গোপাল অধিকারী
২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধবিষয়ক ঐতিহাসিক এক রেজুলেশন ২৮ এপ্রিল ২০২১ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে গৃহীত এই রেজুলেশনটি উত্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। রেজুলেশনটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারী’ হিসেবে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের রেজুলেশন এটাই প্রথম।
পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, জাতীয় পদক্ষেপকে উৎসাহিত করা এবং এ বিষয়ক সর্বোত্তম অনুশীলন ও সমাধানসমূহ পারষ্পরিকভাবে ভাগ করে নেয়ার লক্ষ্যে ২৫ জুলাইকে বিশ্ব ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ পরিষদ। নীরব এই বৈশ্বিক মহামারীর বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন গত ২০১৮ সালে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের পাশাপাশি রেজুলেশনটিতে সহ-নেতৃত্ব দেয় আয়ারল্যান্ড, আর এতে সহ-পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ৮১টি দেশ। বর্তমান সময়ের উপযোগী সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বলা যায়।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু, বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে এই বর্ষা মৌসমে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে চোখে পড়বেই। প্রাণ হারানোর দিক থেকে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা নিউমোনিয়া রোগের পরই পানিতে ডুবে বেশি প্রাণ হারায়। বিশেষ করে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা বেশি এই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। কী মর্মান্তিক ও বেদনাবিধূর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৮৭৫টি ঘটনায় সারাদেশে ১১৬৪ শিশুসহ মোট ১৪০২ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। মৃতদের ৮৩ শতাংশই শিশু। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ও স্থানীয় পর্যায়ের অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত ঘটনা থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে চার বছর বা কম বয়সী ৫৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩৬৩ জন, ১০ থেকে ১৪ বছরের ১০২ এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে আগে জানতে হবে কোন কোন কারণে শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে; পরে এর প্রতিরোধব্যবস্থার বিষয়ে জানতে হবে। শিশুদের পানিতে ডোবার অন্যতম কারণ হলো মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যদের অসচেতনতা। গ্রামে দেখা যায়, বাবারা জীবিকার তাগিদে বেশি সময় বাইরে বাইরে থাকেন এবং মায়েরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গৃহস্থালি কাজের ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাচ্চাকে সঠিকভাবে দেখাশোনা করতে পারেন না। ফলে একটা বাচ্চা তার মায়ের দৃষ্টিগোচরে বাড়ির পাশে পুকুর বা জলাশয়ের কাছে গিয়ে কৌতূহলবশত পানিতে নেমে যায় এবং সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়।
এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো সঠিক তত্ত্বাবধান ও শিক্ষার অভাব। একটি শিশুকে সাঁতার শেখানোর সঠিক বয়স পাঁচ বছর। কিন্তু সাঁতার শেখানোর পর্যাপ্ত বয়সেও একটা শিশুকে সাঁতার শেখানো হচ্ছে না, ফলে একটি শিশুর সাঁতার শেখার পর্যাপ্ত বয়স থাকা সত্ত্বেও পানিতে ডুবে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। সাঁতার শেখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি শিশুকে অবগত করতে হবে। একজন শ্রেণীশিক্ষকও এ ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তিনি সাঁতার শেখার শারীরিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সাঁতার শিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
বাড়ির পাশে অপ্রয়োজনীয় ডোবা বা জলাশয় থাকাটাও শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তাই আমরা একটি শিশুর অকালমৃত্যু ঠেকাতে বেশ কিছু প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে পারি। বাড়ির পাশের পুকুর বা জলাশয়ের চারদিকে বেড়া দিতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় পুকুর বা গর্ত-ডোবা থাকলে বন্ধ করে দিতে হবে। এ প্রতিরোধব্যবস্থার মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রতিটি দিবসই আসে কিছু সচেতনতা নিয়ে। দিবসটি উপলক্ষে হলেও আমরা যদি এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে পারি বা সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে পারি অথবা কারণ ও প্রতিকার আলোচনা করতে পারি তাহলেই ক্ষতিকর দিকগুলো কাটিয়ে ইতিবাচক দিকে ধাবিত হওয়া সম্ভব। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিশ্ব ‘পানিতে ডুবে-মৃত্যু প্রতিরোধ দিবসের প্রচলন। দিবসটি উপলক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হোক। সমাজের সবাইকে সচেতন করার মাধ্যমে এই নীরব মহামারীর হাত থেকে দেশ বাঁচুক, বিশ্ব বাঁচুক সেই প্রত্যাশা রইল। আসুন আমরা সচেতন হই, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু থেকে দেশকে রক্ষা করি, সচেতনতায় এগিয়ে আসি। আগামী বছরে যেন এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যানে আমরা বিচলিত না হয় সেদিকে নজর রাখি।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
গোপাল অধিকারী
সোমবার, ২৪ জুলাই ২০২৩
২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস। পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধবিষয়ক ঐতিহাসিক এক রেজুলেশন ২৮ এপ্রিল ২০২১ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে গৃহীত এই রেজুলেশনটি উত্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। রেজুলেশনটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারী’ হিসেবে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের রেজুলেশন এটাই প্রথম।
পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, জাতীয় পদক্ষেপকে উৎসাহিত করা এবং এ বিষয়ক সর্বোত্তম অনুশীলন ও সমাধানসমূহ পারষ্পরিকভাবে ভাগ করে নেয়ার লক্ষ্যে ২৫ জুলাইকে বিশ্ব ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ পরিষদ। নীরব এই বৈশ্বিক মহামারীর বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন গত ২০১৮ সালে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের পাশাপাশি রেজুলেশনটিতে সহ-নেতৃত্ব দেয় আয়ারল্যান্ড, আর এতে সহ-পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ৮১টি দেশ। বর্তমান সময়ের উপযোগী সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বলা যায়।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু, বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে এই বর্ষা মৌসমে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে চোখে পড়বেই। প্রাণ হারানোর দিক থেকে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা নিউমোনিয়া রোগের পরই পানিতে ডুবে বেশি প্রাণ হারায়। বিশেষ করে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা বেশি এই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। কী মর্মান্তিক ও বেদনাবিধূর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৮৭৫টি ঘটনায় সারাদেশে ১১৬৪ শিশুসহ মোট ১৪০২ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। মৃতদের ৮৩ শতাংশই শিশু। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ও স্থানীয় পর্যায়ের অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত ঘটনা থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে চার বছর বা কম বয়সী ৫৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩৬৩ জন, ১০ থেকে ১৪ বছরের ১০২ এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।
পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার কমাতে আগে জানতে হবে কোন কোন কারণে শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে; পরে এর প্রতিরোধব্যবস্থার বিষয়ে জানতে হবে। শিশুদের পানিতে ডোবার অন্যতম কারণ হলো মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যদের অসচেতনতা। গ্রামে দেখা যায়, বাবারা জীবিকার তাগিদে বেশি সময় বাইরে বাইরে থাকেন এবং মায়েরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গৃহস্থালি কাজের ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাচ্চাকে সঠিকভাবে দেখাশোনা করতে পারেন না। ফলে একটা বাচ্চা তার মায়ের দৃষ্টিগোচরে বাড়ির পাশে পুকুর বা জলাশয়ের কাছে গিয়ে কৌতূহলবশত পানিতে নেমে যায় এবং সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়।
এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো সঠিক তত্ত্বাবধান ও শিক্ষার অভাব। একটি শিশুকে সাঁতার শেখানোর সঠিক বয়স পাঁচ বছর। কিন্তু সাঁতার শেখানোর পর্যাপ্ত বয়সেও একটা শিশুকে সাঁতার শেখানো হচ্ছে না, ফলে একটি শিশুর সাঁতার শেখার পর্যাপ্ত বয়স থাকা সত্ত্বেও পানিতে ডুবে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। সাঁতার শেখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি শিশুকে অবগত করতে হবে। একজন শ্রেণীশিক্ষকও এ ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তিনি সাঁতার শেখার শারীরিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সাঁতার শিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
বাড়ির পাশে অপ্রয়োজনীয় ডোবা বা জলাশয় থাকাটাও শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তাই আমরা একটি শিশুর অকালমৃত্যু ঠেকাতে বেশ কিছু প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে পারি। বাড়ির পাশের পুকুর বা জলাশয়ের চারদিকে বেড়া দিতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় পুকুর বা গর্ত-ডোবা থাকলে বন্ধ করে দিতে হবে। এ প্রতিরোধব্যবস্থার মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রতিটি দিবসই আসে কিছু সচেতনতা নিয়ে। দিবসটি উপলক্ষে হলেও আমরা যদি এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে পারি বা সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে পারি অথবা কারণ ও প্রতিকার আলোচনা করতে পারি তাহলেই ক্ষতিকর দিকগুলো কাটিয়ে ইতিবাচক দিকে ধাবিত হওয়া সম্ভব। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিশ্ব ‘পানিতে ডুবে-মৃত্যু প্রতিরোধ দিবসের প্রচলন। দিবসটি উপলক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হোক। সমাজের সবাইকে সচেতন করার মাধ্যমে এই নীরব মহামারীর হাত থেকে দেশ বাঁচুক, বিশ্ব বাঁচুক সেই প্রত্যাশা রইল। আসুন আমরা সচেতন হই, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু থেকে দেশকে রক্ষা করি, সচেতনতায় এগিয়ে আসি। আগামী বছরে যেন এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যানে আমরা বিচলিত না হয় সেদিকে নজর রাখি।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]