উজ্জ্বলেন্দু চাকমা
ভাদ্র পূর্ণিমা বা মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যময় দিন। মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব। আমরা জানি, মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর মোট ৪৫ বছর বর্ষাবাব্রত পালন করেন অরণ্য, পর্বত, গুহা, বিহার ইত্যাদি নানা স্থানে।
মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ যখন কোশাম্বী ঘোষিতারামে ভিক্ষু-সংঘসহ অবস্থান করছেন সে সময় বিনয়ধর পন্থী ভিক্ষু ও গ্রন্থধর পন্থী ভিক্ষুর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র বিনয় সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তাঁর শিষ্য মন্ডলীগণের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এ বিষয় নিয়ে উভয় পন্থী ভিক্ষুদের মধ্যে মতদ্বৈততা চরম আকার ধারণ করলে তথাগত বুদ্ধ তাদের বিবাদ সমাধান করার প্রচেষ্টা করেন। বুদ্ধ দেখলেন, তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে আত্মকলহে জড়িয়ে তাদের অনুসারীদের মধ্যে একটি বিভাজন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সংঘ ও সদ্ধর্ম-শাসনের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। বৌদ্ধ পরিভাষায় একেই বলে সংঘভেদ”।
কিন্তু উভয় পক্ষ তাদের স্ব স্ব মতের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন; ফলে বিবাদ মীমাংসা করা সম্ভব না হওয়ায় বুদ্ধ কোশাম্বী ত্যাগ করে পারিলেয়্য নামক বনে গমন করেন এবং সেই বনের একটি ভদ্রশাল নামক বৃক্ষমূলের নীচে দশম বর্ষাবত অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি তিন মাস বর্ষবাস যাপন করেন, ধ্যান-সমাধি করেন। সে বনে ছিল নানা পশুপাখি ও জীবজন্তুর আবাস। বুদ্ধের অপরিমেয় মৈত্রী ও করুণার প্রভাবে বনের সেসব পশুপাখি ও জীবজন্তু তাদের হিংস্রতা পরিহার করে। পারিলেয়্য বনে বর্ষা যাপন কালে একটি একাচারী হাতি প্রতিদিন বুদ্ধের সেবা করত; বনের ফল সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করত।
এই পারিলেয়্য নামক হস্তীরাজও মনের দুঃখে সে একাই পথ ধরে এই বনে গমন করে। এ সময় বনের একটি বানর হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধকে সেবা করতে দেখে তার মনেও তথাগত বুদ্ধকে পূজা করার মনোবাসনা জাগে। ভাদ্র পূর্ণিমাতে সে একটি মৌচাক সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করেন। মৌচাকে মৌমাছির ছানা ও ডিম থাকায় বুদ্ধ প্রথমে মধু পান করলেন না। বানর সেটি বুঝতে পেরে মৌচাকটি নিয়ে ছানা ও ডিম পরিষ্কার করে পুনরায় বুদ্ধকে দান করলে এবার বুদ্ধ মধু পান করেন। মধুপান করতে দেখে বানর খুশিতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে এক বৃক্ষের মগডাল হতে অন্য মগডালে লাফাতে লাগল। হঠাৎ অসাবধানতাবশতঃ বৃক্ষের ডাল ভেঙ্গে বানর মাটিতে পড়ে গাছের গোড়ায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করল। বুদ্ধকে মধুদান এবং বুদ্ধের প্রতি প্রসন্নচিত্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর বানর তাবতিংস স্বর্গে ত্রিশ যোজন বিস্তৃত কনক বিমান ও সহস্র অপ্সরা লাভ করল। পারিলেয়্য বনে হস্তীরাজ কর্তৃক ভগবান বুদ্ধের সেবাপ্রাপ্তি ও বানরের
মধুদানের কারণে এ দিনটি বৌদ্ধদের কাছে এক অবিস্মরণীয় ও আনন্দ-উৎসবমুখর পুণ্যময় একটি দিন।
বুদ্ধের একাত্মতার নীতির সাথে সুর মিলিয়ে কবিগুরুও বলেছিলেন “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে....।”
বনের একটি তীর্যক প্রাণী বানর হয়ে বুদ্ধকে মধু দান দিয়ে যেখানে তার মহৎ উদারতা ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে, তৃপ্তি পেয়েছে এবং আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে, সেখানে আমরা মানুষ হয়েও আজ বিপন্ন মানুষের প্রতি সেই উদারতা, ত্যাগ ও দানের মহিমা দেখাতে পারছি না। আজ বিবেকের কাছে আমাদের প্রশ্ন- মানবতা, সেবা আর ত্যাগে আমাদের চিত্তকে কি আমরা সেভাবে প্রসারিত করতে পারি না?
তবে বিশ্বে এটি মধু পূর্ণিমা” নামে পরিচিত। এ দিনটি উপলক্ষে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিহারে (কিয়াং-এ) বুদ্ধ পূজা, পঞ্চশীল/অষ্টশীল গ্রহণ, সংঘদান, মধু ও ভেষজ দান, বাতি প্রজ্জ্বলন, ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডুদানসহ নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা
সম্পন্ন করে থাকে। এদিন বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকা ও আবালবৃদ্ধবণিতা মধু দিয়ে বুদ্ধপূজা করে এবং ভিক্ষুসংঘকে মধু দান করে। বিহারে সন্ধ্যায় বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ এইদিন বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধুদান করার জন্য উৎসবে মেতে উঠেন। বিহারে বা কিয়াং-এ দেখা যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মধুদানের এক আনন্দঘন পরিবেশ। মধু পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদের দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
মধু পূর্ণিমার শিক্ষা হলো- দান, সেবা ও একতা সমাজ জীবনে যেমন, তেমনি আরণ্যজীবনেও অপরিহার্য। ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। দান-সেবা শুধু মানুষের জীবনে নয়, মানবেতর প্রাণীর জীবনেও পরিবর্তন নিয়ে আছে। তাই সর্বদা মৈত্রী, করুণা ও ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক কল্যাণবোধের মানসিকতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করা উচিত। এতে সকলের কল্যাণ সাধিত হয়। মধু পূর্ণিমা আমাদের সবার জীবনে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক। আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক অপার মৈত্রী-করূণায় এবং দান, দয়া, সেবা আর অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
বুদ্ধ জীবনের নানা ঘটনা এবং দান, ত্যাগ ও সেবার নানা মহিমায় দিবসটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিক থেকে বেশ গুরুত্ব বহন করে।
সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক।
ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সকলের মঙ্গল লাভ হোক।
বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক।
বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক।
[লেখক: সভাপতি, তুরুক্কে লতা মেমোরিয়াল, বই’য়ো বাআ, রাঙ্গামাটি]
উজ্জ্বলেন্দু চাকমা
সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
ভাদ্র পূর্ণিমা বা মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যময় দিন। মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব। আমরা জানি, মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর মোট ৪৫ বছর বর্ষাবাব্রত পালন করেন অরণ্য, পর্বত, গুহা, বিহার ইত্যাদি নানা স্থানে।
মহাকারুণিক তথাগত বুদ্ধ যখন কোশাম্বী ঘোষিতারামে ভিক্ষু-সংঘসহ অবস্থান করছেন সে সময় বিনয়ধর পন্থী ভিক্ষু ও গ্রন্থধর পন্থী ভিক্ষুর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র বিনয় সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তাঁর শিষ্য মন্ডলীগণের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির কারণে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এ বিষয় নিয়ে উভয় পন্থী ভিক্ষুদের মধ্যে মতদ্বৈততা চরম আকার ধারণ করলে তথাগত বুদ্ধ তাদের বিবাদ সমাধান করার প্রচেষ্টা করেন। বুদ্ধ দেখলেন, তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে আত্মকলহে জড়িয়ে তাদের অনুসারীদের মধ্যে একটি বিভাজন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা সংঘ ও সদ্ধর্ম-শাসনের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। বৌদ্ধ পরিভাষায় একেই বলে সংঘভেদ”।
কিন্তু উভয় পক্ষ তাদের স্ব স্ব মতের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন; ফলে বিবাদ মীমাংসা করা সম্ভব না হওয়ায় বুদ্ধ কোশাম্বী ত্যাগ করে পারিলেয়্য নামক বনে গমন করেন এবং সেই বনের একটি ভদ্রশাল নামক বৃক্ষমূলের নীচে দশম বর্ষাবত অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি তিন মাস বর্ষবাস যাপন করেন, ধ্যান-সমাধি করেন। সে বনে ছিল নানা পশুপাখি ও জীবজন্তুর আবাস। বুদ্ধের অপরিমেয় মৈত্রী ও করুণার প্রভাবে বনের সেসব পশুপাখি ও জীবজন্তু তাদের হিংস্রতা পরিহার করে। পারিলেয়্য বনে বর্ষা যাপন কালে একটি একাচারী হাতি প্রতিদিন বুদ্ধের সেবা করত; বনের ফল সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করত।
এই পারিলেয়্য নামক হস্তীরাজও মনের দুঃখে সে একাই পথ ধরে এই বনে গমন করে। এ সময় বনের একটি বানর হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধকে সেবা করতে দেখে তার মনেও তথাগত বুদ্ধকে পূজা করার মনোবাসনা জাগে। ভাদ্র পূর্ণিমাতে সে একটি মৌচাক সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করেন। মৌচাকে মৌমাছির ছানা ও ডিম থাকায় বুদ্ধ প্রথমে মধু পান করলেন না। বানর সেটি বুঝতে পেরে মৌচাকটি নিয়ে ছানা ও ডিম পরিষ্কার করে পুনরায় বুদ্ধকে দান করলে এবার বুদ্ধ মধু পান করেন। মধুপান করতে দেখে বানর খুশিতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে এক বৃক্ষের মগডাল হতে অন্য মগডালে লাফাতে লাগল। হঠাৎ অসাবধানতাবশতঃ বৃক্ষের ডাল ভেঙ্গে বানর মাটিতে পড়ে গাছের গোড়ায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করল। বুদ্ধকে মধুদান এবং বুদ্ধের প্রতি প্রসন্নচিত্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর বানর তাবতিংস স্বর্গে ত্রিশ যোজন বিস্তৃত কনক বিমান ও সহস্র অপ্সরা লাভ করল। পারিলেয়্য বনে হস্তীরাজ কর্তৃক ভগবান বুদ্ধের সেবাপ্রাপ্তি ও বানরের
মধুদানের কারণে এ দিনটি বৌদ্ধদের কাছে এক অবিস্মরণীয় ও আনন্দ-উৎসবমুখর পুণ্যময় একটি দিন।
বুদ্ধের একাত্মতার নীতির সাথে সুর মিলিয়ে কবিগুরুও বলেছিলেন “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে....।”
বনের একটি তীর্যক প্রাণী বানর হয়ে বুদ্ধকে মধু দান দিয়ে যেখানে তার মহৎ উদারতা ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে, তৃপ্তি পেয়েছে এবং আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে, সেখানে আমরা মানুষ হয়েও আজ বিপন্ন মানুষের প্রতি সেই উদারতা, ত্যাগ ও দানের মহিমা দেখাতে পারছি না। আজ বিবেকের কাছে আমাদের প্রশ্ন- মানবতা, সেবা আর ত্যাগে আমাদের চিত্তকে কি আমরা সেভাবে প্রসারিত করতে পারি না?
তবে বিশ্বে এটি মধু পূর্ণিমা” নামে পরিচিত। এ দিনটি উপলক্ষে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিহারে (কিয়াং-এ) বুদ্ধ পূজা, পঞ্চশীল/অষ্টশীল গ্রহণ, সংঘদান, মধু ও ভেষজ দান, বাতি প্রজ্জ্বলন, ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডুদানসহ নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা
সম্পন্ন করে থাকে। এদিন বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকা ও আবালবৃদ্ধবণিতা মধু দিয়ে বুদ্ধপূজা করে এবং ভিক্ষুসংঘকে মধু দান করে। বিহারে সন্ধ্যায় বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ এইদিন বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধুদান করার জন্য উৎসবে মেতে উঠেন। বিহারে বা কিয়াং-এ দেখা যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মধুদানের এক আনন্দঘন পরিবেশ। মধু পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদের দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
মধু পূর্ণিমার শিক্ষা হলো- দান, সেবা ও একতা সমাজ জীবনে যেমন, তেমনি আরণ্যজীবনেও অপরিহার্য। ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। দান-সেবা শুধু মানুষের জীবনে নয়, মানবেতর প্রাণীর জীবনেও পরিবর্তন নিয়ে আছে। তাই সর্বদা মৈত্রী, করুণা ও ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক কল্যাণবোধের মানসিকতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করা উচিত। এতে সকলের কল্যাণ সাধিত হয়। মধু পূর্ণিমা আমাদের সবার জীবনে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক। আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক অপার মৈত্রী-করূণায় এবং দান, দয়া, সেবা আর অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
বুদ্ধ জীবনের নানা ঘটনা এবং দান, ত্যাগ ও সেবার নানা মহিমায় দিবসটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিক থেকে বেশ গুরুত্ব বহন করে।
সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক।
ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সকলের মঙ্গল লাভ হোক।
বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক।
বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক।
[লেখক: সভাপতি, তুরুক্কে লতা মেমোরিয়াল, বই’য়ো বাআ, রাঙ্গামাটি]