মাহমুদুল হাছান
প্রিয় এস এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থী বন্ধুরা! তোমাদের জন্যই আমার এ লেখা। ইতোমধ্যে তোমরা জেনে গেছো তোমাদের পরীক্ষার দিন, ক্ষণ ও বিষয় ভিত্তিক সময়সূচি। পরীক্ষার পূর্বে একটূ হলেও মেন্টাল স্ট্রেস বা মানসিক চাপতো তোমরা বোধ করছো। কি পড়বে, কিভাবে পড়বে, পরীক্ষা কেমন হবে, পড়লেও মনে থাকছে না কেন, পরীক্ষার রুমের পরিবেশ কেমন হবে, রিজাল্ট ভালো হবে তো? ইত্যকার নানা দুশ্চিন্তা তোমাদের মাথায় ভর করে বসতে পারে। মনে রাখবে, কি হবে, কেমন হবে, এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তোমরা তোমাদের বর্তমান সময়টুকুকে কিভাবে কাজে লাগাচ্ছো, সেটিই তোমাদেরকে ভাবতে হবে। জানোইতো করোনা পরবর্তিকালে অনুষ্ঠিতব্য এ পরীক্ষার বই ও বিষয়বস্তু কমিয়ে তোমাদের ভালো প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অতএব সুযোগটি কাজে লাগাও। নিম্নের কয়েকটি পরামর্শ তোমাদের উপকারে আসতে পারেঃ
ধরো, পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে বা পরীক্ষা চলছে। তোমাদের প্রথম কাজটি হবে কিভাবে সুস্থ থাকা যায়। ঠিক মতো পানাহার করা, পুষ্টিকর খাবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং নিয়মিত ঘুম ও বিশ্রাম নেয়া হবে তোমাদের সকল কাজের মধ্যে অন্যতম। শরীর ভালো থাকলে মানসিক অবস্থা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। হতে পারে, পরীক্ষার জন্য তোমাদের ভীষণ টেননশন হচ্ছে, তোমরা ভেঙ্গে পড়বে না। তোমাদের মনোবল দৃঢ় রাখতে হবে এবং এজন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল আস্থা রেখে পড়াশোনার প্রতি মনস্থির করতে হবে। তবে গভীর রাত জেগে রুটিনের বাইরে বেশি পড়া ঠিক হবে না। প্রস্তুতির জন্য নিয়ম মেনে বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে পড়াশোনা করলে, সেটি টেকসই হবে এবং স্মৃতিতে ধরে রাখা সহজ হবে।
পরীক্ষা শুরু হতে যদি আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকে, তাহলে যে সকল সাবজেক্ট পরীক্ষার রুটিনের শেষের দিকে রয়েছে সেগুলির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পরীক্ষা শুরুর আগের দু’দিন থেকে তোমাদেরকে বিষয়ভিত্তিক পড়ার প্রতি নিবেদিত থাকতে হবে; তখন অন্য সাবজেক্ট পড়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার ঠিক আগের দিনটিতে গড়পড়তায় বইয়ের সবকছু পড়া ঠিক নয়। এতে যথেষ্ঠ সময় পাবে না এবং পুরা বই শেষও করতে পারবে না। ফলে ব্রেইন লকড হয়ে যেতে পারে এবং মানসিক দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে। যেটি করতে হবে সেটি হলো, গোটা বইয়ের মাঝে যেগুলো বেশি গুরুত্বপুর্ণ সেগুলির প্রতি নজর দিবে। ভুলেও নতুন করে মুখস্ত করার চেষ্টা করা যাবে না, বরং চোখ বুলিয়ে তা আত্মস্থ করতে হবে।
পরীক্ষার আগের রাতে মোটেও রাত জাগা যাবে না, এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, মস্তিষ্কের জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক, যা তোমাদেরকে স্মৃতিভ্রম করে তুলতে পারে। উত্তম কাজ হলো এ রাতে যতটুকু সম্ভব ব্রেইনকে বিশ্রাম দিতে হবে। বেশি কথা বললে, কারোর সাথে অযথা আড্ডায় বসলে, সহপাঠী বা ভাইবোনদের সাথে ঝগড়াঝাটি করলে কিংবা যেকোন কারণে মনমেজাজ খারাপ করলে মস্তিস্কের ক্ষতি হতে পারে, যা পরীক্ষার কক্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পরীক্ষার আগের দিনগুলিতে দ্রুত পড়া মনে রাখার জন্য শুধুমাত্র নির্বাচিত কিছু প্রশ্ন পড়তে পারো। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ কার্ড তৈরী করে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কীওয়ার্ড বা মেইন পয়েন্ট লিখে লিখে পড়তে পারলে পরীক্ষার্থীর জন্য পড়া মনে রাখতে অনেক সহজ হবে। ম্যাথম্যাটিকস বা সাইন্স সাবজেক্টগুলির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য থিওরি ও সূত্রসমষ্টির উপর চোখ বোলান ভালো। অন্যান্য সাবজেক্টগুলির ব্যাপারে যে সকল অধ্যায়ে তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ফ্লাশকার্ড, চিরকুট বা নির্দিষ্ট কাগজে তথ্যভিত্তিক পয়েন্ট লিখে পড়তে পারলে পরীক্ষায় ভালো করার সম্ভাবনা থাকে।
ইতোমধ্যে যেহেতু তোমরা রেজিস্ট্রেশন কার্ড, প্রবেশপত্র হাতে পেয়ে গেছো, সেহেতু পরীক্ষার আগের দিন রাতে এগুলিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন কলম, পেন্সিল, রুলার ইত্যাদি একটি ট্রান্সপারেন্ট ফাইলে সাজিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকতুল্য কারোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোনভাবেই রঙিন ফাইল বহন করা যাবে না এবং প্রবেশপত্র ও রেজিষ্ট্রেশন কার্ডের মূলকপি নিতে হবে। কোন কারণে আবশ্যিক কাগজপত্র নিতে ভুলে গেলে সাথে সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বা শিক্ষককে অবহিত করে সমাধান করতে হবে। কোনরকম চেচামেচি বা হৈ-হুল্লোড় করা যাবে না।
শিক্ষার্থীরা ছেলে হোক বা মেয়ে, প্রত্যেককে শালীন পোষাক পরে পরীক্ষা কক্ষে যেতে হবে। স্কুলের ইউনিফর্ম থাকলে সেটি পরে যাওয়াই সর্বোত্তম। ছেলেদের চুল ছোট রাখা এবং মেয়েদের চুলে ঝুটি বা বেণী বেধে যাওয়া শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়ক। অতিরিক্ত কোন প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার না করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, প্রবেশপত্রে কিছু নির্দেশিকা লেখা রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে তোমাদেরকে মেনে চলতে হবে।
পরীক্ষা শুরুর আগে তোমাদের উচিত তোমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে দোয়া ও আশীর্বাদ নেয়া। তবে এটি প্রতিদিন না হলেও চলবে। প্রথম পরীক্ষার দিন তোমরা অবশ্যই বাসা বা বাড়ি থেকে এমন সময় রওনা হবে যেন পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে পয়তাল্লিশ মিনিট আগে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারো। কারণ, এদিনে তোমাদেরকে প্রথমে আসন বিন্যাস দেখে নিতে হবে এবং যে রুমে আসন পড়েছে সেটি চিনে যথাসময়ে নিজ আসন গ্রহন করতে হবে। এরপর অন্যান্য দিনে পনেরো মিনিট থেকে আধাঘন্টা আগে পৌঁছালে যথেষ্ঠ। মনে রাখতে হবে যে সকল শহরে ট্রাফিক জ্যাম তীব্র সেখানকার পরীক্ষার্থী হলে তাদেরকে আরো সচেতনভাবে বের হতে হবে।
পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের পর কোন কছুতেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আসন চিনতে সমস্যা হলে নিকটতম কারোর সাহায্য নিতে পারো। পরীক্ষা কক্ষে প্রবেশের পূর্বে ওয়াশরুমের কাজটি সেরে নেয়া ভালো, যেন পরীক্ষা চলাকালে বাইরে বের হতে না হয়।হ্ পরীক্ষা কক্ষে ঢোকার পর হাতে সময় থাকলে চুপচাপ বসে বসে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা করবে। কারোর সাথে খোশ আলাপ বা বাহুল্য তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে না। এ সময়টুকুতে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখাই শ্রেয়। পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষক প্রবেশ করার সাথে সাথে তাকে সালাম বা শুভেচ্ছা জানানো কর্তব্য। নিয়ম অনুযায়ী উত্তরপত্র হাতে পেলে খুব সতর্কতার সাথে তোমাদের তথ্য প্রদান করবে এবং কোথাও আটকে গেলে বা ফর্ম পূরণে ভুল হলে অনতিবিলম্বে শিক্ষককে অবহিত করে তা ঠিক করে নিবে। এরপর উত্তরপত্রটি লেখার জন্য প্রস্তুত করবে যেমন; মার্জিন টানা, পৃষ্ঠা নম্বর দেয়া ও কোন ছেড়া-ফাটা পৃষ্ঠা আছে কি না দেখে নিবে।
পরীক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত নির্ধারিত সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের পূর্ণ সৎ ব্যবহার করবে। প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার সাথে সাথে গোটা প্রশ্নের উপর একবার চোখ বুলিয়ে যেটি সহজ পারতপক্ষে সেটি দিয়ে লেখা আরম্ভ করবে। তবে প্রশ্নের ক্রমধারা ঠিক রেখে লিখতে পারলে উত্তম। পরীক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রথম, মাঝের ও শেষ উত্তরগুলো ভালো হওয়া কাম্য। মোটকথা, উত্তরপত্রের পরিচ্ছন্নতা, শ্রীমান, যথাযথ মার্জিন, এক প্রশ্ন থেকে আরেকটির মধ্যে পরিমিত গ্যাপ, কাটাছেঁড়া কম করা, বিভিন্ন কালির কলমের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি পদ্ধতিগুলো মেনে চলা উচিত। সাধারনতঃ কালো কালির কলম দিয়েই উত্তর লিখতে হয়, তবে মার্জিন টানার জন্য পেন্সিল এবং শীরনাম লিখতে নীল কালির কলম ব্যবহার করা যেতে পারে। পরীক্ষার খাতায় ওভার রাইটিং করা দোষণীয়।
পরীক্ষা কক্ষে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত কাগজপত্র নেয়া ঠিক নয়। ভুলেও কোন ধরণের অসদুপায় অবলম্বন করা, পাসের সিটের অন্য পরীক্ষার্থীর সাথে কথা বলা বা টুকরা কাগজ কোথাও ছুড়ে মারা আইনত দণ্ডনীয়। আবার নিজের পায়ের আশপাশে টুকরো কোন কাগজ পড়ে থাকলে সাথে সাথে হল পরিদর্শককে অবহিত করতে হবে।
উত্তরপত্রে যে কয়টি প্রশ্নের উত্তর লেখার কথা ঠিক সে কয়টি লেখার চেষ্টা করবে। কমও লেখা যাবে না আবার বেশিতো নয়ই। মনে রাখতে হবে, বরাদ্দকৃত সময়ের অন্ততপক্ষে দশ মিনিট আগেই লেখা শেষ করার চেষ্টা করবে। ধরো, দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার লেখা শেষ হচ্ছে না, তবুও তোমাদেরকেতো উত্তরপত্র জমা দিতে হবে। তাই লেখা শেষ না হলেও তোমাদের লেখা থামিয়ে নিচে একটি ক্ষুদ্র দাগ টেনে এন্ডিং মার্ক (সমাপ্তিসূচক চিহ্ন) দেয়া উচিত। আর যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারো, তাহলে উত্তরগুলো বারবার রিভিশন করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর ঠিকমত লেখা হয়েছে কিনা, ক্রমিক নম্বর সঠিকভাবে লিখতে পেরেছো কি না, তথ্যগত ভুল আছে কি না, এগুলি পুনরায় দেখে নিতে হবে। বিশেষ করে উত্তরপত্রের উপরের তথ্য ফর্মটিতে তোমার নিজের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, রোল নম্বর ইত্যাদি সঠিক আছে কি না তা ভালোভাবে চেক করে নিতে হবে। লিখতে লিখতে উত্তপত্রের মূল অংশ শেষ হয়ে গেলে অতিরিক্ত লুজসিট নেয়া লাগতে পারে, সেক্ষেত্রে লুজশিটের ক্রমিক সংখ্যা মুলপত্রের যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি নিশ্চিত করে যথাযথভাবে সেলাই বা পিন আপ করতে হবে।
এবার তোমাদের উত্তরপত্র লেখা ও রিভিশন শেষ হয়ে গেলে খাতাটি সুন্দরভাবে সাজিয়ে হল পরিদর্শকের নিকট জমা দিতে হবে। খাতা জমাদানকালে শিক্ষককে আবার সালাম দিয়ে হল ত্যাগের প্রস্তুতি নিবে। মনে রাখবে, হল ত্যাগের পূর্বে কলম, পেন্সিল, প্রবেশ পত্র ও রেজিষ্ট্রেশন কার্ড যথাযথভাবে ফাইলের মধ্যে গুছিয়ে নিতে হবে।
সর্বোপরি, প্রিয় পরীক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমরা একটি কথা অবশ্যই মনে রাখবে, পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতির জন্য সকলের দোয়া ও শুভেচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উঠতে, বসতে, চলতে ফিরতে কারোর সাথে অসদাচারণ করবে না। যাদেরকে সম্মান দেয়ার তাদেরকে সম্মান দিবে এবং যাদেরকে স্নেহ করার তাদেরকে স্নেহ করবে। আশাকরি তোমাদের পরীক্ষা ভালো হবে এবং তোমরা একটি সন্তষজনক রেজাল্ট অর্জন করবে। আমার দোয়া ও আশীর্বাদ তোমাদেরই জন্য।
[লেখক:প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]
মাহমুদুল হাছান
রোববার, ১২ জুন ২০২২
প্রিয় এস এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থী বন্ধুরা! তোমাদের জন্যই আমার এ লেখা। ইতোমধ্যে তোমরা জেনে গেছো তোমাদের পরীক্ষার দিন, ক্ষণ ও বিষয় ভিত্তিক সময়সূচি। পরীক্ষার পূর্বে একটূ হলেও মেন্টাল স্ট্রেস বা মানসিক চাপতো তোমরা বোধ করছো। কি পড়বে, কিভাবে পড়বে, পরীক্ষা কেমন হবে, পড়লেও মনে থাকছে না কেন, পরীক্ষার রুমের পরিবেশ কেমন হবে, রিজাল্ট ভালো হবে তো? ইত্যকার নানা দুশ্চিন্তা তোমাদের মাথায় ভর করে বসতে পারে। মনে রাখবে, কি হবে, কেমন হবে, এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তোমরা তোমাদের বর্তমান সময়টুকুকে কিভাবে কাজে লাগাচ্ছো, সেটিই তোমাদেরকে ভাবতে হবে। জানোইতো করোনা পরবর্তিকালে অনুষ্ঠিতব্য এ পরীক্ষার বই ও বিষয়বস্তু কমিয়ে তোমাদের ভালো প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অতএব সুযোগটি কাজে লাগাও। নিম্নের কয়েকটি পরামর্শ তোমাদের উপকারে আসতে পারেঃ
ধরো, পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে বা পরীক্ষা চলছে। তোমাদের প্রথম কাজটি হবে কিভাবে সুস্থ থাকা যায়। ঠিক মতো পানাহার করা, পুষ্টিকর খাবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং নিয়মিত ঘুম ও বিশ্রাম নেয়া হবে তোমাদের সকল কাজের মধ্যে অন্যতম। শরীর ভালো থাকলে মানসিক অবস্থা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। হতে পারে, পরীক্ষার জন্য তোমাদের ভীষণ টেননশন হচ্ছে, তোমরা ভেঙ্গে পড়বে না। তোমাদের মনোবল দৃঢ় রাখতে হবে এবং এজন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল আস্থা রেখে পড়াশোনার প্রতি মনস্থির করতে হবে। তবে গভীর রাত জেগে রুটিনের বাইরে বেশি পড়া ঠিক হবে না। প্রস্তুতির জন্য নিয়ম মেনে বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে পড়াশোনা করলে, সেটি টেকসই হবে এবং স্মৃতিতে ধরে রাখা সহজ হবে।
পরীক্ষা শুরু হতে যদি আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকে, তাহলে যে সকল সাবজেক্ট পরীক্ষার রুটিনের শেষের দিকে রয়েছে সেগুলির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পরীক্ষা শুরুর আগের দু’দিন থেকে তোমাদেরকে বিষয়ভিত্তিক পড়ার প্রতি নিবেদিত থাকতে হবে; তখন অন্য সাবজেক্ট পড়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার ঠিক আগের দিনটিতে গড়পড়তায় বইয়ের সবকছু পড়া ঠিক নয়। এতে যথেষ্ঠ সময় পাবে না এবং পুরা বই শেষও করতে পারবে না। ফলে ব্রেইন লকড হয়ে যেতে পারে এবং মানসিক দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে। যেটি করতে হবে সেটি হলো, গোটা বইয়ের মাঝে যেগুলো বেশি গুরুত্বপুর্ণ সেগুলির প্রতি নজর দিবে। ভুলেও নতুন করে মুখস্ত করার চেষ্টা করা যাবে না, বরং চোখ বুলিয়ে তা আত্মস্থ করতে হবে।
পরীক্ষার আগের রাতে মোটেও রাত জাগা যাবে না, এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, মস্তিষ্কের জন্য আরো বেশি বিপজ্জনক, যা তোমাদেরকে স্মৃতিভ্রম করে তুলতে পারে। উত্তম কাজ হলো এ রাতে যতটুকু সম্ভব ব্রেইনকে বিশ্রাম দিতে হবে। বেশি কথা বললে, কারোর সাথে অযথা আড্ডায় বসলে, সহপাঠী বা ভাইবোনদের সাথে ঝগড়াঝাটি করলে কিংবা যেকোন কারণে মনমেজাজ খারাপ করলে মস্তিস্কের ক্ষতি হতে পারে, যা পরীক্ষার কক্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পরীক্ষার আগের দিনগুলিতে দ্রুত পড়া মনে রাখার জন্য শুধুমাত্র নির্বাচিত কিছু প্রশ্ন পড়তে পারো। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ কার্ড তৈরী করে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কীওয়ার্ড বা মেইন পয়েন্ট লিখে লিখে পড়তে পারলে পরীক্ষার্থীর জন্য পড়া মনে রাখতে অনেক সহজ হবে। ম্যাথম্যাটিকস বা সাইন্স সাবজেক্টগুলির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য থিওরি ও সূত্রসমষ্টির উপর চোখ বোলান ভালো। অন্যান্য সাবজেক্টগুলির ব্যাপারে যে সকল অধ্যায়ে তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ফ্লাশকার্ড, চিরকুট বা নির্দিষ্ট কাগজে তথ্যভিত্তিক পয়েন্ট লিখে পড়তে পারলে পরীক্ষায় ভালো করার সম্ভাবনা থাকে।
ইতোমধ্যে যেহেতু তোমরা রেজিস্ট্রেশন কার্ড, প্রবেশপত্র হাতে পেয়ে গেছো, সেহেতু পরীক্ষার আগের দিন রাতে এগুলিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন কলম, পেন্সিল, রুলার ইত্যাদি একটি ট্রান্সপারেন্ট ফাইলে সাজিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকতুল্য কারোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোনভাবেই রঙিন ফাইল বহন করা যাবে না এবং প্রবেশপত্র ও রেজিষ্ট্রেশন কার্ডের মূলকপি নিতে হবে। কোন কারণে আবশ্যিক কাগজপত্র নিতে ভুলে গেলে সাথে সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বা শিক্ষককে অবহিত করে সমাধান করতে হবে। কোনরকম চেচামেচি বা হৈ-হুল্লোড় করা যাবে না।
শিক্ষার্থীরা ছেলে হোক বা মেয়ে, প্রত্যেককে শালীন পোষাক পরে পরীক্ষা কক্ষে যেতে হবে। স্কুলের ইউনিফর্ম থাকলে সেটি পরে যাওয়াই সর্বোত্তম। ছেলেদের চুল ছোট রাখা এবং মেয়েদের চুলে ঝুটি বা বেণী বেধে যাওয়া শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়ক। অতিরিক্ত কোন প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার না করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, প্রবেশপত্রে কিছু নির্দেশিকা লেখা রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে তোমাদেরকে মেনে চলতে হবে।
পরীক্ষা শুরুর আগে তোমাদের উচিত তোমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে দোয়া ও আশীর্বাদ নেয়া। তবে এটি প্রতিদিন না হলেও চলবে। প্রথম পরীক্ষার দিন তোমরা অবশ্যই বাসা বা বাড়ি থেকে এমন সময় রওনা হবে যেন পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে পয়তাল্লিশ মিনিট আগে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারো। কারণ, এদিনে তোমাদেরকে প্রথমে আসন বিন্যাস দেখে নিতে হবে এবং যে রুমে আসন পড়েছে সেটি চিনে যথাসময়ে নিজ আসন গ্রহন করতে হবে। এরপর অন্যান্য দিনে পনেরো মিনিট থেকে আধাঘন্টা আগে পৌঁছালে যথেষ্ঠ। মনে রাখতে হবে যে সকল শহরে ট্রাফিক জ্যাম তীব্র সেখানকার পরীক্ষার্থী হলে তাদেরকে আরো সচেতনভাবে বের হতে হবে।
পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশের পর কোন কছুতেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আসন চিনতে সমস্যা হলে নিকটতম কারোর সাহায্য নিতে পারো। পরীক্ষা কক্ষে প্রবেশের পূর্বে ওয়াশরুমের কাজটি সেরে নেয়া ভালো, যেন পরীক্ষা চলাকালে বাইরে বের হতে না হয়।হ্ পরীক্ষা কক্ষে ঢোকার পর হাতে সময় থাকলে চুপচাপ বসে বসে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা করবে। কারোর সাথে খোশ আলাপ বা বাহুল্য তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে না। এ সময়টুকুতে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখাই শ্রেয়। পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষক প্রবেশ করার সাথে সাথে তাকে সালাম বা শুভেচ্ছা জানানো কর্তব্য। নিয়ম অনুযায়ী উত্তরপত্র হাতে পেলে খুব সতর্কতার সাথে তোমাদের তথ্য প্রদান করবে এবং কোথাও আটকে গেলে বা ফর্ম পূরণে ভুল হলে অনতিবিলম্বে শিক্ষককে অবহিত করে তা ঠিক করে নিবে। এরপর উত্তরপত্রটি লেখার জন্য প্রস্তুত করবে যেমন; মার্জিন টানা, পৃষ্ঠা নম্বর দেয়া ও কোন ছেড়া-ফাটা পৃষ্ঠা আছে কি না দেখে নিবে।
পরীক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত নির্ধারিত সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের পূর্ণ সৎ ব্যবহার করবে। প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার সাথে সাথে গোটা প্রশ্নের উপর একবার চোখ বুলিয়ে যেটি সহজ পারতপক্ষে সেটি দিয়ে লেখা আরম্ভ করবে। তবে প্রশ্নের ক্রমধারা ঠিক রেখে লিখতে পারলে উত্তম। পরীক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রথম, মাঝের ও শেষ উত্তরগুলো ভালো হওয়া কাম্য। মোটকথা, উত্তরপত্রের পরিচ্ছন্নতা, শ্রীমান, যথাযথ মার্জিন, এক প্রশ্ন থেকে আরেকটির মধ্যে পরিমিত গ্যাপ, কাটাছেঁড়া কম করা, বিভিন্ন কালির কলমের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি পদ্ধতিগুলো মেনে চলা উচিত। সাধারনতঃ কালো কালির কলম দিয়েই উত্তর লিখতে হয়, তবে মার্জিন টানার জন্য পেন্সিল এবং শীরনাম লিখতে নীল কালির কলম ব্যবহার করা যেতে পারে। পরীক্ষার খাতায় ওভার রাইটিং করা দোষণীয়।
পরীক্ষা কক্ষে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত কাগজপত্র নেয়া ঠিক নয়। ভুলেও কোন ধরণের অসদুপায় অবলম্বন করা, পাসের সিটের অন্য পরীক্ষার্থীর সাথে কথা বলা বা টুকরা কাগজ কোথাও ছুড়ে মারা আইনত দণ্ডনীয়। আবার নিজের পায়ের আশপাশে টুকরো কোন কাগজ পড়ে থাকলে সাথে সাথে হল পরিদর্শককে অবহিত করতে হবে।
উত্তরপত্রে যে কয়টি প্রশ্নের উত্তর লেখার কথা ঠিক সে কয়টি লেখার চেষ্টা করবে। কমও লেখা যাবে না আবার বেশিতো নয়ই। মনে রাখতে হবে, বরাদ্দকৃত সময়ের অন্ততপক্ষে দশ মিনিট আগেই লেখা শেষ করার চেষ্টা করবে। ধরো, দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার লেখা শেষ হচ্ছে না, তবুও তোমাদেরকেতো উত্তরপত্র জমা দিতে হবে। তাই লেখা শেষ না হলেও তোমাদের লেখা থামিয়ে নিচে একটি ক্ষুদ্র দাগ টেনে এন্ডিং মার্ক (সমাপ্তিসূচক চিহ্ন) দেয়া উচিত। আর যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারো, তাহলে উত্তরগুলো বারবার রিভিশন করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর ঠিকমত লেখা হয়েছে কিনা, ক্রমিক নম্বর সঠিকভাবে লিখতে পেরেছো কি না, তথ্যগত ভুল আছে কি না, এগুলি পুনরায় দেখে নিতে হবে। বিশেষ করে উত্তরপত্রের উপরের তথ্য ফর্মটিতে তোমার নিজের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, রোল নম্বর ইত্যাদি সঠিক আছে কি না তা ভালোভাবে চেক করে নিতে হবে। লিখতে লিখতে উত্তপত্রের মূল অংশ শেষ হয়ে গেলে অতিরিক্ত লুজসিট নেয়া লাগতে পারে, সেক্ষেত্রে লুজশিটের ক্রমিক সংখ্যা মুলপত্রের যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি নিশ্চিত করে যথাযথভাবে সেলাই বা পিন আপ করতে হবে।
এবার তোমাদের উত্তরপত্র লেখা ও রিভিশন শেষ হয়ে গেলে খাতাটি সুন্দরভাবে সাজিয়ে হল পরিদর্শকের নিকট জমা দিতে হবে। খাতা জমাদানকালে শিক্ষককে আবার সালাম দিয়ে হল ত্যাগের প্রস্তুতি নিবে। মনে রাখবে, হল ত্যাগের পূর্বে কলম, পেন্সিল, প্রবেশ পত্র ও রেজিষ্ট্রেশন কার্ড যথাযথভাবে ফাইলের মধ্যে গুছিয়ে নিতে হবে।
সর্বোপরি, প্রিয় পরীক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমরা একটি কথা অবশ্যই মনে রাখবে, পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতির জন্য সকলের দোয়া ও শুভেচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উঠতে, বসতে, চলতে ফিরতে কারোর সাথে অসদাচারণ করবে না। যাদেরকে সম্মান দেয়ার তাদেরকে সম্মান দিবে এবং যাদেরকে স্নেহ করার তাদেরকে স্নেহ করবে। আশাকরি তোমাদের পরীক্ষা ভালো হবে এবং তোমরা একটি সন্তষজনক রেজাল্ট অর্জন করবে। আমার দোয়া ও আশীর্বাদ তোমাদেরই জন্য।
[লেখক:প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]