ইকবাল হাসান
অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি একটা বড় অন্তরায় হতে পারে। শিশুদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে জরিপ চালিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। এতে সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের ভিত্তিতে ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্র্ভে ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ। জরিপের ফলাফল বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতির হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনুপস্থিত থাকছে। মেয়েদের থেকে ছেলেদের অনুপস্থিতির হার আরও বেশি। অনেকে আবার স্কুলে এসেও টিফিনের পর পালিয়ে যায়। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রথম ধাপই হলো বিদ্যালয়ের অনুপস্থিতি। এখনই এ সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ না নিলে এস ডি জি-৪ অর্জন অসম্ভব হয়ে যাবে। কেন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিম্নলিখিত কারণ সমূহ চিহ্নিত করা হলো :
পরিকল্পিত ও আকর্ষণীয় শ্রেণী কার্যক্রম না হওয়া। শিক্ষকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব। অভিভাবকদের অসচেতনতা। ক্লাস না করলেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে আসতে আনন্দ পায় না। দারিদ্রতা। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ আকর্ষণীয় না হওয়া। পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রীর অভাব। কিছু প্রতিষ্ঠানে ক্লাস সাইজ বড় হওয়া। দুপুরে স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা না থাকা। বাল্যবিবাহ। ভৌগলিক কারণ যেমন- পাহাড়, হাওর, উপকূল ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের জেলাগুলোয় শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার সবচেয়ে কম। প্রতিষ্ঠান ও অভিবাবকদের মধ্যে কোন কোড অব কন্ডাক্ট না থাকা। ছাত্রীদের জন্য হাইজিন কর্নার না থাকা। উপস্থিতির বিষয়টি মনিটর করার জন্য ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার না থাকা।
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতির কারণ বিবিধ। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিদ্যালয় ও পরিবার এজন্য দায়ী। এর পরে বলা যায় শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠদান পদ্ধতি এজন্য দায়ী। একজন শিক্ষকের ক্লাস যখন আকর্ষণীয় হয় তখন ওই ক্লাস শিক্ষার্থীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে, অন্য কোন কিছু আর তাদের ধরে রাখতে পারে না। তারা ওই ক্লাসে যাবেই। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার অন্য কোন মন্ত্র নেই, মন্ত্র একটাই আর তা হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে আকর্ষণীয়, সুখময় ও আনন্দঘন শিখন শেখানোর পরিবেশ সৃষ্টি করা। কোন শিক্ষক যখন পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষক ডায়েরি অনুযায়ী পাঠ টিকা তৈরি করে উপকরণসহ ক্লাস গ্রহণ করে তখন শিখন শেখানোর প্রকৃত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যে শিক্ষক এই কাজটি ফলপ্রসূভাবে করতে পারেন, তিনিই স্বার্থক, শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস করার জন্য উদগ্রীব থাকে। মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে মজা পায় না। এখন যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস হয় তার মানও সন্তোষজনক নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরও নষ্ট, ফলে ক্লাসও ঠিকমত হয় না।
আবার ক্লাস না করলেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়, পরীক্ষায় ভালো করা যায় তাই তারা ক্লাসে আসে না। এটা শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ দুটোর দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে আসতে মজা পায় না, তাই আসে না। শিক্ষকের মধ্যে যদি আন্তরিকতার অভাব থাকে পেশাদারিত্বের অভাব থাকে দিয়ে কোনভাবেই সফল ক্লাস করানো সম্ভব নয়। নতুন কারিকুলাম এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে সবার প্রত্যাশা। শিক্ষকদের আন্তরিকতা বৃদ্ধির জন্য ২/৩ মাস পর পর উপজেলা পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ওয়ার্কশস করার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সক্রিয় বিবেচনা করতে পারেন।
কোন শিক্ষার্থী ৮০% ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে কোন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না এই রকম একটা বিধান করতে পারলে শিক্ষর্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে আশা করা যায়। তার আগে সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল হাজিরা চালু করা জরুরি।
শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন অভিভাবকের অসচেতনতা। গ্রামের তুলনায় শহরের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক বেশি। সচেতন অভিভাবকের তার অন্যতম কারণ। গুণগত শিক্ষার অন্যতম স্টেকহোল্ডার অভিভাবক। অভিভাবকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া গুণগত শিক্ষা সম্ভব নয়। সব অভিভাবকই তার সন্তানকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। সবাই চান তার সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু সন্তানকে মানুষ করতে হলে তার যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে সে সম্পর্কে সচেতন তারা নয়। বিশেষ করে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক শিক্ষিত অভিভাবকও সচেতন নয়।
অভিভাবকদের সচেতন করা না গেলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে না, ফলে গুণগত শিক্ষা অর্জন প্রায় অসম্ভব। অভিভাবকদের সচেতন করার জন্য বর্তমানে অভিভাবক সমাবেশ চালু আছে। এটা খুব বেশি কার্যকর নয়। কৃষি বিভাগের একটা নতুন জাতের বীজ আসলে সে সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অথচ সন্তান হলো একজন অভিভাবকের তথা দেশের অমূল্য সম্পদ। এই সন্তানকে সম্পদে রূপান্তর করতে হলে অভিভাবকের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ হওয়া জরুরি। সবার সম্ভব না হলে শুধু ৬ষ্ঠ শ্রেণী দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস শিক্ষর্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধিসহ গুণগত শিক্ষা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
আমাদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গন পরিচ্ছন্ন, গোছানো, আকর্ষণীয় নয়। আমাদের যতটুকু অবকাঠামো বা খেলার মাঠ আছে তা গোছানো নয়। মোট কথা প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কাছে কোন আকর্ষণীয় স্থান নয়। যতটুকু সম্পদ আছে সেটুকুই সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করতে পারলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়বে আশা করা যায়।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী থাকে, লাইব্রেরিতে যদি পর্যাপ্ত গল্পের বই থাকে, বিজ্ঞান ক্লাব, সাংস্কৃতিক ক্লাব, বির্তক ক্লাব, আই সি টি ক্লাব, স্কাউটিং ইত্যাদি সংগঠন সক্রিয় থাকে তবে দেখা যাবে খেলার আকর্ষণে ১০০ শিক্ষার্থী স্কুলে আসবে, বিজ্ঞান ক্লাবের ৫০ জন সদস্য, নাচ গান কবিতা আবৃতির আকর্ষণে আর ৫০ জন বিতর্ক ক্লাবের আরও ২৫ জন এই ভাবে শিক্ষার্থীদের যদি বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করা যায় তবে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা এত বেশি এ শিক্ষকের পক্ষে সবাই ছাত্রের সঠিক ভাবে সুপারভিশন করা সম্ভব হয় না। সেসব প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। যেহেতু শিক্ষকদের সবাই শিক্ষার্থীদের ওপর নজর রাখা সম্ভব হয় না- ফলে তারা স্কুলে আসলেও পালিয়ে যায়। কিছু প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্য অনেক কম আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে এত ছাত্র যে বসার জায়গা দিতে পারে না। এ কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি নীতিমালা এমনভাবে করা প্রয়োজন যাতে সবাই প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি সমান শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যেমন বৃদ্ধি পাবে অন্য দিকে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। অনেক শিক্ষার্থী আছে ভোর বেলা প্রাইভেট পড়তে যায় এর পর না খেয়েই স্কুলে আসে মিড ডে মিল চালু না থাকায় তারা টিফিনে স্কুল থেকে চলে যায়। মিড ডে মিল চালু করতে পারলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধিসহ স্কুল পালানোর সংখ্যা হ্রাস পাবে। টিফিন বাদ দিয়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত স্কুল সময় সূচি করলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে বলে অনেকে মত দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন দুপুর ২টা ৩০ থেকে ৫টা পর্যন্ত অনলাইনে টেলিভিশন বা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে খ্যাতিমান শিক্ষকদের দিয়ে গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানের মতো কিছু ক্লাস সারা বছর চালু রাখলে প্রাইভেটনির্ভরতা কমবে এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।
বাল্যবিবাহ শিক্ষার্থীর ক্লাসে অনুপস্থিতির আর একটি কারণ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। তার পরেও যাদের বিয়ে হয়ে যাবে তারা যাতে নিয়মিত স্কুল করতে না পারে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একজন বিবাহিত মেয়ে একশ অবিবাহিত মেয়ে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ঠ। যদি বিয়ে হয়েই যায় তবে সে বাড়িতে বসে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেন।
একজন শিক্ষার্থী যখন স্কুলে ভর্তি হয় তখন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, বেতন, আচরণ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলা এবং উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে।
এখন প্রতিটি স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ছেলেদের থেকে মেয়েদের উপস্থিতিও বেশি। কিন্তু পিরিয়ডের কারণে অনেক সময় অনেক মেয়েদের উপস্থিতিতি কমে যায়। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে হাইজিন কর্নার গড়ে তুলতে পারলে এই সমস্যা অনেকখানি সমাধান হবে আশা করা যায়।
সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল হাজিরা এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল হাজিরা সংযোজন করা গেলে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জবাবদিহিতা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও বাড়বে। সেইসঙ্গে শিক্ষকদের হোম ভিজিট অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি শিক্ষকদের আন্তরিকতা বৃদ্ধি ছাড়া কোন কার্যক্রমই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলে এস ডি জি-৪ অর্জন সহজ হবে।
[লেখক: উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার,
গোয়ালন্দ. রাজবাড়ী]
ইকবাল হাসান
বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০২৩
অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতি একটা বড় অন্তরায় হতে পারে। শিশুদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে জরিপ চালিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। এতে সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের ভিত্তিতে ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্র্ভে ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ। জরিপের ফলাফল বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতির হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনুপস্থিত থাকছে। মেয়েদের থেকে ছেলেদের অনুপস্থিতির হার আরও বেশি। অনেকে আবার স্কুলে এসেও টিফিনের পর পালিয়ে যায়। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রথম ধাপই হলো বিদ্যালয়ের অনুপস্থিতি। এখনই এ সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ না নিলে এস ডি জি-৪ অর্জন অসম্ভব হয়ে যাবে। কেন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিম্নলিখিত কারণ সমূহ চিহ্নিত করা হলো :
পরিকল্পিত ও আকর্ষণীয় শ্রেণী কার্যক্রম না হওয়া। শিক্ষকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব। অভিভাবকদের অসচেতনতা। ক্লাস না করলেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে আসতে আনন্দ পায় না। দারিদ্রতা। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ আকর্ষণীয় না হওয়া। পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রীর অভাব। কিছু প্রতিষ্ঠানে ক্লাস সাইজ বড় হওয়া। দুপুরে স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা না থাকা। বাল্যবিবাহ। ভৌগলিক কারণ যেমন- পাহাড়, হাওর, উপকূল ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের জেলাগুলোয় শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার সবচেয়ে কম। প্রতিষ্ঠান ও অভিবাবকদের মধ্যে কোন কোড অব কন্ডাক্ট না থাকা। ছাত্রীদের জন্য হাইজিন কর্নার না থাকা। উপস্থিতির বিষয়টি মনিটর করার জন্য ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার না থাকা।
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিতির কারণ বিবিধ। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিদ্যালয় ও পরিবার এজন্য দায়ী। এর পরে বলা যায় শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠদান পদ্ধতি এজন্য দায়ী। একজন শিক্ষকের ক্লাস যখন আকর্ষণীয় হয় তখন ওই ক্লাস শিক্ষার্থীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে, অন্য কোন কিছু আর তাদের ধরে রাখতে পারে না। তারা ওই ক্লাসে যাবেই। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার অন্য কোন মন্ত্র নেই, মন্ত্র একটাই আর তা হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে আকর্ষণীয়, সুখময় ও আনন্দঘন শিখন শেখানোর পরিবেশ সৃষ্টি করা। কোন শিক্ষক যখন পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষক ডায়েরি অনুযায়ী পাঠ টিকা তৈরি করে উপকরণসহ ক্লাস গ্রহণ করে তখন শিখন শেখানোর প্রকৃত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যে শিক্ষক এই কাজটি ফলপ্রসূভাবে করতে পারেন, তিনিই স্বার্থক, শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস করার জন্য উদগ্রীব থাকে। মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে মজা পায় না। এখন যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস হয় তার মানও সন্তোষজনক নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরও নষ্ট, ফলে ক্লাসও ঠিকমত হয় না।
আবার ক্লাস না করলেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়, পরীক্ষায় ভালো করা যায় তাই তারা ক্লাসে আসে না। এটা শিক্ষাপদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ দুটোর দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে আসতে মজা পায় না, তাই আসে না। শিক্ষকের মধ্যে যদি আন্তরিকতার অভাব থাকে পেশাদারিত্বের অভাব থাকে দিয়ে কোনভাবেই সফল ক্লাস করানো সম্ভব নয়। নতুন কারিকুলাম এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে সবার প্রত্যাশা। শিক্ষকদের আন্তরিকতা বৃদ্ধির জন্য ২/৩ মাস পর পর উপজেলা পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ওয়ার্কশস করার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সক্রিয় বিবেচনা করতে পারেন।
কোন শিক্ষার্থী ৮০% ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে কোন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না এই রকম একটা বিধান করতে পারলে শিক্ষর্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে আশা করা যায়। তার আগে সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল হাজিরা চালু করা জরুরি।
শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন অভিভাবকের অসচেতনতা। গ্রামের তুলনায় শহরের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক বেশি। সচেতন অভিভাবকের তার অন্যতম কারণ। গুণগত শিক্ষার অন্যতম স্টেকহোল্ডার অভিভাবক। অভিভাবকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া গুণগত শিক্ষা সম্ভব নয়। সব অভিভাবকই তার সন্তানকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। সবাই চান তার সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু সন্তানকে মানুষ করতে হলে তার যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে সে সম্পর্কে সচেতন তারা নয়। বিশেষ করে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক শিক্ষিত অভিভাবকও সচেতন নয়।
অভিভাবকদের সচেতন করা না গেলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে না, ফলে গুণগত শিক্ষা অর্জন প্রায় অসম্ভব। অভিভাবকদের সচেতন করার জন্য বর্তমানে অভিভাবক সমাবেশ চালু আছে। এটা খুব বেশি কার্যকর নয়। কৃষি বিভাগের একটা নতুন জাতের বীজ আসলে সে সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অথচ সন্তান হলো একজন অভিভাবকের তথা দেশের অমূল্য সম্পদ। এই সন্তানকে সম্পদে রূপান্তর করতে হলে অভিভাবকের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ হওয়া জরুরি। সবার সম্ভব না হলে শুধু ৬ষ্ঠ শ্রেণী দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস শিক্ষর্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধিসহ গুণগত শিক্ষা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
আমাদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গন পরিচ্ছন্ন, গোছানো, আকর্ষণীয় নয়। আমাদের যতটুকু অবকাঠামো বা খেলার মাঠ আছে তা গোছানো নয়। মোট কথা প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কাছে কোন আকর্ষণীয় স্থান নয়। যতটুকু সম্পদ আছে সেটুকুই সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করতে পারলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়বে আশা করা যায়।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী থাকে, লাইব্রেরিতে যদি পর্যাপ্ত গল্পের বই থাকে, বিজ্ঞান ক্লাব, সাংস্কৃতিক ক্লাব, বির্তক ক্লাব, আই সি টি ক্লাব, স্কাউটিং ইত্যাদি সংগঠন সক্রিয় থাকে তবে দেখা যাবে খেলার আকর্ষণে ১০০ শিক্ষার্থী স্কুলে আসবে, বিজ্ঞান ক্লাবের ৫০ জন সদস্য, নাচ গান কবিতা আবৃতির আকর্ষণে আর ৫০ জন বিতর্ক ক্লাবের আরও ২৫ জন এই ভাবে শিক্ষার্থীদের যদি বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করা যায় তবে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা এত বেশি এ শিক্ষকের পক্ষে সবাই ছাত্রের সঠিক ভাবে সুপারভিশন করা সম্ভব হয় না। সেসব প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। যেহেতু শিক্ষকদের সবাই শিক্ষার্থীদের ওপর নজর রাখা সম্ভব হয় না- ফলে তারা স্কুলে আসলেও পালিয়ে যায়। কিছু প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংখ্য অনেক কম আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে এত ছাত্র যে বসার জায়গা দিতে পারে না। এ কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি নীতিমালা এমনভাবে করা প্রয়োজন যাতে সবাই প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি সমান শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যেমন বৃদ্ধি পাবে অন্য দিকে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। অনেক শিক্ষার্থী আছে ভোর বেলা প্রাইভেট পড়তে যায় এর পর না খেয়েই স্কুলে আসে মিড ডে মিল চালু না থাকায় তারা টিফিনে স্কুল থেকে চলে যায়। মিড ডে মিল চালু করতে পারলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধিসহ স্কুল পালানোর সংখ্যা হ্রাস পাবে। টিফিন বাদ দিয়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত স্কুল সময় সূচি করলে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে বলে অনেকে মত দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন দুপুর ২টা ৩০ থেকে ৫টা পর্যন্ত অনলাইনে টেলিভিশন বা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে খ্যাতিমান শিক্ষকদের দিয়ে গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানের মতো কিছু ক্লাস সারা বছর চালু রাখলে প্রাইভেটনির্ভরতা কমবে এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।
বাল্যবিবাহ শিক্ষার্থীর ক্লাসে অনুপস্থিতির আর একটি কারণ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। তার পরেও যাদের বিয়ে হয়ে যাবে তারা যাতে নিয়মিত স্কুল করতে না পারে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একজন বিবাহিত মেয়ে একশ অবিবাহিত মেয়ে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ঠ। যদি বিয়ে হয়েই যায় তবে সে বাড়িতে বসে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেন।
একজন শিক্ষার্থী যখন স্কুলে ভর্তি হয় তখন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, বেতন, আচরণ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলা এবং উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে।
এখন প্রতিটি স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ছেলেদের থেকে মেয়েদের উপস্থিতিও বেশি। কিন্তু পিরিয়ডের কারণে অনেক সময় অনেক মেয়েদের উপস্থিতিতি কমে যায়। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে হাইজিন কর্নার গড়ে তুলতে পারলে এই সমস্যা অনেকখানি সমাধান হবে আশা করা যায়।
সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল হাজিরা এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল হাজিরা সংযোজন করা গেলে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জবাবদিহিতা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও বাড়বে। সেইসঙ্গে শিক্ষকদের হোম ভিজিট অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি শিক্ষকদের আন্তরিকতা বৃদ্ধি ছাড়া কোন কার্যক্রমই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলে এস ডি জি-৪ অর্জন সহজ হবে।
[লেখক: উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার,
গোয়ালন্দ. রাজবাড়ী]