মাহমুদুল হাছান
নেতৃত্ব বা লিডারশিপ (Leadership) হলো যে কোন প্রতিষ্ঠানের একজন নেতার শৈল্পিক কৌশল ও আদর্শিক সক্ষমতা। নেতৃত্বের সাথে নৈতিকতার একটি বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। এটি নেতার এমন একটি সক্ষমতা যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে দল, গোষ্ঠী, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রভাবিত করা ও পরিচালিত করা সম্ভব হয়। নেতৃত্বের সাথে নেতার নৈতিকতার সম্পর্ক নিবিড়। নীতিহীন নেতৃত্ব ব্যক্তি চরিত্রের অবক্ষয়ের সামিল। যে কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয় আদর্শিক সক্ষমতা ও নৈতিক নেতৃত্বের কারণে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতার গুরুত্ব আরো অনেক বেশি। যে নেতৃত্বে নৈতিকতার সন্নিবেশ থাকে তাকে বলা হয় নৈতিক নেতৃত্ব বা এথিকাল লিডারশিপ (Ethical Leadership)। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক নেতাদের পেশাগত নীতির মধ্যে রয়েছে নিঃস্বার্থতা, সততা, বস্তুনিষ্ঠতা, জবাবদিহিতা, উন্মুক্ততা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামনের দিকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্ব, যেখানে একজন নেতাকে হতে হবে নীতিচর্চার আদর্শ উদাহরণ।
প্রতিষ্ঠানের নেতারা নীতিবোধের বিষয়ে যে উপযুক্ত নেতৃত্বের আচরণ প্রদর্শন করে, সেটি হতে হবে একটি ইতিবাচক উপায়ে, যা সাংগঠনিক সংযোগকে বেশ প্রভাবিত করতে পারে। এজন্য তিনটি মৌলিক উপাদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ; একঃ আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, আচরণ এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বে নিজেকে এবং অন্যদেরকে সম্মান করা। দুইঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক-কর্মচারী, ছাত্র-অভিভাবক এবং জনসাধারণের সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ স্থাপন ও পারস্পরিক সমর্থন বৃদ্ধি করা। এবং তিনঃ সবকিছুতে রোল মডেল হওয়ার জন্য শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষক এবং সমাজের সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের সহযোগিতা পেতে নেতাদের সার্বিক অনুশীলন অব্যাহত রাখা।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নেতৃত্বে নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা আবহমান কাল ধরেই ছিল, গত একশ বছরে নেতৃত্বের নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টান্তে বেশ পরিবর্তন এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, একবিংশ শতাব্দির নেতৃত্ব নেতার নীতি ও নৈতিক গুণাবলীর উপর ভিত্তি করেই গঠিত হওয়া উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হল, নেতৃত্বে নীতি ও নৈতিক গুণাবলী কী এবং কীভাবে অর্জিত হতে পারে সেগুলি পরিমাপ এবং প্রয়োগ করা। আবার শিক্ষাগত প্রেক্ষাপটে নৈতিক নেতা হিসাবে তার কী কী যোগ্যতা অর্জন করা উচিত এবং নৈতিক নেতৃত্বের সাথে কোন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যুক্ত এগুলি নির্ণয় করা ও তা বাস্তবে প্রতিফলিত করা।
জর্জ মার্শালের মতে, নৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নেতা বা প্রশাসকদের জন্য একটি শক্তিশালী স্ক্যাফোল্ড বা মানসম্পন্ন পরিমাপক থাকা উচিত, যার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজেদের নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জসমুহ অতিক্রম করে নৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারে্ন। জনপ্রশাসনে নীতিশাস্ত্র একটি মূল ডোমেইন, বিশেষ করে, উন্নত রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে নীতি ও নৈতিক নেতৃত্বের গুনাবলী শিক্ষা দেয়া হয়। প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারে। যেমন;
প্রথমতঃ ব্যক্তিগত মনোবল - মনে হতে পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অনেক চ্যালেঞ্জ বা অনৈতিক কর্মকান্ড চলমান রয়েছে যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে নেতা বা প্রশাসককে তার ব্যক্তিগত সাহস বা মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাদেরকে একটি ইতিবাচক শিক্ষামূলক পরিবেশ তৈরি করার জন্য নীতি বিবর্জিত কাজগুলির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যান নিশ্চিত হতে পারে এমন কিছু প্রতিষ্ঠার দৃঢ় ইচ্ছা ও মনোবল তৈরি করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ নিজের চেয়ে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া- শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য যা সর্বোত্তম তা অবশ্যই নেতার ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা স্বার্থের উর্ধ্বে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে জনস্বার্থ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে একজন নেতাকে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হতে হবে। সকলের মতামত এবং চাহিদা সর্বদা প্রিন্সিপাল বা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের স্বার্থের আগে থাকা উচিত।
তৃতীয়তঃ আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্ব-শৃঙ্খলা এবং সততা - নৈতিকতা বিবেচনা করার জন্য সমস্ত ধরণের নেতৃত্বে মূলত এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। বৃহত্তর সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সমস্ত ক্ষমতার নেতাদের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সে হিসাবে নেতাদের পক্ষে স্টেকহোল্ডারদের জীবনে একটি ইতিবাচক রোল মডেল এবং শক্তি থাকা প্রয়োজন। নেতা এবং অনুসারীদের মধ্যে সম্পর্কগুলি বিশ্বাসের উপর খুব বেশি নির্ভর করা উচিত নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং নৈতিক কর্মের উপর নির্মিত হওয়া উচিত। সততা, একাগ্রতা, সুশৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ দক্ষতা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্ব কৌশলের এক অন্যতম দিক।
চতুর্থতঃ কর্মপরায়নতা - শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের অবশ্যই সাফল্যের একটি ভিত্তি তৈরি করতে হবে যা শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগকারী শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মশক্তি থেকে আসে। সফল নেতারা যখন সিদ্ধান্ত নেন, তখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে মূল চাবিকাঠি হল কর্মীদের উপর অর্পিত কাজ ও তাদের শক্তি-সামর্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিভিন্ন চাহিদার ভিত্তিতে ঐক্য তৈরি করা।
পঞ্চমতঃ প্রতিভা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি - নৈতিক নেতারা তাদের অনুসারীদের প্রতিভা ও কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেয়। এর অর্থ হল নেতারা শিক্ষার্থী ও কর্মীদের উভয়কেই সনাক্ত করে যারা শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলী প্রদর্শন করে তাদেরকে সকলের সামনে প্রচার করে থাকেন। ফলে, প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্যের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক ও সদ্ভাব সৃষ্টি হয়। প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেওয়ার অন্য দিকটি হল এটিকে সকলের কাছে সর্বাধিকভাবে পরিচিত করা, যাতে অন্যরা তা দেখে অনুপ্রাণিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কল্যান লাভ হয়।
ষষ্ঠতঃ প্রত্যেকের কাছ থেকে উচ্চ নৈতিকতা প্রয়োজন - নেতাদের শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব নৈতিক মান নিয়েই নয় বরং তাদের প্রতিষ্ঠানের অন্যদের নৈতিক মান নিয়েও চিন্তা করতে হবে। এটিতে শুধুমাত্র শিক্ষক এবং কর্মচারীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা নয়, বরং তা ছাত্র এবং অভিভাবকদের মধ্যেও প্রসারিত করতে হবে। এটিকে আরো কার্যকরী করতে এর গুনগত মানগুলি অবশ্যই সকলকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে এবং কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই তা সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে।
সপ্তমতঃ সংবেদনশীলতা এবং বোঝাপড়া - এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সকল সদস্যের মধ্যে সমতা অনুশীলন করার জন্য সংবেদনশীলতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার অনেক প্রয়োজন রয়েছে। এটি নৈতিক নেতৃত্বের সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি। এই অনুশীলনটি অবশ্যই শিক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতির মাধ্যমে প্রয়োগ করা উচিত।
অষ্টমতঃ অন্তর্ভুক্তিকরণ - একটি প্রতিষ্ঠানের সকল কিছুকে নিজের মত করে ভাবা এবং সেখানে আপন মনে করে সব কাজ করা, নেতার নেতৃত্বে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। নেতা হচ্ছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন অভিভাবক, যিনি তার সহকর্মীদেরকে নিয়ে একসাথে একযোগে কাজ করবেন। সকলকে কাজভিত্তিক একত্রিত করে কর্মবন্ঠনের মাধ্যমে কোন প্রজেক্ট সম্পন্ন করলে সেটিতে দ্রুত সফল হওয়া যায় এবং সেরা আউটপুট লাভ করা যায়। প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্যকে বিভিন্ন কাজে অন্তর্ভুক্ত করাই নেতার প্রধান নীতি। কারন, অন্তর্ভুক্তি পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্ত স্টেকহোল্ডারকে খুশি করা যায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকরী ফল লাভ করা যায়। এতে প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্যদের বিবেচনা, মূল্যায়ন এবং সম্মান দেখানো হয় বলে তারা কর্মোদ্যমী হয় এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ফলে, নেতা কর্তৃক গৃহিত যে কোন পদক্ষেপ সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
নবমতঃ পরমতের উপর শ্রদ্ধাশীলতা: পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা যেকোনো নেতার অন্যতম একটি সুন্দর নীতি, যার দ্বারা তিনি সবার মতামতই সমান গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন এবং উপযুক্ত মনে হলে কাজে লাগাবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে অধস্তন থেকে উর্ধতন সকল ব্যক্তিবর্গের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত ও পরামর্শ নেয়া একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের একান্ত কর্তব্য। এতে সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং তা বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ হয়।
অতএব, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নেতার নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ প্রদর্শন একটি অন্যতম প্রধান নীতি, যা ছাড়া নেতৃত্ব মূল্যহীন এবং অসাড়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতারা নৈতিক বিবেচনার যখন উপরোল্লিখিত নীতিগুলো অনুসরণ করেন, তখন তাদের সামগ্রীক পরিবেশে উচ্চতর সাফল্য লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। নৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের সদস্যগন কখন এলো বা কখন গেল, শুধুমাত্র এগুলির উপর নজরদারী করার জন্য নয়, বরং তাদের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি অন্যান্য কল্যানধর্মী কর্মকান্ডে উৎসাহিত করে তা সম্পাদন করাই নেতৃত্বের প্রধান নীতি। দৃঢ় নৈতিক অনুশীলন কর্তব্যরত কর্মী ও অনুসারীদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক ও নেতৃত্ব প্রদর্শনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে নৈতিকতা স্থাপন অতীব আবশ্যক যা কর্মস্থলের পরিবেশকে করে শান্তিময় এবং সাফল্য বয়ে আনে অফুরন্ত।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক]
মাহমুদুল হাছান
মঙ্গলবার, ৩১ মে ২০২২
নেতৃত্ব বা লিডারশিপ (Leadership) হলো যে কোন প্রতিষ্ঠানের একজন নেতার শৈল্পিক কৌশল ও আদর্শিক সক্ষমতা। নেতৃত্বের সাথে নৈতিকতার একটি বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। এটি নেতার এমন একটি সক্ষমতা যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে দল, গোষ্ঠী, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রভাবিত করা ও পরিচালিত করা সম্ভব হয়। নেতৃত্বের সাথে নেতার নৈতিকতার সম্পর্ক নিবিড়। নীতিহীন নেতৃত্ব ব্যক্তি চরিত্রের অবক্ষয়ের সামিল। যে কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয় আদর্শিক সক্ষমতা ও নৈতিক নেতৃত্বের কারণে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতার গুরুত্ব আরো অনেক বেশি। যে নেতৃত্বে নৈতিকতার সন্নিবেশ থাকে তাকে বলা হয় নৈতিক নেতৃত্ব বা এথিকাল লিডারশিপ (Ethical Leadership)। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক নেতাদের পেশাগত নীতির মধ্যে রয়েছে নিঃস্বার্থতা, সততা, বস্তুনিষ্ঠতা, জবাবদিহিতা, উন্মুক্ততা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামনের দিকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন নৈতিক নেতৃত্ব, যেখানে একজন নেতাকে হতে হবে নীতিচর্চার আদর্শ উদাহরণ।
প্রতিষ্ঠানের নেতারা নীতিবোধের বিষয়ে যে উপযুক্ত নেতৃত্বের আচরণ প্রদর্শন করে, সেটি হতে হবে একটি ইতিবাচক উপায়ে, যা সাংগঠনিক সংযোগকে বেশ প্রভাবিত করতে পারে। এজন্য তিনটি মৌলিক উপাদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ; একঃ আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, আচরণ এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বে নিজেকে এবং অন্যদেরকে সম্মান করা। দুইঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক-কর্মচারী, ছাত্র-অভিভাবক এবং জনসাধারণের সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ স্থাপন ও পারস্পরিক সমর্থন বৃদ্ধি করা। এবং তিনঃ সবকিছুতে রোল মডেল হওয়ার জন্য শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষক এবং সমাজের সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের সহযোগিতা পেতে নেতাদের সার্বিক অনুশীলন অব্যাহত রাখা।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে নেতৃত্বে নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা আবহমান কাল ধরেই ছিল, গত একশ বছরে নেতৃত্বের নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টান্তে বেশ পরিবর্তন এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, একবিংশ শতাব্দির নেতৃত্ব নেতার নীতি ও নৈতিক গুণাবলীর উপর ভিত্তি করেই গঠিত হওয়া উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হল, নেতৃত্বে নীতি ও নৈতিক গুণাবলী কী এবং কীভাবে অর্জিত হতে পারে সেগুলি পরিমাপ এবং প্রয়োগ করা। আবার শিক্ষাগত প্রেক্ষাপটে নৈতিক নেতা হিসাবে তার কী কী যোগ্যতা অর্জন করা উচিত এবং নৈতিক নেতৃত্বের সাথে কোন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যুক্ত এগুলি নির্ণয় করা ও তা বাস্তবে প্রতিফলিত করা।
জর্জ মার্শালের মতে, নৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নেতা বা প্রশাসকদের জন্য একটি শক্তিশালী স্ক্যাফোল্ড বা মানসম্পন্ন পরিমাপক থাকা উচিত, যার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজেদের নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জসমুহ অতিক্রম করে নৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারে্ন। জনপ্রশাসনে নীতিশাস্ত্র একটি মূল ডোমেইন, বিশেষ করে, উন্নত রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে নীতি ও নৈতিক নেতৃত্বের গুনাবলী শিক্ষা দেয়া হয়। প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারে। যেমন;
প্রথমতঃ ব্যক্তিগত মনোবল - মনে হতে পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অনেক চ্যালেঞ্জ বা অনৈতিক কর্মকান্ড চলমান রয়েছে যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে নেতা বা প্রশাসককে তার ব্যক্তিগত সাহস বা মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাদেরকে একটি ইতিবাচক শিক্ষামূলক পরিবেশ তৈরি করার জন্য নীতি বিবর্জিত কাজগুলির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যান নিশ্চিত হতে পারে এমন কিছু প্রতিষ্ঠার দৃঢ় ইচ্ছা ও মনোবল তৈরি করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ নিজের চেয়ে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া- শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য যা সর্বোত্তম তা অবশ্যই নেতার ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা স্বার্থের উর্ধ্বে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে জনস্বার্থ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে একজন নেতাকে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হতে হবে। সকলের মতামত এবং চাহিদা সর্বদা প্রিন্সিপাল বা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের স্বার্থের আগে থাকা উচিত।
তৃতীয়তঃ আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্ব-শৃঙ্খলা এবং সততা - নৈতিকতা বিবেচনা করার জন্য সমস্ত ধরণের নেতৃত্বে মূলত এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। বৃহত্তর সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সমস্ত ক্ষমতার নেতাদের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সে হিসাবে নেতাদের পক্ষে স্টেকহোল্ডারদের জীবনে একটি ইতিবাচক রোল মডেল এবং শক্তি থাকা প্রয়োজন। নেতা এবং অনুসারীদের মধ্যে সম্পর্কগুলি বিশ্বাসের উপর খুব বেশি নির্ভর করা উচিত নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং নৈতিক কর্মের উপর নির্মিত হওয়া উচিত। সততা, একাগ্রতা, সুশৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ দক্ষতা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্ব কৌশলের এক অন্যতম দিক।
চতুর্থতঃ কর্মপরায়নতা - শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের অবশ্যই সাফল্যের একটি ভিত্তি তৈরি করতে হবে যা শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগকারী শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মশক্তি থেকে আসে। সফল নেতারা যখন সিদ্ধান্ত নেন, তখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে মূল চাবিকাঠি হল কর্মীদের উপর অর্পিত কাজ ও তাদের শক্তি-সামর্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিভিন্ন চাহিদার ভিত্তিতে ঐক্য তৈরি করা।
পঞ্চমতঃ প্রতিভা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি - নৈতিক নেতারা তাদের অনুসারীদের প্রতিভা ও কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেয়। এর অর্থ হল নেতারা শিক্ষার্থী ও কর্মীদের উভয়কেই সনাক্ত করে যারা শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলী প্রদর্শন করে তাদেরকে সকলের সামনে প্রচার করে থাকেন। ফলে, প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্যের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক ও সদ্ভাব সৃষ্টি হয়। প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেওয়ার অন্য দিকটি হল এটিকে সকলের কাছে সর্বাধিকভাবে পরিচিত করা, যাতে অন্যরা তা দেখে অনুপ্রাণিত হয় এবং সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানের কল্যান লাভ হয়।
ষষ্ঠতঃ প্রত্যেকের কাছ থেকে উচ্চ নৈতিকতা প্রয়োজন - নেতাদের শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব নৈতিক মান নিয়েই নয় বরং তাদের প্রতিষ্ঠানের অন্যদের নৈতিক মান নিয়েও চিন্তা করতে হবে। এটিতে শুধুমাত্র শিক্ষক এবং কর্মচারীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা নয়, বরং তা ছাত্র এবং অভিভাবকদের মধ্যেও প্রসারিত করতে হবে। এটিকে আরো কার্যকরী করতে এর গুনগত মানগুলি অবশ্যই সকলকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে এবং কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই তা সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে।
সপ্তমতঃ সংবেদনশীলতা এবং বোঝাপড়া - এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সকল সদস্যের মধ্যে সমতা অনুশীলন করার জন্য সংবেদনশীলতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার অনেক প্রয়োজন রয়েছে। এটি নৈতিক নেতৃত্বের সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি। এই অনুশীলনটি অবশ্যই শিক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতির মাধ্যমে প্রয়োগ করা উচিত।
অষ্টমতঃ অন্তর্ভুক্তিকরণ - একটি প্রতিষ্ঠানের সকল কিছুকে নিজের মত করে ভাবা এবং সেখানে আপন মনে করে সব কাজ করা, নেতার নেতৃত্বে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। নেতা হচ্ছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন অভিভাবক, যিনি তার সহকর্মীদেরকে নিয়ে একসাথে একযোগে কাজ করবেন। সকলকে কাজভিত্তিক একত্রিত করে কর্মবন্ঠনের মাধ্যমে কোন প্রজেক্ট সম্পন্ন করলে সেটিতে দ্রুত সফল হওয়া যায় এবং সেরা আউটপুট লাভ করা যায়। প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্যকে বিভিন্ন কাজে অন্তর্ভুক্ত করাই নেতার প্রধান নীতি। কারন, অন্তর্ভুক্তি পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্ত স্টেকহোল্ডারকে খুশি করা যায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকরী ফল লাভ করা যায়। এতে প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্যদের বিবেচনা, মূল্যায়ন এবং সম্মান দেখানো হয় বলে তারা কর্মোদ্যমী হয় এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ফলে, নেতা কর্তৃক গৃহিত যে কোন পদক্ষেপ সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
নবমতঃ পরমতের উপর শ্রদ্ধাশীলতা: পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা যেকোনো নেতার অন্যতম একটি সুন্দর নীতি, যার দ্বারা তিনি সবার মতামতই সমান গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন এবং উপযুক্ত মনে হলে কাজে লাগাবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে অধস্তন থেকে উর্ধতন সকল ব্যক্তিবর্গের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত ও পরামর্শ নেয়া একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের একান্ত কর্তব্য। এতে সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং তা বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ হয়।
অতএব, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নেতার নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ প্রদর্শন একটি অন্যতম প্রধান নীতি, যা ছাড়া নেতৃত্ব মূল্যহীন এবং অসাড়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতারা নৈতিক বিবেচনার যখন উপরোল্লিখিত নীতিগুলো অনুসরণ করেন, তখন তাদের সামগ্রীক পরিবেশে উচ্চতর সাফল্য লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। নৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানের সদস্যগন কখন এলো বা কখন গেল, শুধুমাত্র এগুলির উপর নজরদারী করার জন্য নয়, বরং তাদের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি অন্যান্য কল্যানধর্মী কর্মকান্ডে উৎসাহিত করে তা সম্পাদন করাই নেতৃত্বের প্রধান নীতি। দৃঢ় নৈতিক অনুশীলন কর্তব্যরত কর্মী ও অনুসারীদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক ও নেতৃত্ব প্রদর্শনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে নৈতিকতা স্থাপন অতীব আবশ্যক যা কর্মস্থলের পরিবেশকে করে শান্তিময় এবং সাফল্য বয়ে আনে অফুরন্ত।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক]