আসফাক বীন রহমান
আজিমপুর কলোনির ৩৯ নাম্বার মাঠের উত্তর পাশ থেকে বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া বিশাল খেজুর গাছটার নিচে আমরা বসে আছি । কণক গাছ বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে । এরমধ্যে ইমন আর রাজী আলেকজান্ডার ডুমার ‘ দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ’ নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বাতচিত শুরু করে দিয়েছে । রাজী বলছে তিনজন প্রধান মাস্কেটিয়ার , এজন্যই থ্রী মাস্কেটিয়ার্স । ইমন বললো,“ না ,না ,এই বইটির নাম হওয়া দরকার ছিলো ফোর মাস্কেটিয়ার্স । কারণ , নায়ক হচ্ছে চারজন - দ্যঁর্তেগা, পার্থোস,আরামিস আর অ্যাথোস ।” তাদের ক্যাঁচক্যাচানিতে আমাদের কান ঝালাপালা । রাজী অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে বললো , “আমার কাছে তলোয়ার থাকলে এখনই তোকে চ্যালেঞ্জ করতাম ।” ইমনও ছেড়ে দেবার পাত্র না , “ আয় , বিকেলে বাগান থেকে দুটা ডাল দিয়ে তলোয়ার বানিয়ে আনবো , তোকে দ্যঁর্তেগার মতো ফাইট দিয়ে টাইট করে দিবো ।”
আমাদের ছুটি অফুরান । শিডিউল ছুটির বাইরে এরশাদ ভ্যাকেশন থাকে প্রায়ই । এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের কারণে স্কুল কলেজ মাঝে মাঝে একদিন দুদিনের জন্য বন্ধ থাকে । আমরা সারাদিন মাঠে খেলি । নতুন নেশা হয়েছে সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্লাসিকগুলো । আমাদের খেলাধূলায় নতুনত্ব আনতে ‘তিন গোয়েন্দা’র মতো মুসা , রবিন , কিশোর হই । কখনো কখনো স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘শার্লক হোমস’ হয়ে টিলো এক্সপ্রেস খেলি । লেটেস্ট থ্রি মাস্কেটিয়ার্স আর মার্ক টোয়েনের টম সয়ার ও হাকলবেরি ফিনে আমরা মজেছি । সবাই টম সয়ার আর হাকলবেরি ফিন হতে চায় । ইমন নাক সিঁটকে বলে ,‘টম সয়ার-হাকলবেরি ফিন হতে হলে আশেপাশে নদী আর জঙ্গল থাকতে হবে ; আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকায় মিসিসিপি নদীর মত পাগলা নদী আছে । কাজেই আমরা দুই ভাই টম সয়ার আর হাকলবেরি ফিন । মাঝে মাঝে বন্ধুরা মেনে নেয় , আবার অনেক সময় ঘুষাঘুষি কিলাকিলির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয় ।
আম্মা প্রচুর বই পড়েন । কিন্তু এগুলো ইন্ডিয়ান লেখকদের বই আর পুজো সংখ্যার মোটামোটা ভলিউম । নটরডেমের ছাত্র লীপু ভাই মাঝে মাঝে সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক বই নিয়ে আমাদের বাসায় পত্রিকা পড়তে আসেন । আমরা ভয়ে পেপারব্যাকের দিকে নজর দেই না । এগুলো নাকি ছোটদের পড়তে নেই । মাসুদ রানাসহ সব বইই নাকি বড়দের পাঠ্য । আমাদের দৌড় নীল কমল ,লাল কমল , ব্যাঙ্গমা- ব্যাঙ্গমী , ডালিম কুমার ,ঠাকুরমার ঝুলি পর্যন্ত । একদিন লিপু ভাইয়ের হাতে তিনটি ছেলের ছবিসহ তিন গোয়েন্দা বইটা দেখার পর ইমন জিজ্ঞেস করলো “ এই বইয়ে ছোট ছেলেদের ছবি কেন?” লিপু ভাই হেসে বললেন,“ তোমাদের বয়সের তিনটা ছেলে আমেরিকায় গোয়েন্দাগিরি করে । তোমরা এটা পড়তে পারো । ” লিপু ভাই আমাদের কিশোর ক্লাসিকের নেশা ধরিয়ে দেন । আম্মা মাঝে মাঝে বইগুলো সেন্সরশিপে পাঠিয়ে দেখতেন । পরে পাশের বাসার রাখি আপাদের কাছ থেকে ‘কুয়াশা’ সিরিজের বইগুলো মাঝে মাঝে এনে দিতেন ।
পড়ার দ্রুতগতির জন্য লিপু ভাইও মাঝে মাঝে বই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতেন না । বুদ্ধি দিলেন,“ লালবাগের মদিনা হোটেলের কাছাকাছি লালবাগ লাইব্রেরীতে গেলে অনেক বই পড়তে পারবে ।” আমাদের একেকটি বই হাত বদল হয়ে আমাদের সার্কেলের সব বন্ধুরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেলে । শেষ পর্যন্ত লোটাস ভাই একদিন বুদ্ধি দিলেন ,“ তোমরা নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের মার্কেট থেকে বই কিনতে পারো তিনভাগের একভাগ দামে ।” আমাদের কাছে এতো পয়সা কই ? কিন্তু ততদিন আমরা কেউ ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রসো হয়ে নির্জন দ্বীপে কল্পনায় ঘুরে বেড়াই , কেউবা হাওয়ার্ড পাইলের ‘রবিনহুড’ হয়ে হাতে তীর ধনুক নিয়ে কলোনির বাগানকে শেরউডের জঙ্গল মনে করে ঘুরে বেড়াই । পড়ার নেশা মারাত্মক । আম্মা প্রচুর বই পড়তেন , আব্বাও এ ব্যাপারে বাধা দিতেন না । ‘ফাইভ স্টার’ ক্লাবের আমাদের বন্ধুরা ঠিক করলাম টিফিনের পয়সা জমিয়ে সেবা প্রকাশনীর বই কিনবো । কারো বাসায় চার আনা ,কারো বাসায় দশ পাই-আট আনা বরাদ্ধ আবার কারো কোন বরাদ্ধই নেই । ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল একেবারে আমাদের বত্রিশ নাম্বার বিল্ডিং এর সাথে । এজন্য দুপুরে টিফিন আওয়ারে দৌড়ে বাসায় ভাত খেয়ে যাই । অনেক সময় বরাদ্ধ মঞ্জুর হয় ,অনেক সময় নামঞ্জুর । পকেটে পঁচিশ পয়সা থাকলে আরও পঁচিশ এর দিকে নজর । আট আনা জমাতে পারলে মামুর হালিম খাওয়া যাবে । পুরো সপ্তাহেও একেকজনে চার আনা জমাতে পারেনা - কোনদিন বাদাম, কটকটি, কোনদিন চালতার আচার , বেত ফল চটপটি , আবার কখনো বাদামপাপড়ি ,আইসক্রিম , হাওয়াই মিঠাইএর লোভে । প্রতি বৃহস্পতিবার যে যার জমানো পুরো সপ্তাহের সম্পদ নিয়ে এক জায়গায় গোল হয়ে বসি । সব মিলিয়ে ৫ টাকা ৬ টাকা হলেই কেল্লাফতে । সেবা প্রকাশনীর নতুন বইয়ের দাম আট টাকা থেকে শুরু করে বারো টাকা পর্যন্ত । তিন ভাগের এক ভাগ ধরে দুটি বই কিনতে পারি । বৃহস্পতিবার বা শনিবার খালিপায়ে বগলে ফুটবলসহ নীলক্ষেতের পুরান বইএর দোকানে আমাদের ফাইভ ষ্টারের দুই তিনজন প্রতিনিধি হাজির হই ।
আব্বার কলিগ ফরিদা খালা আমাদের কাছাকাছি বিল্ডিংয়ে থাকেন । উনার ছেলে বাবুকে আঙ্কেল আর ফরিদা খালা সমানে বই-কমিকস কিনে দেন । ওদের বাসায় গেলে বাবুর কাছে বাহাদুর ,চাচা চৌধুরী , নন্টে -ফন্টে ,হাঁদা -ভোঁদা , মেন্ড্রক ,ফ্যান্টমের অফুরন্ত সম্ভার দেখে আমাদের মাথা নষ্ট হবার যোগাড় । ওর কাছে একটা কমিক্স বই চাইলে চার-পাঁচটা দেয় । এই বই আবার আমাদের সার্কেল থেকে অন্য সার্কেলে ঘুরে আরো অনেক বই আমাদের হাতে নিয়ে আসে ।
বিকেলে অবসরে আমরা বসে বসে আলাপ করি- কে কি হতে চায় ? ততোদিনে ফঁরাসি লেখক জুলভার্নের আমরা মস্ত ভক্ত হয়ে গেছি । একজন মানুষ একটি চিলেকোঠায় বসে কীভাবে ভবিষ্যতের গল্প লিখতে পারে এটা আমাদের অনেক অবাক করতো । ‘এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’এর ফিলিয়াস ফগ চরিত্রকে আমরা মনে প্রাণে ধারণ করতে চাইতাম । বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম যদি নির্জন কোন দ্বীপে কখনো আটকে পড়ি তাহলেও চিন্তা নাই , মিষ্টিরিয়াস আইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা নিশ্চয়ই ওভারকাম করতে পারবো । তখন নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন নিমোর সাবমেরিন নটিলাসের দেখা পাবো । টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলাকে তখন মনে হতো বাচ্চাদের খেলা । বন্ধু মাহবুব বললো, “ আমরাতো সিমেন্টের পিচে কর্কের বল দিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারি, পীচতো আমাদের বত্রিশ নাম্বার মাঠের মাটির নিচেই আছে । ” আসলেই তাই । পাশে নতুন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সময় সিমেন্টের পীচ ঢাকা পড়ে গেছে সুড়কী আর বালুতে । ‘চলো পীচ খনন করি’ বলে কোদল- শাবল নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি । সোহেল, ইমন , বাবু, মাহবুব সবাইকে দেখে মনে হতো হেনরী রাইডার হেগার্ডের ‘সলোমনের গুপ্তধন’ আবিষ্কার করতে আমরা নেমেছি ।
অফ চান্সে একদিন রোমেনা আফাজের ‘ দস্যু বনহুর ’ সিরিজের একটি বই পড়তে গিয়ে আম্মার হাতের কানমলা আর পিঠে দমাদম কিল হজম করতে হয়েছে । কাজী মাহমুদ হোসেনের ওয়েস্টার্ণ সিরিজের বইগুলোর এরফান জেসাপ, রাইডার চরিত্রগুলো আমাদের অতি শিশু বেলায় টেলিভিশনে দেখা ‘ ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট ’এর হারানো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় । বেল্টের পাশে মোজা ,কাপড় , বাঁশপাতা কাগজের হোলষ্টার বানিয়ে খেলনা পিস্তল নিয়ে কে কতো দ্রুত ড্র করতে পারি অন্যদের চ্যালেঞ্জ করি ।
বাংলা সিনেমার নায়ক আর ভিলেনের বাইরেও যেমন ট্রাজেডি নায়কের পার্ট থাকে তেমনি কিছু কিছু বইয়ের প্রধান চরিত্রদের না পাওয়া এবং হেরে যাওয়া আমাদের চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারতো না । ভিক্টর হুগোর ‘ হাঞ্চব্যাক অব নটরডাম’এর ক্যাথেড্রাল টাওয়ারের পাশে কুঁজো কোয়াসিমোডো আর নর্তকী এসমেরালডার করুণ কাহিনী খুব কষ্ট দিয়েছে । বইয়ের শুরুর দিকে যে কোয়াসিমোডো ছিলো আমাদের চোখে ভিলেন সে হয়ে যায় ট্রাজেডি হিরো । একজন জন্মগত বিকলাঙ্গ মানুষও কিভাবে একটি বইয়ের প্রধান চরিত্র হয়ে যায় সেটা অনেক সময় চিন্তা করতাম । ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল ’ বইটি আম্মা পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন । একজন অনাহারি মানুষ জঁ ভালজঁ শুধুমাত্র একটি রুটি চুরির কারণে সাড়ে চার বছর জেল খাটার শাস্তি পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঊনিশ বছর সাজা খেটে বের হয়েছেন - পড়ে খুব কষ্ট লেগেছিল । সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর অপমানে শহরের ড্রেনে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হতো । যে শেষ পর্যন্ত অন্য আরেকজনকে বাঁচাতে আবারো জেলে যায় । এই পর্যায়ে তীব্র কষ্টে বুক ভেঙ্গে গিয়েছিল ।
রাজা বাদশাহ হলে মন বড় হতে হয় -এই ধারণা ভেঙ্গে গিয়েছিল আলেকজান্ডার ডুমার ‘ ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক ’ বইটি পড়ে । ফ্রান্সের অত্যাচারী রাজা চতুর্দশ লুই তার নিজের জমজ ভাইয়ের মুখটা লোহার মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখার যখন আদেশ দেয় ,তখন মনে হয়েছিল ভাই হয়ে ভাইকে এমন শাস্তি দিতে পারে কেউ ।আব্বা ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন । উনাকে এই চরিত্র সম্পর্কে বলতে জানান মোগল সম্রাটদের অনেকে তাদের ভাইদের সাথে এই ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন।
লিপু ভাইয়ের হাতে খুলির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ফুলের ছবিওয়ালা ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালবাসা (এ টাইম টু লিভ এ টাইম টু ডাই )’ বইটি দেখে প্রচ্ছদের শক্তি বুঝতে পারি ’। এরিক মারিয়া রেমার্কের এই বই এবং ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট ’ বই দুটি পড়ে আমাদের ওয়েস্টার্ণ বই পড়া , তলোয়ার ফাইট করা মননে তীব্র ধাক্কা এসে পড়ে । ‘যুদ্ধের প্রথম বোমাটি এসে পড়ে হৃদয়ে’ এই কথাটি তখনই বুঝতে পারি । আর্নেষ্ট গ্রেভার আর পল বোমার এর মত সদ্য তরুণদের স্বপ্ন ধ্বংস হতে দেখে অনেক কষ্ট পেয়েছি ।
মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’তে সান্তিয়াগো বুড়োই নায়ক । গভীর সমুদ্রে এক একটা হতাশাজনক দিন কিভাবে সান্তিয়াগো কাটায় সেটা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয় । বইটির স্লথ গতির কারণে ইমন দশ-পনেরো পাতা পড়ে সারেন্ডার করে । ধৈর্য্যের পুরস্কার বিশাল বড় মারলিন মাছ শিকার করার মাধ্যমে সান্তিয়াগো বুড়ো পায় । হাঙ্গরের আক্রমণে
আস্তে আস্তে মাছটির আয়তন কমতে থাকায় মনে হয়েছিল সব সময় বড় কিছু পেলেও কপালে না থাকলে সেটা ভোগ করা যায় না । রবার্ট লুই ষ্টিভেনসনের ‘ ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইড ’ মানুষের ভিতরের মানুষকে চিনিয়ে দেয় । নোংরা ,কদর্য ,নীচ মিস্টার হাইড সমাজের একই মানুষের বিভিন্ন রূপ উন্মোচন করে ।
বইয়ের প্রতিবাদী রবিনহুড থেকে শুরু করে নিঃসঙ্গ ক্যাপ্টেন নিমো ,সান্তিয়াগো বুড়ো ; চিরদুঃখী জঁ ভালজঁ, কোয়াসিমোডো ; স্বপ্নভঙ্গের পল বোমার,আর্নেষ্ট গ্রেভার ; ভবঘুরে হাকলবেরি ফিন;হার না মানা ফিলিয়াস ফগ, দ্যঁর্তেগার জন্য আজো মন কাঁদে । আমাদের আশেপাশের অনেককে চতুর্দশ লুই-এর মতো নিষ্ঠুর আর মিস্টার হাইডের মতো হীন , নোংরা ,শয়তান মানুষগুলো চিনিয়েছে ।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]
আসফাক বীন রহমান
শনিবার, ০১ জুলাই ২০২৩
আজিমপুর কলোনির ৩৯ নাম্বার মাঠের উত্তর পাশ থেকে বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া বিশাল খেজুর গাছটার নিচে আমরা বসে আছি । কণক গাছ বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে । এরমধ্যে ইমন আর রাজী আলেকজান্ডার ডুমার ‘ দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ’ নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বাতচিত শুরু করে দিয়েছে । রাজী বলছে তিনজন প্রধান মাস্কেটিয়ার , এজন্যই থ্রী মাস্কেটিয়ার্স । ইমন বললো,“ না ,না ,এই বইটির নাম হওয়া দরকার ছিলো ফোর মাস্কেটিয়ার্স । কারণ , নায়ক হচ্ছে চারজন - দ্যঁর্তেগা, পার্থোস,আরামিস আর অ্যাথোস ।” তাদের ক্যাঁচক্যাচানিতে আমাদের কান ঝালাপালা । রাজী অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে বললো , “আমার কাছে তলোয়ার থাকলে এখনই তোকে চ্যালেঞ্জ করতাম ।” ইমনও ছেড়ে দেবার পাত্র না , “ আয় , বিকেলে বাগান থেকে দুটা ডাল দিয়ে তলোয়ার বানিয়ে আনবো , তোকে দ্যঁর্তেগার মতো ফাইট দিয়ে টাইট করে দিবো ।”
আমাদের ছুটি অফুরান । শিডিউল ছুটির বাইরে এরশাদ ভ্যাকেশন থাকে প্রায়ই । এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের কারণে স্কুল কলেজ মাঝে মাঝে একদিন দুদিনের জন্য বন্ধ থাকে । আমরা সারাদিন মাঠে খেলি । নতুন নেশা হয়েছে সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্লাসিকগুলো । আমাদের খেলাধূলায় নতুনত্ব আনতে ‘তিন গোয়েন্দা’র মতো মুসা , রবিন , কিশোর হই । কখনো কখনো স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘শার্লক হোমস’ হয়ে টিলো এক্সপ্রেস খেলি । লেটেস্ট থ্রি মাস্কেটিয়ার্স আর মার্ক টোয়েনের টম সয়ার ও হাকলবেরি ফিনে আমরা মজেছি । সবাই টম সয়ার আর হাকলবেরি ফিন হতে চায় । ইমন নাক সিঁটকে বলে ,‘টম সয়ার-হাকলবেরি ফিন হতে হলে আশেপাশে নদী আর জঙ্গল থাকতে হবে ; আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকায় মিসিসিপি নদীর মত পাগলা নদী আছে । কাজেই আমরা দুই ভাই টম সয়ার আর হাকলবেরি ফিন । মাঝে মাঝে বন্ধুরা মেনে নেয় , আবার অনেক সময় ঘুষাঘুষি কিলাকিলির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয় ।
আম্মা প্রচুর বই পড়েন । কিন্তু এগুলো ইন্ডিয়ান লেখকদের বই আর পুজো সংখ্যার মোটামোটা ভলিউম । নটরডেমের ছাত্র লীপু ভাই মাঝে মাঝে সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক বই নিয়ে আমাদের বাসায় পত্রিকা পড়তে আসেন । আমরা ভয়ে পেপারব্যাকের দিকে নজর দেই না । এগুলো নাকি ছোটদের পড়তে নেই । মাসুদ রানাসহ সব বইই নাকি বড়দের পাঠ্য । আমাদের দৌড় নীল কমল ,লাল কমল , ব্যাঙ্গমা- ব্যাঙ্গমী , ডালিম কুমার ,ঠাকুরমার ঝুলি পর্যন্ত । একদিন লিপু ভাইয়ের হাতে তিনটি ছেলের ছবিসহ তিন গোয়েন্দা বইটা দেখার পর ইমন জিজ্ঞেস করলো “ এই বইয়ে ছোট ছেলেদের ছবি কেন?” লিপু ভাই হেসে বললেন,“ তোমাদের বয়সের তিনটা ছেলে আমেরিকায় গোয়েন্দাগিরি করে । তোমরা এটা পড়তে পারো । ” লিপু ভাই আমাদের কিশোর ক্লাসিকের নেশা ধরিয়ে দেন । আম্মা মাঝে মাঝে বইগুলো সেন্সরশিপে পাঠিয়ে দেখতেন । পরে পাশের বাসার রাখি আপাদের কাছ থেকে ‘কুয়াশা’ সিরিজের বইগুলো মাঝে মাঝে এনে দিতেন ।
পড়ার দ্রুতগতির জন্য লিপু ভাইও মাঝে মাঝে বই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতেন না । বুদ্ধি দিলেন,“ লালবাগের মদিনা হোটেলের কাছাকাছি লালবাগ লাইব্রেরীতে গেলে অনেক বই পড়তে পারবে ।” আমাদের একেকটি বই হাত বদল হয়ে আমাদের সার্কেলের সব বন্ধুরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেলে । শেষ পর্যন্ত লোটাস ভাই একদিন বুদ্ধি দিলেন ,“ তোমরা নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের মার্কেট থেকে বই কিনতে পারো তিনভাগের একভাগ দামে ।” আমাদের কাছে এতো পয়সা কই ? কিন্তু ততদিন আমরা কেউ ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রসো হয়ে নির্জন দ্বীপে কল্পনায় ঘুরে বেড়াই , কেউবা হাওয়ার্ড পাইলের ‘রবিনহুড’ হয়ে হাতে তীর ধনুক নিয়ে কলোনির বাগানকে শেরউডের জঙ্গল মনে করে ঘুরে বেড়াই । পড়ার নেশা মারাত্মক । আম্মা প্রচুর বই পড়তেন , আব্বাও এ ব্যাপারে বাধা দিতেন না । ‘ফাইভ স্টার’ ক্লাবের আমাদের বন্ধুরা ঠিক করলাম টিফিনের পয়সা জমিয়ে সেবা প্রকাশনীর বই কিনবো । কারো বাসায় চার আনা ,কারো বাসায় দশ পাই-আট আনা বরাদ্ধ আবার কারো কোন বরাদ্ধই নেই । ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল একেবারে আমাদের বত্রিশ নাম্বার বিল্ডিং এর সাথে । এজন্য দুপুরে টিফিন আওয়ারে দৌড়ে বাসায় ভাত খেয়ে যাই । অনেক সময় বরাদ্ধ মঞ্জুর হয় ,অনেক সময় নামঞ্জুর । পকেটে পঁচিশ পয়সা থাকলে আরও পঁচিশ এর দিকে নজর । আট আনা জমাতে পারলে মামুর হালিম খাওয়া যাবে । পুরো সপ্তাহেও একেকজনে চার আনা জমাতে পারেনা - কোনদিন বাদাম, কটকটি, কোনদিন চালতার আচার , বেত ফল চটপটি , আবার কখনো বাদামপাপড়ি ,আইসক্রিম , হাওয়াই মিঠাইএর লোভে । প্রতি বৃহস্পতিবার যে যার জমানো পুরো সপ্তাহের সম্পদ নিয়ে এক জায়গায় গোল হয়ে বসি । সব মিলিয়ে ৫ টাকা ৬ টাকা হলেই কেল্লাফতে । সেবা প্রকাশনীর নতুন বইয়ের দাম আট টাকা থেকে শুরু করে বারো টাকা পর্যন্ত । তিন ভাগের এক ভাগ ধরে দুটি বই কিনতে পারি । বৃহস্পতিবার বা শনিবার খালিপায়ে বগলে ফুটবলসহ নীলক্ষেতের পুরান বইএর দোকানে আমাদের ফাইভ ষ্টারের দুই তিনজন প্রতিনিধি হাজির হই ।
আব্বার কলিগ ফরিদা খালা আমাদের কাছাকাছি বিল্ডিংয়ে থাকেন । উনার ছেলে বাবুকে আঙ্কেল আর ফরিদা খালা সমানে বই-কমিকস কিনে দেন । ওদের বাসায় গেলে বাবুর কাছে বাহাদুর ,চাচা চৌধুরী , নন্টে -ফন্টে ,হাঁদা -ভোঁদা , মেন্ড্রক ,ফ্যান্টমের অফুরন্ত সম্ভার দেখে আমাদের মাথা নষ্ট হবার যোগাড় । ওর কাছে একটা কমিক্স বই চাইলে চার-পাঁচটা দেয় । এই বই আবার আমাদের সার্কেল থেকে অন্য সার্কেলে ঘুরে আরো অনেক বই আমাদের হাতে নিয়ে আসে ।
বিকেলে অবসরে আমরা বসে বসে আলাপ করি- কে কি হতে চায় ? ততোদিনে ফঁরাসি লেখক জুলভার্নের আমরা মস্ত ভক্ত হয়ে গেছি । একজন মানুষ একটি চিলেকোঠায় বসে কীভাবে ভবিষ্যতের গল্প লিখতে পারে এটা আমাদের অনেক অবাক করতো । ‘এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’এর ফিলিয়াস ফগ চরিত্রকে আমরা মনে প্রাণে ধারণ করতে চাইতাম । বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম যদি নির্জন কোন দ্বীপে কখনো আটকে পড়ি তাহলেও চিন্তা নাই , মিষ্টিরিয়াস আইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা নিশ্চয়ই ওভারকাম করতে পারবো । তখন নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন নিমোর সাবমেরিন নটিলাসের দেখা পাবো । টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলাকে তখন মনে হতো বাচ্চাদের খেলা । বন্ধু মাহবুব বললো, “ আমরাতো সিমেন্টের পিচে কর্কের বল দিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারি, পীচতো আমাদের বত্রিশ নাম্বার মাঠের মাটির নিচেই আছে । ” আসলেই তাই । পাশে নতুন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সময় সিমেন্টের পীচ ঢাকা পড়ে গেছে সুড়কী আর বালুতে । ‘চলো পীচ খনন করি’ বলে কোদল- শাবল নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি । সোহেল, ইমন , বাবু, মাহবুব সবাইকে দেখে মনে হতো হেনরী রাইডার হেগার্ডের ‘সলোমনের গুপ্তধন’ আবিষ্কার করতে আমরা নেমেছি ।
অফ চান্সে একদিন রোমেনা আফাজের ‘ দস্যু বনহুর ’ সিরিজের একটি বই পড়তে গিয়ে আম্মার হাতের কানমলা আর পিঠে দমাদম কিল হজম করতে হয়েছে । কাজী মাহমুদ হোসেনের ওয়েস্টার্ণ সিরিজের বইগুলোর এরফান জেসাপ, রাইডার চরিত্রগুলো আমাদের অতি শিশু বেলায় টেলিভিশনে দেখা ‘ ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট ’এর হারানো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় । বেল্টের পাশে মোজা ,কাপড় , বাঁশপাতা কাগজের হোলষ্টার বানিয়ে খেলনা পিস্তল নিয়ে কে কতো দ্রুত ড্র করতে পারি অন্যদের চ্যালেঞ্জ করি ।
বাংলা সিনেমার নায়ক আর ভিলেনের বাইরেও যেমন ট্রাজেডি নায়কের পার্ট থাকে তেমনি কিছু কিছু বইয়ের প্রধান চরিত্রদের না পাওয়া এবং হেরে যাওয়া আমাদের চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারতো না । ভিক্টর হুগোর ‘ হাঞ্চব্যাক অব নটরডাম’এর ক্যাথেড্রাল টাওয়ারের পাশে কুঁজো কোয়াসিমোডো আর নর্তকী এসমেরালডার করুণ কাহিনী খুব কষ্ট দিয়েছে । বইয়ের শুরুর দিকে যে কোয়াসিমোডো ছিলো আমাদের চোখে ভিলেন সে হয়ে যায় ট্রাজেডি হিরো । একজন জন্মগত বিকলাঙ্গ মানুষও কিভাবে একটি বইয়ের প্রধান চরিত্র হয়ে যায় সেটা অনেক সময় চিন্তা করতাম । ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল ’ বইটি আম্মা পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন । একজন অনাহারি মানুষ জঁ ভালজঁ শুধুমাত্র একটি রুটি চুরির কারণে সাড়ে চার বছর জেল খাটার শাস্তি পেয়ে শেষ পর্যন্ত ঊনিশ বছর সাজা খেটে বের হয়েছেন - পড়ে খুব কষ্ট লেগেছিল । সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর অপমানে শহরের ড্রেনে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হতো । যে শেষ পর্যন্ত অন্য আরেকজনকে বাঁচাতে আবারো জেলে যায় । এই পর্যায়ে তীব্র কষ্টে বুক ভেঙ্গে গিয়েছিল ।
রাজা বাদশাহ হলে মন বড় হতে হয় -এই ধারণা ভেঙ্গে গিয়েছিল আলেকজান্ডার ডুমার ‘ ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক ’ বইটি পড়ে । ফ্রান্সের অত্যাচারী রাজা চতুর্দশ লুই তার নিজের জমজ ভাইয়ের মুখটা লোহার মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখার যখন আদেশ দেয় ,তখন মনে হয়েছিল ভাই হয়ে ভাইকে এমন শাস্তি দিতে পারে কেউ ।আব্বা ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন । উনাকে এই চরিত্র সম্পর্কে বলতে জানান মোগল সম্রাটদের অনেকে তাদের ভাইদের সাথে এই ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন।
লিপু ভাইয়ের হাতে খুলির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা ফুলের ছবিওয়ালা ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালবাসা (এ টাইম টু লিভ এ টাইম টু ডাই )’ বইটি দেখে প্রচ্ছদের শক্তি বুঝতে পারি ’। এরিক মারিয়া রেমার্কের এই বই এবং ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট ’ বই দুটি পড়ে আমাদের ওয়েস্টার্ণ বই পড়া , তলোয়ার ফাইট করা মননে তীব্র ধাক্কা এসে পড়ে । ‘যুদ্ধের প্রথম বোমাটি এসে পড়ে হৃদয়ে’ এই কথাটি তখনই বুঝতে পারি । আর্নেষ্ট গ্রেভার আর পল বোমার এর মত সদ্য তরুণদের স্বপ্ন ধ্বংস হতে দেখে অনেক কষ্ট পেয়েছি ।
মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’তে সান্তিয়াগো বুড়োই নায়ক । গভীর সমুদ্রে এক একটা হতাশাজনক দিন কিভাবে সান্তিয়াগো কাটায় সেটা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয় । বইটির স্লথ গতির কারণে ইমন দশ-পনেরো পাতা পড়ে সারেন্ডার করে । ধৈর্য্যের পুরস্কার বিশাল বড় মারলিন মাছ শিকার করার মাধ্যমে সান্তিয়াগো বুড়ো পায় । হাঙ্গরের আক্রমণে
আস্তে আস্তে মাছটির আয়তন কমতে থাকায় মনে হয়েছিল সব সময় বড় কিছু পেলেও কপালে না থাকলে সেটা ভোগ করা যায় না । রবার্ট লুই ষ্টিভেনসনের ‘ ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইড ’ মানুষের ভিতরের মানুষকে চিনিয়ে দেয় । নোংরা ,কদর্য ,নীচ মিস্টার হাইড সমাজের একই মানুষের বিভিন্ন রূপ উন্মোচন করে ।
বইয়ের প্রতিবাদী রবিনহুড থেকে শুরু করে নিঃসঙ্গ ক্যাপ্টেন নিমো ,সান্তিয়াগো বুড়ো ; চিরদুঃখী জঁ ভালজঁ, কোয়াসিমোডো ; স্বপ্নভঙ্গের পল বোমার,আর্নেষ্ট গ্রেভার ; ভবঘুরে হাকলবেরি ফিন;হার না মানা ফিলিয়াস ফগ, দ্যঁর্তেগার জন্য আজো মন কাঁদে । আমাদের আশেপাশের অনেককে চতুর্দশ লুই-এর মতো নিষ্ঠুর আর মিস্টার হাইডের মতো হীন , নোংরা ,শয়তান মানুষগুলো চিনিয়েছে ।
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]