alt

মুক্ত আলোচনা

বেত

আসফাক বীন রহমান

: রোববার, ১৯ জুন ২০২২

আজ আর রেহাই নেই । দুই অপরাধী মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি । ‘চোরের দশ দিন ,গৃহস্থের একদিন’- আজকে আমরা ধরা খেয়ে গেছি ! আব্বা প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় আমাদের পড়া দিয়ে যান ; অফিস শেষে ধরবেন । আব্বা আর্টসের ছাত্র হওয়ায় ইংরেজি গ্রামার আর ট্রান্সলেশন এর উপর ঝোঁক বেশি । ছোট ইঁদুরের দাঁত প্রতিদিনই বাড়ে- আর এ কারণেই বইপত্র -কাপড় সামনে যা পায় কেটে ফেলে । কাটাকুটির প্র্যাকটিসটা বিরতিহীন । আমাদের জন্যও ব্যাপারটা প্রযোজ্য । আমাদের দুষ্টুমির প্র্যাকটিসটাকে দমন করতে আব্বা বড় বড় ছুটির দিনগুলোতে পড়া দিয়ে যান - পড়া ধরেন । ফাঁকে ফাঁকে অফিস থেকে টেলিফোন করে আমাদের মতি গতি সম্বন্ধে আম্মার কাছে ওয়াকিফহাল হোন ।

ইমনের অনেক বুদ্ধি । সে গত একমাস শুধুমাত্র বীজগণিতের ২’১ অনুশীলনীর [ (a+b)2 = a2+ 2ab+b2 ] দিয়েই আব্বাকে ফাঁকি দিচ্ছে । আমি প্রথম তিন-চারটি ট্রান্সলেশন পড়ার পর ফাঁকে- ফুঁকে আরো তিন-চারটি পড়ে সন্ধ্যায় আব্বার মুখোমুখি হই । কিন্তু , ইমনের “ মারিতো গণ্ডার ,লুঠিতো ভান্ডার” সিস্টেম। আব্বা অফিস থেকে এসে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পরই আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনে নেন কার কি অবস্থা ! ইমন প্রায় প্রতিদিনই পেন্সিল কামড়ে গভীর মনোযোগের সাথে অংক করতে থাকে । আব্বা বিছানায় রেষ্টে গেলেই এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের একটি বীজগণিত আব্বার সামনে পেশ করে ‘এটা বুঝি না’। “এটা না বুঝলে পরেরটা করো”, আব্বা । দুই-তিন মিনিট পর আরেকটা অংক দেখিয়ে “এটাও বুঝিনা ,স্কুল খুললে পরীক্ষা হবে; না পারলে স্যার কান ধরে দাঁড় করিয়ে

রাখবেন”। আব্বা বিরক্ত হয়ে,“ সন্ধ্যায় দেখবো , এখন একটু রেস্ট নিতে দাও”।

আজকে সন্ধ্যায় তিন তলার কাজল ভাইকে দেখতে পেয়ে আব্বা বলেন, “দেখোতো বাবা কাজল, ইমন কোন একটা অংক পারে না ।” কাজল ভাই এর আগেও এই অংক আরো কয়েকদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন । “ কিরে ইমইন্যা,এই অংকটা আরো কয়েকবার তোরে দেখাইছি ।” আব্বা তরিবত দেখিয়ে বললেন ,“ আর মারবো না , অন্য শাস্তি দিতে হবে ।” আব্বার কাছে বেতই তরিবত ! ছেলেপেলে মানুষ করতে হলে আদর-ভালোবাসার সাথে সাথে শাসনেরও দরকার আছে । এজন্য বাসার মীটসেফের উপর একটা প্রমাণ সাইজের বেত সবসময় থাকতো । এর প্রায়োগিক ব্যবহার খুবই কম, কিণ্তু প্রাদর্শনিক ব্যবহার খুব বেশী ছিলো । অবশ্য কাজল ভাইয়ের সামনে আমাদেরকে বেত মারতেন না আবার মারতে পারতেনও না । অপশন দুইটা ,“ রিক্সা চালাবে না লাঙ্গল চষবে ?” আব্বার রাগ দেখে আর একইসাথে সিরিয়াসনেস দেখে আমরা শিওর আমাদেরকে দু’টো রিক্সা কিনে দিবেন । এতে আমাদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থাও হবে আবার বাসায় এক্সট্রা ইনকামের ব্যবস্থাও হবে ।আমি লাঙ্গল চালানোর কথা বললে ,আম্মা ফুট কেটে বললেন ,“তোমাদের যে সাইজ-গরুর পায়ের তলায় চ্যাপ্টা হয়ে যাবে ।” কাজল ভাই মিটিমিটি হেসেই চলেছেন । শেষ পর্যন্ত তিন তলার চাচীর মধ্যস্থতায় শেষবারের জন্য আমাদেরকে মাফ করা হলো । এজন্য কান ধরে শপথ করতে হয়েছে ।

বিকেলে আসরের আযান শেষ হওয়ার পর পর বাইরে যাবার জন্য আম্মার কাছে তদবির শুরু হয় । সারাদিনের আচার-আচরণ এবং পড়াশোনা হাল দেখে আব্বা ছুটি মঞ্জুর করতেন । যেতে দেরী - কিন্তু বাসায় ফেরত এর বেলায় মাগরিবের আজান শুরুর সাথে সাথেই দৌড় । মাগরিব শেষ হবার সাথে সাথে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে । আব্বা নামাজ পড়ে এসে টেবিলে আমাদের উচ্চকণ্ঠে পড়াশোনা দেখে ও শুনে সন্তুষ্ট হলে, আম্মার ডিপার্টমেন্টে আমাদের চালান দিতেন । তখন নাস্তার ইন্তেজাম । ‘চা-টা’এর চা নাই । তবে ,আম্মার বিশেষ ক্ষমতাবলে সাহায্যকারী বাসির( বশীর ) এর মাধ্যমে চোরাইপথে আমাদের এক কাপ করে চায়ের ব্যবস্থা করে দিতেন ।

ছাপড়া মসজিদের মক্তবে আজিমপুর কলোনীর ছেলে-মেয়েরা আরবী পড়তো- আদব লেহাজ সম্বন্ধে জ্ঞান নিতো । এখানেও তরিবতের প্রধান হাতিয়ার বেত ।দুপুরগুলো ছিল নির্জন । রাস্তায় একটা দুইটা রিকশার টুংটাং শব্দ আর মাঝে মাঝে হকারদের ‘ ই-ই-ই ক্যাঁগাজ’ শব্দগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে এসে নির্জনতাকে আরো গভীর করতো । আমরা দুইভাই বগলে আমপারা ও মাথায় বড় সাইজের ফেজটুপি পড়ে পায়জামা সামলে দুপুরে মক্তবে আরবি পড়তে যেতাম। মাঝে মাঝে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের আশেপাশে ২৭ নাম্বার মাঠের ওই পারে ‘কইলজাখোর খলিলুল্লাহ’কে দেখে জানে পরানে একহাতে টুপী অন্য হাতে পায়জামা সামলে দৌড় দিয়ে কোন একটি বিল্ডিং এর সিড়ির মধ্যে পালাতাম । সিড়ির খোপ দিয়ে খলিলুল্লাহর মতিগতি অবজার্ভ করতাম। বিরাট বিভীষিকা । ছোট্ট একটি মাথা, ধনুকের মত বাঁকা শরীর নিয়ে খলিলুল্লাহ ভয়ার্ত ও সতর্ক চোখে আস্তে আস্তে হেঁটে যেতো- লিটিল এন্জেলস স্কুল হয়ে আজিমপুর কবরস্থানের দিকে । শরীরে প্রায় সময়ই বোতাম না লাগানো সাদা ময়লা শার্ট আর বুকের কাছাকাছি গিট দেয়া লুঙ্গি পড়া খলিলুল্লাহ ছিলো আমাদের ছোটবেলার ত্রাস । আশেআশেপাশের ছেলেপেলে ও রিকশাওয়ালাদের সিগনাল পেলে বের হতাম । বুকের ধুকপুকানি থামতে অনেক সময় লাগতো । একদিন পুরান ঢাকার বনগ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় রিকশা থেকে খলিলুল্লাহকে দেখে ভয় না পেয়ে আপন মনে হয়েছিলো - “আরে, ওই যে আজিমপুরের খলিলুল্লাহ ”। উনি বোধহয় আজিমপুর এলাকাতেই শান্তিমতো হেঁটে যেতে পারতেন । কারণ বনগ্রামের ঐ রাস্তায় অনেক ছোট -বড়- সিকি- আধুলি সাইজের বাচ্চা-কাচ্চা -তরুণ-যুবক গালি দিতে দিতে ঢিল ছুড়ছিলো । মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আজিমপুর কবরস্থানের দক্ষিণ গেটে খলিলুল্লাহকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখতাম । সেই ছোট্ট মাথাটি ও শীর্ণকায় শরীরটা পরিবর্তিত হয়ে পৃথুলা হয়ে গেছে ।কখনো কখনো আশেপাশের যানজট নিরসনে রিকশাগুলোকে লাইনমতো চলার জন্য কাজ করতো । চোখের ভয়ার্ত -সতর্ক দৃষ্টির পরিবর্তে স্বাভাবিক চাহনি । তখন উনাকে দেখলে মানসিকভাবে সুস্থ একজন মানুষই মনে হতো ।

ক্যানিব্যলিজম (cannibalism)নরমাংসভুক মানুষ । এটা পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতি ; আবার তীব্র খাবারের স্বল্পতায় ও বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্যানিব্যলিজম এর চর্চা হয়েছে । মানসিক কিছু রোগের কারণেও অনেকে নরমাংসভুক হয়ে যায়। মানসিক সমস্যা গুলোর মধ্যে কুরু ডিজিজ (Kuru Disease)-নিউরো ডিজানরেটিভ ডিজঅর্ডর (Neuro Degenarative Disorder),প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া(Paranoid Schizophrenia), প্যারাফিলিয়া( Paraphilia)-অস্বাভাবিক যৌন বিকারগ্রস্থতা । এদের কারও কারও মধ্যে সেডিসটিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (Sadistic Personality Disorder)থাকে - অন্যের উপর অত্যাচার , নিপীড়ন ,ভয় প্রদর্শনও অনেককে ক্যানিবল এ রূপান্তর করে ।

“এই কে , কে ওখানে ?” লাউডস্পিকারের মতো এই আওয়াজটি আমাদের ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের হেডস্যার আব্দুর রশিদ সরকার স্যারের। বৈরুত ইউনিভার্সিটির পিএইচডি হেডস্যার সবসময়ই সুটেড-বুটেড । হাতে জালিবেত । এই স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষা ,সহবত শেখানোর জন্য অর্থাৎ তরিবতের জন্য যা দরকার তার একটি ছোটখাটো নমুনা । আগে দর্শনধারী ,পরে গুণবিচারী - স্যারের লাউডস্পিকার কণ্ঠস্বর, ব্যক্তিত্ব দিয়েই ক্রম -ক্ষয়িষ্ণু এককালের বিখ্যাত স্কুলের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন । দুষ্টু ছাত্রদের মধ্যে বেশি ইঁচড়ে পাকাগুলো স্কুল বিল্ডিং এর বাইরের টয়লেটে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে এবং বনালা ছাত্ররা দেয়াল টপকে বাইরে গিয়ে চার আনা- আট আনা দিয়ে মামুর হালিম- চটপটি খেয়ে শার্টের কলারে ঝাড়া দিয়ে আবার স্কুলে ঢুকে পড়তো । স্যারের সিম্বল এই লম্বা জালিবেতের ব্যাবহার খুব একটা দেখিনি ।

মাঝে মাঝে অনিবার্য কারণবশতঃ কোন শিক্ষক ক্লাসে আসতে না পারলে গেমটিচার ছোটখাটো গড়ণের আমির আলী স্যার চুপচাপ ক্লাসে ঢুকে পড়তেন । হাতে ৬ ইঞ্চি থেকে ৯ ইঞ্চি সাইজের বেত প্রদর্শন করে ছেলেদের তরিবত শিক্ষা দিতেন । “এই যে এটা দেখতে পাচ্ছো, দু’ঘা এমন জায়গায় দিবো , উফ্ করবে ; বাসায় গিয়ে বাবাকে দেখাতে পারবে না ,মাকে দেখাতে পারবে না, ভাইকে দেখাতে পারবেনা । শুধু বাথরুমে গিয়ে নিজেই চেক করতে পারবে ।”

অনেকদিন পরে একদিন আমাদের আজিমপুরের বাসায় সেই ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের একজন শিক্ষককে পরম মমতায় হাত ধরে নিয়ে আসে ইমন। বেসরকারি স্কুল হওয়াতে চাকরি জীবনের শেষে প্রায় সব টিচারই অসহায় হয়ে পড়েন । যারা বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষক না তাদের জন্য ব্যাপারটা আরো কষ্টদায়ক ।খুব যত্নে সোফায় বসিয়ে চা -নাস্তা পরিবেশন করে স্যারের কাছ থেকে ঠিকানা যোগাড় করে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়েছে । একদিন পর আব্বার কাছে স্যারের জন্য তদবির করে কোন কিছু করা যায় কিনা পরামর্শ চেয়েছে । আশ্চর্যের ব্যাপারটা হচ্ছে সে যখন স্যারের জন্য তদবির করছিল, তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল । পরবর্তীতে তার বন্ধু এবং পরিচিত স্কুলের অন্য ছাত্রদের নিয়ে একটা ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেয় ।

আসলে তরিবত শিক্ষার জন্য বেতের প্রায়োগিক ব্যবহার খুব একটা দরকার না । শ্রদ্ধা , সম্মানবোধ, গুরুজনদের কথা ও নৈতিকশিক্ষা মানুষকে অনেক মানবিক ও শক্তিশালী করে ।আব্বা আব্দুর রহমান সাহেব এবং শিক্ষকবৃন্দ কথা দিয়ে বুঝিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে যে নৈতিক শিক্ষা ,পুঁথিগত শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছেন সেটা প্রতিটি রক্তকণিকায় এমনভাবে সেট হয়েছে যে অনেকবার চেষ্টা করেও লাইনছাড়া হতে পারিনি ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক , শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বেত

আসফাক বীন রহমান

রোববার, ১৯ জুন ২০২২

আজ আর রেহাই নেই । দুই অপরাধী মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি । ‘চোরের দশ দিন ,গৃহস্থের একদিন’- আজকে আমরা ধরা খেয়ে গেছি ! আব্বা প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় আমাদের পড়া দিয়ে যান ; অফিস শেষে ধরবেন । আব্বা আর্টসের ছাত্র হওয়ায় ইংরেজি গ্রামার আর ট্রান্সলেশন এর উপর ঝোঁক বেশি । ছোট ইঁদুরের দাঁত প্রতিদিনই বাড়ে- আর এ কারণেই বইপত্র -কাপড় সামনে যা পায় কেটে ফেলে । কাটাকুটির প্র্যাকটিসটা বিরতিহীন । আমাদের জন্যও ব্যাপারটা প্রযোজ্য । আমাদের দুষ্টুমির প্র্যাকটিসটাকে দমন করতে আব্বা বড় বড় ছুটির দিনগুলোতে পড়া দিয়ে যান - পড়া ধরেন । ফাঁকে ফাঁকে অফিস থেকে টেলিফোন করে আমাদের মতি গতি সম্বন্ধে আম্মার কাছে ওয়াকিফহাল হোন ।

ইমনের অনেক বুদ্ধি । সে গত একমাস শুধুমাত্র বীজগণিতের ২’১ অনুশীলনীর [ (a+b)2 = a2+ 2ab+b2 ] দিয়েই আব্বাকে ফাঁকি দিচ্ছে । আমি প্রথম তিন-চারটি ট্রান্সলেশন পড়ার পর ফাঁকে- ফুঁকে আরো তিন-চারটি পড়ে সন্ধ্যায় আব্বার মুখোমুখি হই । কিন্তু , ইমনের “ মারিতো গণ্ডার ,লুঠিতো ভান্ডার” সিস্টেম। আব্বা অফিস থেকে এসে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পরই আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনে নেন কার কি অবস্থা ! ইমন প্রায় প্রতিদিনই পেন্সিল কামড়ে গভীর মনোযোগের সাথে অংক করতে থাকে । আব্বা বিছানায় রেষ্টে গেলেই এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের একটি বীজগণিত আব্বার সামনে পেশ করে ‘এটা বুঝি না’। “এটা না বুঝলে পরেরটা করো”, আব্বা । দুই-তিন মিনিট পর আরেকটা অংক দেখিয়ে “এটাও বুঝিনা ,স্কুল খুললে পরীক্ষা হবে; না পারলে স্যার কান ধরে দাঁড় করিয়ে

রাখবেন”। আব্বা বিরক্ত হয়ে,“ সন্ধ্যায় দেখবো , এখন একটু রেস্ট নিতে দাও”।

আজকে সন্ধ্যায় তিন তলার কাজল ভাইকে দেখতে পেয়ে আব্বা বলেন, “দেখোতো বাবা কাজল, ইমন কোন একটা অংক পারে না ।” কাজল ভাই এর আগেও এই অংক আরো কয়েকদিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন । “ কিরে ইমইন্যা,এই অংকটা আরো কয়েকবার তোরে দেখাইছি ।” আব্বা তরিবত দেখিয়ে বললেন ,“ আর মারবো না , অন্য শাস্তি দিতে হবে ।” আব্বার কাছে বেতই তরিবত ! ছেলেপেলে মানুষ করতে হলে আদর-ভালোবাসার সাথে সাথে শাসনেরও দরকার আছে । এজন্য বাসার মীটসেফের উপর একটা প্রমাণ সাইজের বেত সবসময় থাকতো । এর প্রায়োগিক ব্যবহার খুবই কম, কিণ্তু প্রাদর্শনিক ব্যবহার খুব বেশী ছিলো । অবশ্য কাজল ভাইয়ের সামনে আমাদেরকে বেত মারতেন না আবার মারতে পারতেনও না । অপশন দুইটা ,“ রিক্সা চালাবে না লাঙ্গল চষবে ?” আব্বার রাগ দেখে আর একইসাথে সিরিয়াসনেস দেখে আমরা শিওর আমাদেরকে দু’টো রিক্সা কিনে দিবেন । এতে আমাদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থাও হবে আবার বাসায় এক্সট্রা ইনকামের ব্যবস্থাও হবে ।আমি লাঙ্গল চালানোর কথা বললে ,আম্মা ফুট কেটে বললেন ,“তোমাদের যে সাইজ-গরুর পায়ের তলায় চ্যাপ্টা হয়ে যাবে ।” কাজল ভাই মিটিমিটি হেসেই চলেছেন । শেষ পর্যন্ত তিন তলার চাচীর মধ্যস্থতায় শেষবারের জন্য আমাদেরকে মাফ করা হলো । এজন্য কান ধরে শপথ করতে হয়েছে ।

বিকেলে আসরের আযান শেষ হওয়ার পর পর বাইরে যাবার জন্য আম্মার কাছে তদবির শুরু হয় । সারাদিনের আচার-আচরণ এবং পড়াশোনা হাল দেখে আব্বা ছুটি মঞ্জুর করতেন । যেতে দেরী - কিন্তু বাসায় ফেরত এর বেলায় মাগরিবের আজান শুরুর সাথে সাথেই দৌড় । মাগরিব শেষ হবার সাথে সাথে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে । আব্বা নামাজ পড়ে এসে টেবিলে আমাদের উচ্চকণ্ঠে পড়াশোনা দেখে ও শুনে সন্তুষ্ট হলে, আম্মার ডিপার্টমেন্টে আমাদের চালান দিতেন । তখন নাস্তার ইন্তেজাম । ‘চা-টা’এর চা নাই । তবে ,আম্মার বিশেষ ক্ষমতাবলে সাহায্যকারী বাসির( বশীর ) এর মাধ্যমে চোরাইপথে আমাদের এক কাপ করে চায়ের ব্যবস্থা করে দিতেন ।

ছাপড়া মসজিদের মক্তবে আজিমপুর কলোনীর ছেলে-মেয়েরা আরবী পড়তো- আদব লেহাজ সম্বন্ধে জ্ঞান নিতো । এখানেও তরিবতের প্রধান হাতিয়ার বেত ।দুপুরগুলো ছিল নির্জন । রাস্তায় একটা দুইটা রিকশার টুংটাং শব্দ আর মাঝে মাঝে হকারদের ‘ ই-ই-ই ক্যাঁগাজ’ শব্দগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে এসে নির্জনতাকে আরো গভীর করতো । আমরা দুইভাই বগলে আমপারা ও মাথায় বড় সাইজের ফেজটুপি পড়ে পায়জামা সামলে দুপুরে মক্তবে আরবি পড়তে যেতাম। মাঝে মাঝে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের আশেপাশে ২৭ নাম্বার মাঠের ওই পারে ‘কইলজাখোর খলিলুল্লাহ’কে দেখে জানে পরানে একহাতে টুপী অন্য হাতে পায়জামা সামলে দৌড় দিয়ে কোন একটি বিল্ডিং এর সিড়ির মধ্যে পালাতাম । সিড়ির খোপ দিয়ে খলিলুল্লাহর মতিগতি অবজার্ভ করতাম। বিরাট বিভীষিকা । ছোট্ট একটি মাথা, ধনুকের মত বাঁকা শরীর নিয়ে খলিলুল্লাহ ভয়ার্ত ও সতর্ক চোখে আস্তে আস্তে হেঁটে যেতো- লিটিল এন্জেলস স্কুল হয়ে আজিমপুর কবরস্থানের দিকে । শরীরে প্রায় সময়ই বোতাম না লাগানো সাদা ময়লা শার্ট আর বুকের কাছাকাছি গিট দেয়া লুঙ্গি পড়া খলিলুল্লাহ ছিলো আমাদের ছোটবেলার ত্রাস । আশেআশেপাশের ছেলেপেলে ও রিকশাওয়ালাদের সিগনাল পেলে বের হতাম । বুকের ধুকপুকানি থামতে অনেক সময় লাগতো । একদিন পুরান ঢাকার বনগ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় রিকশা থেকে খলিলুল্লাহকে দেখে ভয় না পেয়ে আপন মনে হয়েছিলো - “আরে, ওই যে আজিমপুরের খলিলুল্লাহ ”। উনি বোধহয় আজিমপুর এলাকাতেই শান্তিমতো হেঁটে যেতে পারতেন । কারণ বনগ্রামের ঐ রাস্তায় অনেক ছোট -বড়- সিকি- আধুলি সাইজের বাচ্চা-কাচ্চা -তরুণ-যুবক গালি দিতে দিতে ঢিল ছুড়ছিলো । মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আজিমপুর কবরস্থানের দক্ষিণ গেটে খলিলুল্লাহকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখতাম । সেই ছোট্ট মাথাটি ও শীর্ণকায় শরীরটা পরিবর্তিত হয়ে পৃথুলা হয়ে গেছে ।কখনো কখনো আশেপাশের যানজট নিরসনে রিকশাগুলোকে লাইনমতো চলার জন্য কাজ করতো । চোখের ভয়ার্ত -সতর্ক দৃষ্টির পরিবর্তে স্বাভাবিক চাহনি । তখন উনাকে দেখলে মানসিকভাবে সুস্থ একজন মানুষই মনে হতো ।

ক্যানিব্যলিজম (cannibalism)নরমাংসভুক মানুষ । এটা পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতি ; আবার তীব্র খাবারের স্বল্পতায় ও বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্যানিব্যলিজম এর চর্চা হয়েছে । মানসিক কিছু রোগের কারণেও অনেকে নরমাংসভুক হয়ে যায়। মানসিক সমস্যা গুলোর মধ্যে কুরু ডিজিজ (Kuru Disease)-নিউরো ডিজানরেটিভ ডিজঅর্ডর (Neuro Degenarative Disorder),প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া(Paranoid Schizophrenia), প্যারাফিলিয়া( Paraphilia)-অস্বাভাবিক যৌন বিকারগ্রস্থতা । এদের কারও কারও মধ্যে সেডিসটিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (Sadistic Personality Disorder)থাকে - অন্যের উপর অত্যাচার , নিপীড়ন ,ভয় প্রদর্শনও অনেককে ক্যানিবল এ রূপান্তর করে ।

“এই কে , কে ওখানে ?” লাউডস্পিকারের মতো এই আওয়াজটি আমাদের ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের হেডস্যার আব্দুর রশিদ সরকার স্যারের। বৈরুত ইউনিভার্সিটির পিএইচডি হেডস্যার সবসময়ই সুটেড-বুটেড । হাতে জালিবেত । এই স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষা ,সহবত শেখানোর জন্য অর্থাৎ তরিবতের জন্য যা দরকার তার একটি ছোটখাটো নমুনা । আগে দর্শনধারী ,পরে গুণবিচারী - স্যারের লাউডস্পিকার কণ্ঠস্বর, ব্যক্তিত্ব দিয়েই ক্রম -ক্ষয়িষ্ণু এককালের বিখ্যাত স্কুলের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন । দুষ্টু ছাত্রদের মধ্যে বেশি ইঁচড়ে পাকাগুলো স্কুল বিল্ডিং এর বাইরের টয়লেটে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে এবং বনালা ছাত্ররা দেয়াল টপকে বাইরে গিয়ে চার আনা- আট আনা দিয়ে মামুর হালিম- চটপটি খেয়ে শার্টের কলারে ঝাড়া দিয়ে আবার স্কুলে ঢুকে পড়তো । স্যারের সিম্বল এই লম্বা জালিবেতের ব্যাবহার খুব একটা দেখিনি ।

মাঝে মাঝে অনিবার্য কারণবশতঃ কোন শিক্ষক ক্লাসে আসতে না পারলে গেমটিচার ছোটখাটো গড়ণের আমির আলী স্যার চুপচাপ ক্লাসে ঢুকে পড়তেন । হাতে ৬ ইঞ্চি থেকে ৯ ইঞ্চি সাইজের বেত প্রদর্শন করে ছেলেদের তরিবত শিক্ষা দিতেন । “এই যে এটা দেখতে পাচ্ছো, দু’ঘা এমন জায়গায় দিবো , উফ্ করবে ; বাসায় গিয়ে বাবাকে দেখাতে পারবে না ,মাকে দেখাতে পারবে না, ভাইকে দেখাতে পারবেনা । শুধু বাথরুমে গিয়ে নিজেই চেক করতে পারবে ।”

অনেকদিন পরে একদিন আমাদের আজিমপুরের বাসায় সেই ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের একজন শিক্ষককে পরম মমতায় হাত ধরে নিয়ে আসে ইমন। বেসরকারি স্কুল হওয়াতে চাকরি জীবনের শেষে প্রায় সব টিচারই অসহায় হয়ে পড়েন । যারা বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষক না তাদের জন্য ব্যাপারটা আরো কষ্টদায়ক ।খুব যত্নে সোফায় বসিয়ে চা -নাস্তা পরিবেশন করে স্যারের কাছ থেকে ঠিকানা যোগাড় করে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়েছে । একদিন পর আব্বার কাছে স্যারের জন্য তদবির করে কোন কিছু করা যায় কিনা পরামর্শ চেয়েছে । আশ্চর্যের ব্যাপারটা হচ্ছে সে যখন স্যারের জন্য তদবির করছিল, তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল । পরবর্তীতে তার বন্ধু এবং পরিচিত স্কুলের অন্য ছাত্রদের নিয়ে একটা ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেয় ।

আসলে তরিবত শিক্ষার জন্য বেতের প্রায়োগিক ব্যবহার খুব একটা দরকার না । শ্রদ্ধা , সম্মানবোধ, গুরুজনদের কথা ও নৈতিকশিক্ষা মানুষকে অনেক মানবিক ও শক্তিশালী করে ।আব্বা আব্দুর রহমান সাহেব এবং শিক্ষকবৃন্দ কথা দিয়ে বুঝিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে যে নৈতিক শিক্ষা ,পুঁথিগত শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছেন সেটা প্রতিটি রক্তকণিকায় এমনভাবে সেট হয়েছে যে অনেকবার চেষ্টা করেও লাইনছাড়া হতে পারিনি ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক , শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।]

back to top