি সবচেয়ে ভালো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে যেতেন । আমরা ততোদিনে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ- এর সিতারা হোমিও হল এর ডাক্তারসাহেবের কল্যাণে নাক্স ভোমিকা , আর্নিকা ওষুধের নাম ও কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হয়ে গেছি । ফুপার কাছে আমাদের জ্ঞানের বহর উন্মোচন করলে উনি ভবিষ্যতে ওনার শখের পেশার দু-তিনজন উত্তরসূরী পেয়ে খুশি হোন । আর উনি খুশি মানে আমাদের জন্য হোমিওপ্যাথিক চিনির গুল্লি ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালাইশ্রীপাড়ার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ জয়চন্দ্রের নাম তখন জেলা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আগরতলা পর্যন্ত চলে গেছে । আম্মা আর্টসের ছাত্রী ছিলেন । কিন্তু , আশেপাশে শত শত ডাক্তার (!) থাকায় উনিও নিরাপদ ঔষুধ হিসেবে তিন-চারটি হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনের নাম জেনে আমাদের সর্দি, জ্বর ,পেটব্যথায় এগুলো এপ্লাই করতেন । কঠোর নজরদারি থাকার পরও প্রায়ই আম্মার ভান্ডারের হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি থেকে চিনির দানাগুলো গায়েব হয়ে যেতো ।
বড়ফুপা কর্মোদ্যোগী মানুষ ছিলেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পি,টি ইনস্টিটিউটের বিশাল কম্পাউন্ডে প্রতিবার আমাদের জন্য বিষ্ময় থাকতো । উনি ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টাক্রুজ ইউনিভার্সিটিতে শুধু প্রাইমারী এডুকেশনের উপর কোর্সই সম্পন্ন করেননি একইসাথে তৎকালীন আমেরিকার অনেক আধুনিক প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ করেন এইদেশে । উনি তেলাপিয়ার চাষ করে আশির দশকের প্রথমদিকে এলাকায় নাড়া ফেলে দেন ।ডোবার নীচে পলিথিন বিছিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় থাইল্যান্ডের তেলাপিয়া চাষের পদ্ধতি দেখতে পদস্থ কর্মকর্তা ও আগ্রহী মানুষেরা পিটি ইনস্টিটিউটের ভীড় জমাতো । ঢাকার নিউ মার্কেটের বিশেষ যত্নের টুকরীতে গাজর দেখতাম । সেই গাজর প্রথমবার চাষ করে সফল হওয়ার পর আমাদের ঢাকার আজিমপুরের বাসায় পাঠানোর পর ব্যাপারটা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল । আমাদের ধারণা ছিল শুধু ডেনমার্ক, আমেরিকা - রাশিয়া ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও গাজর উৎপাদন করা যায় না । ব্যাপক আগ্রহ দেখালে এনাম ভাই সহজভাবে বলে দেন - তোমরা ‘মুলা গাছ’ দেখেছো ? গাজরও একইরকমভাবে মাটি থেকে বের হয় । পার্থক্য একটি সাদা, আর অন্যটি লালচে কমলা রঙের ।
বিকেলে বা সন্ধ্যায় যেকোনো সময় পিটি ইনস্টিটিউটের ফুপুর বাসা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনমুখী অথবা ঢাকামুখী ট্রেনের লম্বা হুইসেলের আওয়াজে আমরা উতলা হয়ে উঠতাম । দৌঁড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখার অপেক্ষায় থাকতাম । সামনের পুনিয়াউটের ধানক্ষেত পার হয়ে কলা বাগানের সারির ভেতর দিয়ে ঝমঝমাঝম শব্দ তুলে ট্রেন- মালগাড়ী চলে যেতো। গুনতাম , কয়টা করে বগি আছে ? মালগাড়ির জন্য ৩১ বা ৩২ টি বগি আর যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য নয় কিংবা দশটি বগি থাকতো । সন্ধ্যার পর কালিবাড়ী মোড় থেকে কাজীপাড়া ঈদগাহ হয়ে মোড়াইল,পুনিয়াউট ,পৈরতলা পুরো এলাকাটাই নির্জন হয়ে যেতো । পৌরসভার একটা বা দুইটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এই পরিবেশকে আরো রহস্যময় করে তুলতো । মাঝে মাঝে শিয়ালের চিৎকার ভীতির সঞ্চার করতো। বড় ফুপুর হাতের ডিমের হালুয়া খেয়ে পকেটভর্তি গোলাপি ,নীল, হলুদ চক নিয়ে নানাবাড়ীর দিকে ফিরতাম । কালিবাড়ীর দিকে ঈদগাহ পেরোলেই বাম দিকে পর পর কয়েকটি ডোবা আর ডানদিকে একটা পুরানো আমলের বাড়ির সামনে জোড়া পাম গাছ বড় ফুপুর বাসায় যাওয়ার ল্যান্ডমার্ক । অনেক দূর থেকে একটা দুইটা রিক্সার টুংটাং শব্দ আর চলন্ত হারিকেনের আলো মনে সাহস যোগাতো ।
অবশেষে চুরুট নিয়ে আমাদের তিনজন একটা চুক্তিতে আসায় পারস্পরিক হুমকি-ধামকি বন্ধ হলো । চুক্তি অনুযায়ী ছোট থেকে বড় সবাই একবার করে চুরুটে টান দিবে আর আবুইল্যা চুরুট চুরির পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিবারে দুটি করে টান দিবে । ফুপাকে কখনোই একবারে পুরো চুরুট খেতে দেখিনি । ফুপার এই চুরুট স্পেশাল । খয়েরী এই চুরুটের গায়ে লাল একটি স্টীকার । হাভানা চুরুট । একসাথে ২০টি কি ৩০টি চুরুট সেলোফেনের কাগজে প্যাক করা থাকে ।এটি কিনতে এনাম ভাই গুলিস্তানের দিকে কোন একটি দোকানে যেতেন ।
তিনতলার স্বপন ভাইদের বাসায় একটি ওয়েস্টার্ন ছবির পোস্টারে ক্লিন্ট ইস্টউড হাতে যেভাবে সিগার ধরে দাঁড়ায় ঠিক সেই একই ভঙ্গিমায় ইমন চুরুট ধরে পার্ট নিয়ে একটা টান দিতেই কাশতে কাশতে মেঝেতে পরে গেলো ; আবুল এটা নিয়ে খোঁচা দেওয়ার পর আমি ধরালাম । মাথা হঠাৎ করে চক্কর দিয়ে আমিও মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম । আবুল একটা টান দিয়ে চুপচাপ মাটিতে বসে গেলো,চুরুটটি নিভিয়ে থম মেরে বসে রইলো ।বোঝা যাচ্ছে ,আবুল হোসেনও ফেইল । কয়দিন আগে মিষ্টি খালারা আবুধাবি থেকে আসার পর খালুর রথম্যান সিগারেটের একটি প্যাকেট সরিয়ে ফেলেছিলো আবুল। চুপেচাপে টয়লেটে গিয়ে পুরোটিই সাবাড় করে দিয়েছিলো । একদিন হাতেনাতে ধরায় আমাদেরকে একটা করে টান দেওয়ার সুযোগ দেয় । মনে হচ্ছিলো, মুখের ভেতর গরম কি যেনো একটা ভাঁপ ও তীব্র দুর্গন্ধ । এটা কিভাবে লোকজন মজা করে খায় ?
বিড়ি-সিগারেটখেকো লোকজন অসংখ্য দেখতাম । শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের কানে গোঁজা থাকতো বিড়ি । মাঝে মাঝে কানের উপর থেকে নামিয়ে ম্যাচবক্স জ্বালিয়ে সুখটান দিতো । ‘আবুল বিড়ি’ ছিলো বিখ্যাত।
অর্থনৈতিকভাবে আরেক ধাপ ওপরের মানুষ ফিল্টার ছাড়া সিগারেট খেতো। বগা,সিজার, স্টার ,ক্যাপস্টান এসব সিগারেট বহুল সমাদৃত । এরচেয়ে আরো উপরের পার্টি ফিল্টার সিগারেট ফুকতেন ।
ফাইভ ফিফটি ফাইভ, গোল্ড লীফ , গোল্ড ফ্ল্যাক ছিলো খুব চালু আইটেম । আর যারা বিদেশ থেকে আসতেন - তারা নিয়ে আসতেন বেনসন , রথম্যান, মোর সিগারেট ।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি সাবালক পুরুষ মানুষ হুক্কা টানতেন । এখন হুক্কার খুব একটা চল দেখতে পাই না । হুক্কার মধ্যেও আশরাফ-আতরাফ ভাগ করা ছিলো । নারিকেলের পুরো খোলটাকে কালো রং করে এর উপরে কাঠের তৈরি একটা ফাঁকা টিউব ফিট করে দেয়া হতো । খোল ভর্তি পানি থাকতো । এই টিউবের উপরে থাকতো কল্কি । সেই কল্কিতে আরো দুটো অংশ - একটা জ্বালানি ‘টিক্কা’ অন্যটি তামুক ( মূল তামাক ) । টিক্কা জ্বালিয়ে এর উপরে তামুক ঠেসেঠুসে দিয়ে নারকেলের একটা ফুটায় জোরে টান দিলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তামাকের ধোঁয়া পানি পার হয়ে সেবনকারী মুখে চলে আসতো । একবার টিক্কা জ্বালালে তিন-চারজন কৃষক একজনের পর একজন হাত বদল করে হুক্কা পান করতো । আশরাফ শ্রেণির হুক্কাগুলো মেটালের তৈরি । হুক্কার ফুটার
অংশ থেকে একটি রাবারের টিউব দুই তিন ফুট দূরের সেবনকারীর ঠোঁট পর্যন্ত চলে গেছে । খুব আয়েশ করে আশরাফ শ্রেণীর লোকজন হূক্কায় টান দিতেন -- আম-জনতা জুলজুল নেত্রে তাকিয়ে থাকতেন; যদি তাদেরকে একটু শরীক করেন ! এতে সামাজিকভাবে একটু আপগ্রেডেশন হবে ।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর।]