alt

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবার : বিশ্বের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান

জিল্লুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪

পরিবার হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এবং এ কারণে পরিবারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে পরিবারে একজন মানুষ সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সাংস্কৃতিক পরিসরে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারকে বলা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা ও দায়িত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারই একজন মানুষের সর্বপ্রথম আশ্রয়স্থল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।

১৫ মে ছিল বিশ্ব পরিবার দিবস। পরিবারের প্রতি গুরুত্ব ও সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ১৫ মে তারিখে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে দুনিয়াজুড়ে পরিবারের জীবনযাত্রারমান উন্নত করতে ও পরিবারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের ঘোষণা করে। এই বিশেষ দিনটি পালনের পিছনে যে কারণটি নিহিত রয়েছে তা হল সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার একটি সুষ্ঠু পরিবার। ছোট-বড় সকল সদস্যের নিরাপদ ও নিশ্চিত জায়গা হল পরিবার। পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো ও ঐতিহ্য যাতে অটুট থাকে, আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো যাতে পরিবারগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দারিদ্র্য, পরিবারের কাজের সামঞ্জস্য বজায় রাখার লক্ষ্যেই এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।

সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পরিবার হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তিভূমি। পরিবারই সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার সূচনা করে। পরিবারকে সমাজ দেহের হৃৎপি-ের সাথে তুলনা করা চলে। এই হৃৎপি- যদি দুর্বল বা বিকল হয়ে পড়ে তাহলে পুরো সমাজ ব্যবস্থাই বিকল হয়ে যায়। সমাজ জীবনের মূল্যবোধের যত অবক্ষয় ঘটেছে তার অধিকাংশেরই কারণ বিশ্লেষণে দুর্বল পারিবারিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। পরিবার শিশুর প্রাথমিক ও নৈতিক শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। এখান থেকেই তার চরিত্রের ভিত্তি গড়ে উঠে। তাই পরিবারে মা-বাবার প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে সন্তানকে শৈশব থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। সন্তানকে মাঝেমধ্যে কাছে কিংবা দূরে কোথাও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হয়। ভ্রমণেও শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। বর্তমান শহুরে সমাজে অনেক পরিবারের অভিভাবক পিতা মাতা উভয়ই নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকে। ফলে তাদের কাছ থেকে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য তা থেকে সে বঞ্চিত হয়। তাই কার্টুন ছবি দেখে আর মোবাইল-গেম খেলে শিশু সময় কাটায়। এতে তার মস্তিষ্ক ধারণ করে যতসব উদ্ভট চিন্তা।

পরিবারের যৌথ কাঠামো এই সামাজিক বন্ধন ও নৈতিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। বড়দের মান্য করা, প্রত্যেক সম্পর্ককে সম্মান করা, এসব কিছুই তারা গুরুজনদের কাছ থেকে শিখে। সেই পারিবারিক সম্পর্ক এখন দ্বিখন্ডিত হয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার হচ্ছে এবং এ কারণে সবাই এখন চারপাশের জীবন ও জীবিকা নিয়ে মহা ব্যস্ত। ফলে অসুখী দাম্পত্য জীবন, সন্তানের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে, চাওয়া-পাওয়া আর উন্নতির চক্রে ঘুরছে সবকিছু। পরিবার থেকে সন্তানরা সামাজিক অনুশাসন মূল্যবোধ না শিখায় ভাল মন্দ বুঝতে পারছে না।

অন্যদিকে বর্তমান সময়ে আধুনিক নগরায়ন ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ নানান কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। কারণ সময়ের সাথে সাথে সামাজিক বন্ধন এবং পারিবারিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট সেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রবীণ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। পারিবারিক ভাঙনে যৌথ পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা। যার কারণে শেষ বয়সে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে।

পারিবারিক অনুশাসনের বাইরে চলে যাওয়ায় অভদ্রতা, অসম্মান করা আধুনিক ও স্মার্টনেস জ্ঞান বলে মনে করছে। ভদ্রতা, সম্মান করা এই সকল বিষয় পরিবারের কাঠামো দাদা-দাদি, ফুফু, চাচা-চাচিদের কাছ থেকে শিখবে। কিন্তু যৌথ থেকে একক পরিবারে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে শিশুটি কাজের মানুষটির কাছে সার্বক্ষনিক থাকায় কিছুই শিখতে পারছে না। তাই শিশুর আদর্শিক জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন যৌথ পরিবার। আসলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধন। এগুলো এখন শুধু সোনালি অতীত মনে করিয়ে দেয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু নিয়মনীতি আছে তেমনি পরিবারেরও নিয়মনীতি রয়েছে। যেমন- পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যা না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা প্রভৃতি। মানবজীবনে প্রত্যেক মানুষের জন্য এই পারিবারিক শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলো আয়ত্ত করতে পরিবার-ই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। নানাবিধ চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ শেখা, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা, উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না অর্জন করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবার থেকে অর্জন করা যায়।

মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরিত্রের প্রয়োজনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করে। পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপালনে পিতা মাতার ভূমিকা ব্যাপক। পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য বাবা-মা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসা দরকার। কেবল মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলী বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলীসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।

পারিবারিক একাত্মতা জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলে। সমাজ বিজ্ঞানীরা রীতিমতো জোর দিয়ে বলছেন, পারিবারিক সম্প্রীতির সাথে মানুষের দীর্ঘায়ু অর্জনের সম্পর্কটা একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত। তাদের মতে, বাবা-মা, সন্তান ও ভাইবোনদের সাথে কাটানো আনন্দঘন মুহূর্ত দীর্ঘায়ু লাভে বিশেষভাবে সহায়ক। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন যাদের দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটতে পারে। পারিবারিক একাত্মতার সুফল মানুষ পেতে শুরু করে জীবনের গোড়া থেকেই। যেসব পরিবারে বাবা-মা ও সন্তানদের মাঝে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজমান, ক্যান্সারের মতো অসুখে পড়ার সম্ভাবনাও তাদের কম এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেসব পরিবারে একত্রে খাওয়া দাওয়ার রীতি চালু আছে, তারা তুলনামূলক সুস্থ খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত।

বিশ্বজুড়ে আধুনিক ধারার সমাজবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য-গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণার ভিত্তিতে এটা আজ প্রমাণিত সত্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক একাত্মতা একজন মানুষকে সুস্থ সুখী সফল জীবনের পথে চালিত করে। তাই আমাদেরও উচিত এ যূথবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতিটি সুযোগকেই কাজে লাগানো এবং প্রয়োজন আমাদের উত্তর প্রজন্মকেও সাধ্যমতো এমন জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলা। তাই যে কোনো বিষয়ে পারিবারিক আলোচনা, পরিবারের সবাই অন্তত একবেলা একসাথে খাওয়া ইত্যাদি আচরণ-অভ্যাসের পাশাপাশি সঙ্ঘবদ্ধভাবে নৈতিকতার চর্চায়ও মনোযোগী হওয়া দরকার।

[লেখক : ব্যাংকার]

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পোস্টমর্টেম প্রসঙ্গে

রাজনীতির লালসালু ও ময়না দ্বীপ : জনগণের আস্থার সংকট

প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব কি বাস্তবসম্মত

‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ও সাধারণ গ্রামবাসী

রম্যগদ্য : ‘ধেয়ে আসছে বুলেট’

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

অপরিকল্পিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি

ছবি

‘বেগমপাড়া’ হইতে খোলা চিঠি

সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে

মকর সংক্রান্তি : বাঙালির উৎসব ও ঐতিহ্যের ধারক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : অপসংস্কৃতি ও নৈতিক প্রশ্ন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

রজিনাদের বেঁচে থাকার লড়াই

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পরিবার : বিশ্বের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান

জিল্লুর রহমান

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪

পরিবার হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এবং এ কারণে পরিবারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে পরিবারে একজন মানুষ সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও সাংস্কৃতিক পরিসরে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারকে বলা হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়না। রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা ও দায়িত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারই একজন মানুষের সর্বপ্রথম আশ্রয়স্থল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।

১৫ মে ছিল বিশ্ব পরিবার দিবস। পরিবারের প্রতি গুরুত্ব ও সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ১৫ মে তারিখে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে দুনিয়াজুড়ে পরিবারের জীবনযাত্রারমান উন্নত করতে ও পরিবারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের ঘোষণা করে। এই বিশেষ দিনটি পালনের পিছনে যে কারণটি নিহিত রয়েছে তা হল সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার একটি সুষ্ঠু পরিবার। ছোট-বড় সকল সদস্যের নিরাপদ ও নিশ্চিত জায়গা হল পরিবার। পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো ও ঐতিহ্য যাতে অটুট থাকে, আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো যাতে পরিবারগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দারিদ্র্য, পরিবারের কাজের সামঞ্জস্য বজায় রাখার লক্ষ্যেই এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।

সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পরিবার হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তিভূমি। পরিবারই সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার সূচনা করে। পরিবারকে সমাজ দেহের হৃৎপি-ের সাথে তুলনা করা চলে। এই হৃৎপি- যদি দুর্বল বা বিকল হয়ে পড়ে তাহলে পুরো সমাজ ব্যবস্থাই বিকল হয়ে যায়। সমাজ জীবনের মূল্যবোধের যত অবক্ষয় ঘটেছে তার অধিকাংশেরই কারণ বিশ্লেষণে দুর্বল পারিবারিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। পরিবার শিশুর প্রাথমিক ও নৈতিক শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। এখান থেকেই তার চরিত্রের ভিত্তি গড়ে উঠে। তাই পরিবারে মা-বাবার প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে সন্তানকে শৈশব থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। সন্তানকে মাঝেমধ্যে কাছে কিংবা দূরে কোথাও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হয়। ভ্রমণেও শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। বর্তমান শহুরে সমাজে অনেক পরিবারের অভিভাবক পিতা মাতা উভয়ই নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকে। ফলে তাদের কাছ থেকে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য তা থেকে সে বঞ্চিত হয়। তাই কার্টুন ছবি দেখে আর মোবাইল-গেম খেলে শিশু সময় কাটায়। এতে তার মস্তিষ্ক ধারণ করে যতসব উদ্ভট চিন্তা।

পরিবারের যৌথ কাঠামো এই সামাজিক বন্ধন ও নৈতিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। বড়দের মান্য করা, প্রত্যেক সম্পর্ককে সম্মান করা, এসব কিছুই তারা গুরুজনদের কাছ থেকে শিখে। সেই পারিবারিক সম্পর্ক এখন দ্বিখন্ডিত হয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার হচ্ছে এবং এ কারণে সবাই এখন চারপাশের জীবন ও জীবিকা নিয়ে মহা ব্যস্ত। ফলে অসুখী দাম্পত্য জীবন, সন্তানের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে, চাওয়া-পাওয়া আর উন্নতির চক্রে ঘুরছে সবকিছু। পরিবার থেকে সন্তানরা সামাজিক অনুশাসন মূল্যবোধ না শিখায় ভাল মন্দ বুঝতে পারছে না।

অন্যদিকে বর্তমান সময়ে আধুনিক নগরায়ন ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ নানান কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। কারণ সময়ের সাথে সাথে সামাজিক বন্ধন এবং পারিবারিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট সেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রবীণ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। পারিবারিক ভাঙনে যৌথ পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা। যার কারণে শেষ বয়সে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে।

পারিবারিক অনুশাসনের বাইরে চলে যাওয়ায় অভদ্রতা, অসম্মান করা আধুনিক ও স্মার্টনেস জ্ঞান বলে মনে করছে। ভদ্রতা, সম্মান করা এই সকল বিষয় পরিবারের কাঠামো দাদা-দাদি, ফুফু, চাচা-চাচিদের কাছ থেকে শিখবে। কিন্তু যৌথ থেকে একক পরিবারে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে শিশুটি কাজের মানুষটির কাছে সার্বক্ষনিক থাকায় কিছুই শিখতে পারছে না। তাই শিশুর আদর্শিক জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন যৌথ পরিবার। আসলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধন। এগুলো এখন শুধু সোনালি অতীত মনে করিয়ে দেয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু নিয়মনীতি আছে তেমনি পরিবারেরও নিয়মনীতি রয়েছে। যেমন- পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যা না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা প্রভৃতি। মানবজীবনে প্রত্যেক মানুষের জন্য এই পারিবারিক শিক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলো আয়ত্ত করতে পরিবার-ই সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। নানাবিধ চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ শেখা, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা, উদার মানসিকতাবোধ জাগ্রত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যতটা না অর্জন করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবার থেকে অর্জন করা যায়।

মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরিত্রের প্রয়োজনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করে। পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপালনে পিতা মাতার ভূমিকা ব্যাপক। পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য বাবা-মা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসা দরকার। কেবল মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলী বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলীসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।

পারিবারিক একাত্মতা জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলে। সমাজ বিজ্ঞানীরা রীতিমতো জোর দিয়ে বলছেন, পারিবারিক সম্প্রীতির সাথে মানুষের দীর্ঘায়ু অর্জনের সম্পর্কটা একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত। তাদের মতে, বাবা-মা, সন্তান ও ভাইবোনদের সাথে কাটানো আনন্দঘন মুহূর্ত দীর্ঘায়ু লাভে বিশেষভাবে সহায়ক। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন যাদের দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটতে পারে। পারিবারিক একাত্মতার সুফল মানুষ পেতে শুরু করে জীবনের গোড়া থেকেই। যেসব পরিবারে বাবা-মা ও সন্তানদের মাঝে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজমান, ক্যান্সারের মতো অসুখে পড়ার সম্ভাবনাও তাদের কম এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেসব পরিবারে একত্রে খাওয়া দাওয়ার রীতি চালু আছে, তারা তুলনামূলক সুস্থ খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত।

বিশ্বজুড়ে আধুনিক ধারার সমাজবিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য-গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণার ভিত্তিতে এটা আজ প্রমাণিত সত্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক একাত্মতা একজন মানুষকে সুস্থ সুখী সফল জীবনের পথে চালিত করে। তাই আমাদেরও উচিত এ যূথবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতিটি সুযোগকেই কাজে লাগানো এবং প্রয়োজন আমাদের উত্তর প্রজন্মকেও সাধ্যমতো এমন জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলা। তাই যে কোনো বিষয়ে পারিবারিক আলোচনা, পরিবারের সবাই অন্তত একবেলা একসাথে খাওয়া ইত্যাদি আচরণ-অভ্যাসের পাশাপাশি সঙ্ঘবদ্ধভাবে নৈতিকতার চর্চায়ও মনোযোগী হওয়া দরকার।

[লেখক : ব্যাংকার]

back to top