alt

মুক্ত আলোচনা

অসুর জাতির ইতিহাস

বাবুল রবিদাস

: বুধবার, ০৫ অক্টোবর ২০২২

ভারতের অতীত ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে জনজাতি অর্থাৎ আদিবাসীরাই হলো প্রকৃত ভূমিপুত্র। এরাই একদিন ভারতের যাবতীয় ভূ-সম্পত্তি ও ধন-সম্পত্তির অধিকারী ছিল।

বহিরাগত আর্যরা তাদের পরাভুত করে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। আদিবাসীদের আর্যরা সহজেই পরাভুত করতে পারেনি, তা আমরা পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে দেবাসুরের দ্বন্দ্ব ও লড়াই-এর মধ্যে সম্যকরূপে দেখতে পাই।

বহুবার দেবতা নামধারী আর্যকুল অসুর নামধারী আদিবাসী ভূমিপুত্রদের কাছে পরাভুত হয়েছে। তারপর আর্যকুল নানা ছলাকলা ও অবৈধ উপায়ে অসুর বা দৈত্য নাম দিয়ে ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে জনপদ থেকে বিতারিত করেছে। আজ আমরা সেইসব ভূমিপূত্রদের পাহাড়-পবর্ত, বন-জঙ্গলের অধিবাসী আদিবাসী বা জনজাতি হিসাবে দেখতে পাই। ইতিহাস বলছে, বিজয়ীরা সর্বদা বিজিতদের প্রতি অপমানসূচক প্রতিশব্দ করেছে। যেমন- আফ্রিকার সাদা শাসকরা কালোদের প্রতি “নিগ্রো” শব্দটি ব্যবহার করতো ব্যঙ্গার্থেই। ইংরেজরা ভারতীয়দের প্রতি অপমানসূচক “নেটিভ” শব্দটি ব্যবহার করতো। এইভাবে এদেশীয় পরাজিত মানুষদেরকে “অসুর” হিসাবে সম্বোধন করা শুরু হয় তাদের অসভ্যতা, বর্বরাতে ইঙ্গিত করার জন্য। অনেকের মতে– বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ এই দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন। তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে দুর্গা পূজা করেছিলেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে রাধারমণ রায় তাঁর কলকাতার দুর্গোৎসব শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন– সর্বপ্রথম দুর্গা পূজা শুরু হয় পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া এবং কলকাতায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন ঘটে। লর্ড ক্লাইভের পরামর্শে নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ বস্তকালিন দুর্গা পূজাকে শরৎকালে পিছিয়ে এনে পলাশী যুদ্ধের বিজয় উৎসবরূপে সারদীয়া দুর্গোৎসব শুরু করে বা পরবর্তীতে পলাশী যুদ্ধে স্মারক উৎসবে পরিণত হয়। প্রতি বছর এই উৎসব পালন করার জন্য তারা অন্যান্য হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতেন। ফলে সেকালে জমিদার ও বিত্তশালীদের বাড়ীতে দুর্গা পূজার আয়োজন করা হতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে। সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের কুটকৌশল, অস্ত্রসস্ত্র, তীর-ধুনক, গোলা-বারুদ যার বেশী থাকে সম্ভবতঃ সেই পক্ষই জয়ী হয়ে যান। জয়ী ব্যক্তি সমাজে হয়ে ওঠেন মহান ব্যক্তি এবং বিজয়ীদের গৌরব গাঁথা গল্পগুলো লেখা হয় ইতিহাসে। সকলেই বিজয়ীদের কাছে মাথানত করে।

অপর দিকে– পরাজিতরা আত্মগোপন করে এবং তারা সব কিছু থেকে বঞ্চিত থাকে। প্রাণভয়ে দূর্গম পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলে পরাজিতরা আশ্রয় গ্রহণ করে। তাঁদের ইতিহাস যায় মুছে। তাদেরকে ইতিহাসে অত্যাচারীত জাতিরূপে বর্ণনা করা এবং তাদের ঘৃণা ও অবজ্ঞাসূচক নামে সমাজের নতুন প্রজন্মদের শেখানো হয়।

ভারতের প্রাচীন প্রাগার্যযুগের পরাজিত আদিম সহজসরল বাসিন্দাদের দাস, দস্যু, নিষাদ, কিরাত, গন্ধব, কিন্নর, দৈত্য-দানব, রাক্ষস, নাগ-নাগিন, অসুর প্রভৃতি বিদ্বেষমূলক ও ঘৃণাসূচক নামে উল্লেখ করা হয়। ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক ও দূর্গম অঞ্চলে এই সমস্ত জনজাতিভুক্ত আদিবাসী অনগ্রসর মানুষেরা আজও “অসুর”-এর বংশধর মনে করেন এবং নামের শেষে “অসুর” পদবী ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা রয়েছে। মাননীয় জেলা প্রশাসকগণের কাছ থেকে প্রেরিত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট প্রশাসকগণের কাছ থেকে প্রেরিত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে জানা যায় যে, দেশে ২২৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নামের তালিকায় ২য় স্থলে “অসুর।” অসুর জাতির পরিচয় পাওয়া যায়।

উল্লেখ করা আবশ্যক যে, জঙ্গল, জলাভূমি, কৃষিভূমি রক্ষায় আদিবাসী বিরসামুন্ডা, সিদু, কানু, চাঁদ, ভৈরবসহ বহু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানুষ আন্দোলন শুরু করলে বৃটিশ সরকার নিরীহ আদিবাসীদের গ্রেফতার করে হত্যা করে। তাই ইংরেজ সরকার এই সকল আদিবাসীদের অপরাধ প্রবণ জনজাতি (ঈৎরসরহধষ ঃৎরনব) হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।

‘অসুর’ বলতে প্রাচীন ভারতের এক অনার্য জাতিকে বোঝায়। ঋগবেদের প্রাচীনতম অংশে জোরাস্ট্রীয় “আহুর” (আহুর মাজদা) শব্দের মতো “অসুর” শব্দটি পরমাত্মা (ঝঁঢ়ৎবসব ংঢ়ৎরঃ) বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। অসুর শব্দের আরও অর্থ ছিল ‘দেবতা বা ঈশ্বর এবং বরুণ, অগ্নি, মিত্র, ইন্দ্র প্রভৃতি প্রথম সারির দেবতাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। (মতান্তরে– ‘অসুর’ শব্দটি এতটাই সম্মানসূচক ছিল যে, প্রথম সারির দেবতারা ‘অসুর’ উপাধি গ্রহণ করেছিল ।

ঋগবেদের পরবর্তী অংশে এবং অনেকাংশে আর্যবিরোধী অথর্ববেদে– “অসুর” শব্দটি একেবারে বিপরীত অর্থ প্রকাশ করতে থাকে এবং তখন থেকেই টাইটান বা দৈত্য বা দেবতাদের শত্রু তথা তাদের যাগযজ্ঞ বা বলি সংক্রান্ত অনুধাবণে বাধা প্রদানকারীদেরকেই “অসুর” সম্বোধন করা শুরু হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, অসুররা যাদুবিদ্যার অধিকারী ছিল এবং তারা ধাতব শিল্পে অতি দক্ষ ছিল।

‘অসুর’ নামটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বে অবতারণা করা হয়েছে। কেউ বলেন যে, আসিরীয় দেবতা অসুর এবং এর সঙ্গে জড়িত অপমানসূচক ইঙ্গিত উদ্ভুত হওয়ার মূলে রয়েছে যে, ঘটনা তা হলো- আর্যরা ভারত ভূখন্ডে আসার আগে আসিরীয়রা ছিল তাদের শত্রু। অন্যমত বলে যে, “সুরা” নামক কড়া মদ্যপানে অভ্যস্ত আর্যরা সুরাপান থেকে বিরত অনার্যদেরকে ‘অসুর’ জাতিরূপে অভিহিত করতো। কেউ আবার বিশ্বাস করেন যে, প্রজাপতির নিশ্বাস বা ‘অসু’র জীবিত বা প্রাণসমৃদ্ধ রূপই হলো আজকের “অসুর” সম্প্রদায়। আম্বেদকরের ভাষায় বিশ্লেষণ করলে– যারা সুরাপান করতেন তারা সুর (দেবতা), আর যারা সুরাপান করতেন না তারা অসুর (অনার্য) ।

দুর্গার পদতলে পেশিবহুল প্রবল এক ব্যক্তিকে দেখা যায়, তার নাম মহিষাসুর। তিনি আসলে কে? ভয়ানক দানব? যাকে নিধন করেছিলেন দেবী। নাকি এক অসামান্য বীর? ভূমিপুত্র, রাজা? যাকে এই ধরণীর বহিরাগত সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে ‘খুন’ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের লেখক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী মতে- দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে যে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়েছিল, তার বংশধর রয়েছে। ভারত বর্ষের কিছু বিশেষ অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলেই ভাবেন। দেবী দুর্গা তাদের কাছে যমদূতের প্রতিনিধি বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার পাশাপাশি ভারতের প্রায় ৫০০টি জায়গায় দলিত বহুজন আদিবাসী হুদুড়দুর্গা অর্থাৎ মহিষাসুর স্মরণ দিবস করে থাকে। আশ্বিনের শারদোৎসবের চারদিন অসুর বংশের এরা বাড়ী থোেক পারতপক্ষে বের হন না। আতঙ্ক, দেবী দুর্গার কোপে বেঘোরে প্রাণটা হাড়াতে হয় বুঝি। এক-দু’টি পরিবার নয়, এমন “অসুর”-এর সংখ্যাটা হাজার হাজার ।

অসুর জাতির বাস মূলতঃ ঝাড়খন্ডের গুমলা ও লোহারডেগা জেলায়। অসুর ঝাড়খন্ডের একটি প্রাচীন জাতি। যারা ধাতু-নিষ্কাশন ও ধাতব সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন। রিজলির মতে– অসুররা ওড়িশ্যা, মধ্য ভারত, ছোট নাগপুরের সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পূর্বসুরি। তাঁরা নিজেদের মধ্যে অসুরি ভাষায় কথা বলেন যা মুন্ডারি গোষ্ঠীর একটি ভাষা।

রিজলির মতে– অসুরদের মধ্যে কতকগুলি উপজাতি আছে। যেমন– আগারিয়, বিরজিয়া, কোল-অসুর, লোহরা-অসুর এবং পাহাাড়িয়া অসুর। আবার প্রত্যেতটির মধ্যে কতকগুলি গোত্র আছে। যেমন- আইন্ধ, বাড়োয়া, কছুয়া, কেরকেট্টা, শিয়াত, নাগ, তিরকি এবং টপ্পো প্রভৃতি।

অসুররা সিংবোঙ্গা ও মারাং বোঙ্গার পুজা করেন এবং সারজুন, সোহরাই, করম ও হোলি প্রভৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। ।

বাংলাদেশ ঃ

বাংলাদেশের অসুরগণ সিলেটের মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ এলাকায় বসবাস করেন। প্রায় তারা ৩৮ ঘর। তাঁরা আসাম থেকে এসেছে। তারা মূলতঃ চা-শ্রমিক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রতিটি জেলা থেকে আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নামের তালিকা প্রেরণ করা হয়। নামের ০২নং ক্রমিকে অশুর বা অসুর জাতির নাম উল্লেখ রয়েছে।

আদিবাসীদের ‘দাঁসায়’ উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে।

দুর্গা পূজার সঙ্গে ‘দাঁসায়’ উৎসবের সম্পর্ক কিংবা আর্য-অনার্য সংঘাত ইত্যাদি নানা কিছু বিষয় আলোচনা দরকার। দুর্গা পূজা সম্পর্কে একটা প্রাচীন সাঁওতাল বাহিনী হচ্ছে– দেবাসুর সংগ্রামের সময় আর্যদের দলনেতা ছিলেন ইন্দ্র এবং অসুর অর্থাৎ খেরওয়ান গোষ্ঠীর দলনেতা ছিলেন দোর্দ- প্রতাপশালী হুদুড় দুর্গা। খেরওয়ালদের সঙ্গে আর্যদের প্রায় যুদ্ধ হতো, কিন্তু খেরওয়ালদের (অসুরদের) পরাজিত করা যাচ্ছিল না। আর্যদের সমস্ত চেষ্টা খেরওয়াল দলনেতা হুদুড় দুর্গা ব্যর্থ করে দিচ্ছিলেন। তখন আর্য দলনেতা ইন্দ্র এক কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি আর্য নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী এক যুবতিকে কৌশলে খেরওয়াল দলনেতা হুদুড় দুর্গার কাছে উপহার হিসাবে প্রেরণ করলেন। হুদুড় দুর্গা (অসুর) সুন্দরী যুবতীর মোহিনী রূপে ভুলে গিয়ে নিজের এবং খেরওয়াল জাতির (অসুরদের) ডেকে আনলেন। আর্য সুন্দরীর হাতে হুদুড় দুর্গাকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। অপর এক তথ্যে জানা যায় যে, প্রেমের অভিনয় করে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন ছলনাময়ী নারী। এক সময় ধৈর্য্যরে বাধ ভাঙ্গল অসুর রাজের। বিয়ে আট দিন কাছে নবমী তিথিয় রাতে মদ খাইয়ে অজ্ঞান অবস্থায় হত্যা করা হলো ঘোড়াসুর (অসুর রাজ)। দশমির দিন সকলে খবর পাওয়া মাত্র বিষাদ নামল আদিবাসী জনজাতির মহল্লায়।

পরবর্তীকালে সুন্দরী শ্রেষ্ঠা সেই মনোহারিণী নারীকে সম্মানের শীর্ষ চূড়ায় দেবীরূপে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করা হলো এবং অসুর দলনেতা হুদুড় দুর্গাকে বধ করায় তার নাম রাখা হলো দুর্গা। আদিবাসী ভাষায় দুর্গা অর্থ- সেনানায়ক আর হুদুড় দুর্গা অর্থ মহাসেনানয়ক।

দাঁসায় উৎসব সাঁওতাল সমাজে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তা সঠিক জানা যায় না, তবে দাঁসায় গানের মধ্যে তাদের ইতিহাসের বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তারা কোন কোন জায়গায় বসতি স্থাপন করেছে কিংবা ঘুরে বেড়িয়েছে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন–

হায়রে! হায়রে! হায়রে!

তিমিন দাঙ্গিঞ হাতে গিরু নৗই দ?

তিমিন দাঙ্গিঞ হাতে বাহা নৗই দ?

হায়রে! হায়রে! হায়রে!

হানে গো ঞেলঃকান গো

হানে গো ঞেলঃকান

গিরু নৗইরে দ জুয়াক এনেচকান

বাহা নৗইরে দ ধুড়িক আটাঙএৎ

অর্থাৎ–

হায়! হায়! হায়!

কত দূরে বন্ধু লোহিত সমুদ্র?

কত দূরে বন্ধু শ্বেত সাগর?

হায়! হায়! হায়!

ওই যে দেখা যায়

ওই যে দেখা যায়

লোহিত সমুদ্রে জুয়া খেলছে

বহু পুরানো গান। হয়তো এক সময়ে তারা ওই অঞ্চলে বসবাস করেছে। সে অঞ্চল তারা ছেড়ে এসেছে। কিন্তু আজও তারা সে সমস্ত অঞ্চল ভুলতে পারেনি। তাই দাঁসায় নাচ-গানের সময় সেই পুরানো দিনের স্মৃতিই তারা রোমন্থন করে। অনেক দার্শনিক বলেছেন, মানব সেবাই সর্বোৎকৃষ্ট সেবা। তাই কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন–

“.... মানুষের ঘৃণা করি

ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল

চুম্বিছে থরি থরি।

ও মুখ হতে কেতাবগ্রন্থ নাও

জোর করে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব

সেই মানুষে মেরে

পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল,

মুর্খরা সব শুনো।

মানুষ এনেছে গ্রন্থ

গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।”

বর্তমান বিশ্ব শান্তি, সমৃদ্ধি, সুসম্পর্ক ও পরস্পরের উন্নতির বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। তাই হানাহানি, মারামারি কেউ পছন্দ করে না। তৎকারণে যুদ্ধবিগ্রহ ছেড়ে শান্তির দিকে পুরোবিশ্ব কাজ করে চলেছে। বর্তমানে মানুষ হত্যার রক্ত নিয়ে খেলা, মানুষ আর দেখতে চায় না। প্রাচীনকালেও জ্ঞানী-গণিগণ বলেছেন, জীব হত্যা মহা পাপ! সর্ব জীবের প্রতি দয়া কর। জীব সেবাতে জীবন দাতার সেবা ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমানে ঐসব জ্ঞানী-গণি’র কথা অনুকরণীয়। যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে সত্যকে অনুসরণযোগ্য। তাই অসবর্ণ চালু করা উচিৎ একাত্মতা প্রকাশের জন্য। জানা যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সময় হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কথাটি বলেছেন– জাতিসংঘ র‌্যাপোর্টিয়ার। বিষয়টি বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য উদ্বেগজনক বটে।

[লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ

tab

মুক্ত আলোচনা

অসুর জাতির ইতিহাস

বাবুল রবিদাস

বুধবার, ০৫ অক্টোবর ২০২২

ভারতের অতীত ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে জনজাতি অর্থাৎ আদিবাসীরাই হলো প্রকৃত ভূমিপুত্র। এরাই একদিন ভারতের যাবতীয় ভূ-সম্পত্তি ও ধন-সম্পত্তির অধিকারী ছিল।

বহিরাগত আর্যরা তাদের পরাভুত করে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। আদিবাসীদের আর্যরা সহজেই পরাভুত করতে পারেনি, তা আমরা পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে দেবাসুরের দ্বন্দ্ব ও লড়াই-এর মধ্যে সম্যকরূপে দেখতে পাই।

বহুবার দেবতা নামধারী আর্যকুল অসুর নামধারী আদিবাসী ভূমিপুত্রদের কাছে পরাভুত হয়েছে। তারপর আর্যকুল নানা ছলাকলা ও অবৈধ উপায়ে অসুর বা দৈত্য নাম দিয়ে ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে জনপদ থেকে বিতারিত করেছে। আজ আমরা সেইসব ভূমিপূত্রদের পাহাড়-পবর্ত, বন-জঙ্গলের অধিবাসী আদিবাসী বা জনজাতি হিসাবে দেখতে পাই। ইতিহাস বলছে, বিজয়ীরা সর্বদা বিজিতদের প্রতি অপমানসূচক প্রতিশব্দ করেছে। যেমন- আফ্রিকার সাদা শাসকরা কালোদের প্রতি “নিগ্রো” শব্দটি ব্যবহার করতো ব্যঙ্গার্থেই। ইংরেজরা ভারতীয়দের প্রতি অপমানসূচক “নেটিভ” শব্দটি ব্যবহার করতো। এইভাবে এদেশীয় পরাজিত মানুষদেরকে “অসুর” হিসাবে সম্বোধন করা শুরু হয় তাদের অসভ্যতা, বর্বরাতে ইঙ্গিত করার জন্য। অনেকের মতে– বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ এই দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন। তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে দুর্গা পূজা করেছিলেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে রাধারমণ রায় তাঁর কলকাতার দুর্গোৎসব শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন– সর্বপ্রথম দুর্গা পূজা শুরু হয় পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া এবং কলকাতায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন ঘটে। লর্ড ক্লাইভের পরামর্শে নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ বস্তকালিন দুর্গা পূজাকে শরৎকালে পিছিয়ে এনে পলাশী যুদ্ধের বিজয় উৎসবরূপে সারদীয়া দুর্গোৎসব শুরু করে বা পরবর্তীতে পলাশী যুদ্ধে স্মারক উৎসবে পরিণত হয়। প্রতি বছর এই উৎসব পালন করার জন্য তারা অন্যান্য হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতেন। ফলে সেকালে জমিদার ও বিত্তশালীদের বাড়ীতে দুর্গা পূজার আয়োজন করা হতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে। সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের কুটকৌশল, অস্ত্রসস্ত্র, তীর-ধুনক, গোলা-বারুদ যার বেশী থাকে সম্ভবতঃ সেই পক্ষই জয়ী হয়ে যান। জয়ী ব্যক্তি সমাজে হয়ে ওঠেন মহান ব্যক্তি এবং বিজয়ীদের গৌরব গাঁথা গল্পগুলো লেখা হয় ইতিহাসে। সকলেই বিজয়ীদের কাছে মাথানত করে।

অপর দিকে– পরাজিতরা আত্মগোপন করে এবং তারা সব কিছু থেকে বঞ্চিত থাকে। প্রাণভয়ে দূর্গম পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলে পরাজিতরা আশ্রয় গ্রহণ করে। তাঁদের ইতিহাস যায় মুছে। তাদেরকে ইতিহাসে অত্যাচারীত জাতিরূপে বর্ণনা করা এবং তাদের ঘৃণা ও অবজ্ঞাসূচক নামে সমাজের নতুন প্রজন্মদের শেখানো হয়।

ভারতের প্রাচীন প্রাগার্যযুগের পরাজিত আদিম সহজসরল বাসিন্দাদের দাস, দস্যু, নিষাদ, কিরাত, গন্ধব, কিন্নর, দৈত্য-দানব, রাক্ষস, নাগ-নাগিন, অসুর প্রভৃতি বিদ্বেষমূলক ও ঘৃণাসূচক নামে উল্লেখ করা হয়। ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক ও দূর্গম অঞ্চলে এই সমস্ত জনজাতিভুক্ত আদিবাসী অনগ্রসর মানুষেরা আজও “অসুর”-এর বংশধর মনে করেন এবং নামের শেষে “অসুর” পদবী ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে ৬৪টি জেলা রয়েছে। মাননীয় জেলা প্রশাসকগণের কাছ থেকে প্রেরিত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট প্রশাসকগণের কাছ থেকে প্রেরিত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে জানা যায় যে, দেশে ২২৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নামের তালিকায় ২য় স্থলে “অসুর।” অসুর জাতির পরিচয় পাওয়া যায়।

উল্লেখ করা আবশ্যক যে, জঙ্গল, জলাভূমি, কৃষিভূমি রক্ষায় আদিবাসী বিরসামুন্ডা, সিদু, কানু, চাঁদ, ভৈরবসহ বহু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানুষ আন্দোলন শুরু করলে বৃটিশ সরকার নিরীহ আদিবাসীদের গ্রেফতার করে হত্যা করে। তাই ইংরেজ সরকার এই সকল আদিবাসীদের অপরাধ প্রবণ জনজাতি (ঈৎরসরহধষ ঃৎরনব) হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।

‘অসুর’ বলতে প্রাচীন ভারতের এক অনার্য জাতিকে বোঝায়। ঋগবেদের প্রাচীনতম অংশে জোরাস্ট্রীয় “আহুর” (আহুর মাজদা) শব্দের মতো “অসুর” শব্দটি পরমাত্মা (ঝঁঢ়ৎবসব ংঢ়ৎরঃ) বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। অসুর শব্দের আরও অর্থ ছিল ‘দেবতা বা ঈশ্বর এবং বরুণ, অগ্নি, মিত্র, ইন্দ্র প্রভৃতি প্রথম সারির দেবতাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। (মতান্তরে– ‘অসুর’ শব্দটি এতটাই সম্মানসূচক ছিল যে, প্রথম সারির দেবতারা ‘অসুর’ উপাধি গ্রহণ করেছিল ।

ঋগবেদের পরবর্তী অংশে এবং অনেকাংশে আর্যবিরোধী অথর্ববেদে– “অসুর” শব্দটি একেবারে বিপরীত অর্থ প্রকাশ করতে থাকে এবং তখন থেকেই টাইটান বা দৈত্য বা দেবতাদের শত্রু তথা তাদের যাগযজ্ঞ বা বলি সংক্রান্ত অনুধাবণে বাধা প্রদানকারীদেরকেই “অসুর” সম্বোধন করা শুরু হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, অসুররা যাদুবিদ্যার অধিকারী ছিল এবং তারা ধাতব শিল্পে অতি দক্ষ ছিল।

‘অসুর’ নামটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বে অবতারণা করা হয়েছে। কেউ বলেন যে, আসিরীয় দেবতা অসুর এবং এর সঙ্গে জড়িত অপমানসূচক ইঙ্গিত উদ্ভুত হওয়ার মূলে রয়েছে যে, ঘটনা তা হলো- আর্যরা ভারত ভূখন্ডে আসার আগে আসিরীয়রা ছিল তাদের শত্রু। অন্যমত বলে যে, “সুরা” নামক কড়া মদ্যপানে অভ্যস্ত আর্যরা সুরাপান থেকে বিরত অনার্যদেরকে ‘অসুর’ জাতিরূপে অভিহিত করতো। কেউ আবার বিশ্বাস করেন যে, প্রজাপতির নিশ্বাস বা ‘অসু’র জীবিত বা প্রাণসমৃদ্ধ রূপই হলো আজকের “অসুর” সম্প্রদায়। আম্বেদকরের ভাষায় বিশ্লেষণ করলে– যারা সুরাপান করতেন তারা সুর (দেবতা), আর যারা সুরাপান করতেন না তারা অসুর (অনার্য) ।

দুর্গার পদতলে পেশিবহুল প্রবল এক ব্যক্তিকে দেখা যায়, তার নাম মহিষাসুর। তিনি আসলে কে? ভয়ানক দানব? যাকে নিধন করেছিলেন দেবী। নাকি এক অসামান্য বীর? ভূমিপুত্র, রাজা? যাকে এই ধরণীর বহিরাগত সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে ‘খুন’ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের লেখক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী মতে- দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে যে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়েছিল, তার বংশধর রয়েছে। ভারত বর্ষের কিছু বিশেষ অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলেই ভাবেন। দেবী দুর্গা তাদের কাছে যমদূতের প্রতিনিধি বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার পাশাপাশি ভারতের প্রায় ৫০০টি জায়গায় দলিত বহুজন আদিবাসী হুদুড়দুর্গা অর্থাৎ মহিষাসুর স্মরণ দিবস করে থাকে। আশ্বিনের শারদোৎসবের চারদিন অসুর বংশের এরা বাড়ী থোেক পারতপক্ষে বের হন না। আতঙ্ক, দেবী দুর্গার কোপে বেঘোরে প্রাণটা হাড়াতে হয় বুঝি। এক-দু’টি পরিবার নয়, এমন “অসুর”-এর সংখ্যাটা হাজার হাজার ।

অসুর জাতির বাস মূলতঃ ঝাড়খন্ডের গুমলা ও লোহারডেগা জেলায়। অসুর ঝাড়খন্ডের একটি প্রাচীন জাতি। যারা ধাতু-নিষ্কাশন ও ধাতব সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন। রিজলির মতে– অসুররা ওড়িশ্যা, মধ্য ভারত, ছোট নাগপুরের সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পূর্বসুরি। তাঁরা নিজেদের মধ্যে অসুরি ভাষায় কথা বলেন যা মুন্ডারি গোষ্ঠীর একটি ভাষা।

রিজলির মতে– অসুরদের মধ্যে কতকগুলি উপজাতি আছে। যেমন– আগারিয়, বিরজিয়া, কোল-অসুর, লোহরা-অসুর এবং পাহাাড়িয়া অসুর। আবার প্রত্যেতটির মধ্যে কতকগুলি গোত্র আছে। যেমন- আইন্ধ, বাড়োয়া, কছুয়া, কেরকেট্টা, শিয়াত, নাগ, তিরকি এবং টপ্পো প্রভৃতি।

অসুররা সিংবোঙ্গা ও মারাং বোঙ্গার পুজা করেন এবং সারজুন, সোহরাই, করম ও হোলি প্রভৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। ।

বাংলাদেশ ঃ

বাংলাদেশের অসুরগণ সিলেটের মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ এলাকায় বসবাস করেন। প্রায় তারা ৩৮ ঘর। তাঁরা আসাম থেকে এসেছে। তারা মূলতঃ চা-শ্রমিক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রতিটি জেলা থেকে আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নামের তালিকা প্রেরণ করা হয়। নামের ০২নং ক্রমিকে অশুর বা অসুর জাতির নাম উল্লেখ রয়েছে।

আদিবাসীদের ‘দাঁসায়’ উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে।

দুর্গা পূজার সঙ্গে ‘দাঁসায়’ উৎসবের সম্পর্ক কিংবা আর্য-অনার্য সংঘাত ইত্যাদি নানা কিছু বিষয় আলোচনা দরকার। দুর্গা পূজা সম্পর্কে একটা প্রাচীন সাঁওতাল বাহিনী হচ্ছে– দেবাসুর সংগ্রামের সময় আর্যদের দলনেতা ছিলেন ইন্দ্র এবং অসুর অর্থাৎ খেরওয়ান গোষ্ঠীর দলনেতা ছিলেন দোর্দ- প্রতাপশালী হুদুড় দুর্গা। খেরওয়ালদের সঙ্গে আর্যদের প্রায় যুদ্ধ হতো, কিন্তু খেরওয়ালদের (অসুরদের) পরাজিত করা যাচ্ছিল না। আর্যদের সমস্ত চেষ্টা খেরওয়াল দলনেতা হুদুড় দুর্গা ব্যর্থ করে দিচ্ছিলেন। তখন আর্য দলনেতা ইন্দ্র এক কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি আর্য নারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী এক যুবতিকে কৌশলে খেরওয়াল দলনেতা হুদুড় দুর্গার কাছে উপহার হিসাবে প্রেরণ করলেন। হুদুড় দুর্গা (অসুর) সুন্দরী যুবতীর মোহিনী রূপে ভুলে গিয়ে নিজের এবং খেরওয়াল জাতির (অসুরদের) ডেকে আনলেন। আর্য সুন্দরীর হাতে হুদুড় দুর্গাকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। অপর এক তথ্যে জানা যায় যে, প্রেমের অভিনয় করে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন ছলনাময়ী নারী। এক সময় ধৈর্য্যরে বাধ ভাঙ্গল অসুর রাজের। বিয়ে আট দিন কাছে নবমী তিথিয় রাতে মদ খাইয়ে অজ্ঞান অবস্থায় হত্যা করা হলো ঘোড়াসুর (অসুর রাজ)। দশমির দিন সকলে খবর পাওয়া মাত্র বিষাদ নামল আদিবাসী জনজাতির মহল্লায়।

পরবর্তীকালে সুন্দরী শ্রেষ্ঠা সেই মনোহারিণী নারীকে সম্মানের শীর্ষ চূড়ায় দেবীরূপে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করা হলো এবং অসুর দলনেতা হুদুড় দুর্গাকে বধ করায় তার নাম রাখা হলো দুর্গা। আদিবাসী ভাষায় দুর্গা অর্থ- সেনানায়ক আর হুদুড় দুর্গা অর্থ মহাসেনানয়ক।

দাঁসায় উৎসব সাঁওতাল সমাজে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তা সঠিক জানা যায় না, তবে দাঁসায় গানের মধ্যে তাদের ইতিহাসের বহু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তারা কোন কোন জায়গায় বসতি স্থাপন করেছে কিংবা ঘুরে বেড়িয়েছে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন–

হায়রে! হায়রে! হায়রে!

তিমিন দাঙ্গিঞ হাতে গিরু নৗই দ?

তিমিন দাঙ্গিঞ হাতে বাহা নৗই দ?

হায়রে! হায়রে! হায়রে!

হানে গো ঞেলঃকান গো

হানে গো ঞেলঃকান

গিরু নৗইরে দ জুয়াক এনেচকান

বাহা নৗইরে দ ধুড়িক আটাঙএৎ

অর্থাৎ–

হায়! হায়! হায়!

কত দূরে বন্ধু লোহিত সমুদ্র?

কত দূরে বন্ধু শ্বেত সাগর?

হায়! হায়! হায়!

ওই যে দেখা যায়

ওই যে দেখা যায়

লোহিত সমুদ্রে জুয়া খেলছে

বহু পুরানো গান। হয়তো এক সময়ে তারা ওই অঞ্চলে বসবাস করেছে। সে অঞ্চল তারা ছেড়ে এসেছে। কিন্তু আজও তারা সে সমস্ত অঞ্চল ভুলতে পারেনি। তাই দাঁসায় নাচ-গানের সময় সেই পুরানো দিনের স্মৃতিই তারা রোমন্থন করে। অনেক দার্শনিক বলেছেন, মানব সেবাই সর্বোৎকৃষ্ট সেবা। তাই কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন–

“.... মানুষের ঘৃণা করি

ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল

চুম্বিছে থরি থরি।

ও মুখ হতে কেতাবগ্রন্থ নাও

জোর করে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব

সেই মানুষে মেরে

পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল,

মুর্খরা সব শুনো।

মানুষ এনেছে গ্রন্থ

গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।”

বর্তমান বিশ্ব শান্তি, সমৃদ্ধি, সুসম্পর্ক ও পরস্পরের উন্নতির বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। তাই হানাহানি, মারামারি কেউ পছন্দ করে না। তৎকারণে যুদ্ধবিগ্রহ ছেড়ে শান্তির দিকে পুরোবিশ্ব কাজ করে চলেছে। বর্তমানে মানুষ হত্যার রক্ত নিয়ে খেলা, মানুষ আর দেখতে চায় না। প্রাচীনকালেও জ্ঞানী-গণিগণ বলেছেন, জীব হত্যা মহা পাপ! সর্ব জীবের প্রতি দয়া কর। জীব সেবাতে জীবন দাতার সেবা ইত্যাদি ইত্যাদি। বর্তমানে ঐসব জ্ঞানী-গণি’র কথা অনুকরণীয়। যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে সত্যকে অনুসরণযোগ্য। তাই অসবর্ণ চালু করা উচিৎ একাত্মতা প্রকাশের জন্য। জানা যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সময় হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কথাটি বলেছেন– জাতিসংঘ র‌্যাপোর্টিয়ার। বিষয়টি বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য উদ্বেগজনক বটে।

[লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

back to top