আসফাক বীন রহমান
“এই টুক্কু মিয়া, তোমার নাম কি ? বয়স কতো ? কোন ক্লাসে পড়ো ?”- ছোট্ট রিক্সাওয়ালাটি ঘাম মুছতে মুছতে আব্বার দিকে অবাক হয়ে তাকায় । “ ফোরে পড়তাম, বাবায় বিছানায় । পড়া বন্ধ।” ক্লান্ত ১০/১১ বছরের ছেলেটির জবাব । “পড়াশোনা শুরু করো ।তোমার ঠিকানা দাও ,” আব্বা । আব্বাকে বললাম , “ও পড়াশোনা করলে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হবে ”। “দেখি আলমের স্কুলে পিয়নের কাজ দেয়া যায় কিনা; চাকুরীও হবে পড়াশুনাও চলবে ”,আব্বা ।
পড়াশোনা এবং কোন দূঃস্হ পরিবারকে নিয়মিত ইনকামের পথে যতোটুকু সাহায্য করা যায় উনার আমলাতান্ত্রিক যোগাযোগ ও বন্ধুদের সহযোগিতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন । এইতো বেশ কিছুদিন আগে দাদা আমাদের গ্রামের বেশ কয়েকটি দুঃস্থ পরিবারের ব্যাপারে আব্বাকে কিছু করার জন্য বলেন । আব্বা আশ্বাস দিলেন,“ আমি দেখবো ”। আব্বার এই ‘আমি দেখবো’ মানে তাঁদের জন্য উনি শেষ পর্যন্ত যতটুকু করার করবেন ।
কেউ টাকা- পয়সা ধার চাইলে আব্বা নিরুৎসাহিত করতেন । কেউ হাত পাতবে , নিজেকে ছোট করবে - এটা আব্বার অপছন্দ । ছোট চাকুরীজীবী, জুনিয়ার কলিগ, পিয়ন,মেন্তী , ফেরিওয়ালা প্রত্যেককে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন ।
দাদার সরকারী চাকুরীর সুবাদে ছাত্র জীবনটা আজিমপুর কলোনীতে কাটিয়েছেন ।আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় সবক দিতে ছাপড়া মসজিদ এর হুজুরের মক্তবে দুপুরে ভর্তি করে দেন -“ হুজুর আরবী শিক্ষার সাথে সাথে আদব -লেহাজ শিখাবেন ।কোন ছাড় দিবেন না , দরকার লাগলে বেত মারবেন ।” মুক্তি ফার্মেসীর মন্টু মিয়া আব্বার তরুণকালের সুহৃদ । উনাকে দায়িত্ব অর্পণ করলেন , “তুমি দেখবা ,এই দুইজন ছাপড়া মসজিদের এই এলাকায় যেন দুষ্টামি না করে বেড়ায় ।”
রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল সকাল লালবাগ মোড়ের বাজারে সাপ্তাহিক বাজারের সাথে সাথে ‘কাল্লু মিয়া কসাইয়ের গরুর মাংস’ কিনতে যাবেন-ই যাবেন । দুপুরে আম্মার হাতের লাল লাল ঝাল গরুর মাংসের ঝোল দিয়ে মজা করে ভাত খেয়ে ভাতঘুমের আগে - দরজায় ছোট ছোট টোকায় সচকিত হয়ে “ বুড়া মিয়া মনে হয় এসেছে ।” দরজা খোলার পর আব্বা পত্রিকা ফেরিওলা মারফতীর বাবাকে “আসেন বুড়া মিয়া, এইখানে ফ্যানের নিচে যুতমতো বসেন । ভাত খাইছেন ? আমাদের সাথে দু’টা ডাল ভাত খান ।” যত্নের সাথে বসিয়ে খাবার খাওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত রোদে যেন না ঘোরাঘুরি করে এজন্য গল্প করতে বসেন । একেবারে বিকালে চা- নাস্তা খাওয়ার পর বুড়া মিয়ার মুক্তি ।
লিম্ফ নোডে টিবি, ৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পরিদর্শনে এক্সিডেন্ট , ৮২ তে এয়ারপকেটে পড়ে অস্ট্রেলিয়া ফেরত প্লেনের অ্যাক্সিডেন্ট , ২০০১ এ হার্টে বাইপাস অপারেশনসহ অসংখ্য বার অপারেশন টেবিলে যেতে হয়েছে । প্রতিবারই দৃঢ়তা ও সাহসের সাথে সমস্যাগুলো মিটিয়েছেন । পরপর তিন ভাইবোনের পরিবারে বেশ কয়েকটি মৃত্যুতে মাথা ঠান্ডা রেখে অবিচলভাবে আগত সমস্যাগুলো মিটিয়েছেন ।বাইপাস অপারেশন আগে আমাকে শুধু আলাদাভাবে রুমে ডেকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন ,“ বাবা, সততার সাথে চলবে ; মানুষকে ঠকাবে না ; বিপদে সাহস হারাবে না, অন্যকে সম্মান করবে ,”শেষে বলেন ,“তোমার আম্মাকে দেখো ”।
মরহুম আব্দুর রহমান সাহেব আমার বাবা । সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে অবসর নেন ।
“ রাব্বীর হাম হুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা ”।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]
আসফাক বীন রহমান
শনিবার, ০২ জুলাই ২০২২
“এই টুক্কু মিয়া, তোমার নাম কি ? বয়স কতো ? কোন ক্লাসে পড়ো ?”- ছোট্ট রিক্সাওয়ালাটি ঘাম মুছতে মুছতে আব্বার দিকে অবাক হয়ে তাকায় । “ ফোরে পড়তাম, বাবায় বিছানায় । পড়া বন্ধ।” ক্লান্ত ১০/১১ বছরের ছেলেটির জবাব । “পড়াশোনা শুরু করো ।তোমার ঠিকানা দাও ,” আব্বা । আব্বাকে বললাম , “ও পড়াশোনা করলে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হবে ”। “দেখি আলমের স্কুলে পিয়নের কাজ দেয়া যায় কিনা; চাকুরীও হবে পড়াশুনাও চলবে ”,আব্বা ।
পড়াশোনা এবং কোন দূঃস্হ পরিবারকে নিয়মিত ইনকামের পথে যতোটুকু সাহায্য করা যায় উনার আমলাতান্ত্রিক যোগাযোগ ও বন্ধুদের সহযোগিতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন । এইতো বেশ কিছুদিন আগে দাদা আমাদের গ্রামের বেশ কয়েকটি দুঃস্থ পরিবারের ব্যাপারে আব্বাকে কিছু করার জন্য বলেন । আব্বা আশ্বাস দিলেন,“ আমি দেখবো ”। আব্বার এই ‘আমি দেখবো’ মানে তাঁদের জন্য উনি শেষ পর্যন্ত যতটুকু করার করবেন ।
কেউ টাকা- পয়সা ধার চাইলে আব্বা নিরুৎসাহিত করতেন । কেউ হাত পাতবে , নিজেকে ছোট করবে - এটা আব্বার অপছন্দ । ছোট চাকুরীজীবী, জুনিয়ার কলিগ, পিয়ন,মেন্তী , ফেরিওয়ালা প্রত্যেককে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন ।
দাদার সরকারী চাকুরীর সুবাদে ছাত্র জীবনটা আজিমপুর কলোনীতে কাটিয়েছেন ।আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় সবক দিতে ছাপড়া মসজিদ এর হুজুরের মক্তবে দুপুরে ভর্তি করে দেন -“ হুজুর আরবী শিক্ষার সাথে সাথে আদব -লেহাজ শিখাবেন ।কোন ছাড় দিবেন না , দরকার লাগলে বেত মারবেন ।” মুক্তি ফার্মেসীর মন্টু মিয়া আব্বার তরুণকালের সুহৃদ । উনাকে দায়িত্ব অর্পণ করলেন , “তুমি দেখবা ,এই দুইজন ছাপড়া মসজিদের এই এলাকায় যেন দুষ্টামি না করে বেড়ায় ।”
রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল সকাল লালবাগ মোড়ের বাজারে সাপ্তাহিক বাজারের সাথে সাথে ‘কাল্লু মিয়া কসাইয়ের গরুর মাংস’ কিনতে যাবেন-ই যাবেন । দুপুরে আম্মার হাতের লাল লাল ঝাল গরুর মাংসের ঝোল দিয়ে মজা করে ভাত খেয়ে ভাতঘুমের আগে - দরজায় ছোট ছোট টোকায় সচকিত হয়ে “ বুড়া মিয়া মনে হয় এসেছে ।” দরজা খোলার পর আব্বা পত্রিকা ফেরিওলা মারফতীর বাবাকে “আসেন বুড়া মিয়া, এইখানে ফ্যানের নিচে যুতমতো বসেন । ভাত খাইছেন ? আমাদের সাথে দু’টা ডাল ভাত খান ।” যত্নের সাথে বসিয়ে খাবার খাওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত রোদে যেন না ঘোরাঘুরি করে এজন্য গল্প করতে বসেন । একেবারে বিকালে চা- নাস্তা খাওয়ার পর বুড়া মিয়ার মুক্তি ।
লিম্ফ নোডে টিবি, ৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পরিদর্শনে এক্সিডেন্ট , ৮২ তে এয়ারপকেটে পড়ে অস্ট্রেলিয়া ফেরত প্লেনের অ্যাক্সিডেন্ট , ২০০১ এ হার্টে বাইপাস অপারেশনসহ অসংখ্য বার অপারেশন টেবিলে যেতে হয়েছে । প্রতিবারই দৃঢ়তা ও সাহসের সাথে সমস্যাগুলো মিটিয়েছেন । পরপর তিন ভাইবোনের পরিবারে বেশ কয়েকটি মৃত্যুতে মাথা ঠান্ডা রেখে অবিচলভাবে আগত সমস্যাগুলো মিটিয়েছেন ।বাইপাস অপারেশন আগে আমাকে শুধু আলাদাভাবে রুমে ডেকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন ,“ বাবা, সততার সাথে চলবে ; মানুষকে ঠকাবে না ; বিপদে সাহস হারাবে না, অন্যকে সম্মান করবে ,”শেষে বলেন ,“তোমার আম্মাকে দেখো ”।
মরহুম আব্দুর রহমান সাহেব আমার বাবা । সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে অবসর নেন ।
“ রাব্বীর হাম হুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা ”।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]