রাজিব শর্মা
"বাংলার ঘরে ঘরে বেজে উঠল শংখ্যধ্বনি, মর্তে প্রচারিত হল মনসার উপাখ্যান, দিকে দিকে সবাই গাইতে লাগল -মনসা মঙ্গল"
মনসামঙ্গল কাব্যের মূল আখ্যানবস্তুটি নিম্নরূপ...
চম্পক নগরের অধীশ্বর বণিক চাঁদ সদাগর। জগতপিতা শিবের মহাভক্ত। চাঁদ জগতপিতা শিবের থেকে মহাজ্ঞান লাভ করেছেন। মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব অর্জন সম্ভব নয়; তাই মনসা চাঁদের কাছে পূজা চাইলেন। শিবভিন্ন অপর কাউকে পূজা করতে চাঁদ প্রত্যাখ্যান করলেন। এমনকী পত্নী সনকার মনসার ঘটে হেঁতালদন্ডের বাড়ি মারেন। পরিণামে মনসা কৌশলে চাঁদের মহাজ্ঞান হরণ করেন এবং ছয়পুত্রকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন। তারপর সমুদ্রপথে চাঁদের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়ে চাঁদকে সর্বস্বান্ত করেন। চাঁদ কোনক্রমে প্রাণরক্ষা করেন। মনসা ছলনা করে স্বর্গের নর্তক দম্পতি অনিরুদ্ধ-ঊষাকে মর্ত্যে পাঠালেন। অনিরুদ্ধ চাঁদের ঘরে জন্মাল লখিন্দর রূপে, আর উজানী শহরে সাধু-বণিকের ঘরে বেহুলা রুপে ঊষা জন্ম নিল। বহুকাল পর চাঁদ সহায়-সম্বলহীনভাবে চম্পক নগরে উন্মত্ত পাগল বেশে করিল গমন। অবশেষে পিতা-পুত্রের মিলন ঘটল। বেহুলার সাথে লখিন্দরের বিবাহ স্থির হল । মনসা বৃদ্ধাবেশে এসে ছল করে বেহুলাকে শাপ দিল, বিভা রাতে খাইবা ভাতার। সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর বানান হল। কিন্তু গোপনে মনসার নির্দেশে একটি ছিদ্র রাখা হল। ছিদ্র পথে কালনাগিনী ঢুকে লখাইকে দংশন করল। বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে কলার মাজসে ভেসে পাড়ি দিল মনসার উদ্দেশে। বহু বিপদ অতিক্রম করে অবশেষে নেতো ধোবানির সাহায্যে দেবপুরে পৌঁছে নাচের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করল।তখন দেবতাদের আদেশে মনসা লখীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিল। বেহুলার সতীত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে অবশেষে চাঁদ মনসার পুজো দিল। মর্ত্যবাসের মেয়াদ ফুরাতে বেহুলা-লখীন্দর আবার ইন্দ্রসভায় স্থান পেল।
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপু্রাণ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য। এই ধারার অপর দুই প্রধান কাব্য চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্যের তুলনায় মনসামঙ্গল প্রাচীনতর। এই কাব্যের আদি কবি কানাহরি দত্ত সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান ছিলেন। অনুমিত হয়, মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অথবা বিহার অঞ্চলে। পরে পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গেও এই কাব্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে বহু মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়েছে, তন্মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কাব্যগুলি ‘মনসামঙ্গল’ ও পূর্ববঙ্গে প্রায়শই ‘পদ্মাপুরাণ’ নামে পরিচিত।
মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। মনসা মূলগতভাবে অনার্য দেবী। ভারতের আদিবাসী ও অন্ত্যজ সমাজে সর্পদেবী মনসার পূজা সুপ্রচলিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর মতো কয়েকটি আধুনিক উপপুরাণ গ্রন্থে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়; এই গ্রন্থগুলি অবশ্য খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত হয়নি। লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে; এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়।
মনসামঙ্গল একটি আখ্যানকাব্য। এই কাব্যের প্রধান আখ্যানটিও আবর্তিত হয়েছে মর্ত্যলোকে মনসার নিজ পূজা প্রচারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে। কাব্যের মূল উপজীব্য চাঁদ সদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান। এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগর শুধুমাত্র এই কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র; বেহুলা-লখিন্দরের করুণ উপাখ্যানটিও তার মানবিক আবেদনের কারণে আজও বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়।
মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি হরিদত্ত। বিজয় গুপ্ত এই কাব্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য এবং নারায়ণ দেব এই কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। অন্যান্য কবিদের মধ্যে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপলাই প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আধুনিক কালে মনসামঙ্গল অবলম্বনে বিশিষ্ট নাট্যকার শম্ভু মিত্র চাঁদ বণিকের পালা নামে একটি নাটক রচনা করেন। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের আকারেও একাধিকবার এই পুনঃসৃজিত হয়েছে মনসামঙ্গল।
”নেতা বলে বিষহরী, হেথা রহিয়া কি বা করি
মর্তভূবনে চল যাই।
মর্তভূবনে গিয়া, ছাগ-মহিষ বলি খাইয়া,
সেবকেরে বর দিতে চাই!
”কবি বিজয় গুপ্তের লেখা আখ্যানধর্মী কাব্য মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ এর সূচনা হয়েছে এই চরণদুটির মাধ্যমে।ধারণা করা হয় এই কাব্যের অর্থাৎ মনসামঙ্গলের আদি কবি কানা হরিদত্ত। সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তিনি ছিলেন। তার রচিত কোন কাব্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার পরিচয়খানা পাওয়া যায় কবি বিজয় গুপ্তের কাব্যে। তবে সুনাম নয়, বদনাম করার কারনে তার পরিচয় পাওয়া যায়।
“মুর্খে রচিল গীত, না জানে বৃত্তান্ত।
প্রথমে রচিল গীত, কানাহরি দত্ত।”
এখানে গীত মানে মনসামঙ্গল কাব্য। কবি বিজয় গুপ্ত নিজের আত্মপরিচয় দিয়েছেন ‘পদ্মাপুরাণ’ তথা ‘মনসা মঙ্গলের’ পদে। ফতেয়াবাদ মুলুকের বাঙ্গজোড়া তকসিমের অন্তর্গত ঘাগর নদীর পূর্ব, গন্ডেশ্বর নদীর পশ্চিমে ফুল্লশ্রী গ্রামে তাঁর নিবাস ছিল ( বর্তমান নাম গৈলা, বরিশাল জেলা ) । গ্রামটি ছিল শিক্ষা দীক্ষায় বেশ উন্নত। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য জাতির আবাস এই গ্রামে শাস্ত্র চর্চার প্রাবল্য ছিল। বিজয় গুপ্ত নিজে বৈদ্য ছিলেন। তাঁর পিতা সনাতন গুপ্ত, মাতা ছিলেন রুক্মিনী ।
বিজয়ের ভাষ্য :–
“সনাতন তনয় রুক্মিনী গর্ভজাত
সেই বিজয় গুপ্তরে রাখ জগন্নাথ।। ”
মনসামঙ্গল একটি আখ্যানকাব্য। এই কাব্যের প্রধান আখ্যানটিও আবর্তিত হয়েছে মর্ত্যলোকে মনসার নিজ পূজা প্রচারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে। কাব্যের মূল উপজীব্য চাঁদ সদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান নিয়ে। এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগর শুধুমাত্র এই কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র; বেহুলা-লখিন্দরের করুণ উপাখ্যানটিও তার মানবিক আবেদনের কারণে আজও বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়।মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা।
মনসা মূলগতভাবে অনার্য দেবী। প্রাচীন ভারতের আদিবাসী ও অন্ত্যজ সমাজে সর্পদেবী মনসার পূজা সুপ্রচলিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ বা মার্কেন্ডেয় পুরান ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর মতো কয়েকটি উপপুরাণ গ্রন্থে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়; এই গ্রন্থগুলি অবশ্য খ্রিষ্টীয় একাদশ- দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত হয়নি।
বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। তাছাড়া জলবদ্ধতা দেখা দেয়। শ্রাবণ, এই একমাস ধরে মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থটি আসরে বসে সুর করে পাঠ করা হয়। এর নাম রয়ানী গান। অতঃপর শ্রাবণের নাগপঞ্চমী তিথিতে মনসার পূজা করা হয়।আমার মতে মনসামঙ্গল কোন ধর্মীয়গ্রন্থের চেয়েও বড় এক মহাকাব্য। শওকত ওসমানের আদমজী পুরষ্কার প্রাপ্ত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বইটার শুরুতে যেমন কৌশলে কিছু লাইন লেখা হয়েছে যেন পাকিস্তান সরকার বইটি ব্যান করে না দেয়, সেরকম মনসামঙ্গলেও মব সাইকোলজি নিয়ে খেলা হয়েছে এবং সর্বোপরি দেবি মনসার চেয়ে মর্তের মানুষ চাঁদ সদাগরএর গুণকীর্তন বেশি করা হয়েছে। বর্ষাকালে শাক খেতে বারণ করা হয় কারণ শাকে এই সময় পোকামাকড় বেশি থাকে। আর সাপের প্রজনন মাস বলে ক্ষেত, ঝোপঝাড়ে, বাড়ির আনাচে-কানাচে তে সাপ এই সময় বেশি দেখা যায়। তাই বিষধর সাপের কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাপের কামড়ের থেকে রক্ষা এবং প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্য লাভের উদ্দেশ্যে শ্রাবণ মাসে মনসা পূজা করা হয়। মনসাকে বিষহরি/বিষহরা, নিত্যা, পদ্মাবতী ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মনসার বাহন সাপ এবং রাজহংস। মনসার ঘট প্রজনন/উর্বরতার প্রতীক। মনসাপূজার ঘট বসে পূজার একমাস আগে। ঘটে জল, কচু শাক, কচুর ফুল, বাঁশ পাতা, আমের পল্লব, বাসক পাতা, শাপলা ফুল, শাঁখা, সিঁদুর, সাদা শাড়ি লাল পাড় ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। যাদের স্থাপিত/ অধিষ্ঠিত দেবী মনসা আছে, উনারা ঘট বসান দেয় তিনটি(একটি মূল ঘট), আর অন্যরা দুটি করে ঘট বসায়। ঘট বসার পরে প্রতি রবিবার ঘটে নতুন করে জল দিয়ে সব উপকরণ আবার সাজিয়ে দিতে হয়। মনসার ঘট যেদিন বসে সেদিন পূজা হওয়া পর্যন্ত ব্রতীরা উপবাস থাকেন এবং পরিবারের সকলে দুপুরে নিরামিষ খান। পূজার দিন ও একই নিয়ম সাথে পাঁচন খাওয়া হয়। পূজার পরের দিন আবার পূজা করে মূল ঘটটি বিসর্জন দেওয়া হয়। পূজার ঘট বসলে একমাস মাংস এবং শাক খাওয়া নিষিদ্ধ। একমাস ধরে বিভিন্ন গানের সুরে মনসা পুঁথি পড়া হয়। আবার স্বচ্ছল পরিবারে পালা গান করে এমন গায়ক/গায়িকা দিয়ে সারারাত পুঁথি পড়ার আসর বসে। সেইদিন ঐ বাড়িতে গ্রামের সকলে বসে পুঁথি শোনে। পূজার নৈবেদ্য যার যার সামর্থ্য অনুসারে দেয়। ছাগল, ভেড়া, কচ্ছপ, হাঁস, কবুতর এমনকি চালকুমড়া, আঁখ, কলা, শসা, কলার মোচা/ফুল ইত্যাদি বলিতে দেওয়া হয়। মনসার ঘট বসলে সাপকে দেবীর অংশ মনে করে হিন্দুরা সাপ হত্যা থেকে বিরত থাকে। কারণ বলা হয় এই মাসে সাপ হত্যা পাপ। তাই ঘরে সাপ ঢুকে গেলেও বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে বের করে দেওয়া হয় হত্যা না করে। এইভাবে হিন্দুরা শ্রাবণ মাসে নাগ প্রজননে সহায়তা করে। তবে নাগ পঞ্চমীতে সাপকে দুধ খাওয়ানো হয়। যা মোটেও উচিত নয়। সাপ দুধ হজম করতে পারে না। নাগ পঞ্চমীর পর অনেক সাপ দু্ধ খাওয়ানোর ফলে মারা যায়। বিশালাক্ষ্ণী, বনবিবি, বনদেবী নারায়ণী, কালু রায়, মনসা পূজার মতোই আঞ্চলিক/লোকজ পূজা। যেমন - বাঘ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনদেবী নারায়ণী, জ্বর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জ্বরাসুর, গবাদী পশুর রক্ষার জন্য আটেশ্বর, কুমির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কালু রায় এর পূজা করা হয়। সবগুলো লোকজ বিশ্বাস।
প্রান্তিক মানুষ ভক্তি সহকারে পূজা করে এটা সত্য। এইসব পূজা আসলে প্রকৃতি সংরক্ষণের পূজা। আর প্রকৃতি যতো সংরক্ষিত হবে ততোই আমাদের জন্য মঙ্গল। মনসা পূজাতে বলি সবার থাকে না। চট্টগ্রামেই মনসাপূজাতে বলি দেওয়া হয়। তাই আমরা যেহেতু চট্টগ্রামের বাসিন্দা বলির ছাগল নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি দেখতে পাই। ছাগলের দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। চৈত্র সংক্রানিতে যে পাঁচন বা ঘন্ড আমরা খাই সেখানেও প্রতিযোগিতা থাকে কে কতো পদ/সবজি যুক্ত করতে পারে সেটাতে অবশ্য ক্ষতি নেই কারণ ঔষধি গুণ বৃদ্ধি পায়। ধর্মীয় উৎসব গুলোতে টাকার প্রতিযোগিতা ঢুকে গেলে যে কোন ধর্ম তার নিজস্বতা হারায়।
আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দিকে এত চমৎকারভাবে সুর করে পাঠ করা হয় যে মনসামঙ্গল আমার অতীব প্রিয় এক গীত কাব্য। মনসা দেবীর প্রভাবতো নেই ই, কালের পরিক্রমায় সেই রয়ানী গানও হারিয়ে যাচ্ছে। লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে; এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়। সনাতন বাঙালী সমাজে আজ ভক্তি-শ্রদ্ধা যোগে সর্পদেবী মনসার পুজো স্বাড়ম্বরে উদযাপিত হচ্ছে ।
[লেখকঃ সংবাদকর্মী]
রাজিব শর্মা
বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২
"বাংলার ঘরে ঘরে বেজে উঠল শংখ্যধ্বনি, মর্তে প্রচারিত হল মনসার উপাখ্যান, দিকে দিকে সবাই গাইতে লাগল -মনসা মঙ্গল"
মনসামঙ্গল কাব্যের মূল আখ্যানবস্তুটি নিম্নরূপ...
চম্পক নগরের অধীশ্বর বণিক চাঁদ সদাগর। জগতপিতা শিবের মহাভক্ত। চাঁদ জগতপিতা শিবের থেকে মহাজ্ঞান লাভ করেছেন। মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব অর্জন সম্ভব নয়; তাই মনসা চাঁদের কাছে পূজা চাইলেন। শিবভিন্ন অপর কাউকে পূজা করতে চাঁদ প্রত্যাখ্যান করলেন। এমনকী পত্নী সনকার মনসার ঘটে হেঁতালদন্ডের বাড়ি মারেন। পরিণামে মনসা কৌশলে চাঁদের মহাজ্ঞান হরণ করেন এবং ছয়পুত্রকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন। তারপর সমুদ্রপথে চাঁদের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়ে চাঁদকে সর্বস্বান্ত করেন। চাঁদ কোনক্রমে প্রাণরক্ষা করেন। মনসা ছলনা করে স্বর্গের নর্তক দম্পতি অনিরুদ্ধ-ঊষাকে মর্ত্যে পাঠালেন। অনিরুদ্ধ চাঁদের ঘরে জন্মাল লখিন্দর রূপে, আর উজানী শহরে সাধু-বণিকের ঘরে বেহুলা রুপে ঊষা জন্ম নিল। বহুকাল পর চাঁদ সহায়-সম্বলহীনভাবে চম্পক নগরে উন্মত্ত পাগল বেশে করিল গমন। অবশেষে পিতা-পুত্রের মিলন ঘটল। বেহুলার সাথে লখিন্দরের বিবাহ স্থির হল । মনসা বৃদ্ধাবেশে এসে ছল করে বেহুলাকে শাপ দিল, বিভা রাতে খাইবা ভাতার। সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর বানান হল। কিন্তু গোপনে মনসার নির্দেশে একটি ছিদ্র রাখা হল। ছিদ্র পথে কালনাগিনী ঢুকে লখাইকে দংশন করল। বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে কলার মাজসে ভেসে পাড়ি দিল মনসার উদ্দেশে। বহু বিপদ অতিক্রম করে অবশেষে নেতো ধোবানির সাহায্যে দেবপুরে পৌঁছে নাচের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করল।তখন দেবতাদের আদেশে মনসা লখীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিল। বেহুলার সতীত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে অবশেষে চাঁদ মনসার পুজো দিল। মর্ত্যবাসের মেয়াদ ফুরাতে বেহুলা-লখীন্দর আবার ইন্দ্রসভায় স্থান পেল।
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপু্রাণ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য। এই ধারার অপর দুই প্রধান কাব্য চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্যের তুলনায় মনসামঙ্গল প্রাচীনতর। এই কাব্যের আদি কবি কানাহরি দত্ত সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান ছিলেন। অনুমিত হয়, মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অথবা বিহার অঞ্চলে। পরে পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গেও এই কাব্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে বহু মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়েছে, তন্মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কাব্যগুলি ‘মনসামঙ্গল’ ও পূর্ববঙ্গে প্রায়শই ‘পদ্মাপুরাণ’ নামে পরিচিত।
মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। মনসা মূলগতভাবে অনার্য দেবী। ভারতের আদিবাসী ও অন্ত্যজ সমাজে সর্পদেবী মনসার পূজা সুপ্রচলিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর মতো কয়েকটি আধুনিক উপপুরাণ গ্রন্থে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়; এই গ্রন্থগুলি অবশ্য খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত হয়নি। লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে; এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়।
মনসামঙ্গল একটি আখ্যানকাব্য। এই কাব্যের প্রধান আখ্যানটিও আবর্তিত হয়েছে মর্ত্যলোকে মনসার নিজ পূজা প্রচারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে। কাব্যের মূল উপজীব্য চাঁদ সদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান। এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগর শুধুমাত্র এই কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র; বেহুলা-লখিন্দরের করুণ উপাখ্যানটিও তার মানবিক আবেদনের কারণে আজও বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়।
মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি হরিদত্ত। বিজয় গুপ্ত এই কাব্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য এবং নারায়ণ দেব এই কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। অন্যান্য কবিদের মধ্যে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপলাই প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আধুনিক কালে মনসামঙ্গল অবলম্বনে বিশিষ্ট নাট্যকার শম্ভু মিত্র চাঁদ বণিকের পালা নামে একটি নাটক রচনা করেন। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের আকারেও একাধিকবার এই পুনঃসৃজিত হয়েছে মনসামঙ্গল।
”নেতা বলে বিষহরী, হেথা রহিয়া কি বা করি
মর্তভূবনে চল যাই।
মর্তভূবনে গিয়া, ছাগ-মহিষ বলি খাইয়া,
সেবকেরে বর দিতে চাই!
”কবি বিজয় গুপ্তের লেখা আখ্যানধর্মী কাব্য মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ এর সূচনা হয়েছে এই চরণদুটির মাধ্যমে।ধারণা করা হয় এই কাব্যের অর্থাৎ মনসামঙ্গলের আদি কবি কানা হরিদত্ত। সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তিনি ছিলেন। তার রচিত কোন কাব্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার পরিচয়খানা পাওয়া যায় কবি বিজয় গুপ্তের কাব্যে। তবে সুনাম নয়, বদনাম করার কারনে তার পরিচয় পাওয়া যায়।
“মুর্খে রচিল গীত, না জানে বৃত্তান্ত।
প্রথমে রচিল গীত, কানাহরি দত্ত।”
এখানে গীত মানে মনসামঙ্গল কাব্য। কবি বিজয় গুপ্ত নিজের আত্মপরিচয় দিয়েছেন ‘পদ্মাপুরাণ’ তথা ‘মনসা মঙ্গলের’ পদে। ফতেয়াবাদ মুলুকের বাঙ্গজোড়া তকসিমের অন্তর্গত ঘাগর নদীর পূর্ব, গন্ডেশ্বর নদীর পশ্চিমে ফুল্লশ্রী গ্রামে তাঁর নিবাস ছিল ( বর্তমান নাম গৈলা, বরিশাল জেলা ) । গ্রামটি ছিল শিক্ষা দীক্ষায় বেশ উন্নত। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য জাতির আবাস এই গ্রামে শাস্ত্র চর্চার প্রাবল্য ছিল। বিজয় গুপ্ত নিজে বৈদ্য ছিলেন। তাঁর পিতা সনাতন গুপ্ত, মাতা ছিলেন রুক্মিনী ।
বিজয়ের ভাষ্য :–
“সনাতন তনয় রুক্মিনী গর্ভজাত
সেই বিজয় গুপ্তরে রাখ জগন্নাথ।। ”
মনসামঙ্গল একটি আখ্যানকাব্য। এই কাব্যের প্রধান আখ্যানটিও আবর্তিত হয়েছে মর্ত্যলোকে মনসার নিজ পূজা প্রচারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে। কাব্যের মূল উপজীব্য চাঁদ সদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান নিয়ে। এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। চাঁদ সদাগর শুধুমাত্র এই কাব্যেরই নয়, বরং সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র; বেহুলা-লখিন্দরের করুণ উপাখ্যানটিও তার মানবিক আবেদনের কারণে আজও বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়।মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা।
মনসা মূলগতভাবে অনার্য দেবী। প্রাচীন ভারতের আদিবাসী ও অন্ত্যজ সমাজে সর্পদেবী মনসার পূজা সুপ্রচলিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ বা মার্কেন্ডেয় পুরান ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর মতো কয়েকটি উপপুরাণ গ্রন্থে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়; এই গ্রন্থগুলি অবশ্য খ্রিষ্টীয় একাদশ- দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে রচিত হয়নি।
বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। তাছাড়া জলবদ্ধতা দেখা দেয়। শ্রাবণ, এই একমাস ধরে মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থটি আসরে বসে সুর করে পাঠ করা হয়। এর নাম রয়ানী গান। অতঃপর শ্রাবণের নাগপঞ্চমী তিথিতে মনসার পূজা করা হয়।আমার মতে মনসামঙ্গল কোন ধর্মীয়গ্রন্থের চেয়েও বড় এক মহাকাব্য। শওকত ওসমানের আদমজী পুরষ্কার প্রাপ্ত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বইটার শুরুতে যেমন কৌশলে কিছু লাইন লেখা হয়েছে যেন পাকিস্তান সরকার বইটি ব্যান করে না দেয়, সেরকম মনসামঙ্গলেও মব সাইকোলজি নিয়ে খেলা হয়েছে এবং সর্বোপরি দেবি মনসার চেয়ে মর্তের মানুষ চাঁদ সদাগরএর গুণকীর্তন বেশি করা হয়েছে। বর্ষাকালে শাক খেতে বারণ করা হয় কারণ শাকে এই সময় পোকামাকড় বেশি থাকে। আর সাপের প্রজনন মাস বলে ক্ষেত, ঝোপঝাড়ে, বাড়ির আনাচে-কানাচে তে সাপ এই সময় বেশি দেখা যায়। তাই বিষধর সাপের কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাপের কামড়ের থেকে রক্ষা এবং প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্য লাভের উদ্দেশ্যে শ্রাবণ মাসে মনসা পূজা করা হয়। মনসাকে বিষহরি/বিষহরা, নিত্যা, পদ্মাবতী ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মনসার বাহন সাপ এবং রাজহংস। মনসার ঘট প্রজনন/উর্বরতার প্রতীক। মনসাপূজার ঘট বসে পূজার একমাস আগে। ঘটে জল, কচু শাক, কচুর ফুল, বাঁশ পাতা, আমের পল্লব, বাসক পাতা, শাপলা ফুল, শাঁখা, সিঁদুর, সাদা শাড়ি লাল পাড় ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। যাদের স্থাপিত/ অধিষ্ঠিত দেবী মনসা আছে, উনারা ঘট বসান দেয় তিনটি(একটি মূল ঘট), আর অন্যরা দুটি করে ঘট বসায়। ঘট বসার পরে প্রতি রবিবার ঘটে নতুন করে জল দিয়ে সব উপকরণ আবার সাজিয়ে দিতে হয়। মনসার ঘট যেদিন বসে সেদিন পূজা হওয়া পর্যন্ত ব্রতীরা উপবাস থাকেন এবং পরিবারের সকলে দুপুরে নিরামিষ খান। পূজার দিন ও একই নিয়ম সাথে পাঁচন খাওয়া হয়। পূজার পরের দিন আবার পূজা করে মূল ঘটটি বিসর্জন দেওয়া হয়। পূজার ঘট বসলে একমাস মাংস এবং শাক খাওয়া নিষিদ্ধ। একমাস ধরে বিভিন্ন গানের সুরে মনসা পুঁথি পড়া হয়। আবার স্বচ্ছল পরিবারে পালা গান করে এমন গায়ক/গায়িকা দিয়ে সারারাত পুঁথি পড়ার আসর বসে। সেইদিন ঐ বাড়িতে গ্রামের সকলে বসে পুঁথি শোনে। পূজার নৈবেদ্য যার যার সামর্থ্য অনুসারে দেয়। ছাগল, ভেড়া, কচ্ছপ, হাঁস, কবুতর এমনকি চালকুমড়া, আঁখ, কলা, শসা, কলার মোচা/ফুল ইত্যাদি বলিতে দেওয়া হয়। মনসার ঘট বসলে সাপকে দেবীর অংশ মনে করে হিন্দুরা সাপ হত্যা থেকে বিরত থাকে। কারণ বলা হয় এই মাসে সাপ হত্যা পাপ। তাই ঘরে সাপ ঢুকে গেলেও বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে বের করে দেওয়া হয় হত্যা না করে। এইভাবে হিন্দুরা শ্রাবণ মাসে নাগ প্রজননে সহায়তা করে। তবে নাগ পঞ্চমীতে সাপকে দুধ খাওয়ানো হয়। যা মোটেও উচিত নয়। সাপ দুধ হজম করতে পারে না। নাগ পঞ্চমীর পর অনেক সাপ দু্ধ খাওয়ানোর ফলে মারা যায়। বিশালাক্ষ্ণী, বনবিবি, বনদেবী নারায়ণী, কালু রায়, মনসা পূজার মতোই আঞ্চলিক/লোকজ পূজা। যেমন - বাঘ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনদেবী নারায়ণী, জ্বর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জ্বরাসুর, গবাদী পশুর রক্ষার জন্য আটেশ্বর, কুমির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কালু রায় এর পূজা করা হয়। সবগুলো লোকজ বিশ্বাস।
প্রান্তিক মানুষ ভক্তি সহকারে পূজা করে এটা সত্য। এইসব পূজা আসলে প্রকৃতি সংরক্ষণের পূজা। আর প্রকৃতি যতো সংরক্ষিত হবে ততোই আমাদের জন্য মঙ্গল। মনসা পূজাতে বলি সবার থাকে না। চট্টগ্রামেই মনসাপূজাতে বলি দেওয়া হয়। তাই আমরা যেহেতু চট্টগ্রামের বাসিন্দা বলির ছাগল নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি দেখতে পাই। ছাগলের দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। চৈত্র সংক্রানিতে যে পাঁচন বা ঘন্ড আমরা খাই সেখানেও প্রতিযোগিতা থাকে কে কতো পদ/সবজি যুক্ত করতে পারে সেটাতে অবশ্য ক্ষতি নেই কারণ ঔষধি গুণ বৃদ্ধি পায়। ধর্মীয় উৎসব গুলোতে টাকার প্রতিযোগিতা ঢুকে গেলে যে কোন ধর্ম তার নিজস্বতা হারায়।
আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দিকে এত চমৎকারভাবে সুর করে পাঠ করা হয় যে মনসামঙ্গল আমার অতীব প্রিয় এক গীত কাব্য। মনসা দেবীর প্রভাবতো নেই ই, কালের পরিক্রমায় সেই রয়ানী গানও হারিয়ে যাচ্ছে। লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিপত্তি অর্জন করে; এমনকি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কালে শিক্ষিত বাঙালি সমাজেও মনসার পূজা প্রচলিত হয়। সনাতন বাঙালী সমাজে আজ ভক্তি-শ্রদ্ধা যোগে সর্পদেবী মনসার পুজো স্বাড়ম্বরে উদযাপিত হচ্ছে ।
[লেখকঃ সংবাদকর্মী]