আসফাক বীন রহমান
চিন্তা করে দেখোনা,
কোথায় আসল ঠিকানা ।
চিন্তা করে দেখোনা,
কবর আসল ঠিকানা।
বুকের মাঝখানে ধক করে কথাগুলো ধাক্কা মারলো । বাম দিকে একটু দূরেই হাতে দুটি ক্রাচ নিয়ে এক পা ক্ষতিগ্রস্থ ভদ্রলোক গেয়ে চলেছেন -
কত আদরের মা বাবা মোদের,
কেমন আছে তারা
কবর মাঝার ,
সেকথা আজো অজানা ।
আমরাও চলে যাব,
বেলা অবেলায়
বিদায় বেলা তব দিওগো দেখা
ও প্রিয় রাসূল ।।
বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ‘পারাবত’এর জন্য অপেক্ষায় আছি । আমার মেয়ে জুঁই জোড়ে হাত চেপে ধরে কান্না কান্না কন্ঠে বলল ,“আব্বা উনারা এত কষ্টের গান কেন গায়”?
---উনি সাহায্য চান ।
-----উনাকে টাকা দাও ,উনার পা টা ঠিক করে দাও ।
রেল এবং রেলস্টেশনে আসলে সাহায্যপ্রার্থী কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে চলা অনেক মানুষকে প্রায়ই দেখি।উনাদের আর্তি মনে নাড়া দেয় ।
ট্রেনে ওঠার পর জুঁইয়ের মন খারাপ কমার কোন লক্ষনই দেখতে পাচ্ছি না । ট্রেনে উঠেই জানালার পাশে বসার জন্য তার ভাইয়ের সাথে ব্যাপক কম্পিটিশন চলে । সে-ই চ্যাম্পিয়ন । এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই ।
জুঁইঃ আব্বা, ফকিরেরপুল কয়টা ?
আমিঃ কেনো?
জুঁইঃ এই যে ,আমরা গতকাল একটা ফকিরেরপুলে গিয়েছিলাম। আবার আজকে আর এক ফকিরপুলে যাচ্ছি ।
গতকাল ওদেরকে নিয়ে বিজয়নগরের দিকে গিয়েছিলাম । রাস্তার দুইপাশে ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখার সাথে সাথে সাইন বোর্ডের নিচের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে । বিজয়নগরের ফকিরেরপুলে কোনো প্রফেশনাল ফকির বা পুল কোন কিছুই না দেখে দুই ভাই- বোনই অবাক । এদিক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফকিরেরপুল তাদের নিরাশ করবে না । শহরের মাঝখানের খালের উপর প্রধান সড়কের পুলটি ঘোড়াপট্টি এলাকায় হলেও এখানে বেশ কয়জন অন্ধ সাহায্যপ্রার্থী বসে থাকেন ।
ড্যাঞ্জিনিয়ার দিপুকে রুমে ঢুকতে দেখেই রুমমেট শেলি ঠকাস করে ড্রয়ারের তালা লাগিয়ে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে বসলো । দিপু আজকেও ব্যাগী প্যান্টটা পড়ে আছে ।এই প্যান্টে কতোগুলো পকেটে আছে দিপুও বলতে পারবে না । সে একইসাথে ডাক্তার (হবু) আবার ইঞ্জিনিয়ারও ! মেডিকেলে পড়লে কি হবে তার ঝোঁক ইলেকট্রিক আর ইলেকট্রনিক গুডসের উপর । তার পকেট ভর্তি স্ক্র- ড্রাইভার, সুইচ নাইফ ,টেষ্টারসহ আরো এগাড়া -বেগাড়া অসংখ্য যন্ত্রপাতি । সে যে রুমে যায়, সেখানেই চঞ্চল চোখে দ্রুত জরীপ সেরে কোন একটা ঘড়ি ,টু ইন ওয়ান, ফ্যানের দিকে হাত বাড়ায় । “দিপু চানাচুর খাবে”- এক দৃষ্টিতে সে আমার টেবিলের ওপর টেবিলওয়াচের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি প্রমাদ গুনে বললাম- “ঘড়িটি নতুন ,পড়শুই এটা আমার খালা বিদেশ থেকে উপহার হিসেবে এনে দিয়েছেন- এর দিকে বদ নজরে তাকাবে না ।” সে আসলে স্ক্রু -ড্রাইভার দিয়ে যন্ত্রপাতি খুলতে পারে, পরবর্তীতে কি হবে সেটা ঠিক জানে না । তার দুই রুমমেট প্রায়ই উপযাচক হয়ে হোস্টেলের কে-কোথায় -কোন রুমে নতুন পুরানো ইলেকট্রিক গেজেট নিয়ে ঝামেলায় আছে ,তথ্য সাপ্লাই করে । এই পরিপ্রেক্ষিতে দিপু আমার রুমে । গতকালই ঢাকা থেকে এসেছি এই নতুন টেবিলঘড়িটি নিয়ে । দিপুর রুমমেট সন্ধ্যায় এই ঘড়িটি দেখে গেছে ,সাথে চানাচুরও ।
দিপুঃ কয়দিন থাকলে ?
আমিঃ তিনদিন। তুমি কয়দিন যাও না ?
দিপুঃ দুই মাস ,ফাইনাল প্রফ শেষ করে যেতে যেতে পাঁচ মাস হয়ে যাবে।
পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস দিপু ।
আমিঃ তো ট্র্যাফিক কন্ট্রোল শুরু করছো ?
দিপুঃ হাঃ হাঃ এখন বড় হইছি না ! কয়দিন পর
ডাক্তার হমু না ?
সেকেন্ড প্রফের আগে পড়াশোনার একঘেয়েমী কাটাতে দশ-বারোদিন পর পর বিকালে শহরে যেতো । মেডিকেলের বাসে জাহাজ কোম্পানীর মোড়ের নৃপেনের দোকানে নামতো । গরম গরম রসগোল্লা খেয়ে ট্র্যাফিক আইল্যান্ডে হাত-পা নেড়ে অফচান্সে গাড়ী -ঘোড়া কন্ট্রোল করতো !
ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে । সন্ধ্যায় ওয়ার্ড প্লেসমেন্টের জন্য হাসপাতালে ক্লাশে গিয়েছিলাম , সাথে রিডিং পার্টনার উত্তমদা ।খুব ব্রিলিয়ান্ট উত্তমদা রিটেন পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত, “বাডি , গোডাউনে যে মজুদ আছে পাশ নম্বরতো উঠবেনানি ।” ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ফেলো বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার কেশবলাল সাহার ছেলে উত্তমদা । উনি যখন রিটেন পরীক্ষায় পাশ নাম্বার নিয়ে চিন্তিত ,তখন আমাদের মতো ডাল ব্রেইনের ছাত্রদের আর কি করার আছে । উনার ফটোগ্রাফিক মেমোরি ।একটা পড়া বইয়ের পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে গরগর করে না দেখে পুরোটাই বলতে পারেন । অসাধারণ ধীমান । ওনার সাথে পড়াশোনা করতে বসলে খুবই অসহায় লাগে । একবার পড়ার পর , “ও ছোড ভাই হইছে?” শুনলে অকূলপাথারে পড়ে যাই । আমাকে আরো পড়াশোনার সুযোগ দিয়ে বিভিন্ন রুমে উঁকি ঝুঁকি মেরে পরীক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আইডিয়া নিয়ে আসেন । পাশ নাম্বার ৬০ । সবাই রিটেন, ভায়বা আর ক্লিনিক্যাল প্রতিটাতেই পাস করতে পারবে না , তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বী কোন বন্ধু পাশ করলেতো মান-সম্মান নিয়ে প্রশ্ন ! এজন্য মুক্তা হোস্টেলে উত্তমদার রুমের সামনে আলাদা একটি টেবিল -চেয়ার সহ পেতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পার্শ্ববর্তী পিন্নু হোস্টেলের শামীম ভাই আর লরিন হুজুরের পড়াশোনার উপর মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টা চলছে। ক্লাশে লরিন হুজুর খুব হতাশ হয়ে বলত,“তোরা সারা দিন-রাত পড়াশোনা করিস কিভাবে ? তোদের ঘুম পায় না ?এত এনার্জি কোথায় পাস?”
জুঁইয়ের ঝাঁকুনিতে ছাত্রজীবন থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম , “আব্বা, ওনাদের চোখ এমন কেন ? দেখতে পান না ? ওনাদের গান অন্যরকম কেন ?”
লক্ষ করে দেখেনগো ভাই
চক্ষু দুটি নাই
এই পৃথিবীর ভালো-মন্দ
আমি দেখি নাই ।
আমিঃ বাবু, উনারা চোখে দেখতে পান না ; খুব
অসহায় ।
জুঁইঃ উনারা কি ভিক্ষাকরছেন ? উনারা
ভিক্ষুক ?
- কারবা মনে হবে মায়া
কে করিবে দান ,
যদি দিলে লাগে দয়া
আল্লাহর ওয়াস্তে করো দান ।।
অন্যের সহায়তা ছাড়া তাঁদের জীবন চলা দায় -বলে বিনয়ী মিনতি ।
গরীব দেখো অন্ধের মতো
এই দুনিয়ায় নাই-ই ,
আমি অন্ধ ,কপাল মন্দ
সবারে জানাই ।।
আল্লাহতাআলা খাইবার দিছেন
দশজনের কামাই ।
জুঁইয়ের মন খারাপ ভাব কাটছেই না । এই দুইজন অন্ধ মানুষ নিজেদের চোখে না দেখার আর্তি সবাইকে জানাচ্ছেন । সবার মনকে দয়ার্দ্র করে ফেলেছেন । প্রথমেই নিজের অসহায় নিঃস্ব অবস্থাটা জানিয়ে আল্লাহ- রাসূলের কাছে দাতার জন্য দোয়া এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন ।
বিসমিল্লাহির রহমানুর রহিম
করছেন টাকা দান ,
এই দানের প্রতিদান
আল্লাহ করবেন দান
-হাশরের ময়দান ।
হায়াতো বাড়াইয়া দিও
রিযিক করো দান । ।
জুঁইঃ চোখে অপারেশন করে ভালো করা যাবে না ? উনারা সবার জন্য ভালো চান কেনো ?
আমিঃ , ওনারা ভালো এই জন্য আল্লাহর কাছে সবার ভালো চান ।
ভৈরব স্টেশনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যের জোর-জবরদস্তি দেখে দুই বাচ্চাই ভয় পেয়েছে । “উনারাও চাইলো আর এরাও চাইলো; এতো অন্যরকম কেন ? তার মন ভালো করার জন্য বললাম ” দেখো ,অন্ধ সাহায্যপ্রার্থীরা আত্মসম্মান নিয়ে চলেন ; কারো কাছে সরাসরি ভিক্ষা চান না । বিনিময়ে সুন্দর গান , অন্যের ভালো চাওয়া , কোন আয়াত বলেন ।অনেক সময় উপদেশমূলক কথা গানের মাধ্যমে জানান ।
নামাজ-রোজা ছাইড়ো না
বাবা-মারে ভুইলো না ।।
“চিপস চলবে -পেপসি চলবে ” বলে কিছুই চালাতে পারছি না আজ । অন্য সময় ট্রেনে ওঠার আগে এক দফা চিপস -কোল্ডড্রিংকস শেষ করে রাস্তায় আরেকদফা দান মারে ।
জুঁইয়ের মন খারাপ আস্তে আস্তে আমাকেও সংক্রমিত করে । ভৈরবের মেঘনা ব্রিজের উপর হতে আশুগন্জের সোনারামপুর চর পার করে দূরে আকাশের মেঘের মধ্যে দিপু আর উত্তমদার মুখগুলো দেখার চেষ্টা করি । দুই দুইজন হাসি- খুশী তুখোর ডাক্তার আকাশের কোন ঠিকানায় হারিয়ে গেলো ?
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।]
আসফাক বীন রহমান
বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন ২০২২
চিন্তা করে দেখোনা,
কোথায় আসল ঠিকানা ।
চিন্তা করে দেখোনা,
কবর আসল ঠিকানা।
বুকের মাঝখানে ধক করে কথাগুলো ধাক্কা মারলো । বাম দিকে একটু দূরেই হাতে দুটি ক্রাচ নিয়ে এক পা ক্ষতিগ্রস্থ ভদ্রলোক গেয়ে চলেছেন -
কত আদরের মা বাবা মোদের,
কেমন আছে তারা
কবর মাঝার ,
সেকথা আজো অজানা ।
আমরাও চলে যাব,
বেলা অবেলায়
বিদায় বেলা তব দিওগো দেখা
ও প্রিয় রাসূল ।।
বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ‘পারাবত’এর জন্য অপেক্ষায় আছি । আমার মেয়ে জুঁই জোড়ে হাত চেপে ধরে কান্না কান্না কন্ঠে বলল ,“আব্বা উনারা এত কষ্টের গান কেন গায়”?
---উনি সাহায্য চান ।
-----উনাকে টাকা দাও ,উনার পা টা ঠিক করে দাও ।
রেল এবং রেলস্টেশনে আসলে সাহায্যপ্রার্থী কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে চলা অনেক মানুষকে প্রায়ই দেখি।উনাদের আর্তি মনে নাড়া দেয় ।
ট্রেনে ওঠার পর জুঁইয়ের মন খারাপ কমার কোন লক্ষনই দেখতে পাচ্ছি না । ট্রেনে উঠেই জানালার পাশে বসার জন্য তার ভাইয়ের সাথে ব্যাপক কম্পিটিশন চলে । সে-ই চ্যাম্পিয়ন । এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই ।
জুঁইঃ আব্বা, ফকিরেরপুল কয়টা ?
আমিঃ কেনো?
জুঁইঃ এই যে ,আমরা গতকাল একটা ফকিরেরপুলে গিয়েছিলাম। আবার আজকে আর এক ফকিরপুলে যাচ্ছি ।
গতকাল ওদেরকে নিয়ে বিজয়নগরের দিকে গিয়েছিলাম । রাস্তার দুইপাশে ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখার সাথে সাথে সাইন বোর্ডের নিচের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে । বিজয়নগরের ফকিরেরপুলে কোনো প্রফেশনাল ফকির বা পুল কোন কিছুই না দেখে দুই ভাই- বোনই অবাক । এদিক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফকিরেরপুল তাদের নিরাশ করবে না । শহরের মাঝখানের খালের উপর প্রধান সড়কের পুলটি ঘোড়াপট্টি এলাকায় হলেও এখানে বেশ কয়জন অন্ধ সাহায্যপ্রার্থী বসে থাকেন ।
ড্যাঞ্জিনিয়ার দিপুকে রুমে ঢুকতে দেখেই রুমমেট শেলি ঠকাস করে ড্রয়ারের তালা লাগিয়ে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে বসলো । দিপু আজকেও ব্যাগী প্যান্টটা পড়ে আছে ।এই প্যান্টে কতোগুলো পকেটে আছে দিপুও বলতে পারবে না । সে একইসাথে ডাক্তার (হবু) আবার ইঞ্জিনিয়ারও ! মেডিকেলে পড়লে কি হবে তার ঝোঁক ইলেকট্রিক আর ইলেকট্রনিক গুডসের উপর । তার পকেট ভর্তি স্ক্র- ড্রাইভার, সুইচ নাইফ ,টেষ্টারসহ আরো এগাড়া -বেগাড়া অসংখ্য যন্ত্রপাতি । সে যে রুমে যায়, সেখানেই চঞ্চল চোখে দ্রুত জরীপ সেরে কোন একটা ঘড়ি ,টু ইন ওয়ান, ফ্যানের দিকে হাত বাড়ায় । “দিপু চানাচুর খাবে”- এক দৃষ্টিতে সে আমার টেবিলের ওপর টেবিলওয়াচের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি প্রমাদ গুনে বললাম- “ঘড়িটি নতুন ,পড়শুই এটা আমার খালা বিদেশ থেকে উপহার হিসেবে এনে দিয়েছেন- এর দিকে বদ নজরে তাকাবে না ।” সে আসলে স্ক্রু -ড্রাইভার দিয়ে যন্ত্রপাতি খুলতে পারে, পরবর্তীতে কি হবে সেটা ঠিক জানে না । তার দুই রুমমেট প্রায়ই উপযাচক হয়ে হোস্টেলের কে-কোথায় -কোন রুমে নতুন পুরানো ইলেকট্রিক গেজেট নিয়ে ঝামেলায় আছে ,তথ্য সাপ্লাই করে । এই পরিপ্রেক্ষিতে দিপু আমার রুমে । গতকালই ঢাকা থেকে এসেছি এই নতুন টেবিলঘড়িটি নিয়ে । দিপুর রুমমেট সন্ধ্যায় এই ঘড়িটি দেখে গেছে ,সাথে চানাচুরও ।
দিপুঃ কয়দিন থাকলে ?
আমিঃ তিনদিন। তুমি কয়দিন যাও না ?
দিপুঃ দুই মাস ,ফাইনাল প্রফ শেষ করে যেতে যেতে পাঁচ মাস হয়ে যাবে।
পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস দিপু ।
আমিঃ তো ট্র্যাফিক কন্ট্রোল শুরু করছো ?
দিপুঃ হাঃ হাঃ এখন বড় হইছি না ! কয়দিন পর
ডাক্তার হমু না ?
সেকেন্ড প্রফের আগে পড়াশোনার একঘেয়েমী কাটাতে দশ-বারোদিন পর পর বিকালে শহরে যেতো । মেডিকেলের বাসে জাহাজ কোম্পানীর মোড়ের নৃপেনের দোকানে নামতো । গরম গরম রসগোল্লা খেয়ে ট্র্যাফিক আইল্যান্ডে হাত-পা নেড়ে অফচান্সে গাড়ী -ঘোড়া কন্ট্রোল করতো !
ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে । সন্ধ্যায় ওয়ার্ড প্লেসমেন্টের জন্য হাসপাতালে ক্লাশে গিয়েছিলাম , সাথে রিডিং পার্টনার উত্তমদা ।খুব ব্রিলিয়ান্ট উত্তমদা রিটেন পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত, “বাডি , গোডাউনে যে মজুদ আছে পাশ নম্বরতো উঠবেনানি ।” ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ফেলো বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার কেশবলাল সাহার ছেলে উত্তমদা । উনি যখন রিটেন পরীক্ষায় পাশ নাম্বার নিয়ে চিন্তিত ,তখন আমাদের মতো ডাল ব্রেইনের ছাত্রদের আর কি করার আছে । উনার ফটোগ্রাফিক মেমোরি ।একটা পড়া বইয়ের পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে গরগর করে না দেখে পুরোটাই বলতে পারেন । অসাধারণ ধীমান । ওনার সাথে পড়াশোনা করতে বসলে খুবই অসহায় লাগে । একবার পড়ার পর , “ও ছোড ভাই হইছে?” শুনলে অকূলপাথারে পড়ে যাই । আমাকে আরো পড়াশোনার সুযোগ দিয়ে বিভিন্ন রুমে উঁকি ঝুঁকি মেরে পরীক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আইডিয়া নিয়ে আসেন । পাশ নাম্বার ৬০ । সবাই রিটেন, ভায়বা আর ক্লিনিক্যাল প্রতিটাতেই পাস করতে পারবে না , তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বী কোন বন্ধু পাশ করলেতো মান-সম্মান নিয়ে প্রশ্ন ! এজন্য মুক্তা হোস্টেলে উত্তমদার রুমের সামনে আলাদা একটি টেবিল -চেয়ার সহ পেতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পার্শ্ববর্তী পিন্নু হোস্টেলের শামীম ভাই আর লরিন হুজুরের পড়াশোনার উপর মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টা চলছে। ক্লাশে লরিন হুজুর খুব হতাশ হয়ে বলত,“তোরা সারা দিন-রাত পড়াশোনা করিস কিভাবে ? তোদের ঘুম পায় না ?এত এনার্জি কোথায় পাস?”
জুঁইয়ের ঝাঁকুনিতে ছাত্রজীবন থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম , “আব্বা, ওনাদের চোখ এমন কেন ? দেখতে পান না ? ওনাদের গান অন্যরকম কেন ?”
লক্ষ করে দেখেনগো ভাই
চক্ষু দুটি নাই
এই পৃথিবীর ভালো-মন্দ
আমি দেখি নাই ।
আমিঃ বাবু, উনারা চোখে দেখতে পান না ; খুব
অসহায় ।
জুঁইঃ উনারা কি ভিক্ষাকরছেন ? উনারা
ভিক্ষুক ?
- কারবা মনে হবে মায়া
কে করিবে দান ,
যদি দিলে লাগে দয়া
আল্লাহর ওয়াস্তে করো দান ।।
অন্যের সহায়তা ছাড়া তাঁদের জীবন চলা দায় -বলে বিনয়ী মিনতি ।
গরীব দেখো অন্ধের মতো
এই দুনিয়ায় নাই-ই ,
আমি অন্ধ ,কপাল মন্দ
সবারে জানাই ।।
আল্লাহতাআলা খাইবার দিছেন
দশজনের কামাই ।
জুঁইয়ের মন খারাপ ভাব কাটছেই না । এই দুইজন অন্ধ মানুষ নিজেদের চোখে না দেখার আর্তি সবাইকে জানাচ্ছেন । সবার মনকে দয়ার্দ্র করে ফেলেছেন । প্রথমেই নিজের অসহায় নিঃস্ব অবস্থাটা জানিয়ে আল্লাহ- রাসূলের কাছে দাতার জন্য দোয়া এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন ।
বিসমিল্লাহির রহমানুর রহিম
করছেন টাকা দান ,
এই দানের প্রতিদান
আল্লাহ করবেন দান
-হাশরের ময়দান ।
হায়াতো বাড়াইয়া দিও
রিযিক করো দান । ।
জুঁইঃ চোখে অপারেশন করে ভালো করা যাবে না ? উনারা সবার জন্য ভালো চান কেনো ?
আমিঃ , ওনারা ভালো এই জন্য আল্লাহর কাছে সবার ভালো চান ।
ভৈরব স্টেশনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যের জোর-জবরদস্তি দেখে দুই বাচ্চাই ভয় পেয়েছে । “উনারাও চাইলো আর এরাও চাইলো; এতো অন্যরকম কেন ? তার মন ভালো করার জন্য বললাম ” দেখো ,অন্ধ সাহায্যপ্রার্থীরা আত্মসম্মান নিয়ে চলেন ; কারো কাছে সরাসরি ভিক্ষা চান না । বিনিময়ে সুন্দর গান , অন্যের ভালো চাওয়া , কোন আয়াত বলেন ।অনেক সময় উপদেশমূলক কথা গানের মাধ্যমে জানান ।
নামাজ-রোজা ছাইড়ো না
বাবা-মারে ভুইলো না ।।
“চিপস চলবে -পেপসি চলবে ” বলে কিছুই চালাতে পারছি না আজ । অন্য সময় ট্রেনে ওঠার আগে এক দফা চিপস -কোল্ডড্রিংকস শেষ করে রাস্তায় আরেকদফা দান মারে ।
জুঁইয়ের মন খারাপ আস্তে আস্তে আমাকেও সংক্রমিত করে । ভৈরবের মেঘনা ব্রিজের উপর হতে আশুগন্জের সোনারামপুর চর পার করে দূরে আকাশের মেঘের মধ্যে দিপু আর উত্তমদার মুখগুলো দেখার চেষ্টা করি । দুই দুইজন হাসি- খুশী তুখোর ডাক্তার আকাশের কোন ঠিকানায় হারিয়ে গেলো ?
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।]