alt

মুক্ত আলোচনা

১৯৭১ : জোহরাতাজউদ্দীন ও বাঘাউরা ট্রাজেডি রহমান আতিক

: বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা পঞ্চাশ বছর পর এটি যে তরতাজা মাছের মত লাফাবেনা এটাই সত্য। সম্পত্তির দলিল এই ক্ষেত্রে সময় স্বাপেক্ষে তার কথা বদলায় না। তার যে কথা যে অঙ্গীকার সে যাতে কাগজের লিখিত তপছিল-চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে উল্টা পাল্টা বলতে না পারে তার জন্য আইনানুগ একটি স্বাধীনতাই তার জন্য সংরক্ষিত তা হচ্ছে সত্য কথা বলা।

ইতিহাস ও ঘটনা সমূহেরও দলিল আছে, লিখিত পরিমন্ডলের বাইরেও তার অস্তিত্ব আছে। সেই অস্তিত্বের রক্ষক বা বাহক হচ্ছে জনগণ ইলিয়ড, ওডেসি, রামায়ণ ও মহাভারতকে যদি সাহিত্য হিসেবেই স্বীকার করি একথা বলারও অবকাশ নেই কারণ তা বহুকাল ধরেই সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত। এসব সাহিত্যে মানব সভ্যতার এমন এক সময়কার উপাদান যা অতি প্রাকৃতিক ধ্যান ধারণা প্রসূত বিশ্বাসের ভিত্তিকেই পরম্পরায় মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত বহন করেছে যাকে আমরা জনশ্রুতি হিসেবে জানি। এই জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করেই গ্রীক কবি হোমার ইলিয়ড ও ওডিসিকে পান্ডুলিপির আওতায় আনেন। গ্রীক মহাকাব্য দুটি জনশ্রুতিকে ভিত্তি করে লিখা এবং গ্রীক কবি হোমারকে আমরা ্একজন পান্ডুলিপিকার হিসেবেই জানি। উল্লেখিত এবং উল্লেখের বাইরেও অনেক কাব্য, মহাকাব্য উপন্যাস আছে যেগুলো কোন না কোন সমকালের।

আমরা এগুলো পাঠ করে ঐসময়কার সমসাময়িক সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, রাজনৈতিক ব্যবস্থা অর্থাৎ কাঠামো ও অবকাঠামোগত দিকগুলো জানতে পারি। এখন মুক্তিযুদ্ধের সময় জোহরাতাজউদ্দীনের অপহরণের ঘটনা যদি না ঘটত তাইলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টা কতটা কঠিন ও দুর্গম ছিল তা যেমন জানা যেত না তেমনি মামলাটি এই ঘটনার দলিল। জোহরাতাজউদ্দীনের মৃত্যুর পর জনশ্রুতি থাকলেও তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি বর্ণনা করতেন কিংবা গল্প লিখতেন পাঠক তা সহজে গ্রহণ করত কিনা জানি না।

যেহেতু এই ঘটনাটি মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সাবেক মামলা নম্বর ৪৪৩-২০১৫খ্রীঃ, বর্তমানে ০৪-২০২১ খ্রীঃ এই নম্বরের মামলার বিবরণীতে এসেছে এখন তৃতীয় কেন চতুর্থ কোন ব্যক্তিও যদি গল্পটা নিয়ে কাজ করেন তাতে পাঠক মহলকে প্রথমে বিস্মিত করলেও ঘটনার ভেতরে ঢুকবার আগ্রহটি বরং বাড়াবেই। কারণ সরকারি সব সংস্থার চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ রিপোর্টের যাচাই বাছাইয়ের পরই মামলার বিবরণটা গ্রাহ্য হয়। মামলাটি ঐসব মহাকাব্যের কিংবা পৃথিবীর সব মহাকাব্যের আখ্যান যা অনেক অতিপ্রাকৃতিক ধারণা থেকে সৃষ্ট ঘটনাপুঞ্জগুলোর শিল্পভাষ্য সমগ্রবাস্তবতার একটি বৃত্ত তৈরি করে কিংবা বৃত্তটি তৈরি করাই শিল্পীর কাজ। পঞ্চাশ বছর পর ফেরত আসা সন্তানকেও মা’র না চেনার কথার মতোই হচ্ছে যুদ্ধের গল্পগুলোর পরিণাম।

উত্তর-একাত্তরের প্রচুর কবিতা আছে কিন্তু সেই অর্থে সামাজিক উপন্যাস না থাকার মতো অন্তত আমার কাছে মনে হচেছ। এই মনে হবার কারণ দৃষ্টিভঙ্গিগত। কোন উপন্যাস বা গল্প আমার জানবার বাইরে হয়ত আছে এবং থাকলেও সত্তর দশকের দুটি সামাজিক উপন্যাস শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ও আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘলবাড়ী’ উত্তর উপনিবেশ হিসেবে মৌলিক। সংশপ্তকের ক্যানভাস অনেক বড় এবং বহুমাত্রিক উপন্যাসের তপসিল চৌহদ্দি কালের পরিক্রমা সমাজ বিকাশের ধ্রুপদী বিবর্তনের চরিত্ররা স্থির চিত্রের মত এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকেনি।

কিন্তু সূর্যদীঘলবাড়ী একটি কালের বাস্তব প্রতিবেদন। একেবারে মাটির কলসির পানির মতো প্রাকৃতিক। নারায়ণগঞ্জগামী ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভীড়ের ভেতর থেকে একজন উৎসাহী নাগরিকের সংবাদপত্রের উচ্চ স্বরে পড়া একটি শিরোনাম পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংবাদটি কথার ক্যাচকেচিকে মাড়িয়ে জয়গুনের কানে আসে বসন্তের একটা ফুরফুরে বাতাসের মিহি ঝটকা। এই পর্যন্ত এবং তার বাড়ীর তাল গাছটার মত যতদিন পারে অনড় থেকেছে। হুরমতির কপালে গরম ছ্যাকা নিয়েও সে চঞ্চলা কিন্তুু জয়গুণের মতো না। তার সাহস জুগিয়েছে চরম দারিদ্রতা। ক্ষুধা তাকে শ্রমনির্ভর করেছে গোঁড়ামির কোন ফতুয়া তাকে আটকাতে পারেনি শ্রমের মাঠ থেকে। অন্যদিকে হুরমতি প্রকৃতির মতোই ছিল এক প্রকৃতি, নদীর মধ্যে এক নদীময় নদী ৪৭ এর পর তার নদীতেই জাগে চর।

কিন্তু ¯্রােতের তীব্রতা কিংবা ঊর্বষির হলুদ আভায় আমাবস্যাতেও পূর্ণিমা জাগানোর জয়গুণও সূর্যদীঘলবাড়ীর অনড় তালগাছটির মত অনড় থাকে যতক্ষণনা বাড়ীটি একটি ভৌতিক বাড়ীতে পরিণত না হয়। রমজানের মত গদুপ্রধানও পুরুষ হয়ে উঠে মিয়া বাড়ীর জোরে। মিয়া বদলায় বাড়ী বদলায় না। ৪৭ এর পর বাড়ীটা ঠিক থেকে মিয়ার বদলে কাজী হল, ভাবনার এই মৌলিক জায়গায় পাঠককে এখানে ভাবায়। গদুপ্রধান নদীর জলের সাধারণ মাছ। সব নদীতেই থাকে কিন্তু কানপোনা না।

সার্বজনীন শক্তির একক কিন্তু রমজানের মতোই পুরুষ। তার পৌরষত্বের জোর গোঁড়ামি সমাজ। হুরমতির উপনিবেশিক কালের নতুন সংস্করণ উত্তর উপনিবেশের জয়গুন। জয়গুনের সময় গোঁড়া সমাজ নদীর নতুন ¯্রােত না ফেলুমিয়ার প্রভাবের কালের স্মারক ¯্রােত যার পৃষ্ঠােপাষক রাষ্ট্র। সূর্যদীঘলবাড়ীটার ঐ অনড় তালগাছটার জন্য এই পৃষ্ঠপোষকতা তার একাকীকত্ব আরোও বাড়িয়ে দিলো এবং যতটুকু সময় নিল সূর্যদীঘলবাড়ীটি একটি ভৌতিক বাড়ীতে পরিণত হতে ততক্ষণ জয়গুন ভাসমান হল এই মুহূর্তেই ৬৬র ছয়দফা ঘোষণা হয় কিংবা আরো কিছু জয়গুণ আরো কিছু সময় যখন মুখোমুখি হল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত সময়কাল এসে দাঁড়ায় ২০ বছর, আর ৬৬ থেকে ৭১ এই পাঁচ বছর ধরলে মোট ২৪ বছরে ঐ গোঁড়ামি সমাজের কোমড়কে পরিণতই ভাবতে হবে। শক্ত ও সোজা।

উপন্যাসগুলোর শিল্পভাষ্যের রাজনৈতিক বা সমাজতত্ত্বীয় অনুবাদটি দাঁড়ায় আর্থিক কারণেও সংঘটিত সামাজিক পরিবর্তনের কারণে পূর্ব সমাজের অনেক উচ্ছিষ্ট পরবর্তি সমাজ ব্যবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় বা পূর্ব নীপিড়নের বর্তমান উপস্থিতি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গীর ধ্রুপদী চিন্তার প্রতিফলন বাস্তবে দৃশ্যমান হতে দেখেছি ।অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা পূঁজিবাদী ছিল বলেই ৪৭র পর মুসলমান মুসলমানকে শোষণ করতে খৃস্টান বা ইংরেজ হতে হয় নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার তদানীন্তন রোডেশিয়াতে বৃটিশ সাদা খৃস্টান বড় খামার মালিক দুর্বল খামার মালিকের খামার কিভাবে দখল করেছে তৃণদেরগীতিতে’ বৃটিশ ঔপন্যাসিক লেসিং সুন্দরভাবে সা¤্রাজ্য বিস্তারের ঘটনা প্রবাহকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। উত্তর উপনিবেশ উপন্যাস আলোচনায় এখানে যে সব বিষয় এসেছে হয়ত আরো বিস্তৃতভাবে আসবে অন্য জায়গায়। এইজন্য পূর্ববর্তী প্রত্যয়গুলো উত্তরউপনিবেশ উপন্যাসগুলোর হাত ধরে আলোচ্য আলোচনাগুলি এসেছে অন্য একটি হাত ধরার জন্য অপ্রসঙ্গকে প্রাসঙ্গিক করবার জন্যে এবং স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি ঘটনার ফিল্ডওয়ার্কে নেমে দেখা বাস্তবতায় দেখতে পাচ্ছি অন্যরকম বাস্তবতা, সামাজিক মনস্তত্ত্বে দেখা যায় জনগণের উদাসীনতা, ভয়, এড়িয়ে যাওয়া এই জন্য। এতে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র ৭১ এর সময় জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির রাস্তা ধরে চলছে না।

শুধু প্রতিক্রীয়াশীল চক্রের জুজুর ভয়ে আর কত দিনপাত হবে এটি রাজনীতিবিদদের জন্য প্রশ্নটি রাখলাম এই কারণে যে জোহরাতাজউদ্দীন অপহরণের গল্পটি সম্পর্কে আগ্রহ, মুখ খুলতে না চাওয়া এ কিসের আলামত ? নাকি এই পরিবারটি দায়ী নাকি এভাবে মূলায়ন করব রণাঙ্গনের সৈনিকরা জনপদের যোদ্ধারা সমর্থকরা ঐ লড়াইকে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নভঙ্গের পর জেগে উঠা বাস্তবতা তাদেরকে বিদ্রুপ করেছে। এখন দেখছি পুরো জাতির দুর্বল নাগরিকরা যুদ্ধ করছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই বুড়ো জেলেটার মত। হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অন দ্যাসীকে কেউ কেউ একক বিদ্রোহ বলে থাকেন যখন মাঝ সমুদ্রে মাছটাকে অসংখ্য হাঙ্গর খাবলে খুবলে খেতে আসছে, দাঁত বসাচ্ছে যার মাঝখানে সেন্টিয়াগো বর্শা দিয়ে প্রতিরোধ করছে।

শেষ পর্যন্ত মাংসহীন একটা বড় আকৃতির কংকাল নিয়েই ফেরা হল। চুরাশি দিনের সংগ্রামের ফসল কংকাল হল এটি শ্রমজীবী মানুষদের জন্য একটি বার্তা। নয় মাস ধরে যুদ্ধ করে আমরা কোন কংকাল পাইনি তবে সমুদ্রের ঐ হাঙ্গর গুলো পেয়েছি অগণিত, হাজারে হাজারে। এই হাঙ্গরগুলো জাতির যুগপথ অর্জন গুলোকে খাবলে খুবলে খাচ্ছে এই অশনি সংকেতের ভেতর দিয়েই আমি একটি গল্প বলছি- যে গল্পের ভেতর এই দেশের গণপ্রতিরোধের প্রতিরোধযোদ্ধাদের মুখ কতটা বিমর্ষ মলিন মুখ কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না অন্তরের মুখ অন্তরেই থাকে। কারণ এরা সক্রিয় ছিল বলেই মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনআহমদ সহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কি কি ব্রজপাতের কান ধাঁধাঁনো শব্দে শিউরে উঠা ঘটনার পর ঘটনা পার করে একটি মানচিত্রের পরিণত জায়গাটিতে আসতে পারছিলেন। এটি জাতীয় ও প্রান্তিক জনগণের ঘটে যাওয়া ঘটনা যার সবগুলো যোগ করলেই হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের অখন্ড ইতিহাস।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাতে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঐ রাতেই আমজনতার উপর নির্বিচারে গুলি করে চালান হয় গণহত্যা । এরপর থেকেই দৃশ্যপট বদলে যায়। জাতি একটি যুদ্ধের মুখোমুখি যে হতে যাচ্ছে এই আন্দাজে অনেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যেতে থাকে প্রাণে বাচঁবার জন্য। একটি কঠিন সময় পার করার ঠিক কতগুলো মুহূর্ত যোগ হবে এই ভবিষ্যৎ অংকটি করা তখন কারো জন্যই সহজ ছিলনা যারা স্বাধীনতার জন্য প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে চাইল। একে একে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত সামরিক, বেসামরিক, পুলিশ সহ সরকারের সব বিভাগ থেকে বিদ্রোহের সূচনাহতে শুরু করল।

৭ই মার্চের ভাষণে এইরকম প্রতিরোধ বিদ্রোহের ইঙ্গিত ছিল। এই সব বিদ্রোহ সাধারণ জনগনের মধ্যে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে যার প্রেক্ষিতে পুরো জাতি আস্তে আস্তে একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করল। ২৫শে মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল মাত্র ২৪ দিনের ব্যবধানে একটি সরকার গঠন করা স্বাধীনতাকামী যেকোনো জাতির জন্যই স্বাপ্নিক অর্জন। কিংবা যে কোন রাষ্ট্রের জন্যই, কারণ শুধু জাতি বললে বাঙ্গালীকেই বোঝায় যার ফলে অন্যান্য জাতিস্বত্তা যারা এই প্রতিরোধ সংগ্রাম বা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিল তাদের অবদান বাদ যারার আশংকা থাকে। এই সুখ স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন করার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীরা এই স্বপ্নের পেছনে কম দৌড়াননি। এবং এই কারণেই তারা মুজিবনগর সরকারের নির্মাতাদের প্রতি ছিল ভীষণ ক্ষুব্ধ। তাদের চেত কেন্দ্র থেকে তরাঙ্গায়িত হতে হতে প্রত্যন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে যতটুকু মানচিত্র ততটুকুতেই। এর পরেও আঘাতের লক্ষ্য থাকে ভর কেন্দ্রের দিকেই বেশি। এই মেরুকরণে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ সহ দেশের সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে প্রান্তিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের মধ্য থেকে যারা বিদ্রোহ করেছিল সবার প্রতি সবার পরিবার পরিজনদের প্রতি একটি সামরিক নজরের ভেতরে ছিল গতিবিধি লক্ষ রাখতে।

অন্যদিকে জাতি যতই সংগঠিত হতে শুরু করল শাসক গোষ্ঠী ততই চাপ সৃষ্টি করতে লাগল। রণাঙ্গনের বাইরে এই চাপ মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক। পোকার গর্তে প্রবল বেগে পানি ঢালতে ঢালতে ছোট বেলায় হাততালি দিতাম যখন পোকাটি আধমরা হয়ে সিঁধকাটা চোরের মত প্রথমে মাথা, তারপর ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বেরিয়ে আসত। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার গঠন হয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীনআহমদ।তিনি একটি কঠিন সময়ের নেতৃত্ব দেন এবং তার নেতৃত্বের মাধ্যমে দৃশ্যমান থাকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব।

একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গণ ও সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একে অপরের পরিপূরক। এই ক্ষেত্রে আমরা জানি রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক হন কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানী। ইতিহাস লিখা এখানে উদ্দেশ্য নয় তবুও ইতিহাসের অঙ্গহানিকে প্রশ্রয় দেয়া উচিৎ না। প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সরকার গঠনের এক মাসের মাথায় ১৯৭১ সালের ১৬ই মে জোহরা তাজউদ্দীন ও তার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে ভারত পারি দিবার জন্য ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগর থানার কনিকাড়া গ্রামের প্রবেশ মুখে আসেন। তখনই স্থানীয় রাজাকার বাহিনী তাদেরকে অপহরণ করে নবীনগর থানায় কিংবা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্য । এই অপহরণটা কি পূর্বের উপমার সাথে মিল খায়না?

এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে তাজউদ্দীন পরিবারের উপর একটা প্রচন্ড চাপ ছিল। ঐ গর্তের পোকার মতো তারা বেরিয়ে পরলেন ভারত পারি দিতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর মধ্যে তদানীন্তন কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা ছিল অন্যতম সুবিধাজনক ভৌগলিক এলাকা। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমার সদর, আখাউড়া ও কসবা থানা ছিল ভারত সীমান্তবর্তী এবং ঢাকা ও আশপাশ জেলার শরণার্থীরা বিভিন্ন পথ দিয়ে প্রথমে আসতেন নবীনগর থানায়। নবীনগর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সদর ও কসবার প্রতিবেশি থানা। আবার এই থানাটি বিল ও নদী বেষ্টিত যার ভৌগলিক চরিত্র নিয়ে নবীনগরের তিতাস বিভাজিত আগের পাঁচটি বর্তমানের ছয়টি ইউনিয়নের প্রবেশ মুখ হচ্ছে কনিকাড়া গ্রাম। তিতাস ও বুড়ি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই গ্রামটির মধ্যদিয়েই বুড়ি নদীটি কসবা থানার কুটি-চৌমূহনীর ক্ষুদ্র নৌ বাণিজ্য কেন্দ্র পর্যন্ত লোক যাতায়াত ছিল।

এখন নাই। এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে কসবা, আখাউড়া খুব একটা দূরে নয় এই পথ পরিক্রমাতেই পথ চলছিল জোহরা তাজউদ্দীন তার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে এবং নবীনগর থানার শিবপুর ইউনিয়নের কনিকাড়া গ্রামের প্রবেশ মুখে যখন আসেন তখনই নবীনগরের রাজাকাররা তাদেরকে অপহরণ করে। বুড়ি নদীর পশ্চিম তীরের জল্লা গ্রাম থেকে যখন খেয়া পাড়ি দিচ্ছিলেন যার মাঝি ছিল শীতল মাঝি। রাজাকারদের সাথে জোহরা তাজউদ্দীনের কথা কাটাকাটির মাঝ দিয়ে শীতল মাঝি জানতে পারেন এরা সাধারণ কোনো পরিবার নয় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পরিবার। যারা বড় বিপদটাও তাদের বড়। এটা শীতল মাঝি বুঝতে পেরে খবরটি গোপনে পৌঁছে দেন কয়েকজন পরিচিত জনের কাছে। খবরটি বাতাসের সাথে মিশলো।

বিকেলের আয়ু যতই ফুরাচ্ছে এর বিপরীতবেগেই খবরটি জিয়ল হয়ে চুতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল কনিকাড়ার পাশের গ্রাম বাঘাউরার হাজী সোনালী ভূইয়ার বৈঠক ঘর থেকে আশপাশ গ্রামগুলোতে। মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল মামলার মামলা নম্বর ৪৪৩-২০১৫খ্রি: তে এই অপহরণের কথাটি বিবরণীতে উল্লেখ আছে কিন্তু গল্পটি নাই। আমি গল্পটি বলার চেষ্টা করছি। পাকিস্তানী আর্মি গোয়েন্দা সংস্থা তারা যে এদিকে এই পথে আসতেছেন এই খবরটি নিশ্চিত হয়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেনা ক্যাম্প ও নবীনগরের স্থানীয় রাজাকারদের কাছে একটি নির্দেশ আসে যাতে এদেরকে অপহরণ করে নবীনগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এটা পাকিস্তান সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। সোনালী ভূইঁয়ার পরিবারসহ আশপাশ এলাকার নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী পরিবার গুলো এই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। জোহরা তাজউদ্দীন পরিবার উদ্ধারের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, জনগণ জমির মাটির মতো ঘুমন্ত থাকে যাকে লাঙ্গলের ফলায় আবাদ যোগ্য করতে হয়। ইতিহাসে জনগণের ভুমিকার স্বীকৃতিটা আমরা দিতে শিখিনি যদিও নেতৃত্বের মাধ্যমে তারা জেগে উঠেন। তারা সঠিক সময়ে জেগেছেন বলেই রাজাকারদের অপহরণ হয়ে যাওয়া জোহরা তাজউদ্দীন ও তার ছেলেমেয়েদেরকে রাজাকারদের পক্ষে নবীনগর থানায় নিয়ে যেতে পারেনি।

একটি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা থেকেই জাতি মুক্তি পেল। ঐদিন রাতে কনিকাড়ার একটি বাড়িতে পাহারায় রেখে পরদিন ১৭ই মে ভোরে বুড়ি নদী দিয়ে কসবা থানার কুটি চৌমুহনির নৌবাণিজ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হল। ‘একটি বাড়িতে পাহারায়’ কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর এই বাড়ির লোকজন এই পরিবারকে রাতে আশ্রয়ের কথা আজানা আতঙ্কে পাশ কেটে যায়। যাই হোক কুটি থেকে বিভিন্ন পথে কসবা পৌঁছে কসবার ওপারে আগরতলার বিশাল ঘর ক্যাম্পে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। তাজউদ্দীন পরিবারের পরিচয় পেয়ে তাৎক্ষণিক বি,এস,এফ ক্যাম্প থেকে ফোনে আগরতলা থানায় ফোন করলে তারা জিপ গাড়ি করে তাদেরকে নিয়ে যান।

১৭ই মে যখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জানতে পারল জোহরা তাজউদ্দীন স্ব-পরিবারে ভারতে পৌঁছতে পেরেছেন তাদের ফেল মারা এই অভিযান তাদেরকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে এবং করাটাই স্বাভাবিক। ১৮ই মে থেকে ২০ শে মে ১৯৭১ ধোপাকান্দাসহ, বাঘাউরা, কনিকাড়াসমূহ নিকটবর্তী কয়েকটি এলাকার উপর তাদের রক্তজবা চোখের রক্ত আগুনে ঝলসে উঠে। জনগণ প্রতিরোধ নেতৃত্বের মৌলিক শক্তির যোগানদাতা হলেও সরাসরি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে তাদেরকে পড়তে হয়না। যারা এদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছিল ঐসব ব্যক্তি ও পরিবারই শরীর হয়ে যায় শত্রুর হুল ফুটাবার জন্য। ১৮ তারিখ থেকে লুটতরাজ অগ্নি সংযোগ করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২০শে মে বাঘাউড়ায় এসে শেষ হয়। কয়েকটি বাড়ী ঘর লুটপাট অগ্নি সংযোগ করে বিভৎসতার প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় পরিণত করে হল বাঘাউরার সোনালী ভূইঁয়ার বাড়ী, নবীনগর থানার রাজাকার ও পাকিস্তান আর্মি বাড়িটিকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ীর ভিতর অগ্রসর হয়।

১৬ই মে-এর ঘটনার পর আশপাশ এলাকার মানুষদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পরাটাই স্বাভাবিক এবং এর কালো ছায়া থেকেই এই বাড়ীটি মুক্ত থাকে কী করে! প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে সোনালী ভূইঁয়া হচ্ছেন নবীনগরের সর্বমহলে পরিচিত একজন সামাজিক মানুষ।৪৭এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘুদের পক্ষে তাঁর ভ’মিকা ছিল রক্ষাকবজের মত।বিত্তশালী হলেও তার রুচি ছিল অন্যমাত্রার।এক রকম বাড়িটি ছিল সাধারণ মানষুদের আকৃষ্ট করত যা আয়তনে একটি খামার বাড়ীর মত। পুকুরের দুই পাশে দুইটি পাকা ঘাট। অন্দর মহলের ঘাটে মেয়েদের পর্দার জন্য মেয়েরা যে ঘাট ব্যবহার করত ওটার এক পাশে দেয়াল দেয়া ছিল। আর ছিল দুটো সেনিটেশন বাথরুম তখনকার দিনে শহরেই এই স্বাস্থ্যকর অবকাঠামো ছিলনা। ৬ টি বড় বড় কাঠ কোয়ারির পাকাভিটির ঘর, বৈঠক ঘর, শস্য ও পাটের গুদাম ঘর, বিরাটাকারের গোয়াল ঘর এসব অবকাঠামোর মধ্যে শুধু দুটো পাকা ঘাট ও দুটি সেনিটারি বাথরুম ছাড়া এই বাড়ির নৃশংসতার স্বাক্ষী দেবার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

সব পুড়ে ছারখার রক্তজবার মতো আগুনের ঔদ্ধত্য ছাইগুলো উড়ছে। মুহূর্তে বসন্তের আকাশ হল বৈশাখের। ব্রাশফায়ারে উঠানেই লুটিয়ে পড়া মৃতদেহের মধ্যে সোনালী ভূইয়ার ৫ম ছেলে আব্দুল লতিফ ভূইঁয়া, ৩য় ছেলে আব্দুল গণি ভূইঁয়ার স্ত্রী আফিয়া খাতুন ও বাৎসরিক দিনমজুর পাশের বাড়ির বোবা যুবকটি । লুটপাট হল লুটতরাজ যোগ্য সবকিছু। জোহরা তাজউদ্দীনের গন্তব্যের গাড়ি তখন ভারতের ভেতর দিয়ে যত দ্রুত দৌড়াচ্ছিল বাঘাউড়া ট্রাজিডিটা ততটা গুরুত্ব ও দ্রুততার সাথেই শেষ হল।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

১৯৭১ : জোহরাতাজউদ্দীন ও বাঘাউরা ট্রাজেডি রহমান আতিক

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা পঞ্চাশ বছর পর এটি যে তরতাজা মাছের মত লাফাবেনা এটাই সত্য। সম্পত্তির দলিল এই ক্ষেত্রে সময় স্বাপেক্ষে তার কথা বদলায় না। তার যে কথা যে অঙ্গীকার সে যাতে কাগজের লিখিত তপছিল-চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে উল্টা পাল্টা বলতে না পারে তার জন্য আইনানুগ একটি স্বাধীনতাই তার জন্য সংরক্ষিত তা হচ্ছে সত্য কথা বলা।

ইতিহাস ও ঘটনা সমূহেরও দলিল আছে, লিখিত পরিমন্ডলের বাইরেও তার অস্তিত্ব আছে। সেই অস্তিত্বের রক্ষক বা বাহক হচ্ছে জনগণ ইলিয়ড, ওডেসি, রামায়ণ ও মহাভারতকে যদি সাহিত্য হিসেবেই স্বীকার করি একথা বলারও অবকাশ নেই কারণ তা বহুকাল ধরেই সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত। এসব সাহিত্যে মানব সভ্যতার এমন এক সময়কার উপাদান যা অতি প্রাকৃতিক ধ্যান ধারণা প্রসূত বিশ্বাসের ভিত্তিকেই পরম্পরায় মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত বহন করেছে যাকে আমরা জনশ্রুতি হিসেবে জানি। এই জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করেই গ্রীক কবি হোমার ইলিয়ড ও ওডিসিকে পান্ডুলিপির আওতায় আনেন। গ্রীক মহাকাব্য দুটি জনশ্রুতিকে ভিত্তি করে লিখা এবং গ্রীক কবি হোমারকে আমরা ্একজন পান্ডুলিপিকার হিসেবেই জানি। উল্লেখিত এবং উল্লেখের বাইরেও অনেক কাব্য, মহাকাব্য উপন্যাস আছে যেগুলো কোন না কোন সমকালের।

আমরা এগুলো পাঠ করে ঐসময়কার সমসাময়িক সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, রাজনৈতিক ব্যবস্থা অর্থাৎ কাঠামো ও অবকাঠামোগত দিকগুলো জানতে পারি। এখন মুক্তিযুদ্ধের সময় জোহরাতাজউদ্দীনের অপহরণের ঘটনা যদি না ঘটত তাইলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টা কতটা কঠিন ও দুর্গম ছিল তা যেমন জানা যেত না তেমনি মামলাটি এই ঘটনার দলিল। জোহরাতাজউদ্দীনের মৃত্যুর পর জনশ্রুতি থাকলেও তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি বর্ণনা করতেন কিংবা গল্প লিখতেন পাঠক তা সহজে গ্রহণ করত কিনা জানি না।

যেহেতু এই ঘটনাটি মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সাবেক মামলা নম্বর ৪৪৩-২০১৫খ্রীঃ, বর্তমানে ০৪-২০২১ খ্রীঃ এই নম্বরের মামলার বিবরণীতে এসেছে এখন তৃতীয় কেন চতুর্থ কোন ব্যক্তিও যদি গল্পটা নিয়ে কাজ করেন তাতে পাঠক মহলকে প্রথমে বিস্মিত করলেও ঘটনার ভেতরে ঢুকবার আগ্রহটি বরং বাড়াবেই। কারণ সরকারি সব সংস্থার চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ রিপোর্টের যাচাই বাছাইয়ের পরই মামলার বিবরণটা গ্রাহ্য হয়। মামলাটি ঐসব মহাকাব্যের কিংবা পৃথিবীর সব মহাকাব্যের আখ্যান যা অনেক অতিপ্রাকৃতিক ধারণা থেকে সৃষ্ট ঘটনাপুঞ্জগুলোর শিল্পভাষ্য সমগ্রবাস্তবতার একটি বৃত্ত তৈরি করে কিংবা বৃত্তটি তৈরি করাই শিল্পীর কাজ। পঞ্চাশ বছর পর ফেরত আসা সন্তানকেও মা’র না চেনার কথার মতোই হচ্ছে যুদ্ধের গল্পগুলোর পরিণাম।

উত্তর-একাত্তরের প্রচুর কবিতা আছে কিন্তু সেই অর্থে সামাজিক উপন্যাস না থাকার মতো অন্তত আমার কাছে মনে হচেছ। এই মনে হবার কারণ দৃষ্টিভঙ্গিগত। কোন উপন্যাস বা গল্প আমার জানবার বাইরে হয়ত আছে এবং থাকলেও সত্তর দশকের দুটি সামাজিক উপন্যাস শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ও আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘলবাড়ী’ উত্তর উপনিবেশ হিসেবে মৌলিক। সংশপ্তকের ক্যানভাস অনেক বড় এবং বহুমাত্রিক উপন্যাসের তপসিল চৌহদ্দি কালের পরিক্রমা সমাজ বিকাশের ধ্রুপদী বিবর্তনের চরিত্ররা স্থির চিত্রের মত এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকেনি।

কিন্তু সূর্যদীঘলবাড়ী একটি কালের বাস্তব প্রতিবেদন। একেবারে মাটির কলসির পানির মতো প্রাকৃতিক। নারায়ণগঞ্জগামী ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভীড়ের ভেতর থেকে একজন উৎসাহী নাগরিকের সংবাদপত্রের উচ্চ স্বরে পড়া একটি শিরোনাম পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংবাদটি কথার ক্যাচকেচিকে মাড়িয়ে জয়গুনের কানে আসে বসন্তের একটা ফুরফুরে বাতাসের মিহি ঝটকা। এই পর্যন্ত এবং তার বাড়ীর তাল গাছটার মত যতদিন পারে অনড় থেকেছে। হুরমতির কপালে গরম ছ্যাকা নিয়েও সে চঞ্চলা কিন্তুু জয়গুণের মতো না। তার সাহস জুগিয়েছে চরম দারিদ্রতা। ক্ষুধা তাকে শ্রমনির্ভর করেছে গোঁড়ামির কোন ফতুয়া তাকে আটকাতে পারেনি শ্রমের মাঠ থেকে। অন্যদিকে হুরমতি প্রকৃতির মতোই ছিল এক প্রকৃতি, নদীর মধ্যে এক নদীময় নদী ৪৭ এর পর তার নদীতেই জাগে চর।

কিন্তু ¯্রােতের তীব্রতা কিংবা ঊর্বষির হলুদ আভায় আমাবস্যাতেও পূর্ণিমা জাগানোর জয়গুণও সূর্যদীঘলবাড়ীর অনড় তালগাছটির মত অনড় থাকে যতক্ষণনা বাড়ীটি একটি ভৌতিক বাড়ীতে পরিণত না হয়। রমজানের মত গদুপ্রধানও পুরুষ হয়ে উঠে মিয়া বাড়ীর জোরে। মিয়া বদলায় বাড়ী বদলায় না। ৪৭ এর পর বাড়ীটা ঠিক থেকে মিয়ার বদলে কাজী হল, ভাবনার এই মৌলিক জায়গায় পাঠককে এখানে ভাবায়। গদুপ্রধান নদীর জলের সাধারণ মাছ। সব নদীতেই থাকে কিন্তু কানপোনা না।

সার্বজনীন শক্তির একক কিন্তু রমজানের মতোই পুরুষ। তার পৌরষত্বের জোর গোঁড়ামি সমাজ। হুরমতির উপনিবেশিক কালের নতুন সংস্করণ উত্তর উপনিবেশের জয়গুন। জয়গুনের সময় গোঁড়া সমাজ নদীর নতুন ¯্রােত না ফেলুমিয়ার প্রভাবের কালের স্মারক ¯্রােত যার পৃষ্ঠােপাষক রাষ্ট্র। সূর্যদীঘলবাড়ীটার ঐ অনড় তালগাছটার জন্য এই পৃষ্ঠপোষকতা তার একাকীকত্ব আরোও বাড়িয়ে দিলো এবং যতটুকু সময় নিল সূর্যদীঘলবাড়ীটি একটি ভৌতিক বাড়ীতে পরিণত হতে ততক্ষণ জয়গুন ভাসমান হল এই মুহূর্তেই ৬৬র ছয়দফা ঘোষণা হয় কিংবা আরো কিছু জয়গুণ আরো কিছু সময় যখন মুখোমুখি হল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত সময়কাল এসে দাঁড়ায় ২০ বছর, আর ৬৬ থেকে ৭১ এই পাঁচ বছর ধরলে মোট ২৪ বছরে ঐ গোঁড়ামি সমাজের কোমড়কে পরিণতই ভাবতে হবে। শক্ত ও সোজা।

উপন্যাসগুলোর শিল্পভাষ্যের রাজনৈতিক বা সমাজতত্ত্বীয় অনুবাদটি দাঁড়ায় আর্থিক কারণেও সংঘটিত সামাজিক পরিবর্তনের কারণে পূর্ব সমাজের অনেক উচ্ছিষ্ট পরবর্তি সমাজ ব্যবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় বা পূর্ব নীপিড়নের বর্তমান উপস্থিতি মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গীর ধ্রুপদী চিন্তার প্রতিফলন বাস্তবে দৃশ্যমান হতে দেখেছি ।অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা পূঁজিবাদী ছিল বলেই ৪৭র পর মুসলমান মুসলমানকে শোষণ করতে খৃস্টান বা ইংরেজ হতে হয় নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার তদানীন্তন রোডেশিয়াতে বৃটিশ সাদা খৃস্টান বড় খামার মালিক দুর্বল খামার মালিকের খামার কিভাবে দখল করেছে তৃণদেরগীতিতে’ বৃটিশ ঔপন্যাসিক লেসিং সুন্দরভাবে সা¤্রাজ্য বিস্তারের ঘটনা প্রবাহকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। উত্তর উপনিবেশ উপন্যাস আলোচনায় এখানে যে সব বিষয় এসেছে হয়ত আরো বিস্তৃতভাবে আসবে অন্য জায়গায়। এইজন্য পূর্ববর্তী প্রত্যয়গুলো উত্তরউপনিবেশ উপন্যাসগুলোর হাত ধরে আলোচ্য আলোচনাগুলি এসেছে অন্য একটি হাত ধরার জন্য অপ্রসঙ্গকে প্রাসঙ্গিক করবার জন্যে এবং স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি ঘটনার ফিল্ডওয়ার্কে নেমে দেখা বাস্তবতায় দেখতে পাচ্ছি অন্যরকম বাস্তবতা, সামাজিক মনস্তত্ত্বে দেখা যায় জনগণের উদাসীনতা, ভয়, এড়িয়ে যাওয়া এই জন্য। এতে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্র ৭১ এর সময় জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির রাস্তা ধরে চলছে না।

শুধু প্রতিক্রীয়াশীল চক্রের জুজুর ভয়ে আর কত দিনপাত হবে এটি রাজনীতিবিদদের জন্য প্রশ্নটি রাখলাম এই কারণে যে জোহরাতাজউদ্দীন অপহরণের গল্পটি সম্পর্কে আগ্রহ, মুখ খুলতে না চাওয়া এ কিসের আলামত ? নাকি এই পরিবারটি দায়ী নাকি এভাবে মূলায়ন করব রণাঙ্গনের সৈনিকরা জনপদের যোদ্ধারা সমর্থকরা ঐ লড়াইকে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নভঙ্গের পর জেগে উঠা বাস্তবতা তাদেরকে বিদ্রুপ করেছে। এখন দেখছি পুরো জাতির দুর্বল নাগরিকরা যুদ্ধ করছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই বুড়ো জেলেটার মত। হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অন দ্যাসীকে কেউ কেউ একক বিদ্রোহ বলে থাকেন যখন মাঝ সমুদ্রে মাছটাকে অসংখ্য হাঙ্গর খাবলে খুবলে খেতে আসছে, দাঁত বসাচ্ছে যার মাঝখানে সেন্টিয়াগো বর্শা দিয়ে প্রতিরোধ করছে।

শেষ পর্যন্ত মাংসহীন একটা বড় আকৃতির কংকাল নিয়েই ফেরা হল। চুরাশি দিনের সংগ্রামের ফসল কংকাল হল এটি শ্রমজীবী মানুষদের জন্য একটি বার্তা। নয় মাস ধরে যুদ্ধ করে আমরা কোন কংকাল পাইনি তবে সমুদ্রের ঐ হাঙ্গর গুলো পেয়েছি অগণিত, হাজারে হাজারে। এই হাঙ্গরগুলো জাতির যুগপথ অর্জন গুলোকে খাবলে খুবলে খাচ্ছে এই অশনি সংকেতের ভেতর দিয়েই আমি একটি গল্প বলছি- যে গল্পের ভেতর এই দেশের গণপ্রতিরোধের প্রতিরোধযোদ্ধাদের মুখ কতটা বিমর্ষ মলিন মুখ কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না অন্তরের মুখ অন্তরেই থাকে। কারণ এরা সক্রিয় ছিল বলেই মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনআহমদ সহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কি কি ব্রজপাতের কান ধাঁধাঁনো শব্দে শিউরে উঠা ঘটনার পর ঘটনা পার করে একটি মানচিত্রের পরিণত জায়গাটিতে আসতে পারছিলেন। এটি জাতীয় ও প্রান্তিক জনগণের ঘটে যাওয়া ঘটনা যার সবগুলো যোগ করলেই হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের অখন্ড ইতিহাস।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাতে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঐ রাতেই আমজনতার উপর নির্বিচারে গুলি করে চালান হয় গণহত্যা । এরপর থেকেই দৃশ্যপট বদলে যায়। জাতি একটি যুদ্ধের মুখোমুখি যে হতে যাচ্ছে এই আন্দাজে অনেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যেতে থাকে প্রাণে বাচঁবার জন্য। একটি কঠিন সময় পার করার ঠিক কতগুলো মুহূর্ত যোগ হবে এই ভবিষ্যৎ অংকটি করা তখন কারো জন্যই সহজ ছিলনা যারা স্বাধীনতার জন্য প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে চাইল। একে একে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত সামরিক, বেসামরিক, পুলিশ সহ সরকারের সব বিভাগ থেকে বিদ্রোহের সূচনাহতে শুরু করল।

৭ই মার্চের ভাষণে এইরকম প্রতিরোধ বিদ্রোহের ইঙ্গিত ছিল। এই সব বিদ্রোহ সাধারণ জনগনের মধ্যে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে যার প্রেক্ষিতে পুরো জাতি আস্তে আস্তে একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করল। ২৫শে মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল মাত্র ২৪ দিনের ব্যবধানে একটি সরকার গঠন করা স্বাধীনতাকামী যেকোনো জাতির জন্যই স্বাপ্নিক অর্জন। কিংবা যে কোন রাষ্ট্রের জন্যই, কারণ শুধু জাতি বললে বাঙ্গালীকেই বোঝায় যার ফলে অন্যান্য জাতিস্বত্তা যারা এই প্রতিরোধ সংগ্রাম বা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিল তাদের অবদান বাদ যারার আশংকা থাকে। এই সুখ স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন করার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীরা এই স্বপ্নের পেছনে কম দৌড়াননি। এবং এই কারণেই তারা মুজিবনগর সরকারের নির্মাতাদের প্রতি ছিল ভীষণ ক্ষুব্ধ। তাদের চেত কেন্দ্র থেকে তরাঙ্গায়িত হতে হতে প্রত্যন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে যতটুকু মানচিত্র ততটুকুতেই। এর পরেও আঘাতের লক্ষ্য থাকে ভর কেন্দ্রের দিকেই বেশি। এই মেরুকরণে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ সহ দেশের সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে প্রান্তিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের মধ্য থেকে যারা বিদ্রোহ করেছিল সবার প্রতি সবার পরিবার পরিজনদের প্রতি একটি সামরিক নজরের ভেতরে ছিল গতিবিধি লক্ষ রাখতে।

অন্যদিকে জাতি যতই সংগঠিত হতে শুরু করল শাসক গোষ্ঠী ততই চাপ সৃষ্টি করতে লাগল। রণাঙ্গনের বাইরে এই চাপ মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক। পোকার গর্তে প্রবল বেগে পানি ঢালতে ঢালতে ছোট বেলায় হাততালি দিতাম যখন পোকাটি আধমরা হয়ে সিঁধকাটা চোরের মত প্রথমে মাথা, তারপর ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বেরিয়ে আসত। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার গঠন হয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীনআহমদ।তিনি একটি কঠিন সময়ের নেতৃত্ব দেন এবং তার নেতৃত্বের মাধ্যমে দৃশ্যমান থাকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব।

একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গণ ও সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একে অপরের পরিপূরক। এই ক্ষেত্রে আমরা জানি রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক হন কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানী। ইতিহাস লিখা এখানে উদ্দেশ্য নয় তবুও ইতিহাসের অঙ্গহানিকে প্রশ্রয় দেয়া উচিৎ না। প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সরকার গঠনের এক মাসের মাথায় ১৯৭১ সালের ১৬ই মে জোহরা তাজউদ্দীন ও তার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে ভারত পারি দিবার জন্য ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগর থানার কনিকাড়া গ্রামের প্রবেশ মুখে আসেন। তখনই স্থানীয় রাজাকার বাহিনী তাদেরকে অপহরণ করে নবীনগর থানায় কিংবা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্য । এই অপহরণটা কি পূর্বের উপমার সাথে মিল খায়না?

এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে তাজউদ্দীন পরিবারের উপর একটা প্রচন্ড চাপ ছিল। ঐ গর্তের পোকার মতো তারা বেরিয়ে পরলেন ভারত পারি দিতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর মধ্যে তদানীন্তন কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা ছিল অন্যতম সুবিধাজনক ভৌগলিক এলাকা। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমার সদর, আখাউড়া ও কসবা থানা ছিল ভারত সীমান্তবর্তী এবং ঢাকা ও আশপাশ জেলার শরণার্থীরা বিভিন্ন পথ দিয়ে প্রথমে আসতেন নবীনগর থানায়। নবীনগর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সদর ও কসবার প্রতিবেশি থানা। আবার এই থানাটি বিল ও নদী বেষ্টিত যার ভৌগলিক চরিত্র নিয়ে নবীনগরের তিতাস বিভাজিত আগের পাঁচটি বর্তমানের ছয়টি ইউনিয়নের প্রবেশ মুখ হচ্ছে কনিকাড়া গ্রাম। তিতাস ও বুড়ি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই গ্রামটির মধ্যদিয়েই বুড়ি নদীটি কসবা থানার কুটি-চৌমূহনীর ক্ষুদ্র নৌ বাণিজ্য কেন্দ্র পর্যন্ত লোক যাতায়াত ছিল।

এখন নাই। এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে কসবা, আখাউড়া খুব একটা দূরে নয় এই পথ পরিক্রমাতেই পথ চলছিল জোহরা তাজউদ্দীন তার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে এবং নবীনগর থানার শিবপুর ইউনিয়নের কনিকাড়া গ্রামের প্রবেশ মুখে যখন আসেন তখনই নবীনগরের রাজাকাররা তাদেরকে অপহরণ করে। বুড়ি নদীর পশ্চিম তীরের জল্লা গ্রাম থেকে যখন খেয়া পাড়ি দিচ্ছিলেন যার মাঝি ছিল শীতল মাঝি। রাজাকারদের সাথে জোহরা তাজউদ্দীনের কথা কাটাকাটির মাঝ দিয়ে শীতল মাঝি জানতে পারেন এরা সাধারণ কোনো পরিবার নয় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পরিবার। যারা বড় বিপদটাও তাদের বড়। এটা শীতল মাঝি বুঝতে পেরে খবরটি গোপনে পৌঁছে দেন কয়েকজন পরিচিত জনের কাছে। খবরটি বাতাসের সাথে মিশলো।

বিকেলের আয়ু যতই ফুরাচ্ছে এর বিপরীতবেগেই খবরটি জিয়ল হয়ে চুতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল কনিকাড়ার পাশের গ্রাম বাঘাউরার হাজী সোনালী ভূইয়ার বৈঠক ঘর থেকে আশপাশ গ্রামগুলোতে। মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল মামলার মামলা নম্বর ৪৪৩-২০১৫খ্রি: তে এই অপহরণের কথাটি বিবরণীতে উল্লেখ আছে কিন্তু গল্পটি নাই। আমি গল্পটি বলার চেষ্টা করছি। পাকিস্তানী আর্মি গোয়েন্দা সংস্থা তারা যে এদিকে এই পথে আসতেছেন এই খবরটি নিশ্চিত হয়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেনা ক্যাম্প ও নবীনগরের স্থানীয় রাজাকারদের কাছে একটি নির্দেশ আসে যাতে এদেরকে অপহরণ করে নবীনগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এটা পাকিস্তান সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। সোনালী ভূইঁয়ার পরিবারসহ আশপাশ এলাকার নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী পরিবার গুলো এই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। জোহরা তাজউদ্দীন পরিবার উদ্ধারের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, জনগণ জমির মাটির মতো ঘুমন্ত থাকে যাকে লাঙ্গলের ফলায় আবাদ যোগ্য করতে হয়। ইতিহাসে জনগণের ভুমিকার স্বীকৃতিটা আমরা দিতে শিখিনি যদিও নেতৃত্বের মাধ্যমে তারা জেগে উঠেন। তারা সঠিক সময়ে জেগেছেন বলেই রাজাকারদের অপহরণ হয়ে যাওয়া জোহরা তাজউদ্দীন ও তার ছেলেমেয়েদেরকে রাজাকারদের পক্ষে নবীনগর থানায় নিয়ে যেতে পারেনি।

একটি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা থেকেই জাতি মুক্তি পেল। ঐদিন রাতে কনিকাড়ার একটি বাড়িতে পাহারায় রেখে পরদিন ১৭ই মে ভোরে বুড়ি নদী দিয়ে কসবা থানার কুটি চৌমুহনির নৌবাণিজ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হল। ‘একটি বাড়িতে পাহারায়’ কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর এই বাড়ির লোকজন এই পরিবারকে রাতে আশ্রয়ের কথা আজানা আতঙ্কে পাশ কেটে যায়। যাই হোক কুটি থেকে বিভিন্ন পথে কসবা পৌঁছে কসবার ওপারে আগরতলার বিশাল ঘর ক্যাম্পে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। তাজউদ্দীন পরিবারের পরিচয় পেয়ে তাৎক্ষণিক বি,এস,এফ ক্যাম্প থেকে ফোনে আগরতলা থানায় ফোন করলে তারা জিপ গাড়ি করে তাদেরকে নিয়ে যান।

১৭ই মে যখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জানতে পারল জোহরা তাজউদ্দীন স্ব-পরিবারে ভারতে পৌঁছতে পেরেছেন তাদের ফেল মারা এই অভিযান তাদেরকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে এবং করাটাই স্বাভাবিক। ১৮ই মে থেকে ২০ শে মে ১৯৭১ ধোপাকান্দাসহ, বাঘাউরা, কনিকাড়াসমূহ নিকটবর্তী কয়েকটি এলাকার উপর তাদের রক্তজবা চোখের রক্ত আগুনে ঝলসে উঠে। জনগণ প্রতিরোধ নেতৃত্বের মৌলিক শক্তির যোগানদাতা হলেও সরাসরি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে তাদেরকে পড়তে হয়না। যারা এদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছিল ঐসব ব্যক্তি ও পরিবারই শরীর হয়ে যায় শত্রুর হুল ফুটাবার জন্য। ১৮ তারিখ থেকে লুটতরাজ অগ্নি সংযোগ করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২০শে মে বাঘাউড়ায় এসে শেষ হয়। কয়েকটি বাড়ী ঘর লুটপাট অগ্নি সংযোগ করে বিভৎসতার প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় পরিণত করে হল বাঘাউরার সোনালী ভূইঁয়ার বাড়ী, নবীনগর থানার রাজাকার ও পাকিস্তান আর্মি বাড়িটিকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ীর ভিতর অগ্রসর হয়।

১৬ই মে-এর ঘটনার পর আশপাশ এলাকার মানুষদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পরাটাই স্বাভাবিক এবং এর কালো ছায়া থেকেই এই বাড়ীটি মুক্ত থাকে কী করে! প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে সোনালী ভূইঁয়া হচ্ছেন নবীনগরের সর্বমহলে পরিচিত একজন সামাজিক মানুষ।৪৭এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘুদের পক্ষে তাঁর ভ’মিকা ছিল রক্ষাকবজের মত।বিত্তশালী হলেও তার রুচি ছিল অন্যমাত্রার।এক রকম বাড়িটি ছিল সাধারণ মানষুদের আকৃষ্ট করত যা আয়তনে একটি খামার বাড়ীর মত। পুকুরের দুই পাশে দুইটি পাকা ঘাট। অন্দর মহলের ঘাটে মেয়েদের পর্দার জন্য মেয়েরা যে ঘাট ব্যবহার করত ওটার এক পাশে দেয়াল দেয়া ছিল। আর ছিল দুটো সেনিটেশন বাথরুম তখনকার দিনে শহরেই এই স্বাস্থ্যকর অবকাঠামো ছিলনা। ৬ টি বড় বড় কাঠ কোয়ারির পাকাভিটির ঘর, বৈঠক ঘর, শস্য ও পাটের গুদাম ঘর, বিরাটাকারের গোয়াল ঘর এসব অবকাঠামোর মধ্যে শুধু দুটো পাকা ঘাট ও দুটি সেনিটারি বাথরুম ছাড়া এই বাড়ির নৃশংসতার স্বাক্ষী দেবার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

সব পুড়ে ছারখার রক্তজবার মতো আগুনের ঔদ্ধত্য ছাইগুলো উড়ছে। মুহূর্তে বসন্তের আকাশ হল বৈশাখের। ব্রাশফায়ারে উঠানেই লুটিয়ে পড়া মৃতদেহের মধ্যে সোনালী ভূইয়ার ৫ম ছেলে আব্দুল লতিফ ভূইঁয়া, ৩য় ছেলে আব্দুল গণি ভূইঁয়ার স্ত্রী আফিয়া খাতুন ও বাৎসরিক দিনমজুর পাশের বাড়ির বোবা যুবকটি । লুটপাট হল লুটতরাজ যোগ্য সবকিছু। জোহরা তাজউদ্দীনের গন্তব্যের গাড়ি তখন ভারতের ভেতর দিয়ে যত দ্রুত দৌড়াচ্ছিল বাঘাউড়া ট্রাজিডিটা ততটা গুরুত্ব ও দ্রুততার সাথেই শেষ হল।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

back to top