alt

মুক্ত আলোচনা

‘সত্যিই দেশের মানুষ তাকে মারলো?’

আব্দুল মান্নান খান

: সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০২২

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণ মানুষের খুব কাছের একজন। আগের কোন কথায় না গিয়ে দেশ স্বাধীনের পরের একটা ঘটনা বলি। বঙ্গবন্ধুকে অনেকটা কাছে থেকে সেই শেষ দেখা ‘৭২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি। সালটা ৭৩-ও হতে পারে আমি ঠিক নিশ্চিত না। ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু নেমে আসছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। এ সময় চারদিক থেকে তাকে এমন ভাবে ভিড় করে ঘিরে ধরেছে লোকে যে, তিনি দাঁড়িয়ে গেছেন প্রায়। কেউ বঙ্গবন্ধুকে একটু স্পর্শ করে ধন্য হতে চাচ্ছে কেউ হাতের ছোয়া পেয়ে ধন্য হতে চাচ্ছে কেউ হাত ধরে চুমু খেতে চাচ্ছে কেউবা পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে চুমু খাচ্ছে। তখন বঙ্গবন্ধুর এমন অবস্থা যে, পা বাড়ানোই দায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে দৃশ্য যারা দেখেছিলেন তারা নিশ্চয় ভুলে যান নি। আর ভুলে গেলেও আমার এ লেখাটি তাদের মধ্যে যারা পড়বেন তারা নতুন করে সেই স্মৃতিটা ফিরে পাবেন। বঙ্গবন্ধু বহরে-অবয়বে সবার মাথার ওপরে। মৌমাছির মতো তাকে যারা ঘিরে ধরেছেন তারা সব বঙ্গবন্ধুর বুক সমান কেউবা একটু এদিক ওদিক । দেখা গেল তিনি কারো গায়-মাথায় হাত দিয়ে দিচ্ছেন কাউকে বাহুতে নিয়ে আদর করে দিচ্ছেন। হাসি মুখে কিছু বলছেনও দুএক কথায়। তবে কী বলছেন সেটা আমি যে দূরত্বে ছিলাম সেখান থেকে বোঝার মতো ছিল না। এর মধ্যে মৃদু ধাক্কাধাক্কিও ছিল-কে কার আগে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারবেন বঙ্গবন্ধুকে একটু ছুঁয়ে দেখে তা নিয়ে।

আমার পরিষ্কার উপলব্ধিতে আছে আমি সেদিন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম,এটা কী হচ্ছে, আল্লাহ না করুক যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়! এ অবস্থায় যে কোনো কিছু তো ঘটে যেতে পারে! কিছু যে ঘটবে না এ নিশ্চয়তা কে দিয়েছে ওদের যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন! তারা কেন ওই সব লোকদের সরিয়ে দিচ্ছে না! একই সাথে এও উপলব্ধিতে এসেছিল বঙ্গবন্ধ তো বঙ্গবন্ধুই। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি না চাইলে সিকিউরিটির কী ক্ষমতা তার পাশ থেকে সাধারণ লোকজনকে সরিয়ে দেয়।

শহীদ মিনারে আমার দেখা সেই ঘটনার পরে আর কয়দিনেরইবা পরের কথা। ১৫ আগস্ট ’৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। মোহাম্মদপুরে সলিমুল্লাহ রোডের এক বাড়িতে থাকি তখন। ছিলাম সপরিবারে। ভোরে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। গোলাগুলির শব্দ শুনছি কিন্তু বিছানা ছাড়ছি না। মর্টারের আওয়াজ বেশি করে কানে এসে লাগল। তখন আমার মতো একজন যুদ্ধ না করা মানুষও গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারত কোনটা কোন অস্ত্রের আওয়াজ। এসময় আমার শিক্ষিকা মিসেস বারান্দা থেকে বলে উঠল, কিছু একটা ঘটেছে, উঠোতো! বারান্দায় গিয়ে দেখি একটা লোক খালি গায়ে গলির মাথার দোকানটার দিকে ছুটছে। আরো দুএকজনকে দেখলাম। তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে ফিরে রেডিও ছাড়লাম। ছাড়তেই শুনলাম, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দায় ফিরে গিয়ে। দু‘চারজন লোক ছোটাছুটি করছে। গলির মাথার দোকানটার দিকে যাচ্ছে। দোকানে একটা রেডিও আছে। তখনো দোকান খোলেনি। কত সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক নেই। চোখের পানি থামছে না। এ কী হলো! বারবার শুধু এটাই আওড়াতে থাকি, এ কী হলো! পরে যে অনুভূতি তা হলো, হায়রে বাঙালি, কী করে পারলি বত্রিশ নম্বর রক্তে ভাসাইতে। কিন্তু আজ এটুকু বলে থামতে পারছি না কিছুতেই । স্বস্থি পাচ্ছি না। আরও কিছু বলতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। তাই স্বনামধন্য লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বলা কথাগুলো এখানে স্মরণ করছি। তার ভাষায়,‘ দোতলায় সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব, সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছেন, নীচের দিকে এল এম জি হাতে সৈন্যদের দেখতে পেলেন, হয়তো মুখ চিনতেও পেরেছেন দু’একজনের, ভুরু তুলে তিনি তাঁর গম্ভীর গলায় গর্জে উঠলেন, এই, তোরা মনে করেছিস কী? গঙ্গে সঙ্গে ঘ্যার ঘ্যার ঘ্যার শব্দে গুলি ! ঝাঁঝরা শরীরে জাতির পিতা গড়াতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে, দু’চোখে গভীর বিস্ময়, সত্যিই দেশের মানুষ তাঁকে মারলো? (পূর্ব-পশ্চিম, পৃ:-৪৪৯ অখন্ড)।

এঅবস্থায় মিসেসকে বললাম , চলো ওই বাসায় যাই, টিভিতে কী দেখাচ্ছে দেখে আসি। ওই বাসা মানে কাছেই তাজমহল রোডে তার ভাইয়ের বাসায়। তখনই বের হতে পারলাম না। দেখলাম দোকানের সামনে মানুষ ভিড় করেছে খবর জানতে। পরে যখন ওই বাসায় গেলাম দেখলাম টেলিভিশনে হামদ নাথ শোনাচ্ছে। পরক্ষণে দেখলাম ছড়ি হাতে কয়েকজন জুনিয়র মিলিটারি অফিসার খন্দকার মুসতাক আহমদকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর আকার তাকে নিয়ে বের হলেন। এদৃশ্য টিভিতে দেখাতে লাগল বারবার।

এর পর থেকে শুধু দেখে যাওয়া আর শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার। এক সময় মিটিং-মিছিলে থাকা মানুষ বউ-বাচ্চা নিয়ে একেবারে ঘরের ভেতর সেঁধে রইলাম । কয়েক দিন কারফিউ চললো তারপর চললো রাতে কারফিউ । তারপর সবই চলতে লাগল। পরে শুনলাম বঙ্গবীর বাঘা কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংগঠিত হচ্ছেন। খন্দকার মুসতাক প্রেসিডেন্ট হলেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেন। সে ইনডেমনিটি হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের যাতে কোনদিন বিচার করা না যায় তার ব্যবস্থা করা। মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। দেখা গেল বঙ্গবন্ধুকে খুন করেই খুনিরা থামল না। তারা জেলখানায় ঢুকে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করল। খুনিরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেল কত সুযোগসুবিধা পেল দেশের বাইরে চলে গেল আরো কত কী। ৭ নভেম্বর ট্যাংক বহরের উল্লাস দেখলাম রাস্তায়। অনেক রাজনীতিককে সেই ট্যাংকের ওপরে উঠে পড়েও উল্লাশ করতে দেখা গেল। খালেদ মোশাররফ সাফায়াত জামিল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহের এসব নাম তখন মুখে মুখে ঘুরছে। তারপর এক সময় জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হলেন। সামরিক শাসন জারি হলো। জিয়াউর রহমান নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি সৃষ্টি করলেন। নির্বাচন দিলেন কত কিছু।

১৯৭৯ সালের সেই নির্বাচনে আমাকে এক কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়েছিল। আমি তখন শিক্ষার একটা প্রকল্পে চাকরি নিয়ে কুষ্টিয়াতে। অজপাড়াগাঁয়ের এক কেন্দ্রে ভোট করতে যাই। এর আগে ট্রেনিং হলো। ভোটের আগের দিন রিটার্নিং অফিসার সাহেব প্রিসাইডিং অফিসারদের তার কক্ষে ডেকে নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে নয় সরাসরি বললেন, ধানের শিষকে পাস করাতে হবে। উপরের নির্দেশ আছে’। হলফ করে বলছি আমি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলাম। যথাযথভাবে ভোট গণনা করে যে মার্কায় যতটা ভোট পড়েছিল তা সঠিকভাবে গণনা করে অংকে ও কথায় লিখে যাদের যাদের সই নেয়ার কথা নিয়ে সীলগালা করে পুলিশ সাথে গভির রাতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে জমা দিয়ে ফিরেছিলাম। মানে মানে কাজটা করে আসতে পেরেছিলাম সেদিন। ভয় ছিল। ওই এলাকায় তখন সর্বহারাদের দৌরাত্ব। এই নির্বচনের পর গঠিত জাতীয় সংসদ প্রথম অধিবেশনেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়।

তারপর বহু জল গড়িয়ে যায় বুড়িগঙ্গায়। পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই একুশ বছর পর ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ওই ইনডেমনিটি বাতিল করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শুরু হয়। ফাঁসির রায় হয়। রায় কার্যকরী হয়। খুনিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যাদের গলায় ফাঁসির দড়ি ওঠেনি তাদেরও উঠবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রেহায় পাবে না। কিন্তু যারা ট্রিগার টিপল তাদের নেপথ্যে কারা ছিল সেটা পরিষ্কার করা হয়নি যেটা এখন জাতির দায়িত্ব। আমি গত বছর একবার মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম কোলকাতায় চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে। ফিরে এসে ‘বিশ্বাসঘাতকেরা মরে না’ শিরোনামে একটা লেখাও লিখেছিলাম এ কলামে। সে লেখার সূত্র ধরে এখানে কয়েকটা কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। যেমন এই উপমহাদেশের আড়াইশ তিনশ বছরের ইতিহাসের সেরা বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের সামনে যে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সৃষ্টি করা হলো যার কোন তুলনা সভ্য জগতের ইতিহাসে নেই সেই হত্যাকারীরা তো মিরজাফরের চেয়ে অনেক বড় বিশ্বাসঘাতক। তারা খুনি। ইতিহাসের পাতায়ও তারা মিরজাফরের চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণিত হয়ে থাকবে। মিরজাফর নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেনি তবু সে ইতিহাসের পাতায় হয়েছে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর কারণ সে নবাবকে হত্যার পথ তৈরি করে দিয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে। সিপাহশালার মিরঝাফরের আদেশ না পেয়ে নীরবে হাজার হাজার নবাব বাহিনীর সেনারা দাঁড়িয়ে থেকে ব্রিটিশদের বিজয় দেখেছে। বলতে চাচ্ছি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে সেই মানুষ নামের কলঙ্কটি কে দেশবাসীর কাছে তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন যাতে মানুষ তাকে দেশ ও জাতির কলঙ্ক বলে আখ্যায়িত করতে পারে চিরকাল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে কে বা কারা কাজ করেছিল তা স্পষ্ট করার জন্য অনেক সময় দেখি একটা কমিশন গঠনের কথা ওঠে। জাতির স্বার্থে এটা করা হোক। আজ আমরা গভিরভাবে শোকাহত।

[লেখক :প্রাবন্ধিক]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

‘সত্যিই দেশের মানুষ তাকে মারলো?’

আব্দুল মান্নান খান

সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০২২

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাধারণ মানুষের খুব কাছের একজন। আগের কোন কথায় না গিয়ে দেশ স্বাধীনের পরের একটা ঘটনা বলি। বঙ্গবন্ধুকে অনেকটা কাছে থেকে সেই শেষ দেখা ‘৭২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি। সালটা ৭৩-ও হতে পারে আমি ঠিক নিশ্চিত না। ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু নেমে আসছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। এ সময় চারদিক থেকে তাকে এমন ভাবে ভিড় করে ঘিরে ধরেছে লোকে যে, তিনি দাঁড়িয়ে গেছেন প্রায়। কেউ বঙ্গবন্ধুকে একটু স্পর্শ করে ধন্য হতে চাচ্ছে কেউ হাতের ছোয়া পেয়ে ধন্য হতে চাচ্ছে কেউ হাত ধরে চুমু খেতে চাচ্ছে কেউবা পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে চুমু খাচ্ছে। তখন বঙ্গবন্ধুর এমন অবস্থা যে, পা বাড়ানোই দায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে দৃশ্য যারা দেখেছিলেন তারা নিশ্চয় ভুলে যান নি। আর ভুলে গেলেও আমার এ লেখাটি তাদের মধ্যে যারা পড়বেন তারা নতুন করে সেই স্মৃতিটা ফিরে পাবেন। বঙ্গবন্ধু বহরে-অবয়বে সবার মাথার ওপরে। মৌমাছির মতো তাকে যারা ঘিরে ধরেছেন তারা সব বঙ্গবন্ধুর বুক সমান কেউবা একটু এদিক ওদিক । দেখা গেল তিনি কারো গায়-মাথায় হাত দিয়ে দিচ্ছেন কাউকে বাহুতে নিয়ে আদর করে দিচ্ছেন। হাসি মুখে কিছু বলছেনও দুএক কথায়। তবে কী বলছেন সেটা আমি যে দূরত্বে ছিলাম সেখান থেকে বোঝার মতো ছিল না। এর মধ্যে মৃদু ধাক্কাধাক্কিও ছিল-কে কার আগে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারবেন বঙ্গবন্ধুকে একটু ছুঁয়ে দেখে তা নিয়ে।

আমার পরিষ্কার উপলব্ধিতে আছে আমি সেদিন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম,এটা কী হচ্ছে, আল্লাহ না করুক যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়! এ অবস্থায় যে কোনো কিছু তো ঘটে যেতে পারে! কিছু যে ঘটবে না এ নিশ্চয়তা কে দিয়েছে ওদের যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন! তারা কেন ওই সব লোকদের সরিয়ে দিচ্ছে না! একই সাথে এও উপলব্ধিতে এসেছিল বঙ্গবন্ধ তো বঙ্গবন্ধুই। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি না চাইলে সিকিউরিটির কী ক্ষমতা তার পাশ থেকে সাধারণ লোকজনকে সরিয়ে দেয়।

শহীদ মিনারে আমার দেখা সেই ঘটনার পরে আর কয়দিনেরইবা পরের কথা। ১৫ আগস্ট ’৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। মোহাম্মদপুরে সলিমুল্লাহ রোডের এক বাড়িতে থাকি তখন। ছিলাম সপরিবারে। ভোরে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। গোলাগুলির শব্দ শুনছি কিন্তু বিছানা ছাড়ছি না। মর্টারের আওয়াজ বেশি করে কানে এসে লাগল। তখন আমার মতো একজন যুদ্ধ না করা মানুষও গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারত কোনটা কোন অস্ত্রের আওয়াজ। এসময় আমার শিক্ষিকা মিসেস বারান্দা থেকে বলে উঠল, কিছু একটা ঘটেছে, উঠোতো! বারান্দায় গিয়ে দেখি একটা লোক খালি গায়ে গলির মাথার দোকানটার দিকে ছুটছে। আরো দুএকজনকে দেখলাম। তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে ফিরে রেডিও ছাড়লাম। ছাড়তেই শুনলাম, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দায় ফিরে গিয়ে। দু‘চারজন লোক ছোটাছুটি করছে। গলির মাথার দোকানটার দিকে যাচ্ছে। দোকানে একটা রেডিও আছে। তখনো দোকান খোলেনি। কত সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক নেই। চোখের পানি থামছে না। এ কী হলো! বারবার শুধু এটাই আওড়াতে থাকি, এ কী হলো! পরে যে অনুভূতি তা হলো, হায়রে বাঙালি, কী করে পারলি বত্রিশ নম্বর রক্তে ভাসাইতে। কিন্তু আজ এটুকু বলে থামতে পারছি না কিছুতেই । স্বস্থি পাচ্ছি না। আরও কিছু বলতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। তাই স্বনামধন্য লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বলা কথাগুলো এখানে স্মরণ করছি। তার ভাষায়,‘ দোতলায় সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব, সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছেন, নীচের দিকে এল এম জি হাতে সৈন্যদের দেখতে পেলেন, হয়তো মুখ চিনতেও পেরেছেন দু’একজনের, ভুরু তুলে তিনি তাঁর গম্ভীর গলায় গর্জে উঠলেন, এই, তোরা মনে করেছিস কী? গঙ্গে সঙ্গে ঘ্যার ঘ্যার ঘ্যার শব্দে গুলি ! ঝাঁঝরা শরীরে জাতির পিতা গড়াতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে, দু’চোখে গভীর বিস্ময়, সত্যিই দেশের মানুষ তাঁকে মারলো? (পূর্ব-পশ্চিম, পৃ:-৪৪৯ অখন্ড)।

এঅবস্থায় মিসেসকে বললাম , চলো ওই বাসায় যাই, টিভিতে কী দেখাচ্ছে দেখে আসি। ওই বাসা মানে কাছেই তাজমহল রোডে তার ভাইয়ের বাসায়। তখনই বের হতে পারলাম না। দেখলাম দোকানের সামনে মানুষ ভিড় করেছে খবর জানতে। পরে যখন ওই বাসায় গেলাম দেখলাম টেলিভিশনে হামদ নাথ শোনাচ্ছে। পরক্ষণে দেখলাম ছড়ি হাতে কয়েকজন জুনিয়র মিলিটারি অফিসার খন্দকার মুসতাক আহমদকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর আকার তাকে নিয়ে বের হলেন। এদৃশ্য টিভিতে দেখাতে লাগল বারবার।

এর পর থেকে শুধু দেখে যাওয়া আর শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার। এক সময় মিটিং-মিছিলে থাকা মানুষ বউ-বাচ্চা নিয়ে একেবারে ঘরের ভেতর সেঁধে রইলাম । কয়েক দিন কারফিউ চললো তারপর চললো রাতে কারফিউ । তারপর সবই চলতে লাগল। পরে শুনলাম বঙ্গবীর বাঘা কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংগঠিত হচ্ছেন। খন্দকার মুসতাক প্রেসিডেন্ট হলেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেন। সে ইনডেমনিটি হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের যাতে কোনদিন বিচার করা না যায় তার ব্যবস্থা করা। মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। দেখা গেল বঙ্গবন্ধুকে খুন করেই খুনিরা থামল না। তারা জেলখানায় ঢুকে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করল। খুনিরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেল কত সুযোগসুবিধা পেল দেশের বাইরে চলে গেল আরো কত কী। ৭ নভেম্বর ট্যাংক বহরের উল্লাস দেখলাম রাস্তায়। অনেক রাজনীতিককে সেই ট্যাংকের ওপরে উঠে পড়েও উল্লাশ করতে দেখা গেল। খালেদ মোশাররফ সাফায়াত জামিল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহের এসব নাম তখন মুখে মুখে ঘুরছে। তারপর এক সময় জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হলেন। সামরিক শাসন জারি হলো। জিয়াউর রহমান নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি সৃষ্টি করলেন। নির্বাচন দিলেন কত কিছু।

১৯৭৯ সালের সেই নির্বাচনে আমাকে এক কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়েছিল। আমি তখন শিক্ষার একটা প্রকল্পে চাকরি নিয়ে কুষ্টিয়াতে। অজপাড়াগাঁয়ের এক কেন্দ্রে ভোট করতে যাই। এর আগে ট্রেনিং হলো। ভোটের আগের দিন রিটার্নিং অফিসার সাহেব প্রিসাইডিং অফিসারদের তার কক্ষে ডেকে নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে নয় সরাসরি বললেন, ধানের শিষকে পাস করাতে হবে। উপরের নির্দেশ আছে’। হলফ করে বলছি আমি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলাম। যথাযথভাবে ভোট গণনা করে যে মার্কায় যতটা ভোট পড়েছিল তা সঠিকভাবে গণনা করে অংকে ও কথায় লিখে যাদের যাদের সই নেয়ার কথা নিয়ে সীলগালা করে পুলিশ সাথে গভির রাতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে জমা দিয়ে ফিরেছিলাম। মানে মানে কাজটা করে আসতে পেরেছিলাম সেদিন। ভয় ছিল। ওই এলাকায় তখন সর্বহারাদের দৌরাত্ব। এই নির্বচনের পর গঠিত জাতীয় সংসদ প্রথম অধিবেশনেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়।

তারপর বহু জল গড়িয়ে যায় বুড়িগঙ্গায়। পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই একুশ বছর পর ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ওই ইনডেমনিটি বাতিল করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শুরু হয়। ফাঁসির রায় হয়। রায় কার্যকরী হয়। খুনিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যাদের গলায় ফাঁসির দড়ি ওঠেনি তাদেরও উঠবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রেহায় পাবে না। কিন্তু যারা ট্রিগার টিপল তাদের নেপথ্যে কারা ছিল সেটা পরিষ্কার করা হয়নি যেটা এখন জাতির দায়িত্ব। আমি গত বছর একবার মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম কোলকাতায় চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে। ফিরে এসে ‘বিশ্বাসঘাতকেরা মরে না’ শিরোনামে একটা লেখাও লিখেছিলাম এ কলামে। সে লেখার সূত্র ধরে এখানে কয়েকটা কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। যেমন এই উপমহাদেশের আড়াইশ তিনশ বছরের ইতিহাসের সেরা বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের সামনে যে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সৃষ্টি করা হলো যার কোন তুলনা সভ্য জগতের ইতিহাসে নেই সেই হত্যাকারীরা তো মিরজাফরের চেয়ে অনেক বড় বিশ্বাসঘাতক। তারা খুনি। ইতিহাসের পাতায়ও তারা মিরজাফরের চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণিত হয়ে থাকবে। মিরজাফর নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করেনি তবু সে ইতিহাসের পাতায় হয়েছে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর কারণ সে নবাবকে হত্যার পথ তৈরি করে দিয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে। সিপাহশালার মিরঝাফরের আদেশ না পেয়ে নীরবে হাজার হাজার নবাব বাহিনীর সেনারা দাঁড়িয়ে থেকে ব্রিটিশদের বিজয় দেখেছে। বলতে চাচ্ছি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে সেই মানুষ নামের কলঙ্কটি কে দেশবাসীর কাছে তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন যাতে মানুষ তাকে দেশ ও জাতির কলঙ্ক বলে আখ্যায়িত করতে পারে চিরকাল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে কে বা কারা কাজ করেছিল তা স্পষ্ট করার জন্য অনেক সময় দেখি একটা কমিশন গঠনের কথা ওঠে। জাতির স্বার্থে এটা করা হোক। আজ আমরা গভিরভাবে শোকাহত।

[লেখক :প্রাবন্ধিক]

back to top