মনিরুজ্জামান মনির
মানুষের মস্তিষ্ক একটি বিরাট সুপার কম্পিউটার। একজন মানুষের নিউরনে তার প্রত্যক্ষ করা কোন ছবি, ঘটনা, ব্যক্তি বা উক্তি মনের গভীরে থাকে, যাকে আমরা মানসপট বলি সেখানে গেঁথে যায়। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও হিউম্যান সাইকোলোজি নিয়ে আমার বিস্তর আগ্রহ এবং যৎসামান্য পড়াশুনা আছে।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন আমরা যারা বিজ্ঞান বা তদানিন্তন অবিভক্ত জীববিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রছাত্রী তাদের একাডেমিক কার্য্যক্রম আমাদের শিক্ষাবর্ষের বানিজ্য, কলা এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বন্ধুদের চেয়ে গড়ে ৫/৬ মাস দেরীতে শুরু হয়। বিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ইত্যাদি পড়ার আগ্রহের কারনেই বোধ হয় কে গিয়ে কে থাকবে এ বিষয়টি থিতু হতে এ সময়টুকু লাগে। তো যা হোক ভর্তি হয়েছি এপ্লাইড ফিজিক্সে কিন্তু ক্লাশ তখনো শুরু হয়নি।
ঢাকায় থাকি, সময় কাটে কলাভবন, মলচত্বরে কমার্স বা আর্টস ফ্যাকান্টির বন্ধুদের সাথে গুলতানি মেরে।এরা মাঝে মাঝে ক্লাশে যায়,আর মাঝেমাঝে আড্ডা পিটায়।আমরাও কখনো কখনো তাদের সতীর্থ হই। এভাবে বাংলা, ইংরেজি ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, মার্কেটিং, একাউন্টিং, সব ক্লাশেই টুকটাক ঢুঁ মারার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানে আমার এলাকার দুয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ভর্তি হওয়াতে মাঝে মাঝেই ওদের সাথে সমাজ বিজ্ঞানের ক্লাশ করতাম। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর নজরুল ইসলাম নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। লম্বা, সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত কালো চশমায় ঢাকা উজ্জল দুটি চোখ স্যারের, যাকে চোখ না বলে নেত্র বলাই বোধ হয় সমীচিন হবে, আর অসম্ভব বাগ্মী এবং অদ্ভুত রকমের নান্দনিক পঠনশৈলী ছিল নজরুল স্যারের। তার লেকচার আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, মনে হত আমি সমাজ বিজ্ঞানেরই ছাত্র। তার ক্লাশের প্রতি আমার আকর্ষণ এতটাই তীব্র ছিল যে, আমার সমাজ বিজ্ঞানের বন্ধুদের মনে না থাকলেও সপ্তাহে কি কি বারে নজরুল স্যারের ক্লাশ ছিল তা আমার মনে থাকতো। আমার এই সমাজবিজ্ঞান প্রীতি দেখে আমার বন্ধুরা আমাকে সমানে খোঁচাতো, তাদের বক্তব্য ওসব লেকচার ফেকচার ফালতু বাত, লিপিস্টিক ডিপার্টমেন্ট তো তাই ওদের ক্লাশে আমার আগ্রহ বেশী!! সমাজ বিজ্ঞানে যেহেতু প্রচুর মেয়ে ভর্তি হত সেজন্য আর্টস ফ্যাকান্টিতে সমাজ বিজ্ঞান, কার্জন হলে বোটানী আর জুওলজির লিপস্টিক ডিপার্টমেন্ট হিসাবে কমবেশী পরিচিতি ছিল।
আসল কথা, মানে নজরুল স্যারের কথায় আসি। কি জানি একটা ক্লাশে উনি প্রসংগ ক্রমে সভ্যতা ও সংস্কৃতি কি তা বোঝাচ্ছিলেন। বোঝাতে গিয়ে উনি যেটা করতেন সেটা হল বিষয়টি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের ধারনা জানার চেষ্টা করে ক্লাশটিকে পার্টিসিপেটরী করে ফেলতেন, পরে নিজের বক্তব্য বলতেন। এটা ছিল তার পড়ানোর একটা স্টাইল। আমি ব্যক্তি জীবনে খুব কম বিষয়ই হুবুহু ফলো করি। এখনো পর্য্যন্ত টিচিং বা লেকচারিং এর সুযোগ পেলে নজরুল স্যারের এই স্টাইলটি আমি হুবুহু ফলো করি, যতবার করি ততবারই পরম শ্রদ্ধায় স্যারকে স্মরন করি।
ছাত্র ছাত্রীরা যার যা ইচ্ছে বললো, পরে নজরুল স্যার একটি মাত্র বাক্যে সভ্যতা এবং সংস্কৃতি বোঝালেন। বাক্যটি নিজের অনুধাবন নাকি অন্য কারো কোটেশন তা আমি জানিনা সংগত কারনেই। উনি বললেন, What we do is our culture and what we use is our civilization.উদাহরন দিয়ে বলেছিলেন ঈদের দিনে আমরা যে কোলাকুলি করি এটা আমাদের কালচার আর ঈদের দিনে আমরা যে সেমাই খাই বা নতুন কাপড় পরি এটাই আমাদের সভ্যতা। তিনি আরো বলেছিলেন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। সভ্যতাই সংস্কৃতির রূপকার।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, কাজ করি পুলিশে। হঠাৎ করে সভ্যতা সংস্কৃতি ইত্যকার উদ্ভট বিষয় নিয়ে আমার এত মাথা ব্যাথা কেন এ প্রশ্ন নিতান্তই যৌক্তিক। সেটি বলবো বলেই আজ বসেছি।
বিগত ২৫ শে জুন আমাদের স্বপ্নের সেতু ,প্রমত্তা পদ্মার উপর পদ্মা সেতুর উদ্ভোধন করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সেতুকে ঘিরে দেশী বিদেশী রথি মহারথীদের ষঢ়যন্ত্র এবং অপপ্রচারের বিষয়টিও কমবেশী সকলেরই জানা। আর সেজন্যই হয়তোবা সেতু উদ্বোধন নিয়ে মানুষের আগ্রহও ছিল তুঙ্গে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আবেগঘন ভাষন হৃদয় ছুঁয়ে গেছে আপামর জনতার। সে সেতু নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস থাকবে, মানুষ একটু আধটু বিধি নিষেধ উপেক্ষা করেও তা ছুঁতে চাইবে, দেখতে চাইবে, তাকে স্পর্শ করবে, ছবি তুলবে এটিও অস্বাভাবিক নয় খুব একটা।
কোন একটি চ্যানেলে দেখলাম একটা ইয়াং ছেলে কাঁটা তারের বেড়া সরিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকতে চাইছে। কর্তব্যরত এক পুলিশ সদস্য তাকে যখন বাঁধা দেয় এবং বিধি বহির্ভূতভাবে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করে তখন সে স্বতস্ফূর্তভাবেই বলে উঠলো, ভাই বাঙালীরে কি কাটাতাঁরের বেড়া দিয়ে দাবায় রাখা যায়? সেটিও আমি একজন পুলিশ অফিসার হয়েও মজা হিসেবেই নিলাম। স্বপ্ন ছোঁয়া হয়ে গেলে একটু আধটু বাড়াবাড়ি বিসদৃশ লাগেনা, যদি না তা ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে।
পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়নে একজন বাঙালী হিসাবে আমিও ভীষন গর্বিত। উদ্ধোধনের পর থেকেই লাখো মানুষ এটি পরিভ্রমন করেছেন, যারা এখনো যেতে পারেননি তারা প্লান করছেন কবে কখন যাবেন। আমার পরিচিত ইউ.কে প্রবাসী এক সিলেটি ভদ্রলোক ঢাকায় এসে হোটেলে উঠে আমাকে ফোন দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম সিলেটে না গিয়ে ঢাকায় হোটেলে কেন উঠেছেন। বললেন, একটু ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে, ভিড়ভাট্টা একটু কমলে পদ্মা সেতু দেখতে যাবেন, সেখান থেকে ফিরে ভোর রাতে সিলেট যাবেন। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে ইংল্যান্ড প্রবাসী, গিয়েছেন বিশ্বের বহু দেশে, দেখেছেন বহু অট্টালিকা, সেতু, দর্শনীয় স্থান। তার ও ইচ্ছে হয়েছে পদ্মা সেতুটি একবার নিজ চোখে দেখে তারপর মাকে দেখতে সিলেট যাবেন। আসলে আবেগ কোন গ্রামার মানেনা, অনুভূতিও যুক্তি বিদ্যা মেনে চলেনা সব সময়।
দেশবাসীর এত আবেগ অনুভূতির মধ্যে এটাও দেখলাম, এক মহা পন্ডিত সেতুর শো গ্রিলের নাট বল্টু খুলছে, একজন পিসু করছে, ছয় মিনিটে যে সেতু পার হওয়া যায় সেই সেতুতে কয়েকজন ভদ্রলোক নামাজ পড়ছেন এবং আরেক হুজুর নামাজ না পড়ে ভিডিও করছেন, এক মধ্য বয়স্ক নারী অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী করে টিকটক বানাচ্ছেন, কোন কোন বীর পুরুষ আবার রেসিং স্টাইলে চিৎ,কাইত এমনকি উপুত হয়ে মোটর বাইক চালাচ্ছেন ইত্যকার নানাবিধ বিষয়, যা বলে শেষ করা যাবেনা হয়তোবা।
একসময় যেহেতু বিজ্ঞান পড়েছি, তাই বিজ্ঞান ভাল না বুঝলেও মস্তিষ্কের নিউরনে বিজ্ঞানমনস্কতা কিঞ্চিৎ রয়ে গেছে। সেই বোধ থেকেই অফিসে আসার পথে টুকটাক ঘাটাঘাটি করে দেখলাম বিশ্বের অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রে এমনতর জাতীয় অর্জনে মানুষের অনুভুতি কেমন ছিল, কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ছিলেন সেসব দেশের মানুষেরা। তারাও কি আমাদের মত উদ্ভট আচরন করেছিলেন? বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করতে হলনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই পেয়ে গেলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।
খুঁজতে খুঁজতেই সৌদি প্রবাসী এক ছোট ভাই এর সেতু সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। তিনি লিখেছেন আরব সাগরের উপর সৌদি আরব এবং বাহরাইনের মধ্যকার ২৫ কিলোমিটার লম্বা সেতু বা কজওয়ের কথা। যেটি পঁয়ত্রিশ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। তিনি লিখেছেন সৌদি আরব, বাহরাইনের বিপুল সংখ্যক নাগরিক এবং ট্যুরিষ্টরা এই সেতু দেখতে গেলেও বিসদৃর্শ অঙ্গভঙ্গী করে টিকটক জাতীয় এহেন কর্মকান্ড সেখানে হয়নি। তাহলে আমাদের এখানে এত কিছু কেন হল? সমস্যাটি আসলে কোথায় ?আমরা কি আরবদের চেয়ে অনগ্রসর,অসভ্য নাকি অন্য কিছু?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নিজের গন্ডির মধ্যে টুকটাক আর এন্ড ডি করলাম, পরিচিত দুয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাথেও কথা বললাম। আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের অধ্যাপক এবং সমাজ বিজ্ঞানের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র, বহু বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধের রচয়িতা এবং একজন বিদগ্ধ গবেষক প্রফেসর আমিনুল হকের সাথে কথা বললাম। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের টার্মিনোলজি ব্যাখা করে আমাকে অল্প কথায় মোটামুটি পরিষ্কার একটি ধারনা দিলেন।
নিজস্ব ভাবনার সাথে বিশেষজ্ঞের মতামত মিলিয়ে আমার যা মনে হল তা হল এই যে, মানুষ সব সময়ই নিজেকে গুরুত্বপূর্ন ভাবতে পছন্দ করে, অন্যের নজর কাড়তে চায়। এটেনশন সিক করা মানুষের একটি জন্মগত প্রবৃত্তি। আমরা নিজেদেরকে যতই নিভৃতচারী দাবী করিনা কেন মানুষের মনোজগতে এটেনসন সিক করার একটি তাড়না রয়েই যায়।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের তত্বমতে মানুষের ঈড, ইগো বা সুপার ইগোর একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই এটেনশন সিকিং। মানুষ তার কর্মে, ফ্যাশনে, আচার আচরনে, প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে নিত্যই এ কাজটি করে থাকে। জীবন যুদ্ধে একটু পিছিয়ে পড়া মানুষেরা অন্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য, অন্যের আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিনত হওয়ার জন্য নানাভাবে একাজটি চেতন বা অবচেতনভাবে একটু বেশীই করে থাকেন।
এমনকি ট্র্যাকে থাকা, এগিয়ে থাকা মানবগোষ্ঠীর কেউ কেউ আরো নজর কাড়ার জন্য তাদের দৃষ্টিতে অভূতপূর্ব, ইউনিক বা অসাধারন কিছু কাজ করেন, করে থাকেন বা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন শুধুই মানুষের এটেনশন অর্জনের মত দরিদ্র মানসিকতা নিয়ে।এটিও অস্বাভাবিক নয়, যেটি অস্বাভাবিক সেটি হল এটেনশন সিক করতে গিয়ে সভ্যতা, ভব্যতা, লোকাচার, শিষ্টাচার ,আত্মমর্যাদা বা সুবচন গুলোকে ভুলে যাকে বলে যেকোন মূল্যে নজরকাড়ার চেষ্টা করেন।ব্যক্তি মানুষের এ সকল বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন ঘটিয়েই একটি জাতি বা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী লোকজনের লোকাচার, প্রথা বা কালচারের উদ্ভব হয়।
কালচারের একটি মূল উপাদান হচ্ছে পরম্পরায়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্য। আর এ ঐতিহ্যকে প্রভাবিত করে মানুষের ইনফেরিওরিটি বা সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্স। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় একে সংজ্ঞায়িত করা হয় Ethnocentrism এবং Xeno centrism টার্মিনোলজিতে।
জাতিগোষ্ঠী যখন বিশ্বাস করে যে তার কালচার সমৃদ্ধ এবং সমসাময়িক অন্য জনপদের কালচারের চেয়ে কোন অংশে কম নয় তখন এটি হয় Ethnocentrism অর্থাৎ ethnic বৈশিষ্ট্যে কেন্দ্রীভূত থাকার মধ্য দিয়ে। আর এর বিপরীতে Xeno centrism এ বিশ্বাসীরা মনে করেন তার নিজস্ব কালচার অন্যের কালচারের সাথে তুলনামূলক বিচারে পিছিয়ে পড়া, ততটা আধুনিক বা অগ্রসর নয় এমন এক কালচার, তখন মানুষের মধ্যে বিরাট একটি ঝাঁকুনি তৈরী হয়।
একটা উদাহরন দিই। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত/উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা শিশুদের একটি প্রিয় খেলনা হচ্ছে বার্বিডল। আমি সহ আমাদের জেনারেশনের অনেকেই আমাদের কন্যা শিশুদেরকে বার্বিডল উপহার দিয়েছি। আমাদের কন্যারা বার্বি কালচারেই বড় হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই শিশু যা দেখে তা থেকেই শেখে। বার্বি ডলের কাছ থেকেই আমাদের কন্যারা চুল, চোখ, মুখের ফ্যাশন শিখেছে, তাদের মতে বার্বির মত করে ছোট ছোট কাপড় পরার অভ্যাস রপ্ত হওয়াটাই তাই স্বাভাবিক।
কন্যা শিশুটি যখন শিশু থেকে কিশোরী হয় তখনো সে স্বাভাবিক ভাবেই তার শৈশবের প্রিয় বার্বির মত ছোট ছোট পোষাকই পরতে চাইবে। আর তখনি তৈরী হয় একটি বিরাট কালচারাল শক। এই শকটি ধারন করার জন্য যদি তার মধ্যে ধর্মীয়/ নৈতিক বা সামাজিক শিক্ষাটুকু না থাকে তখন এইসব নির্দোষ কিশোরীদের এই স্বল্প বসন প্রীতি থেকেই যায় এবং সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরী হয়। তখনি বাড়ে দূরত্ব, তৈরী হতে থাকে তিক্ততা। এজন্যই আগে দরকার দেশজ কালচারের গাঁথুনি তারপর বিদেশী/বিজাতীয় কালচারের পত্তন।
আমাদের সমসাময়িক অনেকেই সম্পূর্ণ দেশজ কালচারে বড় হয়ে ইউরোপ এমেরিকা সহ বহিবির্শ্বে বর্তমানে কার্য্য উপলক্ষে অবস্থান করছেন এবং বিদেশী সভ্যতা বা সংস্কৃতির প্রযোজ্য অংশটুকু এডপ্ট করছেন, তাতে কিন্তু একটুও সমস্যা হচ্ছেনা কারন moral বা ethical গাঁথুনির ভিত্তি যেখানে শক্ত সেখানে হঠাৎ করে কোন কিছু জেঁকে বসতে পারেনা।
প্রসংগে ফিরে আসি, পরিষ্কার করে বলতে চাই আমি সেই অর্থে টিকটক কালচারের সমালোচক নই। সভ্যতা একটি গতিশীল স্বত্ত্বা। ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতে সোসাইটি অনেক কিছু বর্জন বা গ্রহন করে, এভাবেই সভ্যতা এগিয়ে চলে। কিন্তু আমি আধুনিকতার নামে আমাদের কালচারে বিজাতীয় কালচারের আংশিক অনুপ্রবেশের ঘোরতর বিরোধী। যদি গ্রহন করতে হয় তো পুরাটা করলেই বরং ভাল। তা না করে ভোগবাদী কালচারটুকু গ্রহণ করা এবং দায়ীত্ব কর্তৃব্যের অংশটুকু পরিহার করলে তা না হবে ঘরকা না হবে ঘাটকা।
জাতি হিসাবে আমরা শংকর। তার উপর শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা শাসিত হয়েছি ভিনদেশীদের দ্বারা। আমাদের সোসাইটি সুনিপুনভাবে শাসকদের অনেক কিছুই গ্রহন বা বর্জন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেনতেন প্রকারে বিখ্যাত হওয়ার জন্য বা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যে জগাখিচুড়ি কালচারের উদ্ভব হচ্ছে তাতে করে আমি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে ভীষন উদ্বিগ্ন।
আমি এই বদ্বীপেরই ভূমি পুত্র। আমার পূর্ব পুরুষেরা (নারীরাও) এই মাটিতেই শুয়ে আছেন, শেষ শয্যায়। ভাগ্যে থাকলে এই মাটিতেই আমার দাফন হবে। আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে কোথায় রেখে যাব তা আমাকে ভীষন ভাবিত করে।ভাষার জন্ম হয়েছে অনুভতি ব্যক্ত করার জন্য। তেমনিভাবে ক্যামেরার জন্ম হয়েছে দৃশ্য বা স্মৃতি কে ধারন করার জন্য। আমাদের বোঝা দরকার সব দৃশ্য বা স্মৃতি শেয়ার করার বিষয় নয়, কিছু দৃশ্য বা স্মৃতি শুধুই স্মৃতিপটে রেখে দেয়ার বিষয়, কিছু স্মৃতি আছে শুধুই ভুলে যাবার জন্য। যা ভুলতে না পারলেই বড় ভুল হয়ে যায়।
একটা ঘটনা শেয়ার করি। সেদিন আমার অফিসে আমার এক বন্ধু এসেছেন ,সস্ত্রীক। আলুথালু বেশ, ভেঙে পড়া চেহারা নিয়ে। ওয়েল অফ ফ্যামিলি, উচ্চ শিক্ষিত, ভাল জব করেন বন্ধু ও বন্ধু পত্নী। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমের নরম সোফায় বসেও ঘামছিলেন স্বামী স্ত্রী। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বাকরুদ্ধ দুজনেই। অনেক ক্ষন পর পানিটানি খেয়ে স্থির হলেন। বললেন কাহিনী।
একমাত্র মেয়ে পনেরো প্লাস, অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী। করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল স্কুল, ক্লাশ, পরীক্ষা। গ্রোয়িং স্টেজের মেয়েটি বলতে গেলে একাই বাসায় থাকে। টিকটকে কিশোরী মেয়েটি হঠাৎ একদিন দেখলো তারই এক বান্ধবী তার নারী হয়ে ওঠার বায়োলজিকাল চেঞ্জগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে তৈরী করা একটি ভিডিও। কিশোরীর ও শখ হয়, তারও হাতে ডিভাইস। সেও তো আর বাচ্চাটি নেই, নারী হয়ে গিয়েছে। সেও করলো একই কাজ, শেয়ার করলো তার ঐ বন্ধুর সাথে। একে একে আট দশজন উঠতি বয়সের কিশোরী একই কাজ করল। তাদের এই গ্রুপে ভাইরাসের মত ঢুকে পড়লো তাদেরই এক বান্ধবীর ও লেভেল পড়ুয়া তরুন কাজিন।
এতগুলো কৈশোরোত্তীর্ণ তরুনীর ওয়াশ রুম ভিডিও দেখে সে আর হজম করতে পারলোনা। বন্ধুর মেয়েটিকে বাধ্য করলো ভিডিওর মত করে ভিডিও চ্যাটিং করতে। এ অবস্থা কয়েকদিন চলতে না চলতেই আরো এক ধাপ পেরিয়ে সরাসরি মেয়েটির সংগ চাইলো ছেলেটি। মেয়েটি ভয় পেয়ে গেল। অনলাইনে একটিভ হলেও অফলাইনে তার তো ভয় আছেই।
বিষন্ন হয়ে পড়লো প্রানোচ্ছল কিশোরীটি। মা টের পেলেন। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। মেয়ে কিছুই বলেনা। অবশেষে একদিন মেয়ে বললো সবকিছু। সদ্য কিশোরী মেয়েটির পার্সোনাল ভিডিও পাবলিক ডোমেইনে আছে জেনে মা বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তারপরে তাদের মনে হল আমার কাছে আসার কথা। আমি যা করার তা করেছি। কিন্তু সবার কি আর রিপোর্ট না করে এ জাতীয় গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রানের মত পথ আছে ? না নেই, আমাদের দেশেও নেই, এমনকি বিশ্বের কোথাও নেই। এ জাতীয় সমস্যা রিপোর্ট না করে সমাধান করা যায় না। অপরাধটির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, পুরোপুরি সর্বনাশ না হওয়াতে তবুও আমার একটু সুযোগ ছিল এমিকেবলি শুধরে দেবার। কাজেই বিষয়টি নেহায়েতই মৌখিক উদ্বেগের বিষয় নয়, আরো গুরুতর।
বাবা মা হিসাবে সংগত কারনেই আমাদের উদ্বেগ আছে। কতক্ষন আমরা আমাদের প্রানপ্রিয় বাচ্চাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখবো? সচেতনতা একটি টুলস, সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার নগরে আগুন লাগলে দেবালয় ও রক্ষা পায়না।
প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কি এসব পছন্দ করে। সহজ উত্তর হচ্ছে ‘না’। একশ্রেনীর মানুষ মজা নেয়, অনেকেই দেখে। মানুষের দৃষ্টি কাড়ার জন্য এগুলো করা হয়। যারা করে তারা একটা কথা ভুলে যায় যে কিছু মানুষ এগুলো দেখে, উৎসাহ দেয়, এক্সিলেন্ট বা সুপার বলে কমেন্ট করে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে বিরাট এক জনগোষ্ঠী এগুলো পছন্দও করেনা, দেখেওনা, তাদের অপছন্দের বিষয়টিও কাউকে জানায়ও না। তারা এগুলোকে জমা রাখে ভবিষ্যতের বড় সিদ্ধান্তের জন্য।
আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের প্রবাসী ডাক্তার ছেলের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। পাত্রীও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সুন্দরী, ভাল ফ্যামিলি, যাকে বলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু বিয়েটা শেষ পর্য্যন্ত হয়নি। ছেলের ছোট বোন কৌশলে মেয়ের আইডিতে গিয়ে দ্যাখে মেয়েটার ওয়ালে তাদের ভাষায় আপত্তিকর দৃশ্যায়ন আছে।
এই যুগে আর কোন কিছুই স্থায়ীভাবে গোপন করা যায়না। সাময়িকভাবে হয়তো যায়, কিন্তু পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে আরো বড় সমস্যার উদ্রেক হয়। বিয়ে বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এখন অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। মনে রাখা দরকার সমাজে এ সংখ্যা যত বাড়বে সমাজে ততই ভারসাম্যহীনতা তৈরী হবে।
বাংলা ভাষার আগে থেকেই “পরশ্রীকাতরতা” বলে একটি শব্দ আছে ।এমনি তো আর এর জন্ম হয়নি। আমাদের কালচারে এ বৈশিষ্ট্য আছে বলেই আমাদের ভাষায় শব্দটি এসেছে। একজনের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হলে স্বভাবতই সে চাইতে পারে আরেকজনের জীবনের ভারসাম্যও নষ্ট হোক। এবং এটি যদি ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে তাহলে সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ সামাজিক সংকট।
আমার মনে হয় আমাদের সমাজে অধিকার সচেতনতা যতটা প্রকট, দায়ীত্ব সচেতনতা ততটাই ম্রিয়মান, অস্ফুট। কারো অধিকার ক্ষুন্ন হলেই সাধারনত সমাজ তার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু কারো কর্তব্যচ্যুতির ক্ষেত্রে সে রাজনৈতিক নেতা বা সরকারী কর্মচারী না হলে মানুষ তার দিকে সাধারনত আঙুলও তোলেনা। এতে করে এ ধরনের নর্মস বা ট্রাডিশন ভায়োলেশন এর ক্ষেত্রে এক ধরনের ইনডেমনিটি তৈরী হয় ,ভ্যাকুয়াম তৈরী হয় সমাজে। এই ভায়োলেটররা সোসাইটির এই সাইলেন্সের ভুল অর্থ করে, তারা ভুলে যায় মৌনতা সবসময় সম্মতির লক্ষন নয়।
আমাদের সোসাইটিতে নর্মস আছে, মূল্যবোধ আছে, সোশ্যাল মোরালও একেবারে ভঙ্গুর নয়। আমার মনে হয় আমাদের নীরব থাকার দিন ফুরিয়েছে। খুব ভদ্রভাবে, অন্যকে একটুও আঘাত না করেও মানুষকে নাড়া দেওয়া সম্ভব। আর সে কাজটি অন্য কেউই করে দেবেনা ,করতে হবে আমাদেরকেই।
বাঙালী মধ্যবিত্তের কাছে তার পরিবার অত্যন্ত পবিত্র একটি স্বত্বা, উপাসনালয় সম। সেই প্রিয় ও পবিত্র স্বত্ত্বাটিকে আগুন থেকে রক্ষা করতে হলে আগুনেই পানি ঢালতে হবে,উপাসনালয়ে ঢেলে লাভ নাও হতে পারে।
সমস্বরের ছোট ছোট প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়াই হয়তো একদিন সমাজের এসব অসংগতি গুলোকে দূর করবে। অন্ততঃ এক্ষেত্রে এ কথা সত্য যে, বেটার লেট দ্যান নেভার।
(বারিধারা, ঢাকা। ২৮ জুন, ২০২২)
[লেখক: উপ মহা পুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি), এন্টি টেরোরিজম ইউনিট]
মনিরুজ্জামান মনির
শনিবার, ০২ জুলাই ২০২২
মানুষের মস্তিষ্ক একটি বিরাট সুপার কম্পিউটার। একজন মানুষের নিউরনে তার প্রত্যক্ষ করা কোন ছবি, ঘটনা, ব্যক্তি বা উক্তি মনের গভীরে থাকে, যাকে আমরা মানসপট বলি সেখানে গেঁথে যায়। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও হিউম্যান সাইকোলোজি নিয়ে আমার বিস্তর আগ্রহ এবং যৎসামান্য পড়াশুনা আছে।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন আমরা যারা বিজ্ঞান বা তদানিন্তন অবিভক্ত জীববিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রছাত্রী তাদের একাডেমিক কার্য্যক্রম আমাদের শিক্ষাবর্ষের বানিজ্য, কলা এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বন্ধুদের চেয়ে গড়ে ৫/৬ মাস দেরীতে শুরু হয়। বিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ইত্যাদি পড়ার আগ্রহের কারনেই বোধ হয় কে গিয়ে কে থাকবে এ বিষয়টি থিতু হতে এ সময়টুকু লাগে। তো যা হোক ভর্তি হয়েছি এপ্লাইড ফিজিক্সে কিন্তু ক্লাশ তখনো শুরু হয়নি।
ঢাকায় থাকি, সময় কাটে কলাভবন, মলচত্বরে কমার্স বা আর্টস ফ্যাকান্টির বন্ধুদের সাথে গুলতানি মেরে।এরা মাঝে মাঝে ক্লাশে যায়,আর মাঝেমাঝে আড্ডা পিটায়।আমরাও কখনো কখনো তাদের সতীর্থ হই। এভাবে বাংলা, ইংরেজি ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, মার্কেটিং, একাউন্টিং, সব ক্লাশেই টুকটাক ঢুঁ মারার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানে আমার এলাকার দুয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ভর্তি হওয়াতে মাঝে মাঝেই ওদের সাথে সমাজ বিজ্ঞানের ক্লাশ করতাম। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর নজরুল ইসলাম নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। লম্বা, সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত কালো চশমায় ঢাকা উজ্জল দুটি চোখ স্যারের, যাকে চোখ না বলে নেত্র বলাই বোধ হয় সমীচিন হবে, আর অসম্ভব বাগ্মী এবং অদ্ভুত রকমের নান্দনিক পঠনশৈলী ছিল নজরুল স্যারের। তার লেকচার আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, মনে হত আমি সমাজ বিজ্ঞানেরই ছাত্র। তার ক্লাশের প্রতি আমার আকর্ষণ এতটাই তীব্র ছিল যে, আমার সমাজ বিজ্ঞানের বন্ধুদের মনে না থাকলেও সপ্তাহে কি কি বারে নজরুল স্যারের ক্লাশ ছিল তা আমার মনে থাকতো। আমার এই সমাজবিজ্ঞান প্রীতি দেখে আমার বন্ধুরা আমাকে সমানে খোঁচাতো, তাদের বক্তব্য ওসব লেকচার ফেকচার ফালতু বাত, লিপিস্টিক ডিপার্টমেন্ট তো তাই ওদের ক্লাশে আমার আগ্রহ বেশী!! সমাজ বিজ্ঞানে যেহেতু প্রচুর মেয়ে ভর্তি হত সেজন্য আর্টস ফ্যাকান্টিতে সমাজ বিজ্ঞান, কার্জন হলে বোটানী আর জুওলজির লিপস্টিক ডিপার্টমেন্ট হিসাবে কমবেশী পরিচিতি ছিল।
আসল কথা, মানে নজরুল স্যারের কথায় আসি। কি জানি একটা ক্লাশে উনি প্রসংগ ক্রমে সভ্যতা ও সংস্কৃতি কি তা বোঝাচ্ছিলেন। বোঝাতে গিয়ে উনি যেটা করতেন সেটা হল বিষয়টি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের ধারনা জানার চেষ্টা করে ক্লাশটিকে পার্টিসিপেটরী করে ফেলতেন, পরে নিজের বক্তব্য বলতেন। এটা ছিল তার পড়ানোর একটা স্টাইল। আমি ব্যক্তি জীবনে খুব কম বিষয়ই হুবুহু ফলো করি। এখনো পর্য্যন্ত টিচিং বা লেকচারিং এর সুযোগ পেলে নজরুল স্যারের এই স্টাইলটি আমি হুবুহু ফলো করি, যতবার করি ততবারই পরম শ্রদ্ধায় স্যারকে স্মরন করি।
ছাত্র ছাত্রীরা যার যা ইচ্ছে বললো, পরে নজরুল স্যার একটি মাত্র বাক্যে সভ্যতা এবং সংস্কৃতি বোঝালেন। বাক্যটি নিজের অনুধাবন নাকি অন্য কারো কোটেশন তা আমি জানিনা সংগত কারনেই। উনি বললেন, What we do is our culture and what we use is our civilization.উদাহরন দিয়ে বলেছিলেন ঈদের দিনে আমরা যে কোলাকুলি করি এটা আমাদের কালচার আর ঈদের দিনে আমরা যে সেমাই খাই বা নতুন কাপড় পরি এটাই আমাদের সভ্যতা। তিনি আরো বলেছিলেন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। সভ্যতাই সংস্কৃতির রূপকার।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, কাজ করি পুলিশে। হঠাৎ করে সভ্যতা সংস্কৃতি ইত্যকার উদ্ভট বিষয় নিয়ে আমার এত মাথা ব্যাথা কেন এ প্রশ্ন নিতান্তই যৌক্তিক। সেটি বলবো বলেই আজ বসেছি।
বিগত ২৫ শে জুন আমাদের স্বপ্নের সেতু ,প্রমত্তা পদ্মার উপর পদ্মা সেতুর উদ্ভোধন করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সেতুকে ঘিরে দেশী বিদেশী রথি মহারথীদের ষঢ়যন্ত্র এবং অপপ্রচারের বিষয়টিও কমবেশী সকলেরই জানা। আর সেজন্যই হয়তোবা সেতু উদ্বোধন নিয়ে মানুষের আগ্রহও ছিল তুঙ্গে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আবেগঘন ভাষন হৃদয় ছুঁয়ে গেছে আপামর জনতার। সে সেতু নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস থাকবে, মানুষ একটু আধটু বিধি নিষেধ উপেক্ষা করেও তা ছুঁতে চাইবে, দেখতে চাইবে, তাকে স্পর্শ করবে, ছবি তুলবে এটিও অস্বাভাবিক নয় খুব একটা।
কোন একটি চ্যানেলে দেখলাম একটা ইয়াং ছেলে কাঁটা তারের বেড়া সরিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকতে চাইছে। কর্তব্যরত এক পুলিশ সদস্য তাকে যখন বাঁধা দেয় এবং বিধি বহির্ভূতভাবে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করে তখন সে স্বতস্ফূর্তভাবেই বলে উঠলো, ভাই বাঙালীরে কি কাটাতাঁরের বেড়া দিয়ে দাবায় রাখা যায়? সেটিও আমি একজন পুলিশ অফিসার হয়েও মজা হিসেবেই নিলাম। স্বপ্ন ছোঁয়া হয়ে গেলে একটু আধটু বাড়াবাড়ি বিসদৃশ লাগেনা, যদি না তা ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে।
পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়নে একজন বাঙালী হিসাবে আমিও ভীষন গর্বিত। উদ্ধোধনের পর থেকেই লাখো মানুষ এটি পরিভ্রমন করেছেন, যারা এখনো যেতে পারেননি তারা প্লান করছেন কবে কখন যাবেন। আমার পরিচিত ইউ.কে প্রবাসী এক সিলেটি ভদ্রলোক ঢাকায় এসে হোটেলে উঠে আমাকে ফোন দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম সিলেটে না গিয়ে ঢাকায় হোটেলে কেন উঠেছেন। বললেন, একটু ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে, ভিড়ভাট্টা একটু কমলে পদ্মা সেতু দেখতে যাবেন, সেখান থেকে ফিরে ভোর রাতে সিলেট যাবেন। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে ইংল্যান্ড প্রবাসী, গিয়েছেন বিশ্বের বহু দেশে, দেখেছেন বহু অট্টালিকা, সেতু, দর্শনীয় স্থান। তার ও ইচ্ছে হয়েছে পদ্মা সেতুটি একবার নিজ চোখে দেখে তারপর মাকে দেখতে সিলেট যাবেন। আসলে আবেগ কোন গ্রামার মানেনা, অনুভূতিও যুক্তি বিদ্যা মেনে চলেনা সব সময়।
দেশবাসীর এত আবেগ অনুভূতির মধ্যে এটাও দেখলাম, এক মহা পন্ডিত সেতুর শো গ্রিলের নাট বল্টু খুলছে, একজন পিসু করছে, ছয় মিনিটে যে সেতু পার হওয়া যায় সেই সেতুতে কয়েকজন ভদ্রলোক নামাজ পড়ছেন এবং আরেক হুজুর নামাজ না পড়ে ভিডিও করছেন, এক মধ্য বয়স্ক নারী অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী করে টিকটক বানাচ্ছেন, কোন কোন বীর পুরুষ আবার রেসিং স্টাইলে চিৎ,কাইত এমনকি উপুত হয়ে মোটর বাইক চালাচ্ছেন ইত্যকার নানাবিধ বিষয়, যা বলে শেষ করা যাবেনা হয়তোবা।
একসময় যেহেতু বিজ্ঞান পড়েছি, তাই বিজ্ঞান ভাল না বুঝলেও মস্তিষ্কের নিউরনে বিজ্ঞানমনস্কতা কিঞ্চিৎ রয়ে গেছে। সেই বোধ থেকেই অফিসে আসার পথে টুকটাক ঘাটাঘাটি করে দেখলাম বিশ্বের অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রে এমনতর জাতীয় অর্জনে মানুষের অনুভুতি কেমন ছিল, কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ছিলেন সেসব দেশের মানুষেরা। তারাও কি আমাদের মত উদ্ভট আচরন করেছিলেন? বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করতে হলনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই পেয়ে গেলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।
খুঁজতে খুঁজতেই সৌদি প্রবাসী এক ছোট ভাই এর সেতু সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। তিনি লিখেছেন আরব সাগরের উপর সৌদি আরব এবং বাহরাইনের মধ্যকার ২৫ কিলোমিটার লম্বা সেতু বা কজওয়ের কথা। যেটি পঁয়ত্রিশ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। তিনি লিখেছেন সৌদি আরব, বাহরাইনের বিপুল সংখ্যক নাগরিক এবং ট্যুরিষ্টরা এই সেতু দেখতে গেলেও বিসদৃর্শ অঙ্গভঙ্গী করে টিকটক জাতীয় এহেন কর্মকান্ড সেখানে হয়নি। তাহলে আমাদের এখানে এত কিছু কেন হল? সমস্যাটি আসলে কোথায় ?আমরা কি আরবদের চেয়ে অনগ্রসর,অসভ্য নাকি অন্য কিছু?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নিজের গন্ডির মধ্যে টুকটাক আর এন্ড ডি করলাম, পরিচিত দুয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাথেও কথা বললাম। আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের অধ্যাপক এবং সমাজ বিজ্ঞানের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র, বহু বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধের রচয়িতা এবং একজন বিদগ্ধ গবেষক প্রফেসর আমিনুল হকের সাথে কথা বললাম। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের টার্মিনোলজি ব্যাখা করে আমাকে অল্প কথায় মোটামুটি পরিষ্কার একটি ধারনা দিলেন।
নিজস্ব ভাবনার সাথে বিশেষজ্ঞের মতামত মিলিয়ে আমার যা মনে হল তা হল এই যে, মানুষ সব সময়ই নিজেকে গুরুত্বপূর্ন ভাবতে পছন্দ করে, অন্যের নজর কাড়তে চায়। এটেনশন সিক করা মানুষের একটি জন্মগত প্রবৃত্তি। আমরা নিজেদেরকে যতই নিভৃতচারী দাবী করিনা কেন মানুষের মনোজগতে এটেনসন সিক করার একটি তাড়না রয়েই যায়।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের তত্বমতে মানুষের ঈড, ইগো বা সুপার ইগোর একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই এটেনশন সিকিং। মানুষ তার কর্মে, ফ্যাশনে, আচার আচরনে, প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে নিত্যই এ কাজটি করে থাকে। জীবন যুদ্ধে একটু পিছিয়ে পড়া মানুষেরা অন্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য, অন্যের আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিনত হওয়ার জন্য নানাভাবে একাজটি চেতন বা অবচেতনভাবে একটু বেশীই করে থাকেন।
এমনকি ট্র্যাকে থাকা, এগিয়ে থাকা মানবগোষ্ঠীর কেউ কেউ আরো নজর কাড়ার জন্য তাদের দৃষ্টিতে অভূতপূর্ব, ইউনিক বা অসাধারন কিছু কাজ করেন, করে থাকেন বা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন শুধুই মানুষের এটেনশন অর্জনের মত দরিদ্র মানসিকতা নিয়ে।এটিও অস্বাভাবিক নয়, যেটি অস্বাভাবিক সেটি হল এটেনশন সিক করতে গিয়ে সভ্যতা, ভব্যতা, লোকাচার, শিষ্টাচার ,আত্মমর্যাদা বা সুবচন গুলোকে ভুলে যাকে বলে যেকোন মূল্যে নজরকাড়ার চেষ্টা করেন।ব্যক্তি মানুষের এ সকল বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন ঘটিয়েই একটি জাতি বা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী লোকজনের লোকাচার, প্রথা বা কালচারের উদ্ভব হয়।
কালচারের একটি মূল উপাদান হচ্ছে পরম্পরায়, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্য। আর এ ঐতিহ্যকে প্রভাবিত করে মানুষের ইনফেরিওরিটি বা সুপেরিওরিটি কমপ্লেক্স। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় একে সংজ্ঞায়িত করা হয় Ethnocentrism এবং Xeno centrism টার্মিনোলজিতে।
জাতিগোষ্ঠী যখন বিশ্বাস করে যে তার কালচার সমৃদ্ধ এবং সমসাময়িক অন্য জনপদের কালচারের চেয়ে কোন অংশে কম নয় তখন এটি হয় Ethnocentrism অর্থাৎ ethnic বৈশিষ্ট্যে কেন্দ্রীভূত থাকার মধ্য দিয়ে। আর এর বিপরীতে Xeno centrism এ বিশ্বাসীরা মনে করেন তার নিজস্ব কালচার অন্যের কালচারের সাথে তুলনামূলক বিচারে পিছিয়ে পড়া, ততটা আধুনিক বা অগ্রসর নয় এমন এক কালচার, তখন মানুষের মধ্যে বিরাট একটি ঝাঁকুনি তৈরী হয়।
একটা উদাহরন দিই। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত/উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা শিশুদের একটি প্রিয় খেলনা হচ্ছে বার্বিডল। আমি সহ আমাদের জেনারেশনের অনেকেই আমাদের কন্যা শিশুদেরকে বার্বিডল উপহার দিয়েছি। আমাদের কন্যারা বার্বি কালচারেই বড় হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই শিশু যা দেখে তা থেকেই শেখে। বার্বি ডলের কাছ থেকেই আমাদের কন্যারা চুল, চোখ, মুখের ফ্যাশন শিখেছে, তাদের মতে বার্বির মত করে ছোট ছোট কাপড় পরার অভ্যাস রপ্ত হওয়াটাই তাই স্বাভাবিক।
কন্যা শিশুটি যখন শিশু থেকে কিশোরী হয় তখনো সে স্বাভাবিক ভাবেই তার শৈশবের প্রিয় বার্বির মত ছোট ছোট পোষাকই পরতে চাইবে। আর তখনি তৈরী হয় একটি বিরাট কালচারাল শক। এই শকটি ধারন করার জন্য যদি তার মধ্যে ধর্মীয়/ নৈতিক বা সামাজিক শিক্ষাটুকু না থাকে তখন এইসব নির্দোষ কিশোরীদের এই স্বল্প বসন প্রীতি থেকেই যায় এবং সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরী হয়। তখনি বাড়ে দূরত্ব, তৈরী হতে থাকে তিক্ততা। এজন্যই আগে দরকার দেশজ কালচারের গাঁথুনি তারপর বিদেশী/বিজাতীয় কালচারের পত্তন।
আমাদের সমসাময়িক অনেকেই সম্পূর্ণ দেশজ কালচারে বড় হয়ে ইউরোপ এমেরিকা সহ বহিবির্শ্বে বর্তমানে কার্য্য উপলক্ষে অবস্থান করছেন এবং বিদেশী সভ্যতা বা সংস্কৃতির প্রযোজ্য অংশটুকু এডপ্ট করছেন, তাতে কিন্তু একটুও সমস্যা হচ্ছেনা কারন moral বা ethical গাঁথুনির ভিত্তি যেখানে শক্ত সেখানে হঠাৎ করে কোন কিছু জেঁকে বসতে পারেনা।
প্রসংগে ফিরে আসি, পরিষ্কার করে বলতে চাই আমি সেই অর্থে টিকটক কালচারের সমালোচক নই। সভ্যতা একটি গতিশীল স্বত্ত্বা। ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতে সোসাইটি অনেক কিছু বর্জন বা গ্রহন করে, এভাবেই সভ্যতা এগিয়ে চলে। কিন্তু আমি আধুনিকতার নামে আমাদের কালচারে বিজাতীয় কালচারের আংশিক অনুপ্রবেশের ঘোরতর বিরোধী। যদি গ্রহন করতে হয় তো পুরাটা করলেই বরং ভাল। তা না করে ভোগবাদী কালচারটুকু গ্রহণ করা এবং দায়ীত্ব কর্তৃব্যের অংশটুকু পরিহার করলে তা না হবে ঘরকা না হবে ঘাটকা।
জাতি হিসাবে আমরা শংকর। তার উপর শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা শাসিত হয়েছি ভিনদেশীদের দ্বারা। আমাদের সোসাইটি সুনিপুনভাবে শাসকদের অনেক কিছুই গ্রহন বা বর্জন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেনতেন প্রকারে বিখ্যাত হওয়ার জন্য বা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যে জগাখিচুড়ি কালচারের উদ্ভব হচ্ছে তাতে করে আমি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে ভীষন উদ্বিগ্ন।
আমি এই বদ্বীপেরই ভূমি পুত্র। আমার পূর্ব পুরুষেরা (নারীরাও) এই মাটিতেই শুয়ে আছেন, শেষ শয্যায়। ভাগ্যে থাকলে এই মাটিতেই আমার দাফন হবে। আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে কোথায় রেখে যাব তা আমাকে ভীষন ভাবিত করে।ভাষার জন্ম হয়েছে অনুভতি ব্যক্ত করার জন্য। তেমনিভাবে ক্যামেরার জন্ম হয়েছে দৃশ্য বা স্মৃতি কে ধারন করার জন্য। আমাদের বোঝা দরকার সব দৃশ্য বা স্মৃতি শেয়ার করার বিষয় নয়, কিছু দৃশ্য বা স্মৃতি শুধুই স্মৃতিপটে রেখে দেয়ার বিষয়, কিছু স্মৃতি আছে শুধুই ভুলে যাবার জন্য। যা ভুলতে না পারলেই বড় ভুল হয়ে যায়।
একটা ঘটনা শেয়ার করি। সেদিন আমার অফিসে আমার এক বন্ধু এসেছেন ,সস্ত্রীক। আলুথালু বেশ, ভেঙে পড়া চেহারা নিয়ে। ওয়েল অফ ফ্যামিলি, উচ্চ শিক্ষিত, ভাল জব করেন বন্ধু ও বন্ধু পত্নী। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমের নরম সোফায় বসেও ঘামছিলেন স্বামী স্ত্রী। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বাকরুদ্ধ দুজনেই। অনেক ক্ষন পর পানিটানি খেয়ে স্থির হলেন। বললেন কাহিনী।
একমাত্র মেয়ে পনেরো প্লাস, অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী। করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল স্কুল, ক্লাশ, পরীক্ষা। গ্রোয়িং স্টেজের মেয়েটি বলতে গেলে একাই বাসায় থাকে। টিকটকে কিশোরী মেয়েটি হঠাৎ একদিন দেখলো তারই এক বান্ধবী তার নারী হয়ে ওঠার বায়োলজিকাল চেঞ্জগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে তৈরী করা একটি ভিডিও। কিশোরীর ও শখ হয়, তারও হাতে ডিভাইস। সেও তো আর বাচ্চাটি নেই, নারী হয়ে গিয়েছে। সেও করলো একই কাজ, শেয়ার করলো তার ঐ বন্ধুর সাথে। একে একে আট দশজন উঠতি বয়সের কিশোরী একই কাজ করল। তাদের এই গ্রুপে ভাইরাসের মত ঢুকে পড়লো তাদেরই এক বান্ধবীর ও লেভেল পড়ুয়া তরুন কাজিন।
এতগুলো কৈশোরোত্তীর্ণ তরুনীর ওয়াশ রুম ভিডিও দেখে সে আর হজম করতে পারলোনা। বন্ধুর মেয়েটিকে বাধ্য করলো ভিডিওর মত করে ভিডিও চ্যাটিং করতে। এ অবস্থা কয়েকদিন চলতে না চলতেই আরো এক ধাপ পেরিয়ে সরাসরি মেয়েটির সংগ চাইলো ছেলেটি। মেয়েটি ভয় পেয়ে গেল। অনলাইনে একটিভ হলেও অফলাইনে তার তো ভয় আছেই।
বিষন্ন হয়ে পড়লো প্রানোচ্ছল কিশোরীটি। মা টের পেলেন। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। মেয়ে কিছুই বলেনা। অবশেষে একদিন মেয়ে বললো সবকিছু। সদ্য কিশোরী মেয়েটির পার্সোনাল ভিডিও পাবলিক ডোমেইনে আছে জেনে মা বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তারপরে তাদের মনে হল আমার কাছে আসার কথা। আমি যা করার তা করেছি। কিন্তু সবার কি আর রিপোর্ট না করে এ জাতীয় গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রানের মত পথ আছে ? না নেই, আমাদের দেশেও নেই, এমনকি বিশ্বের কোথাও নেই। এ জাতীয় সমস্যা রিপোর্ট না করে সমাধান করা যায় না। অপরাধটির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, পুরোপুরি সর্বনাশ না হওয়াতে তবুও আমার একটু সুযোগ ছিল এমিকেবলি শুধরে দেবার। কাজেই বিষয়টি নেহায়েতই মৌখিক উদ্বেগের বিষয় নয়, আরো গুরুতর।
বাবা মা হিসাবে সংগত কারনেই আমাদের উদ্বেগ আছে। কতক্ষন আমরা আমাদের প্রানপ্রিয় বাচ্চাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখবো? সচেতনতা একটি টুলস, সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার নগরে আগুন লাগলে দেবালয় ও রক্ষা পায়না।
প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কি এসব পছন্দ করে। সহজ উত্তর হচ্ছে ‘না’। একশ্রেনীর মানুষ মজা নেয়, অনেকেই দেখে। মানুষের দৃষ্টি কাড়ার জন্য এগুলো করা হয়। যারা করে তারা একটা কথা ভুলে যায় যে কিছু মানুষ এগুলো দেখে, উৎসাহ দেয়, এক্সিলেন্ট বা সুপার বলে কমেন্ট করে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে বিরাট এক জনগোষ্ঠী এগুলো পছন্দও করেনা, দেখেওনা, তাদের অপছন্দের বিষয়টিও কাউকে জানায়ও না। তারা এগুলোকে জমা রাখে ভবিষ্যতের বড় সিদ্ধান্তের জন্য।
আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের প্রবাসী ডাক্তার ছেলের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। পাত্রীও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সুন্দরী, ভাল ফ্যামিলি, যাকে বলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু বিয়েটা শেষ পর্য্যন্ত হয়নি। ছেলের ছোট বোন কৌশলে মেয়ের আইডিতে গিয়ে দ্যাখে মেয়েটার ওয়ালে তাদের ভাষায় আপত্তিকর দৃশ্যায়ন আছে।
এই যুগে আর কোন কিছুই স্থায়ীভাবে গোপন করা যায়না। সাময়িকভাবে হয়তো যায়, কিন্তু পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে আরো বড় সমস্যার উদ্রেক হয়। বিয়ে বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এখন অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। মনে রাখা দরকার সমাজে এ সংখ্যা যত বাড়বে সমাজে ততই ভারসাম্যহীনতা তৈরী হবে।
বাংলা ভাষার আগে থেকেই “পরশ্রীকাতরতা” বলে একটি শব্দ আছে ।এমনি তো আর এর জন্ম হয়নি। আমাদের কালচারে এ বৈশিষ্ট্য আছে বলেই আমাদের ভাষায় শব্দটি এসেছে। একজনের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হলে স্বভাবতই সে চাইতে পারে আরেকজনের জীবনের ভারসাম্যও নষ্ট হোক। এবং এটি যদি ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে তাহলে সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ সামাজিক সংকট।
আমার মনে হয় আমাদের সমাজে অধিকার সচেতনতা যতটা প্রকট, দায়ীত্ব সচেতনতা ততটাই ম্রিয়মান, অস্ফুট। কারো অধিকার ক্ষুন্ন হলেই সাধারনত সমাজ তার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু কারো কর্তব্যচ্যুতির ক্ষেত্রে সে রাজনৈতিক নেতা বা সরকারী কর্মচারী না হলে মানুষ তার দিকে সাধারনত আঙুলও তোলেনা। এতে করে এ ধরনের নর্মস বা ট্রাডিশন ভায়োলেশন এর ক্ষেত্রে এক ধরনের ইনডেমনিটি তৈরী হয় ,ভ্যাকুয়াম তৈরী হয় সমাজে। এই ভায়োলেটররা সোসাইটির এই সাইলেন্সের ভুল অর্থ করে, তারা ভুলে যায় মৌনতা সবসময় সম্মতির লক্ষন নয়।
আমাদের সোসাইটিতে নর্মস আছে, মূল্যবোধ আছে, সোশ্যাল মোরালও একেবারে ভঙ্গুর নয়। আমার মনে হয় আমাদের নীরব থাকার দিন ফুরিয়েছে। খুব ভদ্রভাবে, অন্যকে একটুও আঘাত না করেও মানুষকে নাড়া দেওয়া সম্ভব। আর সে কাজটি অন্য কেউই করে দেবেনা ,করতে হবে আমাদেরকেই।
বাঙালী মধ্যবিত্তের কাছে তার পরিবার অত্যন্ত পবিত্র একটি স্বত্বা, উপাসনালয় সম। সেই প্রিয় ও পবিত্র স্বত্ত্বাটিকে আগুন থেকে রক্ষা করতে হলে আগুনেই পানি ঢালতে হবে,উপাসনালয়ে ঢেলে লাভ নাও হতে পারে।
সমস্বরের ছোট ছোট প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়াই হয়তো একদিন সমাজের এসব অসংগতি গুলোকে দূর করবে। অন্ততঃ এক্ষেত্রে এ কথা সত্য যে, বেটার লেট দ্যান নেভার।
(বারিধারা, ঢাকা। ২৮ জুন, ২০২২)
[লেখক: উপ মহা পুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি), এন্টি টেরোরিজম ইউনিট]