জয়নুল হক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে এক যুবককে ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে অমানুষিক নির্যাতন করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায়। এক রাতে দেশের সর্বোচ্চ দুটি বিদ্যাপীঠে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা কখনো ভালো বার্তা বহন করে না। সত্যিকারের অপরাধীর অবশ্যই সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বিচারবহির্ভূতভাবে যে কোন অপরাধীকেও কোন ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন করা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সব নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে। একজন ভুক্তভোগীর যেমন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে তেমনি একজন অপরাধীরও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে অপরাধের সঠিক শাস্তির নিশ্চয়তা বিধানের অধিকার আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইনবহির্ভূতভাবে অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর করার মতো ঘটনা ব্যাপক আকারে সংগঠিত হচ্ছে। যা ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে পরিগনিত।
মব জাস্টিস বলতে সাধারণভাবে বোঝায় জনতার আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে তুলে নেয়া। এছাড়া জনতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মব জাস্টিসের অংশ।
মূলত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর দেশজুড়ে বড় আকারে ‘মব জাস্টিস’ শুরু হয়। তবে বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে সেটা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।
সম্প্রতি এমন আরও ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী ও গোপালগঞ্জে। গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এসব বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত ব্যক্তিরা কেউবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আবার কেউ মানসিক বিকারগ্রস্ত। এসব ব্যক্তির পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? তাদের কি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব অপরাধেরই শাস্তির বিধান আছে। সে অনুযায়ী বিচার নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তা অনুসরণ না করে অন্যায়ভাবে যে কোন ব্যক্তিকে এভাবে অত্যাচার, নিপীড়ন করা কোনভাবেই কাম্য নয়। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৃথক দুটি ঘটনায় আমাদের সোচ্চার হতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী, নেতানেত্রী তৈরি হয়, ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেয়া হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা জাতির জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। গত জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সুদীর্ঘ জঞ্জাল কাটিয়ে আমরা যে ন্যায় ও সত্যের নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, এসব ঘটনা সে পথে চরম বাধা।
এসব মব জাস্টিস প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রচলিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছি সেভাবে মব জাস্টিসের বিরুদ্ধেও গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার দুঃসাহস করতে না পারে। সর্বোপরী, ভুক্তভোগী-অপরাধী, ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সব নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা বিধান নিশ্চিত করে মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]
জয়নুল হক
রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে এক যুবককে ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে অমানুষিক নির্যাতন করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায়। এক রাতে দেশের সর্বোচ্চ দুটি বিদ্যাপীঠে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা কখনো ভালো বার্তা বহন করে না। সত্যিকারের অপরাধীর অবশ্যই সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বিচারবহির্ভূতভাবে যে কোন অপরাধীকেও কোন ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন করা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সব নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে। একজন ভুক্তভোগীর যেমন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে তেমনি একজন অপরাধীরও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে অপরাধের সঠিক শাস্তির নিশ্চয়তা বিধানের অধিকার আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইনবহির্ভূতভাবে অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর করার মতো ঘটনা ব্যাপক আকারে সংগঠিত হচ্ছে। যা ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে পরিগনিত।
মব জাস্টিস বলতে সাধারণভাবে বোঝায় জনতার আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে তুলে নেয়া। এছাড়া জনতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মব জাস্টিসের অংশ।
মূলত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর দেশজুড়ে বড় আকারে ‘মব জাস্টিস’ শুরু হয়। তবে বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে সেটা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।
সম্প্রতি এমন আরও ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী ও গোপালগঞ্জে। গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এসব বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত ব্যক্তিরা কেউবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আবার কেউ মানসিক বিকারগ্রস্ত। এসব ব্যক্তির পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে? তাদের কি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব অপরাধেরই শাস্তির বিধান আছে। সে অনুযায়ী বিচার নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তা অনুসরণ না করে অন্যায়ভাবে যে কোন ব্যক্তিকে এভাবে অত্যাচার, নিপীড়ন করা কোনভাবেই কাম্য নয়। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৃথক দুটি ঘটনায় আমাদের সোচ্চার হতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী, নেতানেত্রী তৈরি হয়, ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেয়া হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা জাতির জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। গত জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সুদীর্ঘ জঞ্জাল কাটিয়ে আমরা যে ন্যায় ও সত্যের নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, এসব ঘটনা সে পথে চরম বাধা।
এসব মব জাস্টিস প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রচলিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছি সেভাবে মব জাস্টিসের বিরুদ্ধেও গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার দুঃসাহস করতে না পারে। সর্বোপরী, ভুক্তভোগী-অপরাধী, ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সব নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা বিধান নিশ্চিত করে মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ করতে হবে।
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]